
ঢাকা: বহুল আলোচিত মেট্রো রেলের পথ সংশোধন প্রসঙ্গে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে বিমানবাহিনী সদর দপ্তর। বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নূর ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
বিমানবাহিনীর দীর্ঘ তিন পৃষ্ঠার ওই বক্তব্যে মূলত মেট্রো রেলের সংশোধিত পথের পক্ষেই যুক্তি দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, সংশোধিত পথে (ফার্মগেট-খামারবাড়ি-রোকেয়া সরণি) মেট্রো রেল বাস্তবায়ন হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরটি পরিচালনায় অসুবিধা হবে না।
বিমানবাহিনী সদরের ভাষায়, ‘বিজয় সরণি দিয়ে এমআরটি লাইন-সিক্স (MRT LINE-6) নির্মিত হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশন এবং উড্ডয়ন নিরাপত্তা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে যার ফলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের মতো একটি কৌশলগতভাবে পরিচালনা উপযোগী বিমানক্ষেত্রটির (Strategic Operational Airfield) ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাবে।’
আরও বলা হয়, তেজগাঁও বিমানবন্দরটি ডিসইউজড (Disused) বা পরিত্যক্ত নয়। তেজগাঁও বিমানবন্দর পুরোপুরিভাবে সচল (Operational) বিমানঘাঁটি। যেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে সব ধরনের হেলিকপ্টার, প্রশিক্ষণ বিমান, জেট বিমান এবং বৃহদাকার পরিবহন বিমান (০৪ ইঞ্জিন বিশিষ্ট C-130) পরিচালনা করে থাকে।
সেইসঙ্গে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে প্রতি বছর শুধু বিমানবাহিনীই ১০ হাজার ঘণ্টা উড্ডয়ন সম্পন্ন করে থাকে।
এছাড়া এ বিমানবন্দর থেকে নিয়মিত ভিভিআইপি ও ভিআইপি (VVIP ও VIP) ফ্লাইটসহ জরুরি ত্রাণসামগ্রী বহনের জন্য বিশেষ ফ্লাইটও পরিচালনা করা হয়ে থাকে।
বিমানবাহিনী সদর তাদের বক্তব্যে আরও জানায়, যেকোনও বিমানবন্দরের চারপাশে স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে স্থাপনার উচ্চতা বেসামরিক বিমান উড্ডয়ন বিধিমালা (Civil Aviation Regulation (CAR-84) এবং বাংলাদেশ গেজেট-৮৪ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
এ অনুযায়ী রানওয়ের Approach Funnel এর কাছাকাছি স্থানের স্থাপনার সর্বোচ্চ উচ্চতা রানওয়ে থেকে দূরত্বের সঙ্গে ১ঃ৫০ আনুপাতিক হিসাব অনুযায়ী নির্মাণ করা যেতে পারে।
বিজয় সরণি দিয়ে পরিকল্পিত MRT LINE-6 টি রানওয়ে থেকে ৭০১ ফুট দূরে অবস্থিত। সেই অবস্থানে ১৪ ফুট এর বেশি উচ্চতায় কোনও স্থাপনা তৈরি বিমান উড্ডয়ন নিরাপত্তার (Flight Safety) পরিপন্থি। কিন্তু বিজয় সরণির MRT LINE-6 এর উচ্চতা ৬২ ফুট হওয়ায় বিমান অবতরণকালে Landing Approach এর উচ্চতা বাড়াতে হবে।
এক্ষেত্রে বিমানকে রানওয়ের প্রথমভাগের একটি বড় অংশ বাদ দিয়ে অবতরণ করতে হবে। ফলে ব্যবহার্য রানওয়ের দৈর্ঘ্য আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাবে। যা বিমানবন্দরটিকে জঙ্গি বিমান এবং পরিবহন বিমানের অবতরণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। ফলে বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হবে।
বিমান সদর জানায়, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের সর্বোচ্চ অংশ (Dome) রানওয়ে Approach Line এর কিছুটা পূর্বে অবস্থিত। নভোথিয়েটারটি একটি Point Obstruction এবং এর দু’পাশে আর কোনও উঁচু স্থাপনা নেই। ফলে Approach এবং অবতরণের ক্ষেত্রে সামান্য Lateral Manoeuver এর মাধ্যমে বিমানের উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।
কিন্তু MRT LINE-6 এর পূর্বে প্রস্তাবিত বিজয় সরণির অংশটুকু বিমান Approach Path-এ আড়াআড়িভাবে একটি “Wall Obstruction” হওয়ায় Approach Path-এ এটি স্থাপন করলে কোনও Manouever এর জায়গা থাকে না।
ফলে রানওয়ের প্রাথমিক অংশে অবতরণ করতে হলে Approach Angle (সাধারণত ২.৫ ডিগ্রি – ৩ ডিগ্রি হয়ে থাকে) ৮ ডিগ্রির বেশি হবে, যা উড়োজাহাজের অবতরণের সময় যাবতীয় ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি করবে।
অতএব বিজয় সরণি দিয়ে MRT LINE-6 নির্মিত হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশন এবং উড্ডয়ন নিরাপত্তা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে যার ফলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের মতো একটি Strategic Operational Airfield এর ব্যবহার আশংকাজনক হারে হ্রাস পাবে।
বিমান সদর জানায়, বিমানবন্দরের আশে পাশে অবস্থিত উঁচু ভবন যেমন, ফ্যালকন টাওয়ার, নবনির্মিত ট্রাস্ট ব্যাংক এবং IDB ভবনসমূহ তেজগাঁও বিমানবন্দরের উড্ডয়ন এবং অবতরণের Approach Funnel এর মধ্যে অবস্থিত নয় বলে বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের ক্ষেত্রে কোনও প্রকার বাঁধার সৃষ্টি করে না ।
তারা আরও বলে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিভিন্ন জঙ্গি বিমান এবং বেসামরিক বিমানের উড্ডয়নের সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরটি হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিকল্প রানওয়ে হিসাবে জরুরি অবতরণের জন্য ব্যবহারোপযোগী।
এছাড়া তেজগাঁও বিমানবন্দর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সহযোগী হিসাবে দেশি-বিদেশি বিমানের পরিচালন সুবিধা দিয়ে থাকে।
বিমানবাহিনী বলে, প্রতিরক্ষা বিষয়ক Air Strategic দৃষ্টিকোণ থেকে, তেজগাঁও বিমানবন্দর আদর্শ অবস্থানে আছে।
এই বিমানবন্দরের Strategic Depth সর্বাপেক্ষা বেশি যুদ্ধকালে। যুদ্ধকালীন সমর শক্তির Survivability এবং দেশের মধ্যাঞ্চলের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এ বিমানবন্দর।
বিগত অনেক বছর ধরেই প্রচুর অর্থ ও শ্রম দিয়ে এয়ারফিল্ডটি বিভিন্নভাবে যুদ্ধপোযোগী করে তোলা হয়েছে।
ঢাকার এ দু‘টি বিমানবন্দর (তেজগাঁও এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) থেকে যুগপৎ (Simultaneous) বিমান পরিচালনার সামর্থ্য এবং টিকে থাকার (Survivability) শক্তি Synergistic effect এর কারণে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও একটি বিমানবন্দর অপরটির সার্বক্ষণিক Combat Air Operations পরিচালনায় Tactical Redundancy হিসাবে কাজ করে।
এ Strategic ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর হিসাবেই সচল রাখতে হবে।
অন্যথায় বিমানবাহিনী তার উপর অর্পিত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলের কার্যকরী প্রতিরক্ষা প্রদানের সামর্থ্য অনেকাংশেই হারাবে এবং তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি এবং আপদকালীন Catastrophic হতে পারে।
বিমান সদরের ভাষায়, তেজগাঁও বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম সচল রাখতে এবং জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে MRT LINE-6 টি বিজয় সরণি হয়ে নির্মাণ না করে ফার্মগেইট-খামার বাড়ী-রোকেয়া সরণি হয়ে নির্মাণ করার সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে জনস্বার্থ কোনওভাবেই বিঘ্বিত হবে না।
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে নাগরিক স্বার্থে MRT LINE-6 এর বাস্তবায়ন অতি জরুরি জানিয়ে আরও বলা হয়, Strategic Transportation Plan (STP) এর আওতায় MRT LINE-6 টি বিজয় সরণির পরিবর্তে খামার বাড়ী হয়ে নির্মিত হলে তেজগাঁও বিমানবন্দর এবং MRT LINE-6, এই দু’টি Strategic স্থাপনার ব্যবহারই কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক হবে এবং জাতীয় স্বার্থও রক্ষা হবে। তাই সরকারের সিদ্ধান্তই সঠিক বলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী মনে করে।
জাপান আন্তর্জাতিক সংস্থার (JICA) সহযোগিতায় ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (STP) আওতায় মাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট (MRT LINE-6) নির্মাণের পরিকল্পনা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী (বা বি বা) একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী, কার্যকরী এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসাবে বিবেচনা করে।
MRT LINE-6 এর রোকেয়া সরণি হয়ে খামার বাড়ীর যে রুটটি সরকার অনুমোদন দিয়েছেন সেটি সকল বিবেচনায় ও জনস্বার্থের জন্য একটি যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে বিমানবাহিনী মনে করে।
এ প্রস্তাবিত রুটটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে কোনও প্রকার বিমান পরিচালনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না বলেও জানান তারা।
তেজগাঁও বিমানবন্দরকে বাংলাদেশের একটি অতি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ Operational স্থাপনা (Infrastructure) উল্লেখ করে আরও বলা হয়, তাই এটি একটি স্ট্র্যাটেজিক এসেট হিসাবে বিবেচিত।
এছাড়া MRT LINE-6 বাস্তবায়নে বর্তমান যে রুটটি অনুমোদন পেয়েছে তা জনস্বার্থের সঙ্গে মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। বরং বিশদ বিবেচনায় এটি একটি যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে অনুমোদিত রুটটি বাস্তবায়িত হলে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বিমান উড্ডয়ন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে না এবং প্রস্তাবিত MRT-6 প্রকল্পটিও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১১