
বিষয়-বৈচিত্র্য, উপস্থাপনকৌশল আর ভাবনা-প্রকাশরীতির নানান নিরীক্ষা-পর্বে বাংলাদেশের প্রবন্ধ-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাথে তাল মিলিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের গতিও হয়েছে বৈচিত্র্যময় এবং তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সমূহ জটিলতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ তাই, অনায়াসে যোগ হয়েছে প্রবন্ধের কাঠামোয়। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভ্রমণবৃত্তান্ত, রম্যভাষ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সারিবদ্ধভাবে প্রবন্ধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সাহিত্য-শিল্প সংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধের সংখ্যা যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, তা সাধারণ পর্যবেক্ষেণেই দৃষ্টিগোচর হয়।
বাংলাদেশের প্রবন্ধ-সাহিত্যে কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭Ñ৯ অক্টোবর ১৯৮১) এক অনন্য প্রতিভা। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দাবাডু, সঙ্গীতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী হিশেবে বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। সমকালীন নব্যশিক্ষি মুসলিম তরুণদের প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (১৯২৬) প্রতিষ্ঠায় কাজী মোতাহার হোসেন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তৎকালীন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ মুখপত্র শিখা-র সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। ধর্ম-সমাজ- সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর রচনাকর্মে মননশীলতা এবং গভীর জীববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। অসাম্প্রদায়িক বোধবুদ্ধি দ্বারা পরিশীলিত ছিল মোতাহারের সাহিত্যচিন্তা। বাংলা ভাষা ও বাঙালির মর্যাদা, রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য-পরিচয়, এবং আপন ভূবন ও সংস্কৃতির পরিচর্যায় তাঁর অবদান দারুণভাবে তৎপর্যবহ। কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি যথাক্রমেÑ সঞ্চরণ, নজরুল কাব্য পরিচিতি, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, নির্বাচিত প্রবন্ধ, সেই পথ লক্ষ্য করে, সিম্পোজিয়াম, আলোকবিজ্ঞান। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
কাজী মোতাহার হোসেন স্বাধীন চিন্তা-প্রকাশক প্রাবন্ধিক। তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর মুখপত্র ‘শিখা’য় যে বার্ষিক প্রতিবেদন লিখতেন, তাতে তাঁর সেই অভিব্যক্তির স্বাক্ষর চিহ্নিত। তাঁর লেখা তেমন একটি বার্ষিক বিবরণীর অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি-
‘আমরা চক্ষু বুজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না, বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না;Ñ আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিখা দ্বারা আসল সংস্কারকে ভষ্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকামুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।...আমরা জীবনকে ‘ভোজের বাজী’ মনে করিয়া ঐহিক উন্নতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিতে চাই নাÑ আমরা চাই জগতের সমস্ত জাতির সহিত সম্পর্ক রাখিয়া জ্ঞানবান, বলবান ও ঐশর্যবান হইয়া জীবনের পদ্ধতি মার্জিত করিতে এবং তাহাকে পূর্ণভাবে আস্বাদ ও ভোগ করিতে।...আমরা চাই সমাজের চিন্তাধারাকে কুটিল ও পঙ্কিল পথ হইতে ফিরাইয়া, প্রেম ও সৌন্দর্যের সহজ সত্য পথে চালিত করিয়া আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে। এককথায় আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া, প্রশান্ত জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা বস্তুজাতি ও ভাব জগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।’
মূলত বিশশতকের প্রথমার্থে শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে যে নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়, নবজাগরণের সেই চিন্তার ধ্বনি কাজী মোতাহার হোসেনের চিন্তাক্ষেত্রে আশ্রয় গ্রহণ করে। গোড়ামি আর প্রগতিবিমুখতার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর অন্য সহযাত্রীদের নিয়ে সেদিন যে ভূমিকা রেখেছিলেন, পরবর্তীকালে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে তার ব্যাপক ও সূদূরপ্রসারী প্রভাব সুস্পষ্ট। মনে রাখতে হবে, কাজী মোতাহার হোসেন শিখা পত্রিকায় বিবরণী লিখলেও তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে শেষত বিবরণীতে পরিণতি করেননি; সাহিত্যই থেকেছে। এবং বলা চলে, তিনি সাহিত্যকে সাহিত্যরস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের জন্য অ্যাডভোকেসি করেননি; কিন্তু বিজ্ঞান যে সাহিত্যরসে সঞ্জীবিত হয়ে প্রকাশিত হতে পারে এবং তা সমাজ ও জাতির মঙ্গল সাধনে শুভ-ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, তা বাঙালি পাঠককে অন্তত বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা ভাষায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর পর তিনিই সচেতন বিজ্ঞান-সাহিত্য লেখক। এবং এ ধারায় বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম মুসলমান সাহিত্য-কর্মী।
লেখক হওয়ার জন্য যে সাধনা দরকারÑ দরকার চিন্তার একগ্রতা, তা কাজী মোতাহার হোসেন বিশ্বাস করতেন। ব্যক্তিক পরিচয়কে সমাজ-সাহিত্য এমনকি রাষ্ট্রের কাঠামোয় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যেমন চাই বিধাতা-প্রদত্ত প্রতিভা, তেমনি প্রয়োজন একান্ত নিজস্ব জীবন ভাবনা এবং তার প্রকাশকৌশল। আর তিনি এও মানতেন, সাহিত্যসৃষ্টিতে সাহিত্যকর্মীর যেমন থাকে দায়িত্ব, তেমনি পাঠকেরও থাকতে হয় চিন্তা ও ভাষা গ্রহণ করার রুচি ও সামর্থ্য। মোতাহার হোসেন তাঁর, ‘লেখক হওয়ার পথে’ প্রবন্ধে লিখেছেন-
মনের কথা স্বপনেরই মতÑ অস্পষ্ট, অ-কায়া ; মনের ভিতর উঁকি মারে। খেলা করে, আর মিলিয়ে যায়। ঠিক মনের কথাটাÑ তার আবেগ, ব্যাকুলতা ও গভীরতা নিয়ে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। ভাব অসীম, আর ভাষা সসীম। ভাবের এত বিভিন্ন স্তর আছে, মনের এত অসংখ্য সড়ড়ফ বা সাময়িক অবস্থা আছে যে ভাষার ...একটা কথা কখনও মনের কথার ঠিক প্রতিবিম্ব হতে পারে না। তবে এরূপ প্রতিকূল অবস্থার ভিতর একটা সান্ত্বনার কথা এই যে, পাঠক ভাষাকে নিজের মনের রঙে রঞ্জিত করেই গ্রহণ করে। তাতে ভাষার দৈন্যর অনেকখানি পুষিয়ে যায়।
সাহিত্যসৃষ্টির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন বলে মনে করেন কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁর মতে, পরিবেশ থেকেই বিষয়বস্তু আহরণ করে সাহিত্য রচিত হয়। বিষয়বস্তুর চয়ন, বিশে¬ষণ, বিন্যাস ও বর্ণনা (বা সাহিত্যিক প্রকাশ), রচয়িতার নিজস্ব গুণ। এর উৎকর্ষ নির্ভর করে তাঁর মানসিক প্রস্তুতি, অন্তর্দৃষ্টি, সমবেদনা, শিক্ষা ও সাধনার ওপর। বিশেষ করে, শিক্ষা ও সাধনা লেখকের নিজস্ব গুণ হলেও বহুলাংশে শিক্ষা-ব্যবস্থা পাঠকের রুচি ও সমঝদারী, সমাজের আচার ব্যবহার, তাহজীব-তমুদ্দুন প্রভৃতি পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তিনি মনে করেন সমকালীন রাজনীতি, ধর্মচিন্তা এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিকাশ-ধারায় সাহিত্যশিল্পীর দায়িত্ব অনেক। সমাজের সামগ্রিক পাঠ, চিন্তার ব্যাপক প্রসার আর সংস্কারের গুরুভার সাহিত্য-শিল্পীর ওপর কম বর্তায় না। কাজেই প্রকৃতি, মানুষ এবং সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, সহযোগী শক্তি রূপে বিবেচনায় এনে নিজের দৃষ্টি ও চিন্তা শক্তির প্রসারণ ঘটানোই জরুরি বিষয়। বাংলা সাহিত্যের সংকট ও দৈন্য সম্বন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানতেন বাংলা সাহিত্যে বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা না হওয়ার সংকট যেমন প্রবল, তেমনি হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাও কম সংকটযুক্ত নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা হলেও উনিশ ও বিশ শতকে রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে ইংরেজি-ফারসি ও উর্দুর প্রতি সাহিত্যিকদের বিশেষ অংশের ঝোঁক ছিল। প্রসঙ্গত, মোতাহার হোসেন, ‘বাঙলা সাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন-
এই সময় বাঙালী মুসলমান কেবল অতীতের দিকেই মুখ ফিরাইয়া রহিল; কিন্তু হিন্দু সামাজিক সমস্যাবহুল জীবনের দিকেই দৃষ্টিপাত করিয়া সাহিত্য সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল। সতীদহ প্রথা, বহুবিবাহ-বিধবা বিবাহ প্রভৃতি বিশেষ করিয়া হিন্দুর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সহিত সংশি¬ষ্ট, ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার বাহন ও আদালতের ভাষা করিবার জন্য যে সমস্ত বাঙালি উদ্যোগী হইয়াছিলেন তাঁহাদেও মধ্যেও মুসলমান অনুপস্থিত দেখিতে পাই, এইরূপ হিন্দু পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বাঙলার জীবন সমস্যার সম্মুখীন হইয়া ক্রমশ জাগ্রত ও শক্তি-সম্পন্ন হইয়া উঠিতে লাগিল, আর আত্মবিস্মৃত মুসলমান তাদের বহু পশ্চাতে পড়িয়া রহিল। তখন পাশ্চাত্য শিক্ষার মোহে অনেকের জীবনে ও সাহিত্যে কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল সত্য, কিন্তু জনকয়েকের সাময়িক ক্ষতির তুলনায় সমগ্র সমাজের চাঞ্চল্যকর নব-অনুভূতি এবং নূতনতর জীবনাদর্শের প্রতি সবিস্ময় দৃষ্টিপাত অধিক মূল্যবান।
পূর্ব-বাংলার সাহিত্যচর্চা, তার গতি-প্রকৃতি, সম্ভাবনা নিয়েও কাজী মোতাহের হোসেন চিন্তিত ছিলেন। তিনি এ সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতেন; জানতেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় হিন্দু ও মুসলমানদের অংশীদারিত্ব এবং অবদানের কথা। অবগত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার প্রকৃতি ও ভাবসম্পদ সম্বন্ধে। তাই তিনি মনে করতেন পূর্ব-বাংলার সাহিত্যের একটা নিজস্ব ভঙ্গি ও অবস্থান থাকা দরকার। সে বিষয়ে তাঁর পরামর্শও অত্যন্ত স্পষ্ট-
সাহিত্যে কেউ উপেক্ষিত হবে না। সুপুষ্ট সাহিত্যে যেমন যুবক-যুবতীর প্রেমকাহিনী বা মনস্তত্ত্ব থাববে, তেমনি শিশুর রঙ্গীন স্বপ্ন, কর্মীর কর্মচাঞ্চল্য আর বৃদ্ধের অভিজ্ঞতাও স্থান পাবে। বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলা সাহিত্যকে মোটের উপর সমৃদ্ধই বলতে হবে। কিন্তু মুসলিম সাহিত্যিক এ পর্যন্ত সংখ্যায় অল্প থাকায় সবক্ষেত্রেই তাঁদের দানের পরিমাপ সামান্য। ক্রমে ক্রমে ত্র“টি সংশোধন করতে হবে। আশার কথা, চোখের সামনে প্রাণের স্পন্দন দেখা যাচ্ছে। দেশের নবীনরা এগিয়ে আসছেন। এরা সাহিত্যকে সমর্থ করে তুলবেন, সঙ্গে সঙ্গে নব-উত্থিত পাকিস্তান সর্ববিষয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। (পূর্ব-বাংলার সাহিত্য)
দেশভাগের অব্যবহিত পরে বাঙালি এবং বাংলাভাষার জন্য নতুন একটা সমস্যা দানা বেঁচে উঠলোÑ তা হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ। বাংলাকে রাষ্টভাষার মর্যাদা দেওয়া যাবে কি না? না-কি উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে রাজনৈতিক মহলে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কারণে সাহিত্য-অঙ্গনেও এ হাওয়া এসে লাগে। এবং বিদ্বৎসমাজ তখন নানান যুক্তি খাড়া করতে থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার পক্ষে, কাজী মোতাহের হোসেন সমাজসচেতন শিল্পী হিশেবে রাষ্টভাষা প্রসঙ্গে অত্যন্ত সূচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, তার নির্দিষ্ট ভূখন্ডের জন্য ওইটিই স্বাভাবিক ভাষা। মোগল আমল থেকেই ক্রমাগত বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে বলে তিনি উলে¬খ করেন। মোতাহার হোসেন মনে করেন, মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতাই বাঙালি মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ। শিক্ষার বাহন যে মাতৃভাষা হওয়া উচিত আর প্রজা সাধারণের ভাষাকেই যে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা দরকার এ বিষয়ে তাঁর ছিল সুস্পষ্ট অবস্থান। তবে পাকিস্তানে দুটি আলদা ভুখণ্ডে উর্দু এবং বাংলাকে আলদা আলদাভাবে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। এ বিষয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা ও বাংলাদেশের ভাষা-সমস্যা’ প্রবন্ধে তাঁর ভাষ্য-
সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা-ভাষী হিন্দু-মুসলমানই সংখ্যায় গরিষ্ঠ। তবু আমরা পশ্চিম-পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্র্রভাষা করার পক্ষপাতি নই। কারণ তাতে পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বাভাবিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি হবে। সুতরাং পশ্চিম-পাকিস্তানে উর্দু বা পোস্ত এবং পূর্ব-পাকিস্তানে বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ব্যবস্থা মোটেই অশোভন হবে না। রাশিয়া বা কানাডার মত আধুনিক ও উন্নত দেশে বহু রাষ্ট্রভাষার নজির আছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাহিত্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশ, বাংলাদেশে সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থা ইত্যাদি বহবিধ বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি জানেন, আত্ম-আশ্রিত সাহিত্যে লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকে প্রবল; তবে বহিরাশ্রিত সাহিত্যেও প্রতিবেশগত প্রভাবে লেখকের ব্যক্তিত্বের আলো বিকশিত হতে পারে। আর সাহিত্য যেহেতু জীবনের চিত্র ও আদর্শ, তাই, এতে চিত্তরসের পাশাপাশি মননশীলতার প্রকাশও অনিবার্য। ধর্ম-ইতিহাস-ঐতিহ্য সাহিত্যে বিষয় ও উপাদান হিশেবে কাজ করে। যেহেতু মানবমনের বিকাশে সাহিত্যের অবদান অপরিসীম, তাই রহস্যাবৃত ও অপুষ্ট মানবমনের খোরাক জোগাবে সাহিত্যÑ এমন ধারণা পোষণ করেন মোতাহার ।
‘শিক্ষা পদ্ধতি’ এবং ‘শিক্ষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং প্রসঙ্গত সাজেশন দিয়েছেন শিক্ষা-পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে কেমন হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীর পাঠব্যবস্থা ও অন্যান্য নিয়মিত কাজের রুটিন, শিক্ষকের দয়িত্ব, শিক্ষা প্রশাসকের দায়িত্ব, শিক্ষার মাধ্যম ও ভাষা এবং আন্তজার্তিক মানের শিক্ষা-প্রশাসন ইত্যাদি ভাবনা তাঁর রচনাকর্মে চিত্রিত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠব্যবস্থার মধ্যে দারুণ সমন্বয় ও ধারাবাহিকতা থাকা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি কোনো ভাষাকেই বেশি বা কম মর্যাদা প্রদান তার অভিপ্রেত নয়; বাস্তবতা ও প্রয়োজনের তাগিদ অনুযায়ী ভাষাশিক্ষা এবং শিক্ষার বাহন হিশেবে ভাষার অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করার পক্ষে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান। তিনি লিখেছেনÑ
‘আমরা বিদেশীদের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্র্ক রাখবো কিন্তু তাই বলে নিজের দেশে নিজেরাই বিদেশী বনে যেতে রাজী নই। যে শিক্ষায় আমাদের দেশের লোককে ঘৃণা করতে শেখায় বা তাদেরকে শোষণ করবার প্রবৃত্তি যোগায় সে দ্ষ্টু শিক্ষা থেকে আমাদের শত হস্ত দূরে থাকা দরকার। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রথম নিজের মাতৃভাষা, তারপর পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান ভাষা, তারপর সবশেষে বিদেশীদেও সঙ্গে সম্পর্ক-স্থাপনের ভাষা শিক্ষা করবার উপর জোড় দেওয়া হয়েছে। এ করতে পারলেই আমাদের আত্মমর্যাদা বাড়বে প্রকৃত জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হবে, আর বৈদেশিকদের সঙ্গেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমান আসনে বন্ধুত্ব স্থাপন করবার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।’ (শিক্ষা প্রসঙ্গে)
‘বাংলা ভাষা-সমস্যা’ প্রবন্ধে মোতাহার হোসেন বাংলা বানানে প্রচলিত সমস্যা এমনকি বাংলা ভাষার সমূহ সমস্যা বিষয়ক আপন চিন্তা এবং প্রচলিত চিন্তার বিশে¬ষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। ভাষা-সংস্কার, সহজীকরণ কিংবা বিকাশ সাধন করতে গেলে সর্বপ্রথম যে প্রয়োজন চিন্তার সংস্কার এবং ভাববার সামর্থ্য, তা মোতাহার বিশ্বাস করতেন। বাংলা শব্দভাণ্ডার, বর্ণমালা এবং উচ্চারণভঙ্গি বিবেচনা করা যেমন প্রাসঙ্গিকÑ সংস্কারচিন্তার স্বার্থে, তেমনি ভাষার লিখনরীতি বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার। ভাষার স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত এবং সামাজিক ক্রম-বিবর্তনের পক্ষে জোর করে আইন প্রণয়ন করে ভাষা পরিবর্তন-পরিমার্জন প্রক্রিয়াকে তিনি সমর্থন করেন না। তাঁর ভাষ্যÑ
‘ভাষার এইরূপ স্বাভাবিক বিবর্তনই ভাল, কারও নির্দেশে জোর করে অস্বাভাবিক উপায়ে ভাষা-সংস্কার বানান-সংস্কার বা লিখন-সংস্কার করতে গেলে সর্বক্ষেত্রেই অরাজকতার সৃষ্টি হয়ে তালগোল পাকিয়ে শিশু শিক্ষা ও বয়স্কদের শিক্ষা উভয়ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। ...ভাষা আপন গতিতে চলবে। কালের স্রোতে দেশী-বিদেশী লোকের সংশ্রবে এসে ভাষার শব্দসম্ভারের হ্রাস-বৃদ্ধি হবে। এমনকি বাক্যরীতি পাল্টে যাবেÑ এসব হয়েছেও আরও হবে।’
‘সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতভুবন তাঁর সঙ্গীতের বিচরণক্ষেত্র এবং প্রসঙ্গত এদেশে সঙ্গীত সম্বন্ধে সাধারণের ধারণা বিষয়ে নিজস্ব কিছু অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানতেন, সঙ্গীত বিষয়ে এদেশের ভদ্রসমাজে একধরনের নেতিবাচকতা ক্রিয়াশীল ছিল। সঙ্গীতচর্চাকে একরকম অপরাধ বা কখনো কখনো গর্হিত অপরাধ বলেও বিবেচনা করা হতো। আবার এদেশে এমন সময়-পরিসরও বিরল নয়, যখন সঙ্গীত ছিল গৃহস্থ পরিবারে আনন্দের বাহন। রবীন্দ্রনাথেও সঙ্গীত বাঙালির মনে কী রকম প্রভাব ফেলেছিল, তা অনুমান করা যায় প্রাবন্ধিকের এই উক্তিতেÑ ‘রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন নাই, এমন বাঙ্গালী যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে সেটা এক রকম আশ্বর্য ব্যাপার বলতে হবে।’
ইসলামি সাহিত্য, কিংবা সাহিত্যে ইসলাম বিষয়ে মোতাহারের মতামত অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি মনে করেন, ইসলামি সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা জরুরি; তবে তার চর্চা হতে হবে স্বচ্ছ এবং সুস্থধারায়। প্রসঙ্গত, তিনি ‘নজরুল-কাব্যে ইসলামি ভাবধারা’ প্রবন্ধে নজরুলের ইসলামচিন্তার পরিচয় উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। নজরুলের কবিতায় শব্দ চয়ন বিষয়-ভাবনা এবং উপস্থাপন-কৌশলে ইসলামিচেতনা প্রয়োগের বিষয়টি তিনি বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করেছেন। মুসলিমদের ইতিহাস, ইসলামের প্রকৃত বাণী, কোরআন ও হাদিসে নির্দেশিত ভুবনবিধান প্রভৃতি নজরুলের দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যে কীভাবে প্রকাশিত তারই একটা ধারণা-চিত্র নির্মাণ করেছেন প্রবন্ধকার কাজী মোতাহার হোসেন, আর প্রবন্ধের শেষদিকে ইসলামি-চিন্তা প্রকাশক ব্যক্তিবর্গের প্রতি পরামর্শমূলক অনুরোধও ব্যক্ত করেছেনÑ
‘ইসলামিক কালচারের মর্মকথা কি, আর কেমন করে তা কাব্য ও সাহিত্যে পরিবেশন করতে হয়, কবি নজরুলের রচনায় তার একটা উন্নত আদর্শ পাওয়া যায়। বর্তমানে ইসলামি সাহিত্যের বা ইসলামি কবিতার নাম দিয়ে কেউ কেউ এমন প্রপাগান্ডামূলক রচনা ছাপছেন, যা রসাশ্রিত না হওয়ায় সাহিত্য বা কাব্য নামে পরিচিত হতে পারে না। আশা করি, কৃতি সাহিত্যিক ও কবিগণ নজরুলের ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এই ধারাকে আরও বলিষ্ঠ ক’রে তুলতে চেষ্টা করবেন।’
সমাজ-ধর্ম-মানুষ, আর্ট ও ধর্ম প্রভৃতি সমকালীন বাস্তব প্রসঙ্গও কাজী মোতাহার হোসেনের প্রাবন্ধিকমানসকে বিলোড়িত করেছে। সমাজ কী, সমাজের প্রয়োজনীয়তা, মানুষের প্রতি সমাজ অনুকূল না প্রতিকূল, ধর্মের সঙ্গে সমাজ এবং মানুষের সম্পর্ক, ধর্ম এবং আর্টের মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কোনো দ্বন্দ্ব আছে কি-না, না-কি একে অপরের পরিপূরক, না-কি সহযাত্রীÑ এসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে তিনি ‘ধর্ম ও সমাজ’ এবং ‘আর্টের সহিত ধর্মের সম্বন্ধ’ শিরোনামে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর উপলব্ধি, এসব জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়ে চিন্তা এবং বক্তব্য তৈরির আগে দরকার শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক জ্ঞান-সাধনা। প্রাবন্ধিক লিখছেনÑ
‘শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে লোক ধর্ম ও সমাজের সূত্রগুলি স্পষ্টরূপে অনুভব করিতে পারিবে, লোকের উদারতা বৃদ্ধি পাইবে এবং ব্যক্তিত্বের সম্মানও ক্রমাম্বয়ে বৃদ্ধি পাইবে। ব্যক্তিত্বের এই পরিপুষ্টির মধ্যেই জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতির বীজ নিহিত আছে।’ (ধর্ম ও সমাজ)
বিজ্ঞান-বিষয়ক চিন্তাও প্রকাশ করেছেন, কাজী মোতাহার হোসেন, একাধিক প্রবন্ধে। ‘শব্দ ও তাহার ব্যবহার’ ‘আলোর দিশারীÑ বিজ্ঞান’ ‘অসীমের সন্ধানে’ প্রভৃতি তাঁর বিজ্ঞান-চিন্তাপ্রকাশক রচনা। ব্যবহারিক জীবনে শব্দের (সাউন্ড) প্রাসঙ্গিকতা, শব্দের শ্রেণীবিভাজন, শব্দের দ্যোতনা শব্দ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং পণ্ডিতদেও ধারণা ইত্যাকার নানান বিষয় প্রথম প্রবন্ধে, মানবজীবনে বিজ্ঞানের অবদান-প্রভাব দ্বিতীয় প্রবন্ধে আর এই রহস্যঘেরা মহাজগতের অসীমতা তৃতীয় প্রবন্ধে আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক। পাঠকের সামনে আমরা ‘অসীমের সন্ধানে’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ তুলে ধরছিÑ
‘অনন্ত জগতের চিন্তা করিতে গেলে বুদ্ধি কেন, কল্পনাও আড়ষ্ট হইয়া পড়ে। স্বপ্নরাজ্যও এই বিশাল ভয়াবহ মহান অনন্তকে ধারণা করিতে অক্ষম। এ বিষয়ে জাঁ পল রিশটার (Jean paul Richter)-এর লিখিত একটি চমৎকার স্বপ্নবৃত্তান্ত আছে। কোন ব্যক্তিকে আকাশের ঘেরাটোপের ভিতর লইয়া গিয়া অনন্ত স্থানÑ সমুদ্রের ভিতর দিয়া জগতের পর জগৎ দেখান হইল। অবশেষ সম্মুখবর্তী অসীমের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তাহার চিত্ত অবসন্ন হইয়া পড়িল।
কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধে বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় ও সৌকর্য যেমন উপস্থিত, তেমনি হাজির রয়েছে প্রবহমান চিন্তার নানান মাত্রা। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান, আর্ট, ধর্ম, ভাষা-ভাবনা- এসব বিষয় তাঁর প্রবন্ধের শরীর-কাঠামো নির্মাণ করেছে; মনের উদারতা আর চিন্তার প্রাগ্রসরতার ছাপও অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রবল সতর্কতার সঙ্গে তিনি বাস্তব বিষয়কে, সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়কে, প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গকে লেখার টেবিলে হাজির করেছেন এবং তার সমূহচারিত্র্য পরিবেশন করেছেন প্রাতিস্বিক সামর্থ্য ও রুচির অনুকূলে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১১