বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে কিশোর-তরুণের উগ্রতা ও অপরাধপ্রবণতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৮:৪৪, মে ২৩, ২০১৭

মাগরিবের আজানের পূর্বক্ষণ। কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া আবাসিক এলাকায় ৫০/৬০ জন কিশোর-তরুণ বয়েসী ছেলে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মার মার করে ছুটে এলো। বাসা-বাড়ি, দোকানে রাম দা, হকি স্টিক, লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগল। পথে দাঁড়ানো কয়েকজনকে কুপিয়ে জখম করলো। নারী, বৃদ্ধ, শিশুরা ভয়ে-আতঙ্কে আর্তনাদ করতে লাগলেন। পুরো এলাকাকে বিপর্যস্ত ও বাসিন্দাদের দিশেহারা করে প্রায় চল্লিশ মিনিট অবাধে তাণ্ডব চালিয়ে দলটি চলে গেল।

মাস কয়েক আগের এই ত্রাসের ঘটনায় পুরো শহর হতচকিত হয়ে ওঠে। আকস্মিক সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্ত হয় নাগরিক শান্তি। নাগরিক সমাজ ও প্রশাসন হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে পড়ে। জানা গেল, নগুয়ার কোনো একটি ছেলে অন্য পাড়ার আরেকটি কিশোর-তরুণ বয়েসী ছেলেকে ‘অপমান’ করেছিল। প্রতিশোধ নিতে চালানো হয় এই হামলা!

কবে কে কাকে সত্যি সত্যি মেরেছিল, সেটা স্পষ্ট জানা যায় নি। তারপরেও তথাকথিত বন্ধুদের সঙ্গে এসে নিরাপরাধ নারী-পুরুষদের মারপিট করে ‘বীরত্ব’ দেখালো একদল কিশোর ও তরুণ। এরা কেউ রাস্তার মাস্তান বা চিহ্নিত অপরাধী নয়। শহরের স্কুলের ছাত্র। পরিচয়ের দিক থেকেও বেওয়ারিশ বা বস্তিবাসী ছিন্নমূল নয়। সকলেরই পিতৃ পরিচয় আছে। কেউ চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর সন্তান। কিন্তু যে কাজটি তারা করলো, সেটা তাদের শিক্ষা ও পারিবারিক-সামাজিক পরিচিতির সঙ্গে মানানসই নয়।

কেসস্টাডি নেওয়া হলে কিশোর-তরুণদের উগ্রতা ও অপরাধপ্রবণতার অসংখ্য খারাপ ও বীভৎস দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। ঢাকার উত্তরা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ সমগ্র দেশেই উঠতি কিশোর-তরুণদের মারমুখী চরিত্র দৃষ্টি এড়ায় না। এদের দ্বারা নানা ধরনের অপরাধ ও সন্ত্রাসের ঘটনার খবরও কম নয়। আজকেও বাংলানিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে পাড়ায় পাড়ায় কিশোর-তরুণ অপরাধীদের দাপট।

টাকা অভাব নেই, সুযোগ-সুবিধার অন্ত নেই, তারপরও দেশের প্রায়-সর্বত্রই কিশোর-তরুণদের একটি অংশ কেন উগ্র হয়ে উঠছে? কেন তারা হচ্ছে অপরাধপ্রবণ? কেনই এদের কেউ কেউ জড়াচ্ছে মাদকচক্রে? কিংবা যুক্ত হচ্ছে অস্ত্র ও সন্ত্রাসের কালো জগতের সঙ্গে?

দেশের কিশোর-তরুণদের বিপথগাগিতার দায় কার? কিশোর-তরুণদের? শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের? বাবা-মা-পরিবারের? সমাজের? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার? কার?

ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক কলোনি স্কুলের শিক্ষক শায়লা পারভীন সাথী মনে করেন, ‘দায় সবার। এককভাবে কাউকে দোষারোপ করলে সমস্যার সমাধান হবে না।’

এটা ঠিক যে, আজকাল স্কুল হয়ে গেছে বাণিজ্যিক। পড়াশোনার বাইরে শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা মনোযোগ দেওয়া হয় না প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। শিক্ষকরাও প্রাইভেট পড়াতে ব্যস্ত। কে ভালো হলো, কে খারাপ হলো, সে খেয়াল তাদের নেই।

পরিবারগুলোও হয়ে গেছে ব্যস্ত। বাবা-মা  উভয়েই চাকরিজীবী হলে তো সমস্যার অন্ত নেই। সন্তান বেড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণহীনতায়। অনেক পরিবারের কর্তাই বলেন, ‘সন্তানের সব চাহিদা তো আমরা মেটাচ্ছি। আর কি করবো?’ এটা কোনো কাজের কথা নয়। সন্তান কিভাবে, কোথায়, কার সঙ্গে মিশছে, সে খেয়াল করাটাও জরুরি।

সমাজেও এখন শিশু-কিশোররা নিরাপদ নয়। বর্ধিষ্ণু সমাজে ও নগরায়নে নানা চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মানুষ এসে ভিড় করছে। কার কি মতলব, সেটা মোটেও জানা জাচ্ছে না। পার্কে, মাঠে, পাড়ায় কে কার সঙ্গে মিশে কোন পথে চলে যাচ্ছে, সেটারই কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। প্রধানত বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতদের টানে অনেকেই নানা অপকর্মে অনিচ্ছায় বা অগোচরেই জড়িয়ে যাচ্ছে। একজনের সমস্যা পাড়ায়-পাড়ায়, বন্ধু মহলে সংক্রমিত হচ্ছে। এই ঝোঁক মারাত্মক।

সমাজবিজ্ঞানিরা বলেলেন, সঙ্গী-সাথী এবং পরিবেশের কারণে প্রধানত মানুষ ভালো বা মন্দ হয়। পরিবার-পরিজনে, পাড়ায়, মহল্লায় যেমন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গী-সাথী পাওয়া যায়, তেমনই তারা শেখে। পাশাপাশি যে পরিবেশ তারা পায়, তা থেকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। এজন্য পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রধানত ভূমিকা পালন করতে হয়। এ কাজটি বর্তমানে খুব কমই করা হচ্ছে।

টাকা ও ডোনেশন দিয়ে কে কোন ছাত্রকে ভর্তি করছে, প্রচুর অর্থ ব্যয়ে কে বড় ফ্ল্যাট কিনছে বা দামি গাড়ি হাঁকাচ্ছে, সেটা কতটুকু খোঁজ নেওয়া হয়? সবাই যেন ছুটছে তাৎক্ষণিকতার পেছনে। এই প্রবণতা মারাত্মক। দেখে দেখে অনেকেই, বিশেষত কিশোর-তরুণরা মারাত্মক ধরনের খারাপ কিছু শিখছে। এরই সঙ্গে রয়েছে, উত্তেজক চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট, ফেসবুকের ক্ষতিকারক ব্যবহার। অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজের মানুষ সবাই যদি সতর্ক ও তৎপর না হয়, তবে কিশোর-তরুণদের বিপদগামিতা রোধ করা সম্ভব হবে না। বিপজ্জনক হতে হতে তাদের উগ্রতা ও অপরাধপ্রবণতা মারাত্মক পর্যায়েই চলে যাবে।

খারাপ উদাহরণের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। মাদকাসক্ত তরুণী পুলিশ অফিসার পিতা-মাতাকে হত্যা করেছে। তথাকথিত বন্ধুরা মিলে ও সিদ্ধান্ত নিয়েই কোনো বন্ধুকে খুন বা জখম করেছে। বাসা-বাড়ি আক্রমণ করেছে। পথে-ঘাটে উগ্রতা দেখাচ্ছে। নিজের ঘরের অন্য সদস্যদের সন্ত্রস্ত করছে। সর্বত্র তাঁদের অস্থির, উগ্র, অপরাধমুখী প্রবণতা বাড়ছেই।

অভিভাবক, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা এখনই সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের অবনতিশীল পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কি সম্ভব হবে? সম্ভব হবে কি পরিবারের কোমলমতি কিশোর-তরুণদের সঠিক পথে রেখে উন্নত জীবনের দিশা দেওয়া? দেশের একটি সম্ভাবনাময় কিশোর-তরণ প্রজন্মের আত্মঘাতী পথে চলে যাওয়াকে থামাতেই হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৭
জেডএম/


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান