ভুল সংশোধন হচ্ছে না ভূমি খতিয়ানে

সাজিদুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৯:০৫, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১১

ঢাকা: ভুলে ভরা ভূমি খতিয়ান সংশোধন হচ্ছে না। ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ বিষয়ক সুপারিশ ভূমি মন্ত্রণালয়ে নাকচ হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে উঠেছে।

এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় পক্ষে বলা হয়েছে- ‘খতিয়ানের ৮২ শতাংশই সঠিক। তাই কোন সংশোধনের প্রয়োজন নেই। এজন্য বাড়তি সোয়া সাত কোটি টাকা খরচ করারও দরকার নেই।‘

শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছে সংসদীয় কমিটি। তাই খতিয়ানের মতো সরকারি দলিলে বিধি বর্হিভূতভাবে মুদ্রিত নাম শেষ পর্যন্ত থাকছে বলেই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

মন্ত্রণালয়ের মতে, খতিয়ান থেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নাম বাদ দেওয়াসহ সম্পূর্ণ সংশোধনে ৭ কোটির  বেশি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। আর এতে সময়ও লাগবে অনেক। এতে করে খতিয়ান বুঝে নিতে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষমান জমির মালিকদের অসন্তোষ আরও বাড়বে।

তবে যাচাই না করেই খতিয়ান গ্রহণ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে পুরো বিল পরিশোধ করার ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

উল্লেখ্য, গত ৪ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খতিয়ান মুদ্রণের ক্ষেত্রে রেকর্ড টেম্পারিং ও রেকর্ড না বুঝে কিভাবে বিল পরিশোধ করেছে তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের সংসদীয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়।

বেনজীর আহমদকে আহবায়ক করে গঠিত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- আব্দুল হাই ও রণজিত কুমার রায়।
 
সংসদীয় কমিটিতে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮২ শতাংশ খতিয়ান কোম্পানির নামসহই সঠিক হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি ১৮ শতাংশ ইরেজ, ব্লক প্রিন্ট, হাতে লেখা, ফটোকপি ইত্যাদি সেটেলমেন্ট প্রেস থেকে ছাপানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
সংসদীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ৫ বছর আগে অসম্পূর্ণ ও ভুলে ভরা খতিয়ান পেশ করেই ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা বিল তুলে নেয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। শর্তানুযায়ী কাজ করা না হলেও যাচাই বাছাই ছাড়াই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বুঝে নেওয়া হয় ভূমির খতিয়ান।

২০০৬ সালের ১৯ মার্চ ৪টি জোন ফরিদপুর, বগুড়া, রংপুর ও কুমিল্লার ২০ লাখ ২৯ হাজার ৬২১টি খতিয়ান মুদ্রণের কার্যাদেশ জারি হয়। সবনিম্ন দরদাতা হিসাবে কাজটি পায় ডিপিসি-পিডিএএস কনসোর্টিয়াম। ওই বছরের ১৫ জুন ডিপিসি ৪টি জোনের ২১ লাখ ৪২ হাজার ২৯৫টি মুদ্রিত খতিয়ান ৩২ টাকা দর হিসাবে মোট ৬ কোটি ৮৫ লাখ ২১ হাজার ৪৪০ টাকার বিল জমা দেয়। ২৯ জুন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর ‘ডিজিট্যাল খতিয়ান বুঝে পাওয়া গেল’ সনদপত্র দিয়ে বিল পরিশোধ করে। পাশাপাশি কার্য সম্পাদন জামানত হিসাবে জমা নেওয়া ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে।
 
পরবর্তীতে ডিপিসির মুদ্রিত খতিয়ান চূড়ান্ত প্রকাশনার আগে যাচাইয়ের সময় প্রচুর ভুল ধরা পড়ে।

দেখা যায়, চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ না করেই বিল তুলেছে ওই প্রতিষ্ঠান। তিন বছর পর ভুল সংশোধনের জন্য চিঠি দেওয়ার পর ডিপিসি ২০০৯ সালের ২০ জুন কুমিল্লা জোনালের গুরতর ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে পুর্নমুদ্রণের কাজ শেষ করে।

৩ আগস্ট থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত রংপুর জোনালের কাজ শেষ করে এবং ৮ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত বগুড়া জোনালের আংশিক সংশোধনের কাজ শেষ করে। তবে সংশোধন কার্যক্রমও ভূমি অধিদফতরের সুপারিশ অনুযায়ী হয়নি, ওই প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

এ নিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত উপ-কমিটি অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে একটি প্রতিবেদনও জমা দেয়। উপকমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের চার জোনের ভুলে ভরা খতিয়ান সংশোধন করে চূড়ান্ত মুদ্রণের জন্য সোয়া ৭ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে হিসাব দেয় ভূমি অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের ওই হিসাবে বলা হয়, বর্তমানে মজুদ খতিয়ানের সঙ্গে ওই অতিরিক্ত ২১ লাখ ৪১ হাজার ২৯৫টি খতিয়ান অফিসের নির্ধারিত সময়ে করা সম্ভব হবে না। ওভারটাইমে কাজটি শেষ করতে হবে। এজন্য ওভারটাইম খাতে কর্মচারীদের অতিরিক্ত খাটুনির বিল বাবদ প্রয়োজন হবে ২ কোটি ৮১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।

এছাড়া মুদ্রণ কাজের জন্য ৩০টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার, ৩০টি লেজার প্রিন্টার, এক হাজারটি টোনার, ৪২ হাজার রিম সাদা কাগজ কিনতে ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। অর্থাৎ খতিয়ান সংশোধন খাতে সর্বমোট প্রয়োজন হবে ৭ কোটি ২৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
 
এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি খতিয়ান আমূল সংশোধনের সুপারিশ করলেও এখন মন্ত্রণালয়ের যুক্তি মেনে নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় কমিটিকে জানিয়েছে, ৮২ শতাংশ খতিয়ান সঠিক হয়েছে। কিন্তু খতিয়ানের নিচের দিকে কোম্পানির নাম লেখা রয়েছে। এই খতিয়ানগুলো গ্রহণের বিষয়ে মন্ত্রীর সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিটিও সম্মতি দিয়েছে।’

শুধু কোম্পানির নাম বাতিলের জন্য খতিয়ান পুনরায় সংশোধনে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়াজন হবে বলেও জানান তিনি।
 
তিনি বলেন, ‘ভূমির এই খতিয়ার নিয়ে মানুষ অনেকদিন ধরেই দুর্ভোগে আছে। কিছু খতিয়ান কমিটি ফেরত পাঠিয়েছে। সেগুলো সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘খতিয়ানের বিষয়ে সময়ক্ষেপন করা ঠিক হবে না।  ভুল সংশোধন  না হওয়ায় গত ৫ বছরেও জমির মালিকদের সংশ্লিষ্ট রেকর্ডের চূড়ান্ত প্রকাশনা দেওয়া সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সেটলমেন্ট অফিসে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকা খতিয়ানগুলো এখন নষ্ট হওয়ার পথে।’
 
সংসদীয় উপ-কমিটি ছয় মাস পর তাদের প্রতিবেদনে খতিয়ান বিষয়ে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিপিসি কার্যাদেশ অনুযায়ী মুদ্রণের কাজ করেনি।

এছাড়া খতিয়ান মুদ্রণে সরকার নির্ধারিত ফরম অনুসরণ করা হয়নি। খতিয়ান ফরমের নিচে কার্যাদেশ নম্বরসহ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। যা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন হিসাবে বহুল প্রচারের জন্য কৌশল বলে মনে হয়। সরকারি দলিলে বেসরকারি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেওয়া আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপতরের তৎকালীন মহাপরিচালক আবু হায়দার সরদার, খতিয়ান মুদ্রণের ক্ষেত্রে রেকর্ড টেম্পারিং এবং রেকর্ড না বুঝিয়ে বিল পরিশোধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যুগ্ম-সচিব ও পরিচালক (ভূমি রেকর্ড) সামসুল আলম (২০০৭ সালে অবসরে গেছেন), সিনিয়র সহকারী সচিব ও চার্জ অফিসার (বাউন্ডারি-২) জিয়া উদ্দিন আহমেদকে (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি) অভিযুক্ত করে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশ করে।

এছাড়া বিল পরিশোধে সহযোগিতার জন্য ভূমি অধিদপ্তরের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে উপ-কমিটি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১১


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান