ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

নিউইয়র্ক

শিলচর কত দূর? ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য দেয়া ১১ প্রাণের স্মরণে

ফারুক ওয়াহিদ, ক্যানেটিকাট যুক্তরাষ্ট্র থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪১ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪
শিলচর কত দূর? ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য দেয়া ১১ প্রাণের স্মরণে ছবি: ফাইল ফটো

বিশ্বের ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী- বাংলা ভাষার প্রাণ কেন্দ্র তথা তীর্থভূমি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ঈশান বাংলার শিলচর কত দূর! -অনেক দূর! শিলচর কোথায়! বাড়ির কাছে আরশীনগর! তাহলে শিলচরের মাছে-ভাতে বাঙালি, দুধে-ভাতে বাঙালিদের কথা কান পেতে রইলেও কি ঢাকা থেকে শোনা যায় না! না শোনা যায় না, কারণ এই ডিজিটাল- ইন্টারনেটের যুগেও শিলচর ঢাকা থেকে এখনও অনেক দূর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে’। হ্যাঁ আজ পুঞ্জমেঘ-এর দেশ বরাক উপত্যকার ঈশান বাংলার ট্র্যাজেডির কথা বলবো- যে ট্র্যাজেডির কথা শুনলে বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষাভাষীদের হৃদয়ও গলে যাবে!

বাংলাভাষী সিলেট জেলা ১৮৭৪ সালে আসাম প্রদেশের অর্ন্তভুক্ত হয়- তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃখ করে লিখেছিলেন- ‘মমতাহীন কালস্রোতে/বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/নির্বাসিত তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।



অবিভক্ত বাংলায় শিলচর সিলেট জেলারই অংশ ছিল- কিন্তু সাতচল্লিশের বিভাজনের সময় চারটি মহকুমাকে আবার পূর্ববাংলায় অঙ্গীভূত করা হয়। আবারও দ্বৈত চরম ট্র্যাজেডির শিকার হয় বাংলা মায়ের খন্ডিত অংশ কাছাড়(শিলচর), করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি- যা বাংলা থেকে নির্মমভাবে বিছিন্ন করে আসাম প্রদেশের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়। খাঁটি বাঙালি হয়েও এপার বাংলা-ওপার বাংলা কোনো বাংলাতেই স্থান হলো না এই হতভাগ্য ঈশান বাংলার বাঙালিদের। এই দুঃখিনী ঈশান বাংলা বা বরাক ভ্যালির বাঙালিরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যায়। একশত ভাগ বাংলাভাষী কাছাড় জেলায় মায়ের ভাষা বাংলাই ছিল প্রধান সরকারি ভাষা। ১৯৬১ সালে ভারতের আসাম প্রাদেশিক সরকার বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার বাঙালি অধ্যুষিত শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির বাংলাভাষাভাষীদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে অন্যায়ভাবে বাদ দিয়ে শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেলে পড়ে বাঙালিরা এবং পরে তা আন্দোলনে রূপ নেয়।

১৯৬১-র ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরের এগারো জন বাঙালি ভাই-বোন মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য তথা মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, রফিক, সফিক, বরকত ও জব্বার। সেই ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আরো একটি আন্দোলন হয়েছিল এবং সে আন্দোলেনে একজন মহিলাসহ এগারোজন বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন আসামের বরাক উপত্যকার লাল কৃষ্ণচূড়ায় শোভিত শিলচরে, সে কথা বাঙালি হয়েও আমাদের অনেকের এখনো হয়তো অজানা রয়ে গেছে। পৃথিবীতে শুধু বাঙালিরাই তাদের প্রিয় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন।

একষট্টির ১৯ মে বাংলা ভাষার দাবীতে সকাল-সন্ধ্যা ধর্মঘটের সময় শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে রেলপথ অবরোধের সময় আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ন বাংলাভাষা আন্দোলনকারীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য নিরীহ বাঙালিদের প্রতি প্রথমে লাঠিচার্জ এবং পরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং মায়ের ভাষা বাংলার স্বীকৃতির দাবীতে ১১জন ভাষাসৈনিক ঘটানাস্থলে শহীদ হন এবং আহত হন অর্ধশতাধিক। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে শিলচর শহরে। ১১ জন নারী-পরুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় শিলচর রেলওয়ে স্টেশন ও আশেপাশের এলাকা এবং শোকে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে যায় বরাক উপত্যকার বাঙালিরা।

মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার দাবি করতে গিয়ে এমন কী অপরাধ করেছিল বাঙালিরা! মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে চাওয়া কি রাষ্ট্রদ্রোহী? সমগ্র বরাক উপত্যকায় শোকের ছায়া নেমে আসে- প্রকৃতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়- পাখির কলকাকলি স্তব্ধ হয়ে যায় এবং থেমে যায় খরস্রোতা বরাক নদীর স্রোতধারা!

কাঁদো বাঙালি কাঁদো- ২০ মে শোকার্ত আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শহীদদের লাশ নিয়ে শিলচর শহরে স্মরণকালের বৃহত্তম শোকমিছিল বের করে। মায়ের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন, ভাষা শহীদরা হলেন: কমলা ভট্টাচার্য ১৬ -পৈত্রিক নিবাস সিলেট-বাংলাদেশ (পৃথিবীর একমাত্র নারী ভাষা শহীদ), শচীন্দ্রমোহন পাল ১৯ -পৈত্রিক নিবাস হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ-চন্দনপুর-বাংলাদেশ, বীরেন্দ্র সূত্রধর ২৪ -পৈত্রিক নিবাস-হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ-বহরমপুর-বাংলাদেশ, কানাইলাল নিয়োগী ৩৭ -পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ-খিলদা-বাংলাদেশ, চন্ডিচরন সূত্রধর ২২ -পৈত্রিক নিবাস হবিগঞ্জ-জাকেরপুর-বাংলাদেশ, সত্যেন্দ্র কুমার দেব ২৪ -পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশ, হীতেশ বিশ্বাস -পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া-বাংলাদেশ, কুমুদরঞ্জন দাস -পৈত্রিক নিবাস মৌলভীবাজার-জুরি-বাংলাদেশ, তরণী দেবনাথ ২১ -পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া-বাংলাদেশ, সুনীল সরকার- পৈত্রিক নিবাস ঢাকা-মুন্সিবাজার-কামারপাড়া-বাংলাদেশ এবং সুকোমল পুরকায়স্থ -পৈত্রিক নিবাস-করিমগঞ্জ-বাগবাড়ি-আসাম-ভারত।

বাঙালির আত্মপরিচয় তথা জন্মগত অধিকার রক্ষার সংগ্রামে ওরা ১১জন প্রাণ উৎসর্গ করার পর অবশেষে আসাম সরকার বাঙালি অধ্যুষিত আসামের তিনটি জেলায় মায়ের ভাষা তথা বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পৃথিবীতে শুধু বাঙালিরাই তাদের প্রিয় মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু এই রক্তস্নাত ইতিহাস আজও যেন কোথাও কোথাও অনুচ্চারিত রয়ে গেছে- বিশেষ করে দুই বাংলায়।

বায়ান্নতে সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেক নাম না জানা ভাষা শহীদের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন মর্যাদায় আসীন হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির এ এক বিশাল অর্জন। বরাক উপত্যকায়ও ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ আনুষ্ঠানিকভাবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের কোথাও উনিশে মে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস পালন করা হয় না এবং এই রক্তাক্ত ইতিহাস আজও বাংলাদেশে রহস্যজনকভাবে অনুচ্চারিত।

কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে চাই। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হয়েছিল আসামের শিলচর-এর লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পে। আগরতলা থেকে ২৫/৩০টিরও বেশি শিখ ড্রাইভার চালিত বড় ধরনের ট্রাকবহরে করে শিলচর শহরের ভিতর দিয়ে যখন আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শিলচরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্র-ছাত্রী এবং স্থানীয় জনগন রাস্তায় নেমে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ফুল ছিটিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল- শিলচর শহরে মনে হয়েছিল আনন্দের বন্যা বইছে- যেন স্কুল-কলেজ সবকিছু অঘোষিত ছুটি। শিলচরের রাস্তার দুই পাশের দোকান-পাট, অফিস-এর সাইনবোর্ড ছিল সব বাংলায় লেখা- রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হওয়ায় জনগণের কথাবার্তা সব শুনতে পাচ্ছি- তারা আমাদের মায়ের ভাষা তথা বাংলাভাষায় কথা বলছে। ট্রাকের উপরে বসে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখছি, আপ্লুত হচ্ছি আর অবাক হচ্ছি! এ কোন ঈশান-বঙ্গরাজ্যে এসে পড়লাম! এতো খাঁটি বাঙালি কোথা থেকে এলো? শিলচরে যে এতো বাঙালি বাস করে- সেই প্রথম জানলাম।

শিলচরের বাঙালিরা যে বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন- সেকথা তখন স্বপ্নেও শুনিনি- এ মহান প্রাণ উৎসর্গের কথা জেনেছি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক অনেক পরে। এখন খুব আফসোস লাগছে যেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হলো এবং সেখানকার বাঙালিরা আমাদেরকে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আন্তরিকভাবে পুষ্পবর্ষণ করে বরণ করে নিল- সে এলাকার জনগনের এ বীরত্বের কথা এতোদিন পড়ে কেন জানতে পারলাম! ফেব্রুয়ারির মতো মে মাসও বাংলা ভাষার জন্য স্মরণীয় মাস- রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেরই জন্ম মে মাসে। আর ঐতিহাসিক মে মাসেই শিলচর শহরে বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন ওরা ১১ জন।

১৯৬১-র ১৯ মে বাংলাভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা বরাক উপত্যকা তথা ঈশানবাংলার ১১ জন বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির গর্বিত বীর বাঙালিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মায়ের ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়-এর গানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলবো-

“দুইজনাই বাঙালি বন্ধু, বাংলা দুইজনারই জান-
দুইয়ের মুখেই বাংলা কথা, দুইয়ের গলায় বাংলা গান। ”



 

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, মুক্তিযোদ্ধা

বাংলাদেশ সময় ০৪৪০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।