
খোদাভীরুদের দ্বিতীয় গুণ বর্ণনা করা হয়েছে, তারা আখেরাতে বিশ্বাস করে। এখানে আখেরাত বলতে পরকালের সে আবাসস্থলের কথা বোঝানো হয়েছে, যাকে কোরআন পাকে দারুল কারার, দারুল হায়াওয়ান এবং ওকবা নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। সমগ্র কোরআন তার আলোচনা ও তার ভয়াবহতার বর্ণনায় পরিপূর্ণ।
আখেরাতের প্রতি ঈমান প্রসঙ্গটি ঈমান বিল গায়েব-এর আলোচনায় কিছুটা বর্ণিত হয়েছে। পুনরায় এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে এ জন্য যে, যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঈমান অনুযায়ী আমল করার প্রকৃত প্রেরণাও এখান থেকেই সৃষ্টি হয়।
ইসলামি আকায়েদগুলোর মধ্যে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা একটা বৈপ্লবিক বিশ্বাস, যা দুনিয়ার রূপই পাল্টে দিয়েছে। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়েই ওহির অনুসারীগণ প্রথমে নৈতিকতা ও কর্মে এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত দুনিয়ার অন্যান্য সকল জাতির মোকাবেলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছে। পরন্তু তওহিদ ও রেসালতের ন্যায় এ আকিদাও সমস্ত নবি-রসুলের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই সর্বসম্মত বিশ্বাস রূপে চলে আসছে। যেসব লোক জীবন ও এর ভোগ-বিলাসকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গণ্য করে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে তিক্ততাকেই সর্বাপেক্ষা কষ্ট বলে মনে করে, আখেরাতের জীবন, সেখানকার হিসাব-নিকাশ, শাস্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের এতটুকুও আস্থা নেই, তারা যখন সত্য-মিথ্যা কিংবা হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য করাকে তাদের জীবনের সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধারূপে দেখতে পায়, তখন সামান্য একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সকল মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করে না, এমতাবস্থায় এ সকল লোককে যেকোনো দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখার মতো আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যা কিছু অন্যায় অসুন্দর বা সামাজিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলার পক্ষে ক্ষতিকর, সেসব অনাচার কার্যকরভাবে উৎখাত করার কোনো শক্তি সে আইনেরও নেই, এ কথা পরীক্ষিত সত্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো দুরাচারের চরিত্রশুদ্ধি ঘটানোও সম্ভব হয় না। অপরাধ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আইনের শাস্তি সাধারণত তাদের ধাত-সওয়া হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর তাদের মধ্যে শাস্তিকে ভয় করার মতো অনুভূতিও থাকে না। অপরপক্ষে আইনের শাস্তিকে যারা ভয় করে, তাদের সে ভয়ের আওতাও শুধু ততটুকুতেই সীমবদ্ধ থাকে, যতটুকু ধরা পড়ার ভয় বিদ্যমান। কিন্তু গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, সে রূপ পরিবেশে এ সমস্ত লোকের পক্ষেও যে কোনো গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে কোনো বাধাই থাকে না।
প্রকারান্তরে আখেরাতের প্রতি ঈমানই এমন এক কার্যকর নিয়ন্ত্রণবিধি, যা মানুষকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রই যেকোনো গর্হিত আচরণ থেকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে বিরত রাখে। তার অন্তরে এমন এক প্রত্যয়ের অম্লান শিখা অবিরাম সমুজ্জ্বল করে দেয় যে, আমি প্রকাশ্যেই থাকি আর গভীর নির্জনেই থাকি, রাজপথে থাকি কিংবা কোনো বদ্ধঘরে লুকিয়েই থাকি, মুখে বা ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করি আর নাই করি, আমার সকল আচরণ, আমার সকল অভিব্যক্তি, এমনকি অন্তরে লুকায়িত প্রতিটি আকাক্সক্ষা পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজমান এক মহাসত্তার সামনে রয়েছে। তার সদাজাগ্রত দৃষ্টির সামনে কোনো কিছুই আড়াল করার সাধ্য আমার নেই। আমার সত্তার সঙ্গে মিশে রয়েছে এমনসব প্রহরী, যারা আমার
প্রতিটি আচরণ এবং অভিব্যক্তি প্রতিমুহূর্তেই লিপিবদ্ধ করছেন।
উপরোক্ত বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রাথমিক যুগে এমন মহোত্তম চরিত্রের অগণিত লোক সৃষ্টি হয়েছিলেন, যাদের চাল-চলন এবং আচার-আচরণ দেখেই মানুষ ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়তো।
এখানে লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে ‘য়ুমিনূনা’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘য়ুকিনূনা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা বিশ্বাসের বিপরীতে অবিশ্বাস এবং একিনের বিপরীতে সন্দেহ-সংশয়। এই শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হলেই শুধু উদ্দেশ্য সফল হয় না, বরং এমন দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, যে প্রত্যয় স্বচক্ষে দেখা কোনো বস্তু সম্পর্কেই হতে পারে।
খোদাভীরুদের এই গুণ পরকালে আল্লাহ তায়ালার সামনে উপস্থিতি এবং হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান এবং সবকিছুরই একটি পরিপূর্ণ নকশা তার সামনে দৃশ্যমান করে রাখবে। যে ব্যক্তি অন্যের হক নষ্ট করার জন্য মিথ্যা মামলা করে বা মিথ্যা সাক্ষী দেয়, আল্লাহর আদেশের বিপরীত পথে হারাম ধন-দৌলত উপার্জন করে এবং দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরিয়তবিরোধী কাজ করে, সে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাসী হয়ে, প্রকাশ্যে ঈমানের কথা যদি স্বীকার করে এবং শরিয়তের বিচারে তাকে মুমিনও বলা হয়, কিন্তু কোরআন যে একিনের কথা ঘোষণা করেছে, এমন লোকের মধ্যে সে একিন থাকতে পারে না। সেই কোরআনি একিনই মানবজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। এর পরিণামেই খোদাভীরুদেরকে হেদায়েত এবং সফলতার যে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তারাই সরলÑসঠিক পথের পথিক, যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে আর তারাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে।
সুরা বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে কোরআনকে হেদায়েত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থরূপে ঘোষণা করে সকল সন্দেহ ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার পর সে সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এই গ্রন্থের হেদায়েতে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন এবং যাদেরকে কোরআনের পরিভাষায় মুমিন ও মুত্তাকি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি এবং পরিচয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী পনেরটি আয়াতে সে সমস্ত লোকের বিষয় আলোচিত হয়েছে, যারা এই হেদায়েতকে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।
এরা দুটি দলে বিভক্ত। একদল প্রকাশ্যে কোরআনকে অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণের পথ অবলম্বন করেছে। কোরআন তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর দল হচ্ছে, যারা হীন পার্থিব উদ্দেশে অন্তরের ভাব ও বিশ্বাসের কথাটি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে সাহস পায়নি, বরং প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছে; মুসলমানদের নিকট বলে আমরা মুসলমান; কোরআনের হেদায়েত মানি এবং আমরা তোমাদের সাথে আছি। অথচ তাদের অন্তরে লুকায়িত থাকে কুফর ও অস্বীকৃতি। আবার কাফেরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা তোমাদের দলভুক্ত। তোমাদের সাথেই রয়েছি। মুসলমানদিগকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য এবং তাদের গোপন কথা জানার জন্যই তাদের সাথে মেলামেশা করি। কোরআন তাদেরকে মুনাফিক বলে আখ্যায়িত করেছে। এই পনেরটি আয়াত যারা কোরআন অমান্য করে তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে ৬ ও ৭ আয়াতে প্রকাশ্যে যারা কোরআন অস্বীকার করে তাদের কথা ও স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তী তেরটি আয়াতে মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। এতে তাদের স্বরূপ, নিদর্শন, অবস্থা ও পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে।
চলবে...