
ঢাকা : মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করে রাজাকার কুলশিরোমনি খেতাবধারী ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযম বলেছেন, তিনি রাজাকার নন। একাত্তরে রাজাকার নামে যে বাহিনী গঠন করা হয়েছিল তার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিলো না।
তবে কেউ যখন তাকে রাজাকার বলে, তখন একে একটি গালি হিসেবে নেন গোলাম আযম। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা সরকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সংশ্রব ছিল সে কথাও স্বীকার করেছেন সাবেক এই জামায়াত নেতা। গত ১৫ ডিসেম্বর রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দীর্ঘ দেড়ঘণ্টা বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন গোলাম আযম।
নিজেকে তিনি নির্দোষ দাবি করেন, অস্বীকার করেন যুদ্ধাপরাধের কথা, কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নন বলেও জানান। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তার ও তার দলের যে অবস্থান ছিল সে কথা স্বীকার করে নেন অকপটে।
ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া গোলাম আযম নিজেকে দেশপ্রেমিক বলেও দাবি করেন। দেশের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেন অবস্থান নিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নে তার উত্তর ছিল একটাই, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ভারতের কুক্ষিগত হয়ে থাকতে হবে সে কারণেই এর বিরোধিতা করেছি।’
তার এ যুক্তি ঠুনকো, বাংলাদেশ ভারতের কুক্ষিগত হয়নি বরং একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশেরই নাগরিক তিনি নিজেও, বাংলানিউজের পক্ষ থেকে একথা বলা হলে গোলাম আযম বলেন, ‘ভারতের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশ এখনো বের হতে পারেনি।’
মুক্তিযুদ্ধের পর নাগরিকত্ব হারানো এবং জিয়াউর রহমানের বদৌলতে দেশে বসবাসের সুযোগ পাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপকালে গোলাম আযম তার নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার দীর্ঘ কাহিনীও তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ১৯৭৩ এ নাগরিকত্ব হারানোর পর তার দেশে ফেরার আর সুযোগ ছিল না। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর প্রথম সুযোগেই দেশে ফেরার চেষ্টা করেন। এক দফা তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।
গোলাম আযম বলেন, ‘আমার মা আমার দেশে ফেরার সুযোগ চেয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে আবেদন করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি পাসপোর্ট দেখিয়ে বাংলাদেশে আসি। এরপর একদফা সময় বাড়ানো হয়, পরে জানিয়ে দেওয়া হয় আর সময় বাড়ানো হবে না। কিন্তু আমিও বলে দেই আমি আর দেশ থেকে ফিরে যাব না। এরপর জিয়াউর রহমান আমাকে দেশে থাকার সুযোগ দেন। কিন্তু কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই। আমাকে বলে দেওয়া হয়, দেশে থাকুন কিন্তু সরকার কোনো কাগজপত্র দেবে না।’
গোলাম আযম বলতে থাকেন, ‘এরপর দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৯৪ সালে আমি আমার নিজ দেশেরই নাগরিকত্ব ফিরে পাই।’
বাংলানিউজের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, যে দেশটিকে আপনি ‘নিজ দেশ’ বলছেন সে দেশটি তো আপনি চাননি, এ দেশটির জন্য স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাহলে কেন নিজের দেশ বলছেন?
এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান গোলাম আযম। তবে বলেন, ‘নিজের মায়ের প্রতি যেমন মানুষের ভালোবাসা থাকে তেমননি নিজের জন্মভূমির প্রতিও থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা।’
এ পর্যায়ে গোলাম আযম এও দাবি করেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য জান দিতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি।
এ বক্তব্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে তার ভূমিকার কোনোই মিল নেই এমন প্রসঙ্গে গোলাম আযম বলেন, ‘শেখ সাহেব যদি ভারতের সাহায্য না চাইতেন, তাহলে আমরাও তার সঙ্গে সংগ্রামে যোগ দিতাম।’
কিন্তু ইতিহাস যা বলে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের ওপর যে অত্যাচার-অবিচার চালিয়েছিল, তাতে বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশকে স্বাধীন করতে হলে ভারতের সহযোগিতা রাজনৈতিক, ভৌগলিক কারণেই বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল, এমন প্রসঙ্গে গোলাম আযম বলেন, ‘ভারত আমাদের কুক্ষিগত করে রাখতেই সহযোগিতা করতে চেয়েছিল।’
দীর্ঘ নয় মাস দেশের সাহসী সন্তানেরা যুদ্ধ করেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, নারীর সম্ভ্রম কেড়েছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম এত সব ঘটনার পরও কি আপনার মনে দেশাত্ববোধ জাগ্রত হয়নি? এমন পশ্নেও গোলাম আজম বলেন, ‘আমাদের করার কিছুই ছিল না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক পরিপক্কতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গোলাম আযম। তিনি বলেন, ‘তার কারণেই পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছে। তা না হলে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিসেবে পুর্ব পাকিস্তানের নেতারাই পাকিস্তান পরিচালনা করতো।’
সে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বলেই কি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান? একথা জানতে চাওয়া হলে গোলাম আযম বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতার পক্ষেও ছিলাম না, বিপক্ষেও ছিলাম না।’
তাহলে রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনী গঠন করেছিলেন কেনো? এমন প্রশ্নে গোলাম আযমের দাবি, ‘এসব বাহিনীর মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করারই চেষ্টা করেছিলাম।’
কিন্তু এসব বাহিনীর সদস্যরা দেশের সাধারণ মানুষকে হত্যায় সহযোগিতা করেছে, তাদেরই সহায়তায় এ দেশের মা-বোনেরা পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের সম্ভোগের সামগ্রীতে, এরপরও এসব অভিযোগ অস্বীকার করবেন? এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান গোলাম আযম।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় রাজাকার শব্দটিই আজ একটি আলাদা অর্থ পেয়েছে। এর কারণ তাহলে কী? গোলাম আজম মৃদু হেসে বলেন, ‘রাজাকার আজকাল একটি গালি। আমাকেও এ গালি দেওয়া হয়। কিন্তু আমি রাজাকার নই।’
[প্রিয় পাঠক, গোলাম আযমের সঙ্গে বাংলানিউজের কথা হয় আরো অনেক বিষয় নিয়ে। যুদ্ধাপরাধের বিচার, তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন জানা-অজানা দিক উঠে আসে সে আলাপচারিতায়। এসব নিয়ে আরো প্রতিবেদন পড়ুন বাংলানিউজে।]
- মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ
- জাকিয়া আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলাদেশ সময় : ১৫৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১১