অধিকার নিয়ে ফিরতে চায় রোহিঙ্গারা, উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৩:০২, আগস্ট ২৫, ২০২১

কক্সবাজার: মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নিপীড়ন ও ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে পড়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর পূর্তি হচ্ছে আজ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকেই রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। তবে চার বছর পূর্ণ হলেও এখনও পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া প্রত্যাবাসনের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা। 

অন্যদিকে মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দেওয়া হলেও গত চার বছরে এসব রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। হত্যা, অপহরণসহ তাদের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে রীতিমত হুমকির সম্মুখীন স্থানীয় জনগোষ্ঠী। স্থানীয়রা চায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের এ মানবিকতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে উখিয়ার ৫ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নুর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমারে যুগের পর যুগ আমরা নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমরা এখানে পালিয়ে আসি। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জন্য যা করছে আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার, দেশী-বিদেশি সংস্থা আমাদের অনেক কিছু করলেও  এখানে আমাদের শান্তি লাগছে না। নিজের দেশের জন্য প্রাণ কাঁদছে। নিজের দেশে কখনও চলে যেতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তায়।

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে থাকতে আমার একটি চুল দাঁড়িও পাকেনি। এ রকম বুড়োও হয়নি। একদম যুবকের মতো এখানে এসেছি। এখানে এসে চার বছরে আমার সব চুল দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। ত্রিপলের ছাউনীর নিচে থাকতে থাকতে গরমে শরীরের এই অবস্থা। ত্রিপলের নিচে আর কত দিন থাকবো। এই জীবন বদ্ধ জীবন থেকে আমরা মুক্তি চাই।

আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের উপদেষ্টা মাস্টার মো. ইলিয়াছ বাংলানিউজকে বলেন, চার বছরে এসে আমাদের একটাই লক্ষ্য, আমরা আমাদের সব অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু  চার বছর পূর্ণ হলেও প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের ইতিবাচক কোনো সাড়া নেই। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত।


মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম নির্যাতন বন্ধ হয়নি উল্লেখ করে ইলিয়াছ বলেন, সেখানে যেসব রোহিঙ্গারা আছেন, তারা জেলে থাকার চেয়ে আরো বেশি কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা সাগরে ঝাঁপ দিচ্ছে, রেঙ্গুন চলে যাচ্ছে, মালয়েশিয়া যাচ্ছে, থাইল্যান্ডে চলে যাচ্ছে। এভাবে যেতে গিয়ে অনেক রোহিঙ্গা মারাও যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ, মিয়ানমারে অস্থিতিশীল পরিবেশ, বাংলাদেশে করোনা মহামারি সব মিলিয়ে দিন দিন রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম নির্যাতনের কারণে অতীতে চার-পাঁচবার শরণার্থী হয়ে আমাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আর যেন আমাদের আসতে না হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেভাবেই যেন চুক্তি করে। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।

রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, পুনরায় নাগরিকত্ব, ভিটে-মাটি ফেরত, জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। 
বিশ্বে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো ধরনের মানবাধিকার আছে কিনা এমন প্রশ্ন তুলে রোহিঙ্গা নেতা ইউসুফ বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনের সব প্রকার ডকুমেন্ট, ছবি ভিডিও আমরা বিশ্ববাসীকে দিয়ে দিয়েছি। বিশ্ববাসী কবে আমাদের ঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।

এদিকে গত চার বছরে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের বেশির ভাগ ঘর জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। সংস্কারের অভাবে অনেক ঘরের ছাউনি, বেড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বসবাস করতে ভোগান্তি বেড়ে গেছে বলে জানান রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার কুতুপালং ৪ নম্বর ক্যাম্পের মো. সেলিমে বাংলানিউজকে বলেন, সরকার আমাদের জন্য অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু ছোট্ট একটি ঘরে আট থেকে  ১০ জন মানুষ থাকা বেশ কষ্টকর। ঝুঁপড়ি ঘরে চার বছর হয়েছে। ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়ে, রাতে বৃষ্টি হলে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে জেগে থাকতে হয়। কিন্তু এভাবে কতো দিন থাকা যায়।

আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি মো. ইউসুফ বেনারকে বলেন, গত চার বছরে রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত।  

তিনি বলেন, আমরা যখন এদেশে পালিয়ে আসি, তখনও প্রাইমারি, মাধ্যমিক লেভেলে পড়াশুনা করে এ রকম হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে ছিল। আবার বাংলাদেশে এসেও অনেকে লেখাপড়ার উপযুক্ত হয়েছে। এসব শিশুদের মিয়ানমার কারিকুলামে শিক্ষার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

ইউসুফ বলেন, এখানে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হলেও করোনা মহামারির কারণে তাও এখন বন্ধ রয়েছে। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি প্রজন্ম। যে কারণে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বহুমাত্রিক চাপ আর নিতে পারছেন না।

চার বছরে স্থানীয়দের বিষফোঁড়ায় পরিণত রোহিঙ্গারা:
মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দেওয়া হলেও এ চার বছরেই রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের হাতে খুন, হামলা ও অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধের শিকার হয়েছেন স্থানীয়রা। এমন পরিস্থিতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের নয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার চার বছরের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে গেছেন। মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আমরা স্থানীয়রা প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি। 

তিনি বলেন, চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত পাঠানো যায়নি।  প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ বলা যায়। সব মিলে স্থানীয়রা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। 

কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও মাত্র চার বছরে এসব রোহিঙ্গা স্থানীয়দের বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা না গেলে স্থানীয়দের জীবন যাত্রা হুমকির মুখে পড়বে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন সব দায় যেন বাংলাদেশের ঘাড়েই এসে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য মিয়ানমারকে যতটা চাপ দিচ্ছে না, রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য তার চেয়ে বেশি চাপ আছে বাংলাদেশের ওপর।  বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়। 

উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের হাতে অনেক স্থানীয় জনগোষ্ঠী হত্যার শিকার হয়েছে। হামলার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।  রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা এখন রীতিমত আতঙ্কে থাকে। দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করা না গেলে ভবিষ্যতে উখিয়া-টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস হুমকির মুখে পড়বে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা  বাংলাদেশ থেকেই  নাগরিকত্ব পেতে চায়। এখানে থেকেই সব অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। তাদের এ শর্ত তো ভিত্তিহীন। নাগরিকত্ব পেতে হলে সে দেশে গিয়ে নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। কিন্তু তাদের আশ্রয় দিয়ে এখন সব দায় বাংলাদেশের হয়ে গেছে বলে যোগ করেন তিনি।

শিবিরে নতুন চ্যালেঞ্জ করোনা মহামারি:
সারাবিশ্বের মতো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে শিবিরে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. আবু তোহা বাংলানিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত  প্রায় ২ হাজার ৭৭৭ জন রোহিঙ্গা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৩০ জন। তবে জনসংখ্যার দিক দিয়ে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর  সংখ্যা অনেক কম।

তিনি বলেন, ইতোমেধ্যে শিবিরগুলোতে ৫৫ বা তার ঊর্ধ্বে বয়সীদের করোনা টিকাদান শুরু হয়ে গেছে। এদের মধ্যে বয়সী ৮৬ শতাংশ রোহিঙ্গা টিকার আওতায় এসেছে। টিকা পাওয়া সাপেক্ষে অন্যদেরও পর্যায়ক্রমে টিকাদান শুরু করা হবে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। যা যা করণীয় সবকিছুর সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিশ্বে করোনা মহামারির কারণে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে প্রস্তুত আছে। তাদের সেভাবেই রাখা হয়েছে। তারাও জানে তাদের ফিরে যেতে হবে। 

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের  আগে ও পরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে ও ভাসান চরে বসবাস করছেন রোহিঙ্গারা। 

বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২১
এসবি/আরআইএস


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান