শেয়ারের মুরগি সালমান এফ রহমানের কাছে বর্গা!

নজরুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৪:১৮, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১১

ঢাকা: পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে সালমান এফ রহমানের জড়িত থাকার অভিযোগ সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজার সম্পর্কে তার কার্যক্রমে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে। পুঁজিবাজার বিষয়ে বর্তমানে সালমান এফ রহমানের নানা পদক্ষেপ নেওয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন না বাজার বিশেষজ্ঞরাও।

এর আগে ২০১০ সালে বাজার ধসের সময় ও তার পরে সালমান এফ রহমান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি হিসেবে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নেন। যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। আর গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ায় সেই ক্ষোভ প্রকাশ করারও কোনো জায়গা থাকলো না। পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার দিনই  ডিএসইর কার্যালয়ে এসে পর্ষদ সভায় অংশ নেন সালমান এফ রহমান।    

এদিকে গত মঙ্গলবার গুলশান ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে নতুন এক ফর্মুলা দিয়েছেন বেক্সিমকোর এই কর্তা ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছে-পরিশোধিত মূলধন বেশি এমন অন্তত ২০টি কোম্পানির পরিচালকরা তাদের শেয়ারের নির্দিষ্ট একটি দাম ঠিক করবেন। পরে ওই দামে শেয়ার কিনবেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা। দর নির্ধারণ করার কারণে ওইসব শেয়ারের দাম এর নিচে নামবে না। এর আগে দরপতন রোধে বাজার থেকে ৫ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন তিনি।

গত বছরের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি সালমান এফ রহমান সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় সরকারকে। ওইসময় শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিল, নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এই ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে অভিযোগ উত্থাপিত সালমান এফ রহমানকে বিএপিএলসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েই তার বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালিত হবে। কিন্তু কারসাজিকারীকে নীতিনির্ধারণে রেখে তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের হতাশ করে। এরপর সেই তদন্ত কমিটি কোনও শাস্তির সুপারিশ না করে সরকারকে সতর্ক থাকার যে পরামর্শ দিয়েছিল, বাস্তবে সেটুকুও পালন করা হলো না। কারণ, এখনও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদটিসহ বাংলাদেশ লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন সালমান। সম্প্রতি ডিএসইর পর্ষদে যোগ দেওয়ায় তার অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। অথচ এসব পদে থেকে এখন তার পক্ষে পুঁজিবাজারে প্রভাব বিস্তার করা আরও সহজ হয়েছে। কিন্তু সালমান এফ রহমান এখন এতই ক্ষমতাধর এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন যে সরকার এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রতীকী কোনও শাস্তির উদাহরণটুকু পর্যন্ত তৈরি করতে পারেননি।

শুধু এটাই নয়, এখনো তিনি রয়ে গেছেন নীতি নির্ধারণী পর্যায়েই। কারণ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং সদস্য নির্বাচনে তার মতামতকেই আজ অবধি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি চাকলাদার মনসুরুল আলমকে চেয়ারম্যান করার সুপারিশ করেছিলেন, যা প্রায় গৃহীত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু পরে বঙ্গবন্ধুর খুনির সাথে চাকলাদারের সংশ্লিষ্টতা এবং হাওয়া ভবনের সঙ্গে তার দহরম-মহরমের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তার নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। অথচ এর আগে পর্যন্ত সালমান এফ রহমানের এই সুপারিশ গ্রহণ চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল।

এই চাকলাদারের সাথে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিভাবে তিনি মর্টগেজ ছাড়াই তাকে ঋণ দিয়েছিলেন। এসইসির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেলে সালমান এফ রহমানের নানা অবৈধ স্বার্থই যে তিনি সংরক্ষণ করতেন, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সম্প্রতি ডিএসইর পর্ষদে যোগ দেওয়ার মাধ্যমেই বোঝা যায়, সালমান এফ রহমানের আসলে কতটা ক্ষমতাধর ব্যক্তি!

অথচ ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে বাজারের উত্থান-পতন এবং বিভিন্ন ধরনের কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলেও তদন্ত রিপোর্টে তাকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং. সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে এবং এর সাথে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে কমিটি।

এতোসব অনিয়মের সাথে সালমান এফ রহমানসহ আরও বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্ত কমিটি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোনও সুপারিশ করেনি। বরং সালমানসহ অন্যদের অপরাধ এসইসির কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হিসেবে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও ডিএসই`র সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমানের ব্যাপারে সরকারকে কেবল সতর্ক থাকার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এটি না করলে পুঁজিবাজারে আবারও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে তদন্তকমিটি।

যদিও শেয়ারবাজারে ব্যাপক কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-র সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক কফিল উদ্দিন চৌধুরীর  বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি দুর্নীতির মামলা করারও সুপারিশ জানানো হয়েছে। অথচ বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমানের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সতর্ক থাকাই যথেষ্ট বলে মনে করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্তকমিটির মতে, পুঁজিবাজারে প্রভাব রাখতে সক্ষম এ দুইব্যক্তি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে এসইসি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এর ফলে আবারও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে শেয়ারবাজারে। জানা গেছে, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত তদন্তকালে কমিটি এ দু`জনের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক মতামত পেয়েছিলেন। এসইসিকে প্রভাবিত করতে দু`জনই সক্রিয় ছিলেন বলে তারা ধারণা পেয়েছেন। কমিটির মতে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি পরিচালনায় এ দুজনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ছিল। এ কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে বলেও মনে করেছে কমিটি। এত কিছু প্রমাণ পাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থার সুপারিশ করার পরিবর্তে সরকারকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এটাই প্রমাণ করা হয়েছে যে, কতোটা  ক্ষমতাশালী এই ব্যবসায়ী।

সালমান এফ রহমানের পূর্বাপর

২০১০ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের অন্যতম এক খলনায়ক হিসেবে তদন্তরিপোর্টে প্রমাণিত হওয়ার পর সালমান এফ রহমান দেশব্যাপী একটি নিন্দনীয় নামও বটে। তবে একসময় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপটি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিল। বেক্সিমকো ফার্মা এদেশের ওষুধ শিল্পে অন্যতম একটি স্থান দখল করেছিল। সেই সময় তাকে অনেকটা পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু যতই দিন গেছে একের পর এক তিনি জড়িয়ে পড়েছেন বিতর্কিত সব ঘটনায়। আরও সম্পদ বাড়িয়ে তোলার নেশায় পা বাড়িয়েছেন ঋণ খেলাপ, জমি জালিয়াতি এবং শেয়ার কেলেঙ্কারি ও প্রতারণার মত অনৈতিক পথে। আর এসবের মাধ্যমে মানুষের অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এসব কারণে অনেককে এমনও বলতে শোনা যায়, একজন মানুষের আর কতটা সম্পদ অর্জিত হলে তিনি অবৈধ পথে এরকম অর্থ উপার্জন বন্ধ করবেন?

বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানি বা বেক্সিমকো তাদের যাত্রা শুরু করেছিলো ১৯৭২ সালে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেক্সিমকো উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করে। আশির দশকে ওষুধ শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ হবার পরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে বিনিয়োগ করে। এরপর আসে টেক্সটাইলসের খাতে বিনিয়োগ। এখন বেক্সিমকো বিমান পরিবহন খাতকেও তাদের কোর বিজনেস-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু ৯০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি সালমান এফ রহমান ঢুকে পড়েন রাজনীতিতে। প্রথমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন। পরে যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। রাজনীতিতে যোগ দেবার ফলে প্রথমদিকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষত ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বেক্সিমকোকে বেশ খারাপ সময় পার করতে হয়। আর ২০০৭-২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে প্রায় দুইবছর জেলে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এর পরপরই তিনি এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় বসার পর কেবলই তরতর করে এগিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। এর ফলে ২০০১ থেকে দীর্ঘদিন যে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে চলছিলেন তা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেন।

১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নামও এই সালমান এফ রহমান। সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য তো বটেই ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার আগের দফায় ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যেই যে বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়, তার সাথেও ছিল সালমান এফ রহমানের সরাসরি যোগাযোগ। তখনও কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। ওই ঘটনায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান ও ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিলো। কিন্তু এই ঘটনার অন্যতম অংশীদার বেক্সিমকো ও শাইনপুকুরের বিরুদ্ধে মামলার কোনো অভিযোগই গঠন করা সম্ভব হয়নি। মামলা করার পরের দিনই প্রতিষ্ঠান দুইটির ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। উচ্চ আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা যাবে না বলে জানানো হয়। পরে আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে এসইসি। কিন্তু তারপরও আজ পর্যন্তওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

সালমান এফ রহমান এখন বাংলাদেশ লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও ডিএসইর পরিচালক হওয়ায় ক্ষমতাবলে এসইসি`র পরামর্শক কমিটিরও সদস্য। একই ক্ষমতাবলে তার পরামর্শ এবং ইশারায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় এসইসিকে। ফলে আগে যেমন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এখনও তা হচ্ছে না। অথচ ওই সময়ের তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে।

কিছু সুপারিশসহ প্রতারণা ও কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও দর পতনের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়। কিন্তু তা এই ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেয়ার জন্য যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

এবারের শেয়ার কেলেঙ্কারি ২০০১ সালে বিএনপি সরকার আসার আগ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গ্রুপ ছিল বেক্সিমকো। কিন্তু এই সময় থেকেই মূলত বেশ আর্থিক কষ্টে পড়ে যান তিনি। বিএনপি শাসনামলসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন আকার ধারণ করে যে তিনি তার কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিলেন না। বেক্সিমকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকার যোগান দিয়ে কোম্পানিকে কোনভাবে টিকিয়ে রাখে।

কিন্তু এরপর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাতারাতি তার সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে বেক্সিমকোর বিভিন্ন কোম্পানির নামে নেয়া হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে বেক্সিমকো ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সাত বছর ধরে জমতে থাকা ঋণের বোঝার প্রায় অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ২০০৯-এর মাঝামাঝি থেকে তারা দেশে একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিতে শুরু করে। এভাবে ঋণের ভারে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠান রাতারাতি তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে। জিএমজি এয়ারলাইন্স, ওয়েস্টিন হোটেল, সিঙ্গারের মত একটা বিশাল কোম্পানি, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ও একটি অনলাইন নিউজ এজেন্সিও কিনে ফেলে।

হঠাৎ করে এই ব্যবসায়ীর হাতে বিপুল যে ক্যাশ জমা হতে দেখা গেছে- এর পেছনে আছে লাখ লাখ তরুণ-যুবক, গৃহবধূ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সর্বনাশের ইঙ্গিত। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার মাধ্যমে সালমান এফ রহমান তার কয়েক বছরের আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন।

বর্তমান সরকারের বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত থাকায় পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনে আরো বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ভেঙে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ-এর সহযোগী চার প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণের শেয়ার বিক্রি করেছেন। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অনুমোদন সাপেক্ষে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ৩০ দিনের আগাম ঘোষণার বিধান রয়েছে। কিন্তু বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো টেক্সটাইল (বেক্সটেক্স), বেক্সিমকো ফার্মা, বেক্সিমকো সিনথেটিকের পরিচালকরা গত ২ বছরের মধ্যে প্রায় ১৬৫০ কোটি টাকার স্পন্সর শেয়ার বিক্রি করলেও স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির কোনও ঘোষণা দেয়নি। এটি সিকিউরিটিজ আইনে অপরাধ হলেও এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অপরদিকে স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো কোনো আগাম ঘোষণা না দিলেও শেয়ারের দরবৃদ্ধিতে উল্লেখিত সময়ে বিভিন্ন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ২০০৯ সালে জুলাই মাসে বেক্সিমকো লিমিটেড কর্তৃক জিএমজি এয়ারলাইন্সের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয়, আগস্টে বাংলাদেশ অনলাইন অধিগ্রহণের ঘোষণা দেয় বেক্সিমকো। এছাড়া ২০১০ সালের জুন মাসে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে ১৬০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা ও জুলাই মাসে ঢাকা-সাংহাই সিরামিক অধিগ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া গত বছরের আগস্ট মাসে বেক্সিমকো টেক্সটাইল কর্তৃক নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেডের ৩৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনার ঘোষণা। এসব ঘোষণার মাধ্যমে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়ানোর সুযোগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালকরা ঘোষণা ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১১

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন


সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান