নেরুদার জন্য ভালোবাসা

রহমান মাসুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৯:৫৭, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১০

‘রাত্রির বাতাসগুলি আকাশে
চরকি মারে আর গান গায়
আজ রাতে আমিও লিখে যেতে পারি পৃথিবীর
বিষণ্ন কবিতা
আমি তাকে ভালোবাসি, আর সেও
ভালোবাসে কখনও আমাকে’

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র, নেফাতালি রেইয়েস। সাহিত্যবিদ্বেষী পরিবারে জন্মানোর কারণে দ্বিতীয় বই প্রকাশের আগেই নাম পাল্টে ফেলতে বাধ্য হলেন। অথবা, বলা যায় ছদ্মনাম নিলেন। পাবলো  নেরুদার সেই কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি নিরাশার গান’, যার একটা কবিতা আবার লেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গান ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’কে নতুন করে সাজিয়ে।

পাবলো নেরুদা এমন একজন কবি, যিনি কেবল কবিতা লেখার জন্যই নিজের নাম পাল্টে ফেলেছিলেন সে সময়কার তুমুল জনপ্রিয় চেক লেখক ইয়ান নেরুদার নাম থেকে। চিলির জনগণও তার কাব্যশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে বসাতে চেয়েছিল রাষ্ট্রপতির আসনে। ২৩ সেপ্টেম্বর ছিল আধুনিক পৃথিবীর এ অতুলনীয় প্রতিভার প্রয়াণদিবস। ১০৬ বছর আগে ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে এ মহান কবির জন্ম। যার সারাটা জীবনই কেটেছে কবিতার ঘোরগ্রস্ততা ও রাজনীতির উষ্ণ আলিঙ্গনে।

১৯২৩-এ নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে নেরুদা প্রকাশ করলেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘টোয়েলাইট’। কিন্তু পরের বইটির জন্য তাকে মোটেও বেগ পেতে হলো না। প্রকাশক জুটে গেলো ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি নিরাশার গান’-এর । এরপর কেবলই এগিয়ে যাওয়া। এ বইই তাকে লাতিন আমেরিকার জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করে। কলেজজীবনেই এমন খ্যাতির চূড়ায় ওঠার ফলে নেরুদাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সাহিত্যে মন দিতে হয়।

লাতিন আমেরিকার প্রথা হলো বিশেষ প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে ডিপ্লোম্যাট করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। নেরুদার আগে চিলির অন্য একজন নোবেলজয়ী কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালও এ সম্মানে ভূষিত হন। তার নাম তৈরি করা হয়েছিল ইওরোপের লেখকদের নামের টুকরো দিয়ে।

নেরুদা কূটনৈতিক জীবন শুরু হয় বার্মায় ১৯২৭ সালে। একে কেন্দ্র করে প্রায় পুরো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন টো টো করে। ইয়োকোহামায় হাঁটু গেড়ে বসে দেখেছেন ‘নো’ নাটক।  এ নাটকের ভাষা না বুঝলেও দৃশ্য এবং অভিনয়শৈলী তাকে এমন মুগ্ধ করে যে, তিনি তার একমাত্র অপেরা ‘হোয়েকিন মুরিয়েতার মহিমা ও মৃত্যু’তে এই শৈলীটি ব্যবহার করেছিলেন।

কিশোর নেরুদা হুয়ান রামোন হিমোনেথের ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে মুগ্ধ হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য কোলকাতায় আসেন ১৯২৭ সালে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে সময় কোলকাতায় ছিলেন না। ফলে নেরুদা কোলকাতার অলিগলি একা একা ঘুরে বার্মায় ফিরে যান। পরে অবশ্য আরও একবার তিনি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের শহরে। ১৯৫৭ সালে। তখন আর রবীন্দ্রনাথ নেই। কিন্তু এবার আর তাকে একা একা ঘুরতে হলো না। নেরুদা সঙ্গ পেলেন কবি বিষ্ণু দের।

১৯৩৩-এ প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরিসে কনসাল জেনারেল হয়ে আসেন পাবলো নেরুদা। সেখানেই তার গাঢ় বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় নেরুদার ভাষায় ‘বিশ শতকের মহান সাহিত্যিক’ স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার সঙ্গে। এ বন্ধুত্ব নেরুদার রাজনৈতিক জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটায়।

এরপর নেরুদা ১৯৩৪-এ আসেন স্পেনের মাদ্রিদে। ১৯৩৬-এর স্পেনের গৃহযুদ্ধের মর্মান্তিক দৃশ্যপট মারাত্মক ছাপ ফেলে তার ওপর। ভয়ঙ্কর সে দিনগুলোতে নেরুদা লিখতে থাকেন গৃহযুদ্ধের ক্রনিকল,  ‘এস্পানা ইন কোরাসন’। এটি ১৯৩৭ সালে যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই প্রকাশিত হয়। এভাবেই মানুষের জন্য ভালোবাসা ও যন্ত্রণার দলিল হয়ে উঠতে লাগল পাবলো নেরুদার কবিতা। এরপর নেরুদা ফিরে আসেন চিলিতে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মেক্সিকোতে চলে যান দূতাবাসের দায়িত্ব নিয়ে। ফিরে আসেন ঠিক চার বছর পর। নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৩-এ তিনি সিনেটর নির্বাচিত হন এবং একই সঙ্গে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।

চিলিতে কমিউনিজমের পতন হলে পার্টি নিষিদ্ধ হয় এবং নেরুদাকে সিনেট থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে নেরুদাও বেছে নেন গুপ্ত জীবন। আত্মগোপন করে তিনি লিখে চলেন তার দ্রোহী কবিতাবলি, যা ১৯৫০-এ ‘কান্তো হেনারেল`( canto general) নামে প্রকাশিত হয়।

১৯৫২ সালে চিলি সরকার কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। নেরুদাও ফিরে আসেন প্রিয় জন্মভূমিতে। চিলিতে এসেই বিয়ে করেন মাতিলদে উরুতিয়াকে। এটা অবশ্য নেরুদার তৃতীয় বিয়ে। এর আগের দুটি বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে নেরুদার স্বভাবজাত অস্থিরতার কারণে। এর পরের একুশ বছর পাবলো নেরুদা জনগণের কবি হিসেবে জনপ্রিয় হতে থাকলেন ক্রমশ। তখন একদিকে যেমন জনতার মধ্যমণি হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে পাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান। ঠিক যেন শিরোপা আর পুরস্কারের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে তার ওপর। ১৯৫৩ সালে তিনি ভূষিত হন লাতিন আমেরিকান শান্তি পুরস্কার এবং স্তালিন শান্তি পুরস্কারে। আর সাহিত্যে নোবেল পেলেন ১৯৭১ সালে। ঠিক আমাদের স্বাধীনতার সময়।

এরপর ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন নেরুদা। আর সেখানেই ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। নেরুদা ফিরে এলেন চিলিতে। যেদিন চিলির গণতান্ত্রিক শাসনের পতন ঘটল তার ১২ দিন পর, ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, সান্তিয়াগো শহরে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি, কবিদের রাজা, নেরুদা।

প্রেম ও প্রতিবাদের কথা, যুদ্ধ ও শান্তির কথা, যুদ্ধক্ষেত্রের কথাকে একই রকম দক্ষতায় মহান কবিতায় যিনি রূপ দিতে পারেন তাকে কি সাম্যর কবি বা প্রেমের কবির মতো ছোট গন্ডিতে আবদ্ধ করা যায়? পাবলো নেরুদা, বিশ্বজোড়া অগণিত পাঠককে কয়েক দশক ধরে উজ্জীবিত রেখেছেন; তারাভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আজও এ পৃথিবীর কত প্রেমিক তার  প্রেমিকাকে যে আজ শুনিয়ে চলছে  নেরুদার পঙক্তি!

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯৩০, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১০


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান