
গুয়াহাটি (ভারত) থেকে: চীন, মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশের সড়কপথে বহুল প্রত্যাশিত কার র্যালি অবশেষে আগামী ৩১ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে। চীনের কুনমিং থেকে রওনা হয়ে মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ অতিক্রম করে আবারও ভারতে প্রবেশের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় গিয়ে এ র্যালি শেষ হবে।
২০০৬ সালে পরিকল্পনা করা এ র্যালিটির বাস্তবায়নে ৫ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় এবং ১৮ জানুয়ারি এটি শুরুর একটি নির্ধারিত দিন থাকলেও তা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
আসাম রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মঙ্গলবার বাংলানিউজকে এ তথ্য জানান।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অণুবিভাগের মহাপরিচালক মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে কার র্যালি শুরুর তারিখটি নিশ্চিত করেন।
গুয়াহাটি থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, ‘৩১ জানুয়ারি চীনের কুনমিং থেকে বিসিআইএম কার র্যালি শুরু হচ্ছে, এটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত।’
বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তের সুতারকান্দি স্থলবন্দর দিয়ে র্যালি বাংলাদেশে প্রবেশ করে যশোরের বেনাপোল দিয়ে ভারতে যাবে বলেও জানান তিনি।
মহাপরিচালক মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে আরও বলেন, ‘৬ বা ৭ ফেব্রুয়ারি র্যালি বাংলাদেশে প্রবেশের পর তিনদিন বাংলাদেশের সড়কে অবস্থান করবে।’
১৮ জানুয়ারি র্যালি শুরুর দিন আগে নির্ধারণ করা হলেও কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ বাকি থাকায় কয়েকদিন পিছিয়ে ৩১ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয় বলেও তিনি জানান।
ঐতিহাসিক এ র্যালির বহরে সবমিলিয়ে ১৮টি গাড়ি (জিপ/এসইউভি) থাকবে।
বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের তিনটি করে জীপ (এসইউভি) থাকবে।
বহরের সঙ্গে থাকবে একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি সার্ভিস কার ও একটি সুইপার কার।
এছাড়া একটি জিপ থাকবে গণমাধ্যমের জন্য। প্রত্যেক দেশ থেকে একজন করে গণমাধ্যম কর্মী/সাংবাদিক এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এর বাইরে যাত্রাপথে বহরের সামনে ও পেছনে থাকার জন্য দু’টি কন্ট্রোল কার/ পাইলট কার থাকবে।
প্রতি গাড়িতে দুই জন দক্ষ চালক থাকবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আসামে কার র্যালি সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন আসাম সরকারের এমন একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘গাড়িতে কারা থাকবেন তা চার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘গাড়ি চালাতে দক্ষ ও ইঞ্জিন সম্পর্কে কারিগরি জ্ঞান রয়েছে এমন ব্যক্তিদের মনোনীত করা হচ্ছে।’
২০০৬ সালের ৩১ মার্চ নয়াদিল্লিতে বিসিআইএম ফোরামের (বাংলাদেশ চীন ইন্ডিয়া মিয়ানমার ফোরাম) এক বৈঠকে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি র্যালি আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
পরের বছরের ৩১ মার্চ ঢাকায় বিআইসিএমের পরের বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয় এবং সে বছরের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পরের বৈঠকে র্যালির ব্যাপারে কর্মপন্থা তৈরি শুরু হয়।
বিভিন্ন দেশে ধারাবাহিক বৈঠকের পর এর রুট ও অন্যান্য বিষয় মোটামুটি চূড়ান্ত হয় ২০১১ সালের ডিসেম্বরে। সর্বশেষ আরও খুঁটিনাটি কিছু ঠিকঠাক করে যাত্রা শুরুর দিন নির্ধারিত হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর।
বিসিআইএম ফোরামের সদস্য চার দেশের এই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্য ও পর্যটন বৃদ্ধিসহ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোই এ র্যালির অন্যতম উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ র্যালিটি শুধু একটি গাড়ি ভ্রমণ নয়, বরং এটি এই চার দেশের একটি ঐতিহাসিক বন্ধন হবে।’
তিনি বলেন, ‘স্থল বাণিজ্যে এই রুটটি একটি নতুন মাত্রা নির্ধারণ করবে। যার মাধ্যমে এটা বলা যাবে যে, এই পথ দিয়ে স্থল বাণিজ্য সম্ভব হবে।’
র্যালির শেষে কলকাতায় বিসিআইএমের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও রাত্রিযাপনের জন্য নির্ধারিত কিছু স্থানে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের আরও কিছু বৈঠক ও সম্মিলনী করার কথাও জানা গেছে।
র্যালি আয়োজন ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো তদারকি করতে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট উত্তরপূর্বের রাজ্য আসাম ও মনিপুর সরকারের কাছে বিশেষ নিরাপত্তা বার্তা পাঠানো হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্র থেকেও নিরাপত্তা বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
র্যালির পথপরিক্রমা:
চীনের কুনমিং থেকে যাত্রা শুরুর পর দেশটির দালি, রুইলি শহর ধরে মিয়ানমার সীমান্তের মুসে’তে আসবে।
লাসিহো স্থল বন্দর দিয়ে র্যালির বহর মিয়ানমারে প্রবেশের পর হিসপাও, কিয়াওকমে, পিও ও লিন, মান্দালয়, তামু শহর ছুঁয়ে ভারতের মোরে সীমান্ত বন্দরে আসবে।
গাড়ির বহর ভারতের মনিপুর রাজ্যের মোরে সীমান্ত স্থল বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশের পর ইম্ফল দিয়ে শিলচর শহর ছুঁয়ে যাবে করিমগঞ্জের দিকে।
সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে র্যালির বহর সিলেটের মাটিতে পা রেখে র্যালি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এরপর ঢাকা হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতু দিয়ে কুষ্টিয়া, যশোর ছুঁয়ে বেনাপোল অতিক্রম করে পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাবে।
ভারতে ঢুকে বনগাঁ শহরের ভেতর দিয়ে যশোর রোড ধরে বারাসাত হয়ে কলকাতার ময়দানে গিয়ে র্যালিটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
কার র্যালি উপলক্ষ্যে তৈরি করা নীতিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক দিন র্যালির বহর ৮ ঘণ্টা করে চলবে।
যাত্রাপথে র্যালি কোন শহরে কোথায় কত সময় অবস্থান করবে তা সংশ্লিষ্ট দেশ সমন্বয় করবে।
পুরো যাত্রাপথের বেশিরভাগ অংশই পাহাড়ি পথ হওয়ায় কতদিনের মধ্যে র্যালি শেষ হবে তা এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। তবে ু১৬ দিনের মধ্যে ঐতিহাসিক এ যাত্রা শেষ করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের এই র্যালিটির এ রুট নির্ধারিত হলেও গত কয়েক বছরে রুট নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের কয়েক দফা চিঠি চালাচালির কথা জানা যায়।
বাংলাদেশ প্রথমে দু’টো রুটের প্রস্তাব দিয়েছিল। এর একটি করিমগঞ্জের সুতারকান্দি হয়ে যে পথে র্যালিটি আসছে।
বাংলাদেশের অপর প্রস্তাবটি ছিল মেঘালয়ের ডাউকি হয়ে। এ প্রস্তাবে বাংলাদেশে প্রবেশের রুটটি অবশ্য ইমফল থেকে শিলচর হয়ে গুয়াহটি এবং শিলং হয়ে এদেশে প্রবেশ করার কথা ছিল।
ভারত অবশ্য চেয়েছিল গুয়াহাটি থেকে দক্ষিণে মেঘালয়ে না গিয়ে পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চেংরাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে র্যালি প্রবেশ করুক।
তবে পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য-রুটকে মাথায় রেখেই সিলেট দিয়ে র্যালি এদেশে প্রবেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের কর্মকর্তাদেরই জয় হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১২