‘দেশ শত্রু মুক্ত হয়েছে, এবার শহীদ মিনারে যাব’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ২১:২২, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
ছবি: উজ্জ্বল ধর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: উজ্জ্বল ধর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফফর আহমেদ এবং তার ছেলে শেখ মোহাম্মদ আলমগীরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাদের হত্যার জন্য পাক সেনাদের ইন্ধন দিয়েছিল।  কার্যত সালাহউদ্দিনই রেখেছিল মুখ্য ভূমিকা।

স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৪৫ বছরেও দু’জনের লাশও পাননি তাদের স্বজনরা।  বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও  স্বজন হারানোর সেই ব্যাথা বুকে বয়ে চলেছেন তারা।  স্বাধীন দেশে হত্যাকারী সালাহউদ্দিন কাদেরকে তারা মন্ত্রী-এমপি হতে দেখেছেন।  তারা দেখেছেন যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন।  স্বাধীন দেশেও তারা যেন পরাধীন।  এজন্য ৪৪ বছর ধরে শহীদ মিনারে যাননি শহীদ মোজাফফরের ছেলে শেখ মোরশেদ আনোয়ার এবং শহীদ আলমগীরের স্ত্রী উম্মে হাবিবা সুলতানা। 

তবে এবার শহীদ মিনারে যাবেন।  সালাহউদ্দিন কাদেরের (সাকা) ফাঁসি হওয়ায় শহীদ মোজাফফরের পরিবারে এখন বিজয়ের অন্যরকম আনন্দ।  সাকা’র বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারা।  সেই সাকা’র ফাঁসি হয়েছে।  সাকামুক্ত দেশে তারা এবার শহীদ মিনারে গিয়ে জাতির বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাবেন। 

উম্মে হাবিবা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, কখনোই মনে হয়নি আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে।  মনে হচ্ছিল স্বাধীন হয়েও হয়নি।  ২৪ ঘণ্টা শুনছিলাম উল্টো কথা।  ২৪ ঘণ্টা ‍দেখছিলাম যারা পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-আলবদর তাদের বিজয়।  একটা স্বাধীন দেশ কি এরকম হতে পারে ?

‘নিজের শ্বশুর, নিজের স্বামীর লাশ কোথায় ‍জানিনা।  এটা যে কত বড় কষ্ট কেমনে বোঝাব।  এই কষ্ট বুকে নিয়ে স্বাধীনতার পর কোনদিন শহীদ মিনারে যেতে পারিনি।  নিজের সন্তানদেরও কখনও যেতে দেয়নি।  কিন্তু একটা লোকের মৃত্যুর কারণে মনে হচ্ছে দেশ আজ শত্রুমুক্ত হয়েছে।  এবার প্রথমবারের মত মনে হচ্ছে দেশ প্রকৃত স্বাধীন হয়েছে।  এবার আমরা শহীদ মিনারে যাব। ’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন উম্মে হাবিবা সুলতানা।

শেখ মোরশেদ আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, এদেশে বন্দুক ধরে কারা ক্ষমতা নিয়েছিল ? তারা নামে সেনাবাহিনী, আসলে পাকিস্তানের দোসর।  তারাই সালাহউদ্দিন কাদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছিল।  নিজের বাবা-ভাইয়ের খুনি জাতীয় পতাকা উড়াচ্ছে, কেমনে দেশকে স্বাধীন ভাবব ? তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কষ্ট লাঘব করেছেন।  সাকা’র মত খুনি-বর্বরের ফাঁসি হয়েছে, দেশ আজ প্রকৃত স্বাধীন হয়েছে। 

‘আমি শহীদ মিনারে যাব।  নিজের বাবা-ভাইয়ের কবর কোথায় তো জানিনা।  মনে করব আমার বাবা-ভাই শহীদ মিনারে আছে।  শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব। ’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন শেখ মোরশেদ আনোয়ার।

বিজয় দিবসের আগের দিন মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরীর ফয়’সলেক এলাকায় নিজ বাসায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হন শেখ মোরশেদ আনোয়ার এবং উম্মে হাবিবা সুলতানা।  স্বজনের খুনি সাকা মুক্ত বাংলাদেশে তারা কিভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করবেন সেই প্রশ্নের জবাবে তারা এসব কথা বলেন।

বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতরও হন বার্ধক্যে পৌঁছানো শেখ মোরশেদ আনোয়ার এবং উম্মে হাবিবা সুলতানা। 

শেখ মোরশেদ আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবা চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।  শেখ সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।  ৭১ সালের ২৫ মার্চ আমার বাবা লালদিঘির মাঠে তৎকালীন জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের স্বাধীনতার শপথ পাঠ করান।  সেই ঘটনার পর থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমার বাবাকে টার্গেট করেন। 

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুরে আমার ভাই শেখ মোহাম্মদ আলমগীর রাউজানে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবাকে নিয়ে শহরে ফিরছিলেন।  সালাহউদ্দিন কাদের তাদের পেছনে চর লাগিয়ে দিয়েছিলেন।  তারা যখন হাটহাজারীতে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্পের সামনে দিয়ে আসছিলেন তখন সাকা সেখানে আসে।  সে পাক আর্মিকে আমার বাবাকে দেখিয়ে লালদিঘির মাঠে শপথ পাঠ করানোর কথা বলে।  আর্মি আমার বাবাকে ধরে ফেললে ভাই গিয়ে পাকিস্তানি আর্মির পায়ে ধরে ফেলে।  তখন সালাহউদ্দিন বলে, তাকেও নিয়ে চলেন।  আমার ভাই এবং বাবাকে নিয়ে হাটহাজারীতে আর্মি ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।  ১৭ এপ্রিল বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পেটানো হয়।  এরপর হত্যা করে তাদের লাশ কোথায় ফেলে দেয়া হয়েছে আজ পর্যন্ত তার হদিস পাইনি। 

উম্মে হাবিবা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, কি অমানুষিক যন্ত্রণা সে আমাদের দিয়েছে সেটা কোনদিন বলে বোঝাতে পারবনা।  আমি ছিলাম সদ্য বিবাহিতা।  আমার মা এবং ভাই দুই মাস ধরে রাউজান থেকে প্রতিদিন একটি বাস ভাড়া করে তিনটা চেকপোস্ট পার হয়ে শহরে এসে গুডস হিলে (সাকা’র টচার সেল) গিয়ে বসে থাকত।  সালাহউদ্দিন কাদের আজ ফেরত দেব, কাল ফেরত দেব বলে আর দেয়নি।  তাদের মেরে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় না, আমি যখন সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলাম সে (সাকা) তখন আমাকে দেখে টিটকারি মেরেছিল।  চট্টগ্রামের ভাষায় বলেছিল, ‘ল্যাংগর ক্যা তাড়াতাড়ি যা। ’ (খুঁড়িয়ে হাটছিস কেন, তাড়াতাড়ি যা)।  আর্থারাইটিসের সমস্যার কারণে আমার পায়ে সমস্যা।  সেজন্য সে এই ধরনের নির্মম কটাক্ষ আমাকে করেছিল।  কিন্তু আমি ধৈর্য ধরেছি। 

‘সে নিজেই আমাকে জেরা করেছিল।  আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে বর্তমান বয়স পর্যন্ত সব জেরা করেছে।  আমি কোন স্কুলে পড়েছি, আমার বাবার গাড়ি ছিল কিনা, শ্বশুরের গাড়ি ছিলনা, আমার ছেলের নাম, কোথায় চাকরি করে সব জিজ্ঞেস করেছে।  ছেলের কথা বলার উদ্দেশ্য সে মনে করেছিল আমি ভয় পাব।  কিন্তু আমি ভয় পাইনি।  আমি ধৈর্য ধরে জবাব দিয়েছি। ’ বলেন উম্মে হাবিবা সুলতানা।

তিনি বলেন, নানান কৌশলে সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে আটবার সময় নিয়েছিলেন।  নয়বারে গিয়ে আমি সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।  সে ভেবেছিল, আমাকে হয়রানি করলে আমি বোধহয় সাক্ষ্য না দিয়ে ফেরত আসব।  কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। 

শেখ মোরশেদ আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, আমি যেদিন সাক্ষ্য দিতে গেলাম সেদিন সাকা অট্টহাসি দিয়ে বলল মোরশেদ সাহেব, আমার বিরুদ্ধে ‍সাক্ষ্য দিতে এসেছেন ? বিচারপতি বললেন, সাকা চৌধুরী...।  সে চীৎকার করে উঠল, হোয়াট ইজ সাকা, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলুন।  কেমন বেয়াদব ছিল সে !

শেখ মোজাফফর এবং আলমগীরকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল সালাহউদ্দিন কাদেরকে ফাঁসি দিয়েছিল যা আপিল বিভাগেও বহাল ছিল।  ২১ নভেম্বর সাকা’র ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। 

উম্মে হাবিবা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, আমি চাইলে অনেক কথা বলতে পারতাম।  কিন্তু সাকা আমাকে আর আমার পরিবারকে যে কষ্ট দিয়েছিল তার পরিবারের সদস্যরাও একই কষ্ট পাচ্ছে।  আমি কিছু বলে তাদের কষ্ট আর বাড়াতে চাইনা।  সে অমানুষ, তাই বলে আমি তো সেটা হতে পারব না। 

‘সবাই বলত সালাহউদ্দিন কাদেরের বিচার হবেনা।  কিন্তু আমার মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার বিচার হবেই।  ভাবতাম হয়ত আমি দেখে যেতে পারবনা, কিন্তু আমার পরের প্রজন্ম অবশ্যই দেখবে।  কিন্তু আল্লাহ আমাকে তার পরিণতি দেখে যাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। ’ বলেন উম্মে হাবিবা।

শেখ মোরশেদ আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, স্বাধীনতার জন্য আমার বাবা-ভাই জীবন দিয়েছেন।  অথচ তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারের কোন পদক্ষেপ নেই।  আমি চাই তাদের নামে একটা করে সড়ক ‍নির্মাণ করা হোক।  যেখানে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের  একটা স্মৃতিসৌধ হোক। 

বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
আরডিজি/টিসি


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান