সৌরবিদ্যুৎ পাল্টে দিয়েছে সাগরের জেলেদের জীবনমান

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৮:৪৪, মে ২৪, ২০২২

লক্ষ্মীপুর: এক সময় মাছ ধরায় নিয়োজিত ট্রলার বা নৌকা আলোকিত রাখার জন্য লণ্ঠন বা হারিকেন ব্যবহার করা হতো। উত্তাল নদী বা সাগরে থাকা ট্রলারগুলো হেলেদুলে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতো। সেই সঙ্গে রাতের লণ্ঠন বা হারিকেনকেও যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হতো। 

কিন্তু যুগের পরিবর্তনে ট্রলার বা নৌকাতে এখন হারিকেন ও লণ্ঠনের ব্যবহার একেবারে নেই বললেই চলে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গভীর নদী এবং সাগরে থাকা মাছ ধরার ট্রলারগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। এতে পরিবার পরিজন ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্য নদী বা সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের জীবনমান কিছুটা উন্নত হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার লুধুয়া মাছ ঘাটে থাকা একটি ট্রলারে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন কামাল হোসেন ও আরিফ নামে দুই জেলে। সঙ্গে মোবাইল ফোনে গান শুনছেন তারা। 

তাদের ট্রলারের ওপর লাগানো রয়েছে সৌর প্যানেল। ট্রলারটি আলোকিত হয়ে আছে সৌরবিদ্যুতে। সে বিদ্যুতের আলোয় ভাত খাচ্ছেন তারা। 

তারা বলেন, এক সময় হারিকেন ছিল আমাদের ভরসা। মিটমিটে আলোয় আমাদের রাতের বেলা পার করতে হতো। আর এখন একেবারে আলোকিত। 

বলেন, হাতে এখন মোবাইল আছে। ১০-১৫ দিনের জন্য সাগরে যেতে হয় মাছ ধরতে। এ সময়টা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতো। উৎকণ্ঠায় থাকতো বাড়ির লোকজন। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ করার সুবিধা রয়েছে। কারণ হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে চার্জ দিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আগে এ সুবিধা ছিল না। নদীর তীরবর্তী কোনো বাজার থেকে চার্জ দিয়ে আনতে হতো। এক বা দুইদিনের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যেত। এখন আর সে চিন্তা নেই। তাই পরিবার থেকে দূরে থাকলেও যোগাযোগটা রাখতে পারছি। 



বাংলানিউজকে বলেন, সৌরবিদ্যুতের কারণে বিনোদনেরও সুযোগ হয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গান শুনি। কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করেন। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে ট্রলারের ছাদে থাকা সোলার প্যানেলের কল্যাণে। 

লুধুয়ার এ ঘাটে থাকা শতাধিক নৌকার প্রায় সবকটিতে দেখা মেলে সৌর প্যানেল। রাতের বেলা নৌকাগুলোকে সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত অবস্থায় দেখা যায়। দূর থেকে মনে হয় যেন নদীর তীরে জেনাকি পোকা আলো ছড়াচ্ছে। 

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট, কমলনগরের মতিরহাট, লুধুয়া, বার্তির খাল, রামগতির আলেকজান্ডার এবং বয়ারচরের টাংকির ঘাটে গিয়ে দেখা মেলে ছোট-বড় হাজার হাজার মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারের। প্রায় বেশিরভাগ ট্রলার এবং নৌকাতে লাগানো আছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। দামে সাশ্রয় এবং ব্যবহারে বহুমাত্রিক সুবিধা থাকায় জেলে নৌকার মালিকরা সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। 

নদীতে ভাটা পড়লে কমলনগরের মতিরহাট মাছ ঘাটে নোঙর করা থাকে কয়েকশ নৌকা। রাতের বেলা জোনাকীর মতো আলো ঝলমল করছে সারিসারি নৌকা থেকে। 

সেখানকার জেলেরা বাংলানিউজকে জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর বুকে বছরের বেশির ভাগ সময়ই সারি সারি হাজার হাজার নৌকাতে এখন এমন আলো চোখে পড়ে। শুধু আলোই না, নদীতে ভেসে বেড়ানো সব নৌকাতে রয়েছে আধুনিক নানা সামগ্রী। এসব পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে গভীর নদীতে থাকা জেলেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া আগে লণ্ঠন বা হারিকেনে জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার বন্ধ হওয়ার কারণে খরচও কমে আসছে। বিগত কয়েক বছরে জেলেদের জীবনে এমন ব্যতিক্রম পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান তারা।



নৌকার মাঝি সফিকুল জানায়, মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া, রাতে অন্য নৌযান থেকে নিজেদের জাল রক্ষার জন্য জালের মাথায় নিশানা বাতি, অন্য নৌযানের সঙ্গে নিজেদের নৌকার সংঘর্ষ এড়াতে নৌকাতে নিশানা বাতি, ভেতরের আলো এবং সংকেত বাতি ইত্যাদি সব কাজেই এখন তারা সৌরবিদ্যুৎ ও আধুনিক ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করেন।

আরেক জেলে নৌকার মাঝি মো. আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ৬ থেকে ৭ বছর আগেও নদীতে মাছ ধরার সময় রাতের বেলায় অন্য নৌকা ও ফিশিংবোড প্রায়ই ধাক্কা দিত। এতে নদীতে অনেক হতাহতের খবর থাকতো। এখন আর তা হয় না। এখন নৌকায় নিশানা বাতি ও ভেতরে আলো থাকার কারণে দূর থেকে যেকোনো নৌযানের চোখে পড়ে। মূলত নৌকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে এমন সুযোগ ও নিরাপত্তা তৈরি হয়েছে।

জেলেরা জানায়, এ সৌরবিদ্যুতের পণ্যের বাজারও গড়ে ওঠেছে মাছঘাট কেন্দ্রীক হাটগুলোতে।

নৌকার মাঝি আলমগীর জানায়, ৫ বছর আগে ৫০ ওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল লাগিয়েছেন তিনি। এতে ৩টি বাতি ও একটি ছোট পাখা চলে। আগে নৌকায় লণ্ঠনের বাতি জ্বালাতে মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকার কেরোসিন ব্যবহার হতো। এছাড়া বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়ের সময় কেরোসিন বাতি নিভে যেত। এখন সে রকম সমস্যা নেই। 

চর কালকিনি এলাকার জেলে মো. কালাম জানায়, একটি নৌকায় আলোক সজ্জার জন্য সৌরপ্যানেল, ব্যাটারি, চার্জার, চার্জ কন্ট্রোলার, ফিশিং লাইট, জব লাইট, ওয়াচ লাইট এবং সাধারণ বাতিসহ ১০ থেকে ১৫ ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রয়োজন। 



রামগতি উপজেলার টাংকি বাজার মাছ ঘাটের সভাপতি মো. আবদুর রব মিয়া বলেন, বিগত ১০ থেকে ১২ বছর আগ থেকে সাগরে মাছ ধরায় নিয়োজিত জেলেরা সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। ফলে তাদের আগের মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সামগ্রী আর সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে জেলেরা রাতের বেলা মাছ ধরা, নদীতে জাল ফেলা, জাল উঠানো, মাছ সংগ্রহ করা, ফোন চার্জ দেওয়ার কাজ সৌরবিদ্যুতেই করছেন। 

কমলনগরের মতিরহাট মাছঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মিলন ভাণ্ডারী, নূর নবী বলেন, এখন মেঘনা নদীর তীরে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার আলো ছড়িয়ে পড়ে। ঝড়ো বাতাসে বাতি নিভে যাওয়ার ভয় থাকে না। 

মতিরহাট বাজারের ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী জসিম হাওলাদার বাংলানিউজকে জানান, ৬ থেকে ৭ বছর আগে সর্বপ্রথম বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও সংস্থা কিস্তির মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল সরবরাহ করতো। এখন এনজিও সংস্থা নেই। সৌরপ্যানেল সহজলভ্য হয়ে গেছে। তাই বিভিন্ন কোম্পানি সহজ মূল্যে সৌরপ্যানেলসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করছে। 

তিনি জানান, মেঘনা নদীর মজুচৌরীরহাট ঘাট থেকে রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার নদীপাড়ে ২৭০টি টেলিকম ও ইলেকট্রিক দোকান গড়ে ওঠেছে। যারা মূলত নৌকার জেলেদের কাছে ইলেকট্রিক পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে থাকে। 

স্থানীয় মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর সীমানা প্রায় ৮৮ কিলোমিটার। অর্ধলক্ষাধিক জেলে নদীতে মাছ ধরায় নিয়োজিত। লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় প্রায় ৩ হাজার অনুমোদিত ফিশিং ট্রলার ও কয়েক হাজার ছোট জেলে নৌকা রয়েছে। 

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
আরএ


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান