বাংলাদেশে লিম্ফোমার চিকিৎসা

ডাঃ কামরুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৩:২৭, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২

ঢাকা : লিম্ফোমা রক্তের এক প্রকার ক্যান্সার। রক্তের বিভিন্ন কোষীয় উপাদানের একটি হল লিম্ফোসাইট, যার কাজ হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ করা। এই রোগ প্রতিরোধ হতে পারে বাইরের কোন জীবাণুর আক্রমণের বিরুদ্ধে অথবা শরীরের নিজস্ব কোন কোষের অস্বাভাবিক আচরণের বিরুদ্ধে।

এটি শরীরের বিভিন্ন টিস্যুর মধ্যকার ক্ষুদ্র নালী ও রক্তের মাধ্যমে সমস্ত শরীরে ঘুরে বেড়ায় এবং ক্ষতিকর কোষ বা জীবাণুকে চিহ্নিত করে। এরপর সেই সব কোষ বা জীবানুকে নিজে আক্রমণ করে অথবা অন্য রোগ প্রতিরোধক কোষকে আক্রমণে উৎসাহিত করে।

কিন্তু লিম্ফোসাইট যখন নিজেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে তখনই সৃষ্টি হয় নানা বিড়ম্বনা। এসব বিড়ম্বনার একটি হল লিম্ফোসাইটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

অন্যান্য কোষের ন্যায় লিম্ফোসাইটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলেও সুস্থ লিম্ফোসাইটগুলো তাকে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু এই আক্রমণ যদি ঠিকমতো না হয় তাহলে যে রোগটির সৃষ্টি হয় তার নাম লিম্ফোমা।

লিম্ফোমা কি : রক্ত একটি তরল পদার্থ হলেও লিম্ফোমা কিন্তু তরল নয়। এর কারণ হচ্ছে লিম্ফোসাইট যে সমস্ত অঙ্গে তৈরি ও বৃদ্ধি হয় সেগুলো তরল নয়।

এসব অঙ্গের মধ্যে রয়েছে লিম্ফনোড, স্প্লিন (প্লিহা), টনসিল ইত্যাদি। লিম্ফনোড শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে যা স্বাভাবিক অবস্থায় বোঝা যায় না। কোন কারণে এর আকার বড় হলে তা বোঝা যায়।

লিম্ফোমার অবস্থান : শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি পরিপাকতন্ত্র বা ফুসফুসের চারপাশে এগুলো গুটি আকারের টিউমার হিসেবে প্রকাশ পায়। একিউট ইনফেকশন বা জীবাণুর হঠাৎ আক্রমণের কারণে কোন লিম্ফেটিক অঙ্গ বড় হলে তা সাধারণত বেদনা যুক্ত হয়। যক্ষা (টিবি) বা এরূপ কোন জীবাণুর দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণের কারণে বা ক্যান্সারের কারণে কোন লিম্ফেটিক অঙ্গ বড় হলে তাতে ব্যথা হয়।

পূর্ব লক্ষণ : শরীরের কোন এলাকায় লিম্ফনোড বা অন্য কোন লিম্ফেটিক অঙ্গ বেদনা বিহীনভাবে অস্বাভাবিক বড় হতে থাকলে লিম্ফোমা হওয়ার সম্ভবনা সবসময়ই মাথায় আনতে হয়। লিম্ফোমা ও টিবির অন্যান্য লক্ষণাদির মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের অনিয়মিত জ্বর, ওজন হ্রাস ও রাতের বেলায় অস্বাভাবিক ঘাম।

লিম্ফোমা নির্মূল : অন্যান্য ক্যান্সারের মতো লিম্ফোমার ক্ষেত্রেও এর কারণ নির্ণয় সাধারণত সম্ভব হয় না। তবে কিছু কিছু জিবাণুঘটিত কারণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- গ্যাস্ট্রিক আলসারের জীবাণু, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস, এইডস, ইবস্টেইন বার ভাইরাস, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া ইত্যাদি।

কাজেই এসব জীবাণুঘটিত রোগ থেকে মুক্ত থাকা গেলে কিছুটা হলেও লিম্ফোমা প্রতিরোধ সম্ভব। আর ‘সুচনায় পড়লে ধরা, ক্যান্সার যায় যে সারা’-র মতই লিম্ফোমাও সুচনায় নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্ভব হলে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মুল সম্ভব।

লিম্ফোমার চিকিৎসা : বাংলাদেশে হেমাটোলজিস্ট বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কম হলেও লিম্ফোমার চিকিৎসা একেবারে অপ্রতুল নয়।

সরকারি পর্যায়ে মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বতন্ত্র রক্তরোগ বিভাগ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে লিম্ফোমা চিকিৎসারও প্রচুর সুযোগ রয়েছে।

এসব সেন্টারে লিম্ফোমা রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলো এখনও যথেষ্ট নয়। এজন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর উপর নির্ভর করতে হয়।

এছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে রক্ত, বোন ম্যারো বা লিম্ফনোডের স্যাম্পল পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাতে হয়, আর এজন্য কিছু কোম্পানি তাদের এজেন্সির মাধ্যমে এ দেশে ব্যবসা ও সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে সময় ও অর্থের প্রচুর অপচয় হয়।

উপরোক্ত সেন্টারগুলোতে কেমোথেরাপি এবং ক্ষেত্র বিশেষে রেডিওথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হলেও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা বাংলাদেশে এখনও চালু হয়নি।

কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাধ্যমে লিম্ফোমা নিরাময় না হলে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রয়োজনীয় ও যোগ্যতা সম্পন্ন হেমাটোলজিস্ট দেশে থাকা সত্ত্বেও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের জন্য প্রচুর পরিমাণ রোগী বিদেশে চলে যান।

এছাড়াও কেমোথেরাপি জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিছু কিছু দেশে উৎপাদন হলে এখনও অনেক ওষুধ আমদানি করতে হয়। এসব কারণেও অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়।

আমদানিকৃত ওষুধ তো বটেই, দেশে উৎপাদিত ওষুধও অনেক সময় এদেশের মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে।

থাইল্যান্ডের মত দেশগুলো বাংলাদেশের অনেক পরে শুরু করলেও চিকিৎসা প্রযুক্তিতে তারা এখন অনেক এগিয়ে। প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশি রোগীর ঐ সমস্ত দেশ ভ্রমণই তার প্রমাণ।

সরকারি উদ্যোগ : বাংলাদেশে লিম্ফোমা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দক্ষতা। সরকারি ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন সকল প্রকার ওষুধের প্রয়োজনীয় উৎপাদন, মান সংরক্ষণ ও তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আনা।

ডাক্তার, নার্স ও টেকনিসিয়ানদের প্রয়োজনীয় দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যেমন প্রয়োজন সরকারি দিক নির্দেশনা, তেমনি প্রয়োজন চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক উদ্যোগ।


লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময় : ১২৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান