
ঢাকা: মাত্র কয়েক দিন আগেই বিজয়ের মাস ডিসেম্বর গত হয়েছে। ৪০ বছর আগে এই মাসেই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ভাষাগত এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করেছে তার বহু আকাংক্ষিত স্বাধীনতা।
তবে সেই সময় বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছিল আক্রমণকারী পাকিস্তানকে। যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের মিত্র প্রমাণ করার জন্যই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের এই আক্রমণকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কিন্তু অনেক মার্কিনিই তাদের দেশের এই অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এ কারণেই প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম এবং গোলা-বারুদসহ একটি জাহাজ পাকিস্তান থেকে যখন মার্কিন বন্দরে ভিড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল তখন একটি গ্রুপ বিবেকের তাড়নায় এই জাহাজ আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
এ ব্যাপারে সেই সময়ের একজন প্রতিবাদী বর্তমানে ৭৮ বছর বয়সী রিচার্ড টেলর বলেন, ‘এর জন্য আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি একেবারে জাহাজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলাম।’
১৯৭১ সালে জুলাইয়ে ডিঙি এবং ছোট ছোট হালকা নৌকা নিয়ে টেলর এবং প্রতিবাদকারীদের একটি দল পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মাকে বাল্টিমোর বন্দরে নোঙ্গর ঠেকানোর উদ্যোগ নেন।
এই জাহাজটি কানাডা থেকে আসছিল এবং উদ্দেশ ছিল পাকিস্তান। জাহাজটিতে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম এবং গোলা-বারুদ ছিল যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানকে সহায়তার জন্য পাঠানো হচ্ছিল বলে ধারণা করা হয়।
টেলর জানান, সে সময় কিন্তু পাকিস্তানে নতুন করে অস্ত্রের চালান নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পত্রপত্রিকায় খবর বের হয়, মার্কিন বন্দরে অস্ত্র, গোলা-বারুদ নেওয়ার জন্য পদ্মার মতো যে সব মালবাহী জাহাজ অপেক্ষা করছে সেগুলো এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই কেনা হয়েছিল।
টেলরের দলে ছিল দু’টি ডিঙি, তিনটি ছোট হালকা নৌকা এবং একটি রবারের ভেলা। বাল্টিমোরের ব্রোয়েনিং পার্ক থেকে তারা যাত্রা শূরু করেন। পুলিশ এবং কোস্ট গার্ডরা তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু টেলরের দলের সবাই সব ভীতি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল।
টেলর বলেন, ‘আমাদের প্রতিবাদের একটা প্রধানতম কারণ হল, পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের অন্যায় আক্রমণে সহায়তা করছে মার্কিন সরকার। এই বিষয়টি ছিল মর্মভেদী। হাজার হাজার দূরের মানুষেরা দুর্দশাগ্রস্ত আর আমাদের সরকার এই জুলুমে সহায়তা করছে।’
তিম্মি আজিজ জানতেন, এই দুর্দশা ছিল এক পক্ষের। তিনি বড় হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানে। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। বর্তমানে তিনি বাল্টিমোরে এনভাইরনমেন্টাল ডিজাইন সম্পর্কে পড়ান।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টা ছিল খুবই উত্তেজনাকর যে, সমুদ্রের কত গভীরে তাদের যেতে হতো। বন্দর থেকে একেবারে সমুদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের যেতে হত আর এটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো। বিশাল আকৃতির জাহাজ আর ছোট ছোট ডিঙি নৌকা যেগুলো ওই জাহাজের সামান্য ঝাঁকুনিতেই ভেসে যেতে পারত।’
সেই দিনের ৪০ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে সেইসব ঘটনার প্রতি নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাদের একজন আরিস ইউসুফ। তিনি নিউইয়র্কে থাকেন। বর্তমানে সেই ডিঙি নৌকা নিয়ে অবরোধের বিস্ময়কর এবং রোমাঞ্চকর কাহিনী অবলম্বনে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন তিনি।
ইউসুফ বলেন, ‘১৯৭১ সালের ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটেছে তা নিয়ে আমি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই।’
১৯৭১ সালের সেই জুলাইয়ে কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনায় টেলর বলেন, পদ্মা শেষ পর্যন্ত বন্দরে ভিড়ে মালপত্র নিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু এর পরের মাসে প্রতিবাদকারীরা তাদের আন্দোলন আরও জোরদার করে। মার্কিন বন্দরে কোনও পাকিস্তানি জাহাজ ভিড়তে না দেওয়ার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন তারা। এই অবরোধ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তারা ফিলাডেলফিয়া বন্দরের কুলি খালাসিদেরও রাজি করতে পেরেছিলেন তারা।
প্রতিবাদীদের একজন এলিয়ট গেভিস বলেন, ‘এই বিষয়টিতে একটা আন্তরিকতা ছিল। আর সেখানে (পূর্ব পাকিস্তান) ভয়ঙ্কর রকম নৃশংসতা চলছিল।’
গেভিস বর্তমানে একজন শিশুরোগ চিকিৎসক। ১৯৭১ সালে সে সময় তিনি ফিলাডেলফিয়া জাহাজ ঘাটে কাজ করতেন। পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডিঙি নৌকার প্রতিবাদ সম্পর্কে জানার পর তিনি অন্য কুলি-খালাসিদের এই প্রতিবাদে শামিল করেন। বন্দরে কোনও পাকিস্তানি জাহাজে মালামাল না তোলার জন্য তিনি তাদের রাজি করান।
এই অবরোধরে প্রথম শিকার হয় পাকিস্তানের আল আহমাদি জাহাজ। রিচার্ড টেলর এবং তার সঙ্গীরা আবার ডিঙি নৌকা নিয়ে জাহাজটি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এদিকে খালাসিরা জাহাজ থেকে মালামাল নামাতে অস্বীকৃতি জানায়।
সেদিনের কথা স্মরণ করে গেভিস বলেন, ‘অবশ্য সবাই এতে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু তারা এই একতাকে সম্মান করত। তারা আমাদের অবরোধ লাইন অতিক্রম করত না, এরকম আরও কিছু। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে তাদের মজুরির অর্থ দিতে হত।’
ওই জাহাজটি ঠেকানোর পর কোনও মালবাহী জাহাজে মাল উঠানো হয়নি এবং নামানোও হয়নি।
এর চার মাস পরে হোয়াইট হাউসের সামনে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভের পর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে। আমেরিকার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী আন্দোলনের মধ্যে এটি অন্যতম একটি প্রতিবাদের অবসান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
রিচার্ড টেলরের স্ত্রী ফিলিস টেলর বলেন, ‘বাঙালিদের প্রতি বিনয়ের সঙ্গে আমরা শুধু বলতে চাই, এই এরকম একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া আমরা এটা করতে পারতাম না।’
ফিলিস টেলরও সেই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন।
আরেক প্রতিবাদী ডিক বলেন, ‘শুধু আমরাই নই, একটি ছোট প্রতিশ্রুতীশীল দলের মানুষেরা অরণ্যে এমন আশা দিয়েছিলেন, যার কারণে আপনি একটি পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে পারেন।’
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটা হলো সেই সব ত্যাগী মানুষের জন্য একটা পুরস্কার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১১