
চট্টগ্রাম: নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আমাদের তরুণেরা। যাদের বয়স ২১ বছরের নিচে। তারুণ্যের শক্তি বিরাট বিজয় আনবে, তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।’
সামাজিক ব্যবসা ও মুনাফা নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী বলেন, মানুষ টাকার নেশায় মজনু হয়ে যায়। আমি ভাবি, মানুষ টাকার চেয়ে অনেক বড়।
শনিবার সকালে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ১৭৫ বছর পূর্তি উৎসবের উদ্বোধনকালে তিনি একথা বলেন।
এ কীর্তিমানের বক্তৃতাজুড়ে ছিল তারুণ্যের জয়গান। তিনি বলেন, ‘তরুণদের ধারণক্ষমতা অসাধারণ। তাদের মধ্যে স্পিড আছে। মূল বিষয় ধরিয়ে দিতে পারলে যেকোনো তরুণ জ্বলে উঠতে পারে। পুঁজিবাদ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে, নতুন সভ্যতা সৃষ্টির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর জন্য তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।’
শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সব শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জ্ঞানের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাহলেই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব।’ সকালে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন ড. ইউনূস।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েটসের সহ-সভাপতি এমএ মালেক। বক্তব্য দেন ১৭৫ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী ও সচিব মোশতাক হোসাইন।
শৈত্যপ্রবাহ আর কুয়াশাঢাকা আকাশ বাধা হতে পারেনি বিদ্যালয়ের গর্বিত ছাত্রদের প্রাণের মেলায়। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন কি প্রবাসী ছাত্ররাও জড়ো হয়েছিলেন প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে। তাদের স্মৃতিবিজড়িত আঙিনা, শ্রেণীকক্ষ, খেলার মাঠসহ নানা বিষয়-আশয় নস্টালজিক (স্মৃতিকাতর) করে তোলে। কেউ কেউ পুরোনো বন্ধু-সহপাঠীকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কেউ শোভাযাত্রা উপলক্ষে বের করা স্মারক টি-শার্টে নেন বন্ধুর অটোগ্রাফ। পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাধভাঙা হাসিতে ফেটে পড়েন কেউ কেউ। খুনসুটি, উচ্ছ্বাস আর হই-হুল্লোড়ে হারিয়ে যান কেউ কেউ।
এমএ মালেক বলেন, ‘কলেজিয়েট স্কুল একটি ব্রান্ড। এখান থেকে বেরিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ।’
উদ্বোধনী পর্বের পর ছিল ড. ইউনূসের সংবর্ধনা। এ পর্বে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন।
মাহবুবুল হক বলেন, ‘আজ একটি অনন্য-ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ড. ইউনূস দেশের প্রথম নোবেলজয়ী। এ গৌরবের অংশীদার আমরা সবাই। তিনি বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে তরুণদের গড়ে তুলতে চান। প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের সেতুবন্ধন রচনা করেছেন তিনি।’
চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন বলেন, দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে আকাশের উচ্চসীমায় পৌঁছে দিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি ক্ষুদ্র ঋণের জনক, পথিকৃৎ। তিনি ১০০ বছর পরের দিকনির্দেশনা এখনই দিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে তার নতুন থিম।’
চৌধুরী মোহাম্মদ মহসিন জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ড. ইউনূস নোবেল পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দিনটিকে আবেগের ও উচ্ছ্বাসের আখ্যা দিয়ে সংবর্ধনার জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘নোবেল পুরস্কারকে পৃথিবীর সবাই সম্মান করে। কোনও দেশ নোবেল পেলে আনন্দের হুল্লোড় বয়ে যায়। এটা শুধু ব্যক্তির নয়, জাতির স্বীকৃতি। এ গৌরব অর্জন করা জাতির জন্য সৌভাগ্যের। এটা পথ খুলল, এখন তরুণেরা অনুপ্রাণিত হবে। আগে ভাবা হতো নোবেল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিস। নোবেল পাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।’
ক্ষুদ্রঋণের শুরুর দিকে নানাজনের নানা কথা উল্লেখ করে ইউনূস বলেন, ‘কেউ বললেন, গরিবকে টাকা দেবেন, আবার ফেরত নেবেন এতে বাহাদুরির কী আছে! কেউ বললেন, এটা এত সহজ জিনিস, আগে কেউ ভাবল না কেন?’
তিনি বলেন, ‘আরও বহু সোজা কাজ করার সুযোগ সমাজে আছে সেদিকে কারও নজর নেই। দুনিয়াতে এমন কোনও দেশ নেই যেখানে ক্ষুদ্রঋণ চালু করা হয়নি। নিউইয়র্কে সাড়ে চার হাজার নারীকে ঋণ দিয়েছি আমরা, আদায়ও সন্তোষজনক।’
মানুষ প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষ একই রকম। মানুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। মানুষের মঙ্গল করাটাই মানুষের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। মানুষের প্রয়োজন থাকলে ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি কোনো বিষয় ঠেকাতে পারে না। যেটা মানুষের ভেতর নেই সেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারলে সমাধান সহজ হয়।’
সাম্প্রতিক আলোচিত বিষয় সামাজিক ব্যবসা নিয়েও কথা বলেন ইউনূস। তিনি বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসাও একটি সোজা কাজ। এর মূল কথা হলো মুনাফা না চেয়েও ব্যবসা হতে পারে। প্রচলিত জ্ঞান, বিদ্যাকে চ্যালেঞ্জ না করলে নতুন কাজে গতি আসে না। অর্থনীতি বলে, ব্যবসা হলো সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। আমি মনে করি, এতে মানব জন্মের ক্ষুদ্র অর্থ ধরা পড়ে। মানুষ টাকার নেশায় মজনু হয়ে যায়। আমি ভাবি, মানুষ টাকার চেয়ে অনেক বড়।’
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসকে উপহার হিসেবে উত্তরীয় পরিয়ে দেন এমএ মালেক। তিনি মানপত্রও পাঠ করেন।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বিকেলে ছিল প্রবীণ সদস্য সংবর্ধনা, শোকপ্রস্তাব, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ‘কলেজিয়েটস: আমাদের স্বপ্ন আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা, র্যাফেল ড্র ইত্যাদি।
রোববারের কর্মসূচিতে আছে সকাল ১০টায় স্মৃতিচারণ, রক্তদান, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বর্ণাঢ্য আয়োজন উপলক্ষে ড. নুরুল আমিন সম্পাদিত ১৭৫ বছর পূর্তি উৎসব স্মারক ৬০০ পৃষ্ঠার ‘চট্টগ্রাম কলেজিয়েট’ বের হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১