মন্টুর স্বাধীনতা | বিএম বরকতউল্লাহ্

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৫:৫৫, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

‘বাবা, আমি স্বাধীনতা চাই। শুনতে পাচ্ছ বাবা, আমি কী বলছি?’ 
বারান্দায় আরামচেয়ারে বসে পত্রিকা দেখছিলেন মন্টুর বাবা। তিনি মাথা তুলে চশমার উপর দিয়ে তাকালেন মন্টুর দিকে। খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘স্বা-ধী-ন-তা!’

‘জ্বি আমি স্বাধীনতা চাই।’ শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে বললো দশ বছরের ছেলে মন্টু। 
বাবা চোখের চশমাটা হাতে নিলেন এবং তার দিকে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বললেন, ‘কীসের স্বাধীনতা চাও তুমি?’
‘আমার যা-ইচ্ছা তা-ই করবো। আমাকে কিচ্ছু বলতে পারবে না তোমরা এমন স্বাধীনতা চাই।’
মন্টুর বাবা কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে থেকে হাত উল্টিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম।’

মন্টু এক লাফে বারান্দা থেকে উঠোনে গিয়ে পড়লো এবং তিনটা লাফে উঠোন পেরিয়ে ভোঁ দৌড়। তার দৌড় গিয়ে থামলো বাড়ির পাশের এক খেলার মাঠে যেখানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। গরম বালিতে ধান পড়লে যেমন ছট্ ছট্ করে খই ফুটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মন্টু তেমনি ছটফট করে নিজেকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। সে হাত ঝাড়ে, পা ঝাড়ে। হাতে পায়ের রশির শক্ত বান খুলে দিলে যেমন চঞ্চল বেগে রক্ত ছোটাছুটি করতে থাকে; বাবার দেওয়া স্বাধীনতা পেয়ে মন্টুও চঞ্চল বেগে ছোটাছুটি করতে লাগলো। সামনে যাকে পায় তাকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আমি এখন থেকে স্বাধীন, একদম স্বাধীন। আমার যা ইচ্ছা তাই করবো। আমাকে আর কেউ কিছু বলবে না। আহ্ কী শান্তি। আমি স্বাধীন। স্বাধীন আর স্বাধীন। ইশ্ কি মজা, কি আনন্দ!’
অস্থির মন্টু বাবার দেওয়া স্বাধীনতার বার্তা সবলে ঘোষণা করে দিল।

২.
মাগরিবের নামাজের আজান পড়েছে। খেলা শেষে মাঠ থেকে সবাই চলে যাচ্ছে বাড়ি। অন্য সবার সঙ্গে সময়মতো বাড়ি গেলে আবার কীসের স্বাধীনতা? সুতরাং, মন্টু শূন্য মাঠে একা এলোমেলো পাঁয়চারি করছে। পায়ের সামনে মাটির ঢেলা, শুকনো গোবর যা পাচ্ছে তাতেই লাথি মারছে। ঢেলা আর গোবরগুলো ব্যাঙের মতো লাফিয়ে দূরে গিয়ে পড়ছে। 

চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। সবাই মাঠ ছেড়ে চলে গেছে যার যার ঘরে। আলো জ্বালিয়ে পড়তে বসেছে অনেকে। মন্টু চারদিকটা ভালো করে দেখে সোজা ঘরে গিয়ে উঠলো। ছোট বোন রাসুকে আদর করে পড়াচ্ছে তার বাবা। পাশে গিয়ে বিপরীত দিকে ফিরে বসে রইলো মন্টু। সে মাঠ থেকে রাত করে ঘরে ফিরেছে; হাত পা ধোয়নি, পড়তে বসেনি- এটা ঘুরেফিরে তার বাবা-মাকে শোনাতে চাইছে সে। মন্টু রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে এটা সেটা বলে। তার মা একবার তার দিকে তাকিয়ে চুলোয় লাকড়ি ঠেলে দিচ্ছে। কারোর মধ্যে কোনো রাগ বা শাসনের সুর নেই। আর সবই চলছে খুব স্বাভাবিকভাবে। মন্টু তার পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ইচ্ছেমতো চলছে। কোনো বাধা, বন্ধন শাসন-বারণ নেই, দারুণ মজা!

মা রাতের খাবার বেড়েছে। মন্টুর সামনে থেকে ছোট বোন রাসুকে ডেকে নিয়ে গেলো খাবার টেবিলে। মন্টু বসে আছে। তার ডাক পড়েনি। ডাক দিলে যদি মন্টুর স্বাধীনতা কষ্ট পায়! 

অন্যদিন না খেয়ে শুতে গেলে মা ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে খাওয়াতো। আজ কেউ কিছু বলেনি। সবাই যখন শুতে গেলো, তখন মন্টু সুর করে বলতে লাগলো, ‘আমি খা-ই-নি, খা-ব-না, আমার ইচ্ছা...।’ 

মন্টু বই নিয়ে বসলো টেবিলে। একটা একটা করে বই হাতে নিয়ে দু’একটা পাতা উল্টিয়ে ধুম করে ফেলে দেয় খাটের উপর। কখনো উচ্চৈঃস্বরে ছড়া পড়ে, কখনো গুনগুন করে একটু পড়ে বই রেখে দেয়। খাতা নিয়ে এলামেলো আঁকাআঁকি করে। কোনো কিছুতেই তার মন বসে না। ‘আমার পড়া শেষ’ বলেই সে বইগুলি সশব্দে টেবিলে রেখে ধুম করে এসে শুয়ে পড়ে ছোট বোন রাসুর পাশে। 

ভাই-বোন এক সঙ্গেই থাকে। মন্টু লেপ টেনে একপাশে জড়ো করে রাখে, হাত পা ছিটকে নানাভাবে রাসুর কাছে তার স্বাধীনতার সুখ প্রকাশ করে। মন্টুর দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে রাসু অভিযোগ করলে বাবা মা রাসুকে বুকে টেনে নিয়ে বুঝিয়ে বলে, ‘মা, রাগ করে না। ভাইয়া তো স্বাধীন। সে যা ইচ্ছা তা করুকগে।’ তবুও মন্টুকে কিচ্ছুটি বলে না।

৩.
স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। বেণু, রতন, সাজু এসে মন্টুকে বলে, ‘কিরে, তুই এখনো রেডি হসনি?, ইস্কুলে যাবি না? তাড়াতাড়ি রেডি হ।’
‘না, আমি ইস্কুলে যাবো না।’
‘কেনো যাবি না?’
‘এমনি, আমার ইচ্ছা। আমি না গেলে তোদের কোনো অসুবিধা আছে?’ তার সহপাঠীরা একথা শুনে মন্টুর মাকে নালিশ করে চলে গেলো।

মন্টুর অফুরন্ত সময় কাটে নানা দুষ্টুমি করে। খেলার মাঠে সে সকালে দুপুরে-বিকালে যাওয়া আসা করে, একা একাই খেলে, ঢিলাঢিলি করে। গাছের ডালে বসে থাকে, পাখি ধরার ফাঁদ পাতে। যাকে তাকে কিল ঘুষি মারে, থুতু দেয়, বিড়াল দৌড়ায়। বাড়ির পোষা কুকুরের বাঁকা লেজ সোজা করার জন্য কসরত করে। একটি বাইসাইকেল নিয়ে ঘাম ঝরিয়ে ছোটাছুটি করে। মন্টু সারাদিন কী পরিমাণ স্বাধীনতার সুখ বিতরণ করে বেড়ায় তা বোঝা যায় বিকেলে যখন তার বিরুদ্ধে একের পর এক নালিশ আসতে থাকে, তখন।

৪.
মন্টুর ওপর এখন মা-বাবার শাসন-বারণ নেই, আদেশ-নিষেধের বালাই নেই। তার কোন কাজে বা আচরণে মা-বাবা রাগ করে না, ধমক দেয় না। তার আদর নেই, স্নেহ নেই; ছায়া-মায়া নেই। 

সকালবেলা দুই ভাইবোন কথা বলছে। মা এসে নাস্তা করার জন্য রাসুকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন মন্টু তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাকে বলে, ‘নেও, আমাকেও টেনে নিয়ে যাও।’ তার মা, তাকে ধরলো না, রাসুকে নিয়ে চলে গেলো।

খাবার সময় ছোট বোনটির যখন ডাক পড়ে তখন মন্টু এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘আমাকে ডাকতে পারো না? খালি রাসুকে ডাক কেনো? ডাক দেও, ‘এই মন্টু ভাত খেয়ে যা।’ মা ডাকলো না।

দিনে দিনে মন্টুর মন কেবল মা বাবার আদর শাসন, ধমক আর বিধিনিষেধের জন্য কেমন যেন হাহাকার করতে লাগলো। এভাবেই কেটে গেলো দশ দিন। এখন সে দুরন্ত ছাগলছানার মতো আর ছোটাছুটি করে না। কেবল বাবা-মায়ের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। কী যেন বলতে চায় কী যেন পেতে চায় কিন্তু কিছুই বলে না।

৫.
মন্টুর বাবা বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। মন্টু ধীর পায়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সে ভাঙাস্বরে বললো, ‘বাবা, আমার স্বাধীনতা ফিরিয়ে নাও।’

মন্টুর বাবা মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর তিনি মুখে কিছু না বলে ডান হাতটা মন্টুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মন্টু এক লাফে গিয়ে বাবার গলা প্যাঁচিয়ে ধরলো।

বাবার দেওয়া স্বাধীনতা পেয়ে এতদিনে যা হারিয়েছে তাই যেন কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিতে চাইছে মন্টু।

...বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯
এএ


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান