‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৪:৩৫, অক্টোবর ২২, ২০১৭
কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি: সংগৃহীত

কবি জীবনানন্দ দাশ। ছবি: সংগৃহীত

ব্যক্তি ও কবি, উভয় সত্তায় জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯-২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) অন্তর্মুখী চরিত্রের বিবরে আচ্ছন্ন ছিলেন। মৃত্যুর ৬৩ আর জন্মের ১১৮ বছর পরেও তিনি হেমন্তের স্পর্শাতীত রহস্যময়তায় দোলা দিয়ে যাচ্ছেন আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠকদের।   

কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরদিন (২৩ অক্টোবর, ১৯৫৪) কবি সুহৃদ সুবোধ রায় তৎকালের জনপ্রিয় কবি-লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে গিয়েছিলেন। থেকেছিলেন প্রায় দুঘণ্টা। আলোচনার বিষয় অবধারিতভাবে সদ্যপ্রয়াত জীবনানন্দ দাশের বিয়োগান্ত পরিণতি।

আলোচনাকালে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন: “অতি রহস্যময় কবি জীবনানন্দের জীবনকাহিনী। সুতরাং সঠিক, নির্ভুল চরিত্র বিশ্লেষণ আজ একান্ত দরকার। কবি জীবনানন্দকে চেনেন অনেকে। কিন্তু মানুষ জীবনানন্দের সঙ্গে পরিচয় খুব অল্প লোকের। কাজে-কাজেই এ সম্বন্ধে কিছু বলা বা লেখার দায়িত্ব তাঁদের, যাঁরাই কবির সঙ্গে মিশেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। শুধু তাঁর বহু অনুরাগীর কৌতুহল চরিতার্থের জন্যই এর প্রয়োজন। বিভূতি বাবু সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই লেখা হয় নি। আর আজ কে না জানে, এক সমান্তরালবর্তী রেখায় যে দুই ব্যক্তিকে পাশাপাশি রাখা যায়, সে বিভূতি বাবু এবং জীবনানন্দ দাশ। ভিড়ে নিরুদ্দিষ্ট বহুর মধ্যে একক, সংসারে থেকেও বিচ্ছিন্ন। আশ্চর্য সাদৃশ্য এই দুই চরিত্রের।”

সমকালের আরেক প্রসিদ্ধ কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশকে ‘নির্জনতম কবি’ এবং কোথাও ‘আমাদের নির্জনতম কবি’ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। জীবনানন্দের সমসময়ের অন্যতম প্রতিভা বুদ্ধদেব বসু এই নির্জন ও কোলাহলরহিত কবির প্রাথমিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনায় ব্রতী হন এবং কবি সম্পর্কে একটি নিঃসঙ্গ ভাবমূর্তি তৈরি করে সকলের মধ্যেই তা সঞ্চারিত করেন।

সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যায় সব্যসাচী লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় অগ্রণী জীবনানন্দ দাশকে অভিহিত করেছেন ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসাবে। পরে এই নাম ধার করে জীবনানন্দের কাব্যকীর্তি আলোচনামূলক গ্রন্থ রচিত হয় বাংলাদেশ থেকে।

জীবনের নির্জনতার রহস্য নিয়ে মৃত্যুও তার কবিতায় বার বার, নানা ভাবে এসেছে। তিনি বলেছেন:

“ঘুমায়ে পড়িতে হবে একদিন আকাশের নক্ষত্রের তলে
শ্রান্ত হয়ে-উত্তর মেরুর সাদা তুষারের সিন্ধুর মতোন!
এই রাত্রি-এই দিন-এই আলো-জীবনের এই আয়োজন
আকাশের নিচে এসে ভুলে যাব ইহাদের আমরা সকলে
একদিন শরীরের স্বাদ আমি জানিয়াছি, সাগরের জলে
দেহ ধুয়ে-ভালোবেসে ভিজইয়েছি আমাদের হৃদয় কেমন
একদিন জেগে থেকে দেখিয়েছি আমাদের জীবনের এই আলোড়ন
আঁধারের কানে আলো-রাত্রি দিনের কানে কানে কত কথা বলে
শুনিয়াছি-এই দেখা-জেগে থাকা একদিন তবু সাংগ হবে।”

অথচ জীবনানন্দ দাশের বাল্য ও কৈশোর একেবারেই সাদামাটা। তাঁকে বলা যায় গ্রাম ও শহরের মিলিত প্রবাহে বেড়ে ওঠা প্রকৃত মফঃস্বলবাসী। তবে তাদের পরিবারটি ছিল সনাতন হিন্দু সমাজের চেয়ে অগ্রসর ও আধুনিক-ব্রাহ্ম ভাবানুসারী। কোনও রকম উচ্ছৃঙ্খলার অবকাশ নেই, শিশু-কিশোরদের দুরন্তপনাও বরদাস্ত করা হয় না, সর্বদাই হিতোপদেশ ও উচ্চ আদর্শের কথা আর নীতিবাগীশ পরিমণ্ডল ঘিরে ছিল জীবনানন্দ দাশকে।

অন্যদিকে জীবনানন্দের মা কবি হলেও ছেলে কিন্তু শৈশব বা কৈশোরে কবিতা লেখার কোনও চেষ্টাই করেন নি। মন দিয়ে লেখাপড়া করে গেছেন; পরীক্ষায় পাস করাই ছিল জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য; সাফল্যের সীমানা। এহেন বাধাধরা, ছকবদ্ধ জীবনানন্দ কবি হলেন, প্রেম ও বিষণ্নতার কবি এবং শৃঙ্খলার উল্টোপিঠে গিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে আত্মহত্যাও (?) করলেন বলেও তার মৃত্যুতে অনেকেই অভিমত দিলেন।

এ কথা তো নিশ্চিত যে, জীবনের শেষ পাদে কি ঘটবে, অন্য কারোও মতো খোদ জীবনানন্দও টেরটি পর্যন্ত পান নি; লক্ষী ছেলের মতোন কঠোর তপস্যায় পড়াশোনা করে যাচ্ছেন তিনি। বরিশাল থেকে আইএ পাস করে কলকাতায় এসে বিএ পাস করলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। হলেন ইংরেজির স্মাতক। সে সময়, প্রথমবারের মতো একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল ব্রাহ্মদের কাগজে, অকিঞ্চিতকর লেখাটি কেউ গ্রাহ্যই করে নি। এবং এতে মায়ের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। কলকাতার সাহিত্যিক দলের কাছেও বিশেষ কোনও কল্কে পান নি তিনি।

১৯১৯ সালে কবি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ২য় শ্রেণীতে অনার্সসহ বিএ পাশ করেন। তখন তাঁর বয়স ২০। সে সময় ব্রাহ্মবাদী পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘বর্ষ আবাহন‘ [ওই যে পূর্ব্ব তোরণ-আগে...] প্রকাশিত হয়। আত্মপ্রকাশের আদিলগ্নে দেখা গেলো জীবনানন্দ দাশের ওপর অনেকের প্রভাব। ‘ঝরা পালক’-এর কবিতাবলিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব বেশ প্রকট। সত্যেন দত্ত ছন্দের যাদুতে ও দেশীয় শব্দ প্রয়োগে তৎকালে অনেককেই প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু একেবারেই সমবয়সী নজরুলের দ্বারা জীবনানন্দের প্রভাবান্বিত হওয়ার মতো দৃষ্টান্ত তুলনারহিত।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি তাঁর সমবয়সী জীবনানন্দকে চিনতেন, কিংবা তাঁর কবিতা পড়েছেন? মনে হয় না, তেমন কোনও প্রমাণ নেই। কল্লোল গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন লেখক, যেমন, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগের কথা জানা যায়। কিন্তু জীবনানন্দ কল্লোল-প্রগতি পত্রিকায় লেখা শুরু করলেও তিনি ঠিক ওই গোষ্ঠীভুক্ত হন নি। নজরুলের কবিতায় অবশ্য ‘জীবনানন্দ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে: ‘আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।’ তবে, এটা নিছক শব্দ মাত্র; কোনও ব্যক্তি-বিশেষ নন। কেননা, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সময় জীবনানন্দ দাশ নামের কোনও কবির অস্তিত্বই পত্র-পত্রিকায় ছিল না। তখনও তিনি গুপ্ত।

নজরুল-জীবনানন্দের দেখা হোক বা না হোক, এবং নজরুল জীবনানন্দের কবিতা পাঠ না-ই করুন, জীবনানন্দ অবশ্যই নজরুলের লেখা পড়েছেন। কারণ তখন নজরুলের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা গগনস্পর্শী। ফলে প্রভাবিত হওয়ার প্রসঙ্গও যৌক্তিক। অথচ একই বছরে (১৮৯৯), একই দেশে, একই ভাষার পরিমণ্ডলে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দুই জনের জন্ম।

একজন স্বাভাবিক-সাধারণ মানুষের মতোই জীবননান্দ শান্ত-শিষ্টভাবে পাঠ্যক্রম শেষ করে কলকাতার কলেজে চাকরি নিলেন এবং নিজের গ্রামের বাড়ি বরিশালের লোকজন ও জন্মস্থানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। পারিবারিক ও সামাজিক নিয়মনিষ্ঠায় তাঁর কোনোই কমতি ছিল বলা যাবে না। তখন পর্যন্ত যে কয়টি কবিতা তাঁর ছাপা হয়েছে, তা অকিঞ্চিতকর। ব্যক্তি হিসাবেও তাঁকে সুপুরুষ বলা যায় না। ব্যক্তিত্বও আকর্ষণীয় নয়। নারী সান্নিধ্য পেয়েছেন বলে জানা যায় না। তবে হালে ড. আকবর আলী খান ‘বনলতা সেন’-এর যে বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, তা অবশ্য অন্য তথ্য জ্ঞাপন করে। প্রকাশ্য জীবন ও জীবনীতে একেবারেই সাদামাটা জীবন বলতে যা বোঝায়, জীবনানন্দের ঠিক সে রকমের একটি জীবন লক্ষ্য করা যায়। বাধ্য ছেলের মতোন বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়েও করলেন একত্রিশ বছর বয়সে।

মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের জীবনে যেমন অনেক কিছু দ্রুত, নাটকীয় এবং চমকপ্রদ, জীবনানন্দের তেমনই সব কিছু ঢিমে তেতালায় এবং বর্ণহীন। সম্মান, সাফল্য, সম্বর্ধনা বা স্বীকৃতি জীবনানন্দ দাশের জীবনকালে বিরল ঘটনা। তিনি দারিদ্র সহ্য করেছেন আজীবন, খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠাও জোটে নি বিন্দুমাত্র। আনুকূল্য বলতে যা চিহ্নিত হয়, সেটার দেখাও পান নি।

তবু কী আশ্চর্য! বরিশালের এই অধ্যাপক লিখে যাচ্ছেন পাগলের মতোন; এমন কি ছাপা হবে কি হবে না, সে চিন্তাটুকুও তাঁর নেই। ভরিয়ে ফেলছেন খাতার পর খাতা: কবিতা, গল্প, উপন্যাসে। সব কিছুই নীরবে, নিভৃতে। মগ্ন প্রার্থনার মতো। তিনি যে অত লিখছেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠজনরাও টের পান নি। যেন সংগোপনে তৈরি হচ্ছেন  বিরাট কোনো স্বপ্ন সফলের জন্য; সফল হলেনও। আধুনিক বাংলা কবিতাকে তিনি নিয়ে গেলেন অদেখা এক স্বপ্নজগতে: হেমন্তের বিষণ্নতায়। সমসময়ের ‘নির্জনতম কবি’ হিসাবে নিজেকে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা করলেন।

মৃত্যুতেও তিনি ছিলেন একজন অচেনা পথিক; ‘শুদ্ধতম কবি’। যে চুনিলাল ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ট্রামের নিচে চাপা পড়ে থাকা জীবনানন্দকে উদ্ধার করেছিলেন; তিনি কবির জীবনীকার ক্লিন্টন বি সিলিকে জানান, হইচই শুনতে পেয়ে ঘটনা ঘটার মুহূর্তের মধ্যে সেখানে পৌঁছানোর পর দেখতে পান, কেউ একজন ট্রামের নিচে পড়ে আটকে আছেন। চুনিলাল-গাট্টাগোট্টা মানুষটি-ঝুঁকে পড়ে ট্রামের একপাশে দুই হাত লাগিয়ে পরিস্থিতির প্রয়োজনে অতিমানবীয় শক্তি প্রয়োগ করে ট্রামের একটা পাশ আলগা করে তুলে ধরেন, যাতে জীবনানন্দের শরীরটাকে টেনে বের করা যায়। চুনিলাল কবিকে সঠিকভাবে চিনতেন না। আসলে যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁদের সংখ্যাও অত্যল্প। কারণ, তিনি ছিলেন এমনই একজন, যিনি লোক-প্রাবল্য এড়িয়ে প্রধানত থাকতেন কবিতার  ঘোরের মধ্যেই।

জীবনানন্দকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছিলেন যে শুভাকাক্ষী বুদ্ধদেব বসু, তাঁর উপযুক্ত সমাধিফলকই লিখে গিয়েছিলেন, যখন তিনি তাঁকে ‘আমাদের নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। হতে পারে সেই নির্জনতার কারণেই আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের এই মহৎ ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা হয়েছে খুবই সামান্য। তাঁর জীবনীকারের মধ্যে গোপালচন্দ্র রায়, প্রভাতকুমার দাস, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং ক্লিন্টন বি সিলি ছাড়া আর বিশেষ কারো নামোল্লেখ করা যায় না। তবে তাঁকে নিয়ে রচিত প্রবন্ধের সংখ্যা ঈর্ষণীয় রকমের বেশি। যদিও অধিকাংশই হয়েছে কবির মরণোত্তর কালে। নিজের নির্জনতাকে জীবনানন্দ নিজেও কী টের পেয়েছিলেন? এজন্যই কী আগেভাগেই বলে গিয়েছিলেন পরিসমাপ্তির বর্ণময় ব্যাখ্যা:
    “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
    সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
    পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
    তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল”
প্রবল বিচ্ছিন্নতা, এই নির্জনতা, এই একাকিত্ব, এই বিষণ্নতা, এমন কি অসহায় মৃত্যুর পূর্বাভাষ ছায়াপাত করেছিল তাঁর কবিতায়। ট্রামে-মৃত্যুর প্রায় ১৬ বছর আগে (১৯৩৮ সালে) ট্রামলাইনের কথা লিখেছিলেন তিনি কবিতায়:
    “অনেক রাত হয়েছে-অনেক গভীর রাত হয়েছে;
    কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে-ফুটপাত থেকে ফুটপাতে-
    কয়েকটি আদিম সর্পিল সহোদরার মতো
    এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
    পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ
    অনুভব ক‘রে হাঁটছি আমি।
    গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে-কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস
    কোন্ দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার,-
    তারা কোথায়?
    তারা কি হারিয়ে গেছে?
    পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন,-মাথার ওপরে
    অসংখ্য জটিল তারের জাল
    শাসন করছে আমাকে।”

কবির অন্তর্গত চৈতন্যের দূরদৃষ্টিতে জীবননান্দ কী তাঁর নিয়তির শাসনকে পাঠ করতে পেরেছিলেন পূর্বাহ্নেই? বেছে নিয়েছিলেন নিয়তি-নির্ধারিত পথ? তাঁর কী আত্মহত্যা না ইচ্ছামৃত্যু ছিল? কোনও গবেষকই সে ব্যাখ্যায় যান নি। আমরা শুধু দেখতে পাই, দিনান্তে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলেছে অন্তর্গত হাহাকার আর অস্থিরতায় কম্পিত একটি চিল। তাঁর একাকিত্ব ও হতাশা এবং প্রকৃতির মধ্যে অণুর মতো তাঁর নিমগ্নতা তাঁকে তাঁর নামের প্রকৃত অর্থে বিপরীতে ঠাঁই দিয়েছে। বাংলা ভাষায় জীবনানন্দ শব্দটি উচ্চারিত হলে, শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘জীবনের আনন্দ’-এর স্থানে ভিড় করে ‘ঝরা পালক’-এর বিষণ্ন সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রবহমান কুয়াশাঘেরা-রহস্যময় এক বেদনার-জগত।             

জীবনানন্দ-জীবনীকার ক্লিন্টন বি সিলি জানাচ্ছেন, (কলকাতার) রাসবিহারী চৌরাস্তা মোড় থেকে অল্প দূরত্বে ল্যান্সডাউন রোডের (পরে এই রাস্তার নাম হয়েছে শরৎ বোস রোড) এক ভাড়াবাড়িতে থাকতেন জীবনানন্দ আর তাঁর পরিবার। সেখান থেকে পাঁচ ব্লক দক্ষিণে রবীন্দ্র সরোবর, তার বিস্তৃত পার্কে জীবনানন্দ প্রায়ই হাঁটতে যেতেন একাকী। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় এ রকম সান্ধ্য ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তখনই রাসবিহারী এভিনিউ পার হওয়ার সময় একটা চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এখানে ‘চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন’ কথাগুলোর দিকে আমরা বিশেষ মনোযোগ দেবো। মনে রাখা দরকার, ক্লিন্টন হলেন জীবনানন্দের সবচেয়ে প্রামাণ্য, বিশ্বস্ত ও সর্বসাম্প্রতিক জীবনীকার। তিনি ষাটের দশকে দুই বছর বরিশালে ছিলেন। কিন্তু তখনো জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে নি, পরিচয় ঘটে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পর। কবি সম্পর্কে তাঁর গভীর গবেষণালব্ধ তথ্য ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট। ২০১১ সালে ফারুক মঈনউদ্দীন গ্রন্থটি অনুবাদ করেন অনন্য জীবনানন্দ নামে। কবির মৃত্যু প্রসঙ্গে গ্রন্থের ভূমিকায় ক্লিন্টন  যে মন্তব্য করেছেন (‘চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন’), তাতে কবির একটি সচেতন ভূমিকা রয়েছে। যেন তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রামের সামনে চলে এসেছিলেন। গ্রন্থের শেষ দিকে ক্লিন্টন অবশ্য অন্য কথা বলছেন, ‘জীবনানন্দ রাস্তা পার হওয়া শুরু করলে পশ্চিম দিক থেকে একটা ট্রাম এসে পড়ে এবং কোনো কারণে অন্যমনস্ক থাকায় তিনি সামনে পড়ে যান।’

এখানেও আমরা  ‘কোনো কারণে অন্যমনস্ক থাকায়’ শব্দগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে পারি। লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে,  কোনো কারণে অন্যমনস্ক থাকায়’ আর ‘চলন্ত ট্রামের সামনে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন’ একই অর্থ ও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে না। ক্লিন্টন জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু সম্পর্কে পরিষ্কার কোনও তথ্য জ্ঞাপন করতে পারেন নি; দুটি স্ববিরোধী অনুমান করেছেন মাত্র এবং অনুমান দুটিও তিনি গ্রন্থের পৃথক দুটি স্থানে করেছেন পরস্পর-বিরোধীভাবে। কবিতার মতোই মৃত্যুতেও এই কবি রহস্যাবৃত। পশ্চিমী গবেষক সেটা ভেদ করতে পারেন নি।  

ঘটনার বিবরণ মতে, আহত জীবনানন্দ দাশকে ট্যাক্সিতে করে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে কয়েকটা ভাঙা পাঁজর, চিড় ধরা কণ্ঠাস্থি ও চূর্ণবিচূর্ণ পায়ের চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতালে থাকার সময় তখনকার ডাক্তারির ছাত্র ডা. ভূমেন্দ্র গুহ ও তাঁর কয়েকজন সহপাঠী ছাত্র সার্বক্ষণিকভাবে জীবনানন্দের পাশে ছিলেন। সত্যপ্রসন্ন দত্ত কবির একদার প্রচণ্ড বিরুদ্ধবাদী সম্পাদক সজনীকান্ত দাসকে টেলিফোন করলে তিনি সত্যিকার গভীর উদ্বেগ দেখিয়ে এমন ব্যবস্থা করেন, যাতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ব্যক্তিগতভাবে জীবনানন্দের ব্যাপারটা দেখেন। ডা. রায় পরদিন হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁর জীবন রক্ষার সব রকম চেষ্টাই করা হয়েছিল। কিন্তু আহত ও চিকিৎসাধীন জীবনানন্দ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং দুর্ঘটনার আট দিন পর ২২ অক্টোবর মারা যান।

পরদিন ২৩ অক্টোবর দক্ষিণ কলকাতার প্রাচীন কালীঘাট মন্দিরের পাশে কেওড়াতলা শ্মশানে কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নরেশ গুহ (কবিতা, পৌষ ১৩৬১), সঞ্জয় ভট্টাচার্য (কবি জীবনানন্দ দাশ), এবং গোপালচন্দ্র রায়ের (জীবনানন্দ) বরাতে ক্লিন্টন কবির জীবনাবসানের অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেও আট দিনের চিকিৎসাকালীন সময়ে এই ‘দুর্ঘটনা’ সম্পর্কে খোদ জীবনানন্দের কোনও বক্তব্য হাজির করতে পারেন নি। মৃত্যুশয্যায় কারা কারা কবির সঙ্গে দেখা করেন এবং কি কি বিষয়ে অন্তিম আলোচনা হয়, সে সম্পর্কেও কোনও গবেষক বিন্দুমাত্র আলোকপাত করতে পারেন নি। এতে প্রমাণিত হয়, কবি একজন অজ্ঞাত ও সাধারণ লোকের মত হাসপাতালের বেডে মারা যাচ্ছিলেন। এমন কি, যে কোনও দুর্ঘটনার সঙ্গে পুলিশী মামলা ও বিস্তারিত বিবরণের যে রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে; জীবনানন্দের ক্ষেত্রে সেটাও প্রতিপালিত হয় নি।

জন্মের মাত্র ৫৫ বছর ৮ মাসের মাথায় জীবনানন্দের নীরব তিরোধান কালে কেউই স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি যে, এই ‘নিভৃত’ ও ‘বিষণ্ন’ কবি অচীরেই মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পাশে নিজের একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নেবেন এবং তিনি সমসময়ের অন্যদের চেয়ে আলাদা ও বৈশিষ্টপূর্ণভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন। এমন কি, তাঁর কাব্যরুচিকে ঘিরে তৈরি হওয়া  অনাগতকালের অগণিত কবি ও পাঠক জীবনানন্দ দাশ ও আধুনিক বাংলা কবিতার মধ্যে একটি সমান্তরাল পথরেখা খুঁজে পাবেন। কোথাও না হলেও অন্তত তার কবিতার আখরে তিনি রয়ে যাবেন:

আমার মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি তাহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে ম্বপ্ন ছিল-সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন মায়াবী প্রয়োজন লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? ...রৌদ্র নিভে গেলে পাখিপাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
                    [মৃত্যুর আগে, ধূসর পাণ্ডুলিপি]


ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৭
এমপি/জেডএম


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান