
ঢাকাঃ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলের নেতা খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
নেতৃবৃন্দ শুক্রবার তাদের শোকবাণীতে আব্দুর রাজ্জাকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
তোফায়েল আহমেদ: প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন মানুষের নেতা। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে একজন বলিষ্ঠ সৈনিক।
তোফায়েল আহমেদ আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন আমার নেতা। আমি ছিলাম ওনার কর্মী। আমিসহ আওয়ামী লীগ পরিবারে যারা আছি তার স্নেহ-ভালোবাসায় আমরা রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠেছি। তিনি দক্ষ সংগঠক ছিলেন। পাশাপাশি দলের কর্মীদের স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত করেছিলেন।
তিনি ছাত্রলীগের দুইবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগেরও দুইবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুইটি আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোনো দিন কোনো নির্বাচনে তিনি হারেন নি। এটা মানুষের ভালোবাসার নিদর্শন।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি এতোটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশাল রাখতে চেয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি দক্ষ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুজিব বাহিনীর চারজন কর্ণধারের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক এবং আমাকে (তোফায়েল আহমেদ) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং আব্দুর রাজ্জাককে মানসিক এবং আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। ১২ দিন আমাদের অজ্ঞাতস্থানে রাখা হয়েছিল।
আমি এবং আব্দুর রাজ্জাক এক চৌকিতে ঘুমিয়েছি। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করার ক্ষেত্রে আব্দুর রাজ্জাকের মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি তিনি এতই অনুগত ছিলেন যে, এ বছরেই তিনি ভারতের চেন্নাই থেকে চিকিৎসা নিয়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এসেছিলেন। পরে তিনি সেখানে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে লন্ডনে নেওয়া হয়। এটাই ছিল তার শেষ কর্মসূচি।
তিনি অনেক মানুসক যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলেন। তার মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট লুকানো ছিল। আমি দুবার তাকে দেখতে লন্ডনে গিয়েছিলাম। চিকিৎসকরা যখন বললেন ওনার অপারেশন সম্ভব না, তখন তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন।
তারমত বিকল্প সংগঠক আর হবে কিনা আমার জানা নেই। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
মাহবুব উল আলম হানিফঃ শোকবাণীতে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক জননেতা আব্দুর রাজ্জাক এমপি’র মহাপ্রয়ানে আমরা গভীরভাবে শোকাভিভূত। সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য বিশ্বস্ত সহচর। তিনি তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা, সামাজিক মুক্তি ও শান্তির সংগ্রামে।
হানিফ বলেন, ছাত্র অবস্থা থেকে শুরু করে আমৃত্যু তিনি ছিলেন এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক ও নেতা। তিনি ছাত্রবস্থায় ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসাধারণ সংগঠক ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক ষাটের দশকে পর পর দুইবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে জননেত্রী শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হলে আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দীর্ঘদিন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক ও স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, বিশেষত ১৫ দলীয় ঐক্য গঠনেও পালন করেন উদ্যোগী ভূমিকা।
জননেতা আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ’৭১-এর ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার। মৃত্যুকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছাড়াও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি।
হানিফ বলেন, জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্মনিবেদিত জননেতা আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭০ থেকে এ পর্যন্ত ৮ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি প্রয়াত নেতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে শোকের ছায়া: আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে জাতি তার আরেক সূর্য সন্তানকে হারালো বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশি-আমেরিকানরা। লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজ্জাকের মৃত্যু সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে আসামাত্রই প্রবাসীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
বিভিন্ন স্তরের প্রবাসীরা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় এ রাজনীতিকের আত্মার মাগফেরাত এবং তার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছেন।
তারা বলেছেন, এ মৃত্যু জাতির জন্যে অপুরণীয় ক্ষতি। এ মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে।
শোক প্রকাশ করেছেন- যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক নিজাম চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, দলের নিউইয়র্ক সিটির সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নূরন্নবী, সিনিয়র সহসভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুর রহমান চৌধুরী, যুবলীগের সভাপতি মিসবাহ আহমেদ, সেক্রেটারি ফরিদ আলম, নিউইয়র্ক সিটি আ’লীগের উপদেষ্টা খোরশেদ খন্দকার, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন দেওয়ান, সেক্রেটারি নুরুজ্জামকান সর্দার, ছাত্রলীগের সভাপতি জেড আলম জয় প্রমুখ।
তিনি কিংবদন্তি,ফখরুলঃ আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে মাওলানা ভাসানী মিলনায়তনে ঢাকা মহানগর বিএনপির কর্মীসভা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু সংবাদ শোনেন মির্জা আলমগীর।
তিনি বলেন, আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। মির্জা আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে আব্দুর রাজ্জাক এক অবিস্মরণীয় নাম। এ দেশের মানুষ সারা জীবন তার কথা মনে রাখবে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র রাজনীতিতে কিংবদন্তি।
জাতীয় পার্টি: আবদুর রাজ্জাক’র জীবনাবসান আমাদের জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেছেন জাতীয় পার্টি (জাপা) মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি।
তিনি টেলিফোনে শোক প্রকাশ করে বলেন, আমরা আরেকটি জাতীয় সম্পদ হারালাম। তার মত প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমাদের দেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ন। তাকে হারিয়ে আমরা আরেকটি হোঁচট খেলাম।
তিনি বলেন, আবদুর রাজ্জাকের মত জাতীয় নেতার বিদায় আমাদের দেশ পূরন করতে পারবে না। তার রাজনীতির আদর্শ আমাদের সকলের অনসরণীয়।
ভারাক্রান্ত কন্ঠে জাপা মহাসচিব বলেন, আমার ব্যক্তিগত জীবনে ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বড় দলের নেতা হিসেবে কখনো অহংকার বোধ কাজ করেনি ওনার।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন।
জাপা মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার আবদুর রাজ্জাকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি মরহুম আবদুর রাজ্জাকের প্রতি সকলকে দোয়া জানানোর আহবান জানিয়েছেন।
সিপিবিঃ জননেতার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির(সিপিবি) সভাপতি মনজুরুল আহসান খান ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাভিভূত।
দেশের জন্য তিনি যে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন, তা আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন।
তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারালো একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে। আমরা তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
ওয়ার্কার্স পার্টি: আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর সংবাদে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক গভীরভাবে শোকাহত বলে দলের এ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে আব্দুর রাজ্জাকের মতো বলিষ্ঠ নেতাকে হারিয়ে জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। নেতৃবৃন্দ শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী : আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
মন্ত্রী বলেন, আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে দেশ এক মহান নেতাকে হারালো। তিনি মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জেএসডি: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এক বিবৃতিতে বাঙ্গালির স্বাধীকার সংগ্রামের অগ্রসেনানী আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
এক লিখিত বিবৃতিতে জেএসডি নেতৃবৃন্দ বলেছেন ৬২তে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এর পর পর ২ বার সাধারণ সম্পাদক, ৬ দফা আন্দোলনের অগ্রসেনানী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিএলএফ এর ১জন সেক্টর কমান্ডার এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আপোষহীন লড়াকু সৈনিক আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে জাতি স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারালো।
তার এ অভাব সহজে পূরন হবার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১১