
ঢাকা: ছ’দিনের ‘হরতাল ফাঁদে’ পড়ছে দেশ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের অন্যতম মিত্র জামায়াতের ডাকা টানা ৪৮ ঘণ্টার ও পরবর্তীতে ১২ ইসলামী সংগঠনের ডাকা টানা ৩০ ঘণ্টার হরতাল এই ফাঁদ তৈরি করেছে। এতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষত, রোববার বিকেলে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তদের ককটেল হামলায় জনা বিশেক আহত হওয়ার ঘটনা আসন্ন হরতালে নাশকতার আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত নেতাদের অব্যাহত হুমকি ধামকি সেই আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হরতাল বিষয়ক খবর, ইউএনডিপির প্রতিবেদন ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি হরতালেই জাতীয় অর্থনীতির ২০ শতাংশ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতি হরতালে জিডিপির গড় ক্ষতি সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সে হিসেবে আসন্ন সিরিজ হরতালেই কেবল ২০ হাজার কোটি টাকা জিডিপি ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রতি হরতালে কেবল পরিবহন খাতেই প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষ ক্ষতির শিকার হন। বেড়ে যায় দ্রব্যমূল্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন প্রায় ৩ কোটি ব্যবসায়ী।
এছাড়া টানা হরতালে বিদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে অন্যদেশমুখী হন। কমে যায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও নেমে যায় আশঙ্কাজনকভাবে। কমে যায় সরকারি ব্যাংক, বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন। ব্যহত হয় শেয়ারবাজারের বেচাকেনা। লেখাপড়া ব্যাহত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জন দুর্ভোগের অন্ত থাকে না।
এমনতরো হাজারো ক্ষতির আশঙ্কা জাগিয়ে রেখেই রোববার তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অর্ধদিবস হরতাল হলো ঢাকায়। এই হরতালের রেশ কাটতে না কাটতেই আগামী বুধবার সকাল ৬টা থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের অন্যতম মিত্র জামায়াত। শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ওই হরতাল চলবে।
এরপর শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দু’দিন বিরতি বাদে রোববার সকাল ৬টা থেকে শুরু হবে ১২ ইসলামী দলের ডাকা ৩০ ঘণ্টার হরতাল। ওই হরতাল শেষ হবে সোমবার দুপুর ১২টায়।
মূলত বিএনপি ও জামায়াত ৪৮ ঘণ্টা ও ইসলামী দলগুলো ৩০ ঘণ্টার হরতাল ডাকলেও সব মিলিয়ে হরতালের আওতায় আসবে ৪ কার্যদিবস ও ১ সরকারি ছুটির দিনের প্রথম ভাগ। এতে পূর্ববর্তী হরতালগুলোর চেয়ে অধিক আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষত, আম, কাঁঠাল ও আনারসের মতো পচনশীল ফলের মৌসুম হওয়ায় এসবের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা পড়বেন চরম বিপাকে। এরই মধ্যে এসব ব্যবসায়ী সম্ভাব্য ক্ষতি যতো দূর সম্ভব কমাতে বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন।
ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিটি হরতালে গড়ে ৫ হাজার ৫শ’ ৪৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয় জিডিপির।
অপর এক হিসেবে প্রতিটি হরতালে দেশের মোট অর্থনীতির অন্তত ২০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আমদানি-রপ্তানিতেও অন্তত ১০ শতাংশ ক্ষতি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যায় প্রায় ৪৪ শতাংশ। অপরদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়ে প্রায় ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসেবে, দেশে বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও মোটরগাড়িসহ ৯ প্রকারের প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ যান্ত্রিক বাহন চলাচল করে। এর মধ্যে ঢাকা নগরীতেই চলছে অন্তত সোয়া পাঁচ লাখ গাড়ি। এসব পরিবহনের প্রায় ২০ লাখ মালিক ও শ্রমিক রয়েছে। আর তাদের ওপর নির্ভরশীর জনগোষ্ঠী মিলিয়ে প্রায় পৌনে এক কোটি হরতালের কারণে ক্ষতির শিকার হবে।
অনেকটা একই রকম হিসাব, দুই শতাধিক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির।
প্রসঙ্গত, স্বপ্নে পাওয়া ধারণা থেকে হরতাল চালু করেছিলেন অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হরতালের ময়দানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে এক করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন তিনি।
গান্ধীজি গুজরাটের মানুষ হওয়ায় তার ‘হরতাল’ জাতি-ধর্ম, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে ভারতবাসীকে একত্রিত করে সরকার বিরোধী অসহযোগের জন্ম দিয়েছিল। শতাধিক বছরের ব্যবধানে হরতালের চরিত্র অনেকটা পাল্টে গেলেও গান্ধীজির গুজরাটের ‘হরতাল’ শব্দটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।
বঙ্গভঙ্গ রোধে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট যে ‘বয়কট’ কর্মসূচি পালন করা হয় সেটিকেই উপমহাদেশের প্রথম হরতাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল হরতাল ডাকেন মাহাত্মা গান্ধী। হরতাল চালু থাকে জহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও ইন্ধিরা গান্ধীর আমলেও।
পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে হরতাল হয় মূলত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের চেয়ে হরতালের প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাল্টে যেতে থাকে চরিত্রও। আশির দশকে এরশাদের পতনই হয়ে ওঠে হরতালের মূল ইস্যু।
দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আরও পাল্টে যায় হরতালের চরিত্র। রাজপথে সহিংসতা বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারীতায় রাজপথে একের পর এক লাশ পড়ার নজির তৈরি হয়। যানবাহনে ইট-পাটকেলের পরিবর্তে ককটেল-বোমা নিক্ষেপের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে ‘৮২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে হরতালে প্রাণহানি ঘটে সাত জনের। পরবর্তী ৮ বছরে এরশাদবিরোধী হরতালে ১০৯ জন নিহত হন।
’৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ৬৩ জন ও ‘৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৩৭ জন নিহত হন হরতালের ময়দানে।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মধ্যে হরতাল বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছে ব্যবাসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
তাদের মতে, প্রতিটি হরতালেই দেশের তিন কোটি ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
এদিকে আগামী রোববার ইসলামী দলগুলোর ডাকা ৩০ ঘণ্টার হরতাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণ ও অর্ধ দিবস মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এক হাজার দু’শ’ দিন হরতালের মাইলস্টোন পূর্ণ হবে।
বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ২০০২ পর্যন্ত হরতাল হয় ১ হাজার ৩০২টি। তমুদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতাল ডাকে। এরপর ভাষা ইস্যুতে হরতাল ডাকা হয় ১৯৫২ সালের ২২, ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি। একই দাবিতে কেন্দ্রীয় ভাষা পরিষদ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডাকে।
কিন্তু এরশাদের আমল থেকে হরতালের পূর্ববর্তী লক্ষ্য ও চরিত্র পাল্টে যায়। সরকার পতনের আন্দোলনই হয়ে ওঠে হরতালের মূল ইস্যু।
স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এরশাদের বিরুদ্ধে ১শ’ দিন হরতাল দেয় বিরোধীরা। তার পতন নিশ্চিত করতে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ২৪৫টি হরতাল দেওয়া হয়।
আর ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে হরতাল হয় ৪৬২ দিন।
এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১৭৩ দিন হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। আর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৫৯ দিন হরতাল ডাকে বিএনপি।
তবে ২০০১ সালে বিরোধী দলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের হরতাল সংখ্যা বেশ কমে যায়। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তারা হরতাল ডাকে ১৩০ দিন।
ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে হওয়া হরতালের ৮৪ শতাংশ আওয়ামী লীগ ও বাঁকি ১৬ শতাংশ বিএনপির ডাকা।
এমনকি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ।
কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকার এটিই একমাত্র উদাহরণ।
বর্তমান সরকারের আমলে ১ম হরতাল হয় ২০১০ সালের ২৭ জুন। ওই দিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল করে বিএনপি। এরপর ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর ও ৩০ নভেম্বর একই দলের ডাকে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়।
হরতালের আগে গাড়ি পুড়িয়ে যুবক খুনের মামলা ও মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীতে হরতাল পালন করা হয়। এরপর আবার ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল করে বিএনপি।
চলতি বছরের ৪ এপ্রিল ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়।
এরপর বিএনপি ৫ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগের প্রতিবাদে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে। একই দাবিতে বিএনপি ও জামায়াতের হরতাল হয় ১২ ও ১৩ জুন।
সর্বশেষ, ৩ জুলাই রোববার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি কনোকোফিলিপসের সঙ্গে করা বঙ্গোপসাগরের গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি বাতিলের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে রাজধানী ঢাকায় আধা বেলা হরতাল পালিত হয়। এর আগে ঢাকায় আর একটি হরতাল করেছিলো তেল-গ্যাস কমিটি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১১