
ঢাকা: আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে ২০০২ সালের ১২ জুন প্রথম দিবসটি পালিত হয়। এ সময়ে আইএলও ঘোষণা করে প্রতিবছর ১২ জুন বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, কারিতাস, বিলস, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, শ্রম মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। তবে হরতালের দিনে এসব কর্মসূচি কীভাবে অথবা কতটা সুষ্ঠুভাবে পালন করা যাবে বা আদৌ যাবে কীনা এটাই বড় প্রশ্ন।
কিন্তু কেমন আছে বাংলাদেশের শিশুরা। কতোটা ঝুঁকিতে জীবন বাঁচিয়ে রাখছে তারা। কি তাদের ভবিষ্যৎ! এ প্রশ্নের কোনো পরিষ্কার উত্তর জানা নেই কারো কাছে। নেই কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও।
তবে এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা ভালো নেই। শ্রম অধিদপ্তরের ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ৪৯ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে বাংলাদেশে। অভাবের তাড়নায় তারা রাস্তায় পাথর ভাঙে, গার্মেন্টসে কাজ করে, ঠেলাগাড়ি চালায়, কাগজ কুড়ায়, পার্কে ফুলের মালা বিক্রি করে এমনকি এ বয়সেই চুরি করছে ও পকেট মারার মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে শিশুরা। এরা ভালভাবে বেড়ে উঠার কোন স্বপ্ন দেখে না। কোনও মতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারলেই তারা খুশী হয় । কিন্তু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সব ধরণের মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত থাকায় তারা দুর্বিসহ জীবন যাপন করে।
বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম
ইউনিসেফের ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও বেশি শিশু। এদের বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। শিশুদের যে শুধু অধিকার আছে তা নয়, তারা অনেক পণ্য ও সেবার গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা এবং প্রস্তুতকারক। অথচ এ দেশের বেশির ভাগশিশুই বঞ্চনার শিকার।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটিরও বেশি। এদের শতকরা ৯০ জনই প্রাথমিকভাবে স্কুলে যায়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অর্ধেকের বেশি ছেলে-মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এসব শিশুর বেশির ভাগই শ্রমের সাথে যুক্ত হয়।
এ দেশের শহরাঞ্চলের শিশুরা প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে জড়িত। এর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ব্যাপক দারিদ্র্য, জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট দুরবস্থা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, শিশুশ্রমের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব, স্বল্প বেতনে শিশু শ্রমিকের সহজ প্রাপ্তি, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, পারিবারিক জটিলতা, বাবা-মায়ের সম্পর্কের বিচ্ছেদ, সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্থায়ী অনুপস্থিতি, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, পরিবারের সদস্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, পিতা-মাতার পেশা, শহরে বস্তির বিস্তার ইত্যাদি শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দেখেছে জাতিসংঘের এ শাখা সংস্থাটি।
আইএলও’র ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে শ্রমে নিযুক্ত রয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ শিশু। এদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই রয়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ শিশুশ্রমিক। বিশ্বের প্রতি ছয়জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। দাসত্ব, বল প্রয়োগ, যৌন নিপীড়ন, সশস্ত্র সঙ্ঘাত প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুরা সংখ্যায় তিন-চতুর্থাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার শিশুকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের অনেকে পরিচিত হয় টোকাই, ছিন্নমূল কিংবা পথশিশু নামে। নেই তাদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা। আজ এই পাটাতনে তো কাল রাস্তায় পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুমানোর আগের প্রস্তুতি ও থাকে না। কাজ শেষে ঘুমানোর একটু চেষ্টাতেই চোখে চলে আসে রাজ্যের ঘুম।
শিশুশ্রমের ওপর শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক জরিপ দেখলেই বোঝা যায় ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে মোট ৪ কোটি ২৩ লাখ ৬৭ হাজার শিশু। এর মধ্যে ১৭.৫ শতাংশ শ্রমের সঙ্গে জড়িত। যার সংখ্যা ৭৪ লাখ ২৩ হাজার। শিশুশ্রমের মধ্যে ছেলের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৭১ হাজার এবং মেয়ে শিশুর সংখ্যা ১৯ লাখ ৫২ হাজার। মোট শিশুর ৬ শতাংশ স্বীকৃত ক্ষেত্রে (ঝুঁকিপূর্ণ নয়) জড়িত আর ৮৯ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।
বিশ্ব খাদ্যসংস্থার ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ শিশুশ্রম দিচ্ছে কেবল খাদ্যের বিনিময়ে এবং এজন্য তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। ২৩.৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেওয়া হয় যার পরিমাণও শিশু আইনের তুলনায় খুবই নগণ্য।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ভয়েসের নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ স্বপন মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বেশিরভাগ পথশিশুর বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তাদের সবার জীবনই দু:খ-বেদনার মূর্তপ্রতীক। অনেকে মা-বাবা হারিয়েছে ছোটবেলায়। দু’মুঠো অন্নের জন্যই কেবল রাজধানীতে আসা। এরা ঠাঁই নেয় রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল বা লঞ্চঘাটে। শুরু করে কুলিগিরি, হকারি কিংবা কাগজ কুড়ানো। যে বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা চিন্তা করে কিভাবে দু’পয়সা রোজগার করা যায়। এদের বেশির ভাগই সচেতনতার অভাবে ধাবিত হচ্ছে বিপথে।’
তিনি জানান, এই শিশুদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অপরাধী চক্র নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের ব্যবহার করে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। ফলে শিশু হয়ে যাচ্ছে ফেরারি আসামি, চিরদিনের জন্য হয় পঙ্গু, জেলে কাটে জীবনের দীর্ঘ সময় এমনকি মৃত্যুবরণও করে থাকে। পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা তাদের প্রয়োজনে এসব শিশুকে সোর্স হিসেবে কাজে লাগায়। মেয়ে শিশুরা নিয়োজিত হচ্ছে অসামাজিক কাজে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ২০০৯/১০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে ৫ শতাধিক শিশু রয়েছে যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সরাসরি জড়িত। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপকর্মে এরা লিপ্ত। দুর্দশাকে পুঁজি করে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। স্মল আর্মস বহন করার কাজেও শিশুদের ব্যবহার বেড়ে গেছে। মাদক বেঁচা-কেনায় জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা । এতে করে এদের অনেকেই হয়ে উঠছে মাদকসেবী।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১৩ লাখ শিশু, যা মোট শিশু শ্রমিকের ৪১ শতাংশ।
আর্ন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৩ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব কাজে নিয়োজিতদের অধিকাংশই পথশিশু।
এই শিশুরা ঝালাই কারখানা, ঢালাই কারখানা, রি-রোলিং মিলের লোহা গলানোর কাজে, এমনকি জ্বলন্ত বয়লারের পাশে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে।
আইএলওর ভাষ্য মতে, ‘এদেরকে এ ধরনের কাজ করার সময় যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়, তার সঙ্গে তুলনা চলে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকের। যে সীসা মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ, সেই সীসা, তামা, চামড়া কারখানার কেমিক্যালস, বিষাক্ত রি-এজেন্ট, লোহার ঢালাইয়ের গনগনে আগুনে এদের কালো মুখ আরো লাল হয়ে ওঠে।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা শত শত ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ১০ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ধাতব কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, প্লাস্টিক কারখানা, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, গাড়ির গ্যারেজ, ঝালাই কারখানা, রিকশা মেরামতি, মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপ, গাড়ির টেম্পুর হেল্পারি, গার্মেন্টসের ছোটখাটো কাজ, লেদ কারখানা, হাঁড়িপাতিল বানানো এবং ছোট ছোট কুটির শিল্প ধরনের কারখানা। এর বাইরে একটা বড় অংশ কাজ করে বাজারগুলোতে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসেবে, বাংলাদেশে ৬ থেকে ১৬ বছরের মোট ৪ লাখ ২০ হাজার শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে। এদের শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। বাড়ির এঁটো বা উচ্ছিষ্ট খাবারই এদের ভাগ্যে জোটে। রাতে হয় বারান্দা অথবা রান্নাঘরে ঠাঁই হয় এদের। নেই চিকিৎসা ভাতা, নেই ছুটিছাঁটা। বেতন বাড়ারও কোনো সুযোগ নেই। তার ওপর আছে শারীরিক অত্যাচার। গত ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৬৪০টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০৫ জন মারা গেছে। নিয়মিত-অনিয়মিত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৭টি শিশু।
বিশ্বের শিশুরা
জাতিসংঘ বলছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি শিশু যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদীদের আগ্রাসনের শিকার। তারা শুধু গৃহহীনই নয়, তারা বসবাস করছে অন্য আরেকটি দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে। যেসব শিশু কোন না কোন সময় সরাসরি নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে ১ কাটিরও বেশী শিশু রয়েছে ১৮ বছরের নীচের। এরা অন্যত্র বাস করছে এবং এর মূল কারণ হল যুদ্ধ। এসব যুদ্ধে মারা গেছে কমপক্ষ্যে আরো ২ কোটি শিশু। ৬০ লাখ শিশু গুরুতর আহত হয়েছে এবং প্রায় ১০ লাখ শিশু বাবা-মাকে হারিয়েছে।
বিশ্বের প্রায় ৮৭ টি দেশের শিশুরা বসবাস করছে ৬ কোটি স্থল মাইনের ঝুঁকির মধ্যে। প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার শিশু শিকার হচ্ছে এসব স্থল মাইনের। ৩ লাখ মেয়েশিশু যাদের বয়স ১০ বছরের নীচে তাদের জোর করে শিশু সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার বয়স একটু বাড়লেই জোর করে পাঠানো হচ্ছে পতিতালয়ে। সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট আফ্রিকায়।
আবার পশ্চিম ইউরোপের মতো উন্নত সমৃদ্ধ এলাকায় অন্তত ২০ হাজার শিশু একাই বেড়ে ওঠে । তাদের পাশে বাবা-মা থাকে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১০ এর প্রতিবেদনে বলছে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে কেবল এইডসে আক্রান্ত হয়েই প্রায় ৪০ লাখ শিশু মারা গেছে। বাবা-মা হারিয়েছে প্রায় ১৫ লাখ শিশু। গত পাঁচ বছরে শিশুদের জন্য জীবননাশের সবচেয়ে বড হুমকি হিসেবে এইডস দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যে সব দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই রয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে সারা বিশ্বে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতে যত শিশু রয়েছে তার অর্ধেকই ১৫ বছর বয়স পার হওয়ার আগেই মারা যাবে এইডসে আক্রান্ত হয়ে।
সংস্থাটির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে কেবল ভারতেই মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগ শিশু। বর্তমানে সেদেশে প্রায় ৩৮ কোটি শিশু রয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশী শিশুশ্রমিক রয়েছে ভারতে ।
কিছুদিন আগে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ৫০ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। এছাড়া দেশটির ৬৫ ভাগ শিশুই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। ভারতের স্কুলগুলোতে লিঙ্গ বৈষম্যও করা হচ্ছে বলেও ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কন্যা শিশুর ভ্রুণ হত্যা দেশটিতে মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে বলে ও জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ ও শিশুশ্রমে নিয়োগনিষিদ্ধ স্থানে নিয়োগ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার
বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সরকার, মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা আই.এল.ও গত তিন বছর ধরে `বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস` পালন করে আসছে ৷
শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে আই.এল.ও ন্যূনতম বয়স কনভেনশন, জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণসহ বিভিন্ন কনভেনশন ও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ গ্রহণ করে৷ এই প্রত্যেকটি কনভেনশনে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা আছে ৷ বাংলাদেশও বিভিন্ন সময়ে এসব কনভেনশন অনুস্বাক্ষর বা অনুসমর্থন দিয়েছে ৷
অথচ আমাদের দেশের শিশুরা এখনও বিভিন্ন কলকারখানায় এমনকি বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত রয়েছে যা তার স্বাস্থ্য, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ৷ এছাড়াও মাদকদ্রব্য উৎপাদন, পাচার, পর্ণোগ্রাফি, পতিতাবৃত্তির ক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহার এবং দাসত্ব ইত্যাদির শৃঙ্খলে বন্দী অসংখ্য শিশু ৷
যদিও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে শিশু শ্রম নিরুৎসাহিত করার সর্বাতœক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ৷ তবে শিশু হিসেবে কাদেরকে বিবেচনা করা হবে সে সর্ম্পকে বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন ধরনের বয়সের উল্লেখ রয়েছে ৷ ১৯৬৫ সালের কারখানা আইনে শিশু হিসেবে চৌদ্দ বছর বয়সের কম বয়সী শিশুকে বিবেচনা করে এ বয়সের শিশুদেরকে কারখানায় নিয়োগ দেওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন আইনে শিল্প কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শ্রমে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
শিশুশ্রমিক নিয়োগ আইনের তফসিলে কিছু উৎপাদন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে যেখানে শ্রমিক হিসেবে শিশুদের নিয়োগে বিধিনিষেধ রয়েছে । (তফসিল, শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন-১৯৩৮)
আইন যা বলে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট
শিশুশ্রম একটি গুরুত্বর ও জটিল সামাজিক সমস্যা। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় সমাজে শিশুশ্রমের আধিক্য নীতি নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে। তাই এ সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এখনই সচেষ্ট হতে হবে।
১৯৯২ সালে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও ) শিশু শ্রম নিরসন বিষয়ক এক আর্ন্তজাতিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৮০টি দেশে এ কর্মসূচী পালিত হয়।
জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন সময়টি হচ্ছে শৈশব ৷ তবুও বিশ্বের প্রচুর শিশুকেই এ সময়ে পারিবারিক প্রয়োজনে শিশু শ্রমে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে ৷ যার পরিণতি অনেকক্ষেত্রেই অসুস্থতা বা ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু। যদিও বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশু শ্রম বিরোধী আইন রয়েছে, তথাপিও প্রয়োজনের তাগিদে আজ অনেক শিশুই শ্রমজীবী ৷
অপ্রিয় বাস্তবতার এই ক্ষেত্রটি প্রতিরোধে উদ্যোগ নেওয়ার সময় আজ এসেছে ৷ এরইমধ্যে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে শিশু শ্রম বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পোষাক রপ্তানী কারক সমিতি (বিজিএমই), ইউনিসেফ এবং আই.এল.ও`র উদ্যোগে গৃহীত পাইলট প্রকল্পের আওতায় ৪২ হাজার শিশুশ্রমিককে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থেকে বের করে এনে পড়াশুনার সুযোগ,কারিগরী প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে ৷
এছাড়াও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামের ৯টি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত প্রকল্পে ৩ হাজার শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ৷ তবে কর্মসংস্থানের জন্য বিনা সুদে দেত্তয়া ঋণ অভিভাবকরাই খরচ করেছেন বলে জানা গেছে ৷
বাংলাদেশে পরিচালিত অধিকাংশ কার্যক্রমই দূর্বল মনিটরিং-এর কারণে ব্যর্থ হয় ৷ তথাপিও সরকারসহ সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা শিশুশ্রমের মতো অমানবিক ক্ষেত্র থেকে শিশুদের পরিত্রাণে যৌথ উদ্যোগ নিতে পারে, গড়ে তুলতে পারে পর্যাপ্ত সচেতনতা ৷
বিধি-৪৬(৯): ১৮ বছরের নিম্নবয়স্ক কোন লোককে বা পর্যাপ্ত শক্তি বা অন্য যেকোন ভাবে চালিত বা চালককে সংকেত দেওয়ার জন্য চালিত হোক না কেন, নিয়োগ করা যাবে না। (কারখানা বিধিমালা-১৯৭৯)
অন্যদিকে ১৯৩৮ সনের শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন কতিপয় পেশায় শিশুশ্রমিক নিয়োগে বাধার কথা উল্লেখ করেছে।
ধারা-৩: কতিপয় পেশায় শিশু শ্রমিক নিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা:
(১) যে সকল শিশুর বয়স পনের বছর পূর্ণ হয়নি তাদের নিম্নোক্ত যে কোন পেশায় নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না :
(ক) রেলযোগে যাত্রী, মালপত্র বা ডাক পরিবহন সংক্রান্ত কাজ (খ) কোন বন্দরের সীমানার মধ্যে মাল উঠানো-নামানো সংক্রান্ত কাজ।
(২) যে সকল শিশুর বয়স পনের বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু সতের বছর পূর্ণ হয়নি তাদের যেকোন দিনের কাজের ঘন্টা যদি এমনভাবে নির্ধারণ না করা হয় যে, এক নাগাড়ে বার ঘন্টার অবসর পাবে এং রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে তাদের উপধারা (১)-এ বর্ণিত কাজে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না।
শর্ত হচ্ছে, উপরোল্লিখিত এমন কোন অবস্থা ও শর্ত সাপেক্ষে পূর্বোলিখিত নির্ধারিত পেশায় শিক্ষানবিসী বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে কোন শিশু নিযুক্ত থাকলে বা তাকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হলে এ উপধারার বিধান কার্যকরী হবে না : আরো শর্ত হচ্ছে, জরুরি অবস্থা এবং জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে (সরকার) সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা ঘোষণা করতে পারে যে, প্রজ্ঞাপন নির্ধারিত সময়ের জন্য এ উপধারার বিধান কার্যকর হবে না:
(৩) যে সকল শিশুর বয়স বারো বছর পূর্ণ হয়নি তাদেরকে তফসিলে উল্লিখিত ধরণের কাজ করা হয় এমন কোন কারখানায় নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না।
শর্ত হচ্ছে, কোন শ্রমিক নিয়োগ না করে কেবল মালিক তার পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ চালালে আথবা (সরকার) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বা সরকারী সহায়তায় বা অনুমোদনে পরিচালিত কোন বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ উপধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না। (শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন-১৯৩৮)
একই আইনের তফসিলে ১০ টি ক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে শিশু শ্রমিক নিয়োগে বিধিনিষেধ রয়েছে।
তফসিল ( ৩, ৩-ক ও ৩-খ) প্রক্রিয়াগুলোর তালিকা ১. বিড়ি তৈরী ২. কার্পেট বুনন ৩. ব্যাগে সিমেন্ট ভর্তিকরণসহ সিমেন্ট উৎপাদন ৪. কাপড় ছাপা, রং করা ও বুনন ৫. দিয়াশলাই, বিস্ফোরক দ্রব্য ও আতশবাজি উৎপাদন ৬. অভ্র কাটা ও ভাঙ্গা ৭. গালা প্রস্তুতকরণ ৮. সাবান প্রস্তুতকরণ ৯. চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ১০. পশম পরিচ্ছন্নকরণ।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৮ ঘণ্টা, ১২ জুন, ২০১১