শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ফেলনা হয়ে উঠছে জীবন্ত ক্যানভাস

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৩:২৪, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১
টি-ব্যাগে শিল্পকর্ম। ছবি: বাংলানিউজ

টি-ব্যাগে শিল্পকর্ম। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: ছবি যেন শব্দহীন যোগাযোগের বিমূর্ত প্রতীক, এই কথাটিই জীবন্তভাবে ধরা দেয় বিশ্বের নানা শিল্পী, চিত্রগ্রাহকের ছবির মাধ্যমে। গহীন অরণ্যের বা মরুভূমির ছবি থেকে শুরু করে ভ্রমণের ছবি, রং-তুলিতে আঁকা শৈল্পিক ছবি, পরিচিত-অপরিচিত নানা শিল্পের ছবি, দেশি-বিদেশি শিল্পী, গায়ক, অভিনেতার দৈনন্দিন ছবি পর্যন্ত কিসের ছবি নেই এখানে, সবকিছুরই সন্ধান মেলে এই মাধ্যমটিতে। ব্যতিক্রমী কোনো শিল্প বা ছবি আলোড়ন তুলে প্রায়ই। এরকমই একজন আলোড়ন তোলা মানুষ মো. সাদিতউজ্জামান সাদিত এবং তার টি-ব্যাগের ক্যানভাসে করা শিল্পকর্ম।


টি-ব্যাগে করা শিল্পকর্ম, শুনতে কিছুটা অদ্ভুত শোনায়। একে তো ফেলনা জিনিস, তার ওপর ছোট্ট একটি টি-ব্যাগ, স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে এমন বস্তু দ্বারা কী তা সম্ভব? সম্ভব হলেও কীভাবে সম্ভব? কিংবা কতটুকুই নিখুঁত বা জীবন্ত হতে পারে এমন কোনো শিল্প এ ধরনের প্রশ্ন মনে আসবে খুব স্বাভাবিকভাবেই। কোনো খাদ্যবস্তু থেকেও এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ধারার বাস্তব রূপ দেওয়া যায়, সর্বসাধারণের চিন্তার বাইরের এই কাজটিই করেছেন টগবগে এই তরুণ।

এ বৈচিত্র্যময় খুদে শিল্পকর্ম এরইমধ্যে সাড়া ফেলেছে দেশ-বিদেশে। মো. সাদিতউজ্জামানের বাড়ি রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর ঝাউতলায়। তিনি এমবিএ করেছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে।তার অসাধারণ শিল্পচর্চার শুরু যেভাবে: 

মো. সাদিতউজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হয় তার এই শিল্পচর্চা। কীভাবে শুরু হয়? হ্যাঁ, অবশ্যই হুট করে নয়, কোনো কিছু দেখে কৌতূহল উদয় হওয়ায় এবং সেই থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই শুরু। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ঝোক। তার বাবা একবার এক বাক্স আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলেন ছোট্ট সাদিতকে। খাওয়ার পর আইসক্রিমের বাক্সটি ফেলে না দিয়ে তার ওপর রং-তুলির আঁচড় দিতে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকল এক দৃষ্টিনন্দন গ্রাম। পরিত্যক্ত আইসক্রিমের বাক্সই হয়ে উঠল ছবি। সেই থেকে শুরু। পরিত্যক্ত কোনো কিছুকে ছবির ক্যানভাস বানিয়ে ফেলার কাজ এখনো করে যাচ্ছেন সাদিত। একটু ফুরসত মিললেই বসে পড়েন রং-তুলি নিয়ে।টি-ব্যাগের ওপর এঁকেছেন ৪শ ছবি চা-পানের পর যে টি-ব্যাগ ফেলে দেওয়া হয় অবহেলায়, সেটি তিনি সংগ্রহ করার পর পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে ছবি আঁকেন। বিখ্যাত সবাই আছেন তার ছবিতে। সাদিতের তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান।

'টি-ব্যাগ স্টোরিজ' সাদিতের টি-ব্যাগ স্টোরিজ নামে একটি ফেসবুক পেজও আছে। সেখানে তিনি তার আঁকা ছবি নিয়মিত পোস্ট করেন। আর সেই আঁকা ছবি দেখে রুবি সিলাভিয়াস প্রশংসাও করেছেন। রুবি সিলভিয়াস যখন বলেন ‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা, অসম্ভব ভালো আঁকছ তুমি’- তখন গর্বে বুকটা ভরে ওঠে সাদিতের।পেয়েছেন দেশ-বিদেশের স্বীকৃতি: 

টি-ব্যাগে খুদে ছবি নিয়ে সাদিতের এ পর্যন্ত বেশ কিছু স্বীকৃতি মিলেছে। বিখ্যাত টার্কিশ কোম্পানি পেলি পেপার তাদের ক্যাটালগের প্রচ্ছদ সাদিতের আঁকা ছবি দিয়ে করেছে। পেলি পেপার পৃথিবীব্যাপী টি-ব্যাগের কাগজ উৎপাদন করে। এছাড়া সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া দেবী সিনেমার পোস্টারও তিনি এঁকেছিলেন। কাজ করেছেন ইস্পাহানি মির্জাপুর টি-ব্যাগের সঙ্গেও। তার টি-ব্যাগে আঁকা ছবি নিয়ে একটি কোম্পানি তাদের ক্যালেন্ডার বানিয়েছে। এছাড়া লেখক লুৎফর হাসানের ‘বগি নম্বর জ’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ করা হয়েছে তার টি-ব্যাগ স্টোরি দিয়ে। 

সাদিত মনে করেন পরিবার তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার জায়গা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য তার আশপাশের পরিবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে সবক্ষেত্রেই জীবনকে উপভোগ করতে শেখানো হয়েছে। কখনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বরং আমার সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তাই আমার মনে হয় পরিবার আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার জায়গা। জানতে চাইলে সাদিত বলেন, ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা নিয়ে যখন আঁকতে বসি কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। মনে হয় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছি কিংবা প্রকাশ! কতো সময় এরকম হয় যে পানিতে তুলি ভিজাতে গিয়ে ভুল করে চায়ের কাপে ভিজাতে যেয়ে নিজেই জিভ কাটি। এতোটাই ডুবে যাই। চা পানের পরে যে ব্যবহৃত টি-ব্যাগগুলো ময়লার ঝুড়িতে চলে যায় সেগুলোকেই আমি আমার ক্যানভাস বানিয়ে নেই। রুবি সিলভিয়া আমাকে সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করেছে এই মজার ক্যানভাসে কাজ করতে। নিজেকে টি-ব্যাগ আর্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরে চায়ের নেশার মতো আঁকার নেশাটাও কেমন প্রাত্যহিক হয়েছে। চা যেমন আমার একটা তৃপ্তির যায়গা, আঁকাআকিটাও। যেহেতু এগুলো ব্যবহৃত টি-ব্যাগ, আমি বাসায় বা আমার কর্মক্ষেত্রে যেগুলো দিয়ে চা পান করি সেগুলোই সংগ্রহ করি। বাসার বাকি সদস্যরাও খুব যত্নের সঙ্গে তাদের ব্যবহৃত টি-ব্যাগ আমার জন্যে সংরক্ষণ করে। নিজের দেশ ও সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সাদিত বলেন, আমার এই কাজের সূচনা নিজেকে তৃপ্ত করা থেকেই। আমার উদ্দেশ্য নিজেকে ভালো রাখা এবং এই ভালোলাগাটা অন্যের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া। আমি চেষ্টা করি আমার কাজে শুধু আমার ব্যক্তিগত চিন্তা না, সঙ্গে বাংলাদেশকেও তুলে ধরার। পরিকল্পনা আছে আরো সুন্দর করে নিজের দেশ ও সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করার। 

তিনি বলেন, দিনের শুরুতে, কাজের ফাঁকে, বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা একাকী বারান্দায় চা যেমন একটা তৃপ্তির জায়গা, আঁকাআঁকিটাও। আঁকাআঁকি কখনও কারও কাছে শেখা হয়নি। আমি রুবি সিলভিয়ার কাজ দেখার আগেও আরো দুই একজন বিদেশি চিত্রশিল্পীর কাজ দেখেছিলাম। কিন্তু অনুপ্রাণিত হয়েছি রুবি সিলভিয়ার কাজ দেখে। কারণ আমাদের দেশে তো রিসাইকেল ম্টোরিয়াল নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি। আর টি-ব্যাগে ছবি আঁকাও আমারই প্রথম। ২০১৬ সালে টি ব্যাগে ছবি আঁকার শুরু। আঁকাআঁকিটা আমার আত্মতৃপ্তির জায়গা। স্বপ্ন দেখি-এ কাজের মাধ্যমেই দেশীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে নতুন করে তুলে ধরবো।

বাংলাদেশ সময়:১৩২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২১
এসএস/এএটি


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান