যে গ্রামে বাল্যবিবাহ 'সামাজিক রীতি'!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৭:১৯, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০

রাজশাহী: রাজশাহী শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর সীমান্তবর্তী গ্রাম খানপুর। এটি ৮ নং হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে। গ্রামটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাতলামারি গ্রাম লাগোয়া। খানপুর গ্রামটি পদ্মার ভাঙনে বিলীনের পথে। জায়গাটি অনেকে চর খানপুর নামে চিনলেও কাগজে-কলমে এর নাম ‘চরখিদিরপুর পশ্চিম পাড়া’।

পদ্মার চরের এ প্রত্যন্ত গ্রামে বাল্যবিবাহ 'সামাজিক রীতি' হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা আছে ১৮ বছর৷ এর কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে সেটি হবে ‘বাল্যবিবাহ', যা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ৷ কিন্তু আইনের বিধিনিষেধ থাকলেও চরখিদিরপুর গ্রামে এর কোনো বালাই নেই।

এ গ্রামের তরুণী সালমা আক্তার। বয়স ২০ কিংবা ২১। গত দুই বছর ধরে সালমার বিয়ের জন্য তার পরিবার উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু বয়স ২০ বছর শুনলে বেশি বয়সের অজুহাতে কেউ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না না। ফলে মেয়ের বিয়ে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় সালমার মা-বাবা।

শুধু সালমার পরিবারই নয়, তার মতো চরখিদিরপুরে বেশ কয়েকটি পরিবার মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় আছেন। ১৮ বছর বয়স চরখিদিরপুরের মানুষের কাছে অনেক বেশি। তাদের কাছে ১৩-১৪ বছর বয়স হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের বয়স‌। ফলে কোনো মেয়ের বয়স ১৮ কিংবা এর বেশি হলে কেউ বিয়ে করতে চায় না।

তরুণ-তরুণীদের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দরিদ্রতা, শিক্ষার অভাব ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবে বাল্যবিবাহ চরখিদিরপুর গ্রামে রীতিমতো রীতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে একদিকে বাল্যবিবাহ যেমন লাগামহীন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে নেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা। এতে ওই চরের জনসংখ্যা বেড়েই চলছে।

করোনা ভাইরাসের বিস্তারের এ সময় চরখিদিরপুরে বাল্যবিবাহের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। করোনাকালীন এখানে প্রায় ৫০টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন অভিভাবকেরা। অন্যদিকে গ্রামটিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারী নেই বললেই চলে। সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ।

গ্রামের ১৭ বছরের তরুণী রোজিনা আক্তার। অভাব-অনটন এবং স্থানীয়ভাবে উচ্চ শিক্ষার রেওয়াজ না থাকায় মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করতে পারেননি। ৩ বছর আগে তার বিয়ে হয়। সাইফুল ইসলাম নামে তার দেড় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। তামান্না বলেন, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এরপর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেয়।

এই গ্রামের আরেক তরুণী জাকিয়া সুলতানা। দুই সন্তানের জননী জাকিয়ার ছেলের বয়স ১০ বছর ও মেয়ের বয়স ৬ বছর। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় জাকিয়ার। তিনি বলেন, স্কুলে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক অনটন ছিল তাই বাবা-মা বিয়ে দিয়েছে। আমার বড় ছেলে জাকারিয়া ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে।

২৭ বছর বয়সী ফয়জুন্নেসা বেগমের দুই সন্তান। বড় মেয়ে সাদিয়ার বয়স ৮ বছর। ফয়জুন্নেসার ভাষ্যমতে, তার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে অর্থাৎ তারও বাল্যবিবাহ হয়েছিল।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, চরখিদিরপুর গ্রামে প্রশাসনের নজরদারির পাশাপাশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা দিতে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই। আগে চরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি অফিস ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে সেটি নদীতে ভেঙে যায়। চরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও নাজুক। পরিবার পরিকল্পনা ও বিভিন্ন এনজিওর লোকজন মাঝে মধ্যে আসেন। গ্রামের একটি বাড়িতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ রেখে যান। তবে চক্ষুলজ্জায় মেয়েরা এসব ওষুধ নিতেই আসে না।

এই গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার আগেই অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। স্থানীয় চর তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুর নাহার বলেন, প্রতি বছর ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কিন্তু ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। অনেক পরিবার অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। আমরা গ্রামের লোকজনদের বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এখানে বাল্যবিবাহ এক ধরণের রীতি হয়ে গেছে।

৮নং হরিয়ানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল ইসলাম বাচ্চু বলেন, চরখিদিরপুর গ্রামে বাল্যবিবাহ রোধে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কিন্তু অধিকাংশ পরিবার অশিক্ষিত ও দরিদ্র হওয়ায় তারা বাল্যবিবাহের কুফলগুলো বুঝতে চান না। অনেক পরিবার রেজিষ্ট্রেশন ছাড়াই বিয়ে দিচ্ছে। ফলে কোনোভাবেই বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
এসএস/এমএমএস


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান