
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
চট্টগ্রাম: দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার,টেন্ডার বাণিজ্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দলের জেরসহ বেশ কিছু কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অস্থিরতার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন চবির সাবেক কয়েকজন ছাত্রনেতা।
আর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এখানে ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সাবেক ছাত্রনেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের গ্রুপ ও উপ-গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি কারণে গত কয়েকটি বছর কেটেছে নানা অস্থিতিশীল পরিবেশে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ অস্থির থাকার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলো হল দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা, ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশ, ছাত্রলীগের উপর স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে হওয়া ও প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির থাকার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের সঙ্গী হচ্ছে সেশনজট।
ছাত্রলীগের কমিটি নেই দীর্ঘদিন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে গত বছরের ১০ জুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় সংসদ। এরপর থেকে বাড়তে থাকে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল।
কমিটি বিলুপ্তের নয় মাস অতিক্রম হলেও এখনো নতুন কমিটির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি কেন্দ্রীয় সংসদ। ফলে অনেকটা নেতৃত্বশুন্য অবস্থায় কার্যক্রম চালাচ্ছে ছাত্রলীগ। আর এ সুযোগে গ্রুপে উপগ্রুপে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনটি। ফলে অস্থির হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, বাধাগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
তবে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা অন্তর্কোন্দলের কারণেই চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করেছিলাম। মনে করেছিলাম অন্তর্কোন্দল বন্ধ হবে। কিন্তু অন্তর্কোন্দল বন্ধ না করে তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের রেষারেষিতে আরো বেশি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তাই যতদিন পর্যন্ত তারা গ্রুপিং বন্ধ করতে পারবে না কিংবা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এক হতে পারবে না, ততদিন ছাত্রলীগের কোন কমিটি দেওয়া হবে না। ’
ছাত্রলীগের ভেতর শিবিরের অনুপ্রবেশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিভিন্ন গ্রুপ ও উপগ্রুপে বিভক্ত। তারা নিজেদের গ্রুপের শক্তি প্রদর্শন ও সদস্য বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের নিজেদের গ্রুপে টেনে নেয়। এ সুযোগে ছাত্রলীগের গ্রুপগুলোতে শিবির কৌশলে প্রবেশ করে এবং পরে অন্তর্কোন্দল তৈরি করে। ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় শিবির একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই দেশের চলমান সহিংস পরিস্থিতিতেও ছাত্রলীগ কোন্দলে জড়াচ্ছে নিজেদের মধ্যে।
২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষের পর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববৃহৎ ছাত্র হল শাহ আমানত। যা এক সময় শিবিরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দীর্ঘ নয় মাস পর গত বছরের ১৯ নভেম্বর আমানত হলটি খুলে দেওয়া হয়। সে সময় ছাত্রলীগের সঙ্গে সুকৌশলে আমানত হলে প্রবেশ করে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। তাছাড়া একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী তাপস সরকার হত্যার পর ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত শাহজালাল হলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বেশকিছু শিবিরের বই উদ্ধার করে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে বলেন,‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেকে এখন ছাত্রলীগ করছে। কিন্তু তাদের মাঝে কোন আদর্শ নেই, সংগঠনের প্রতি দায়বদ্ধতাও নেই। এরা শিবিরের অনুপ্রবেশকারী। তাই ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কোন্দল বাড়ছে। ’
কমিটি না থাকলে সংগঠনের চেইন অব কমান্ড থাকে না উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘দলের ভেতর কারা সুবিধাবাদি তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। যাদের সংগঠনের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে এবং ছাত্রত্ব আছে তাদেরকে নিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি করলে কোন্দল মিটে যাবে।’
সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে দ্বন্ধ
নতুন কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদটি কোন পক্ষ পাবে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক সংঘাত ও দ্বন্দ্বের অন্যতম মূল কারণ এটি। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, আগামী কমিটিতে মহিউদ্দিনের অনুসারীরা সাধারণ সম্পাদক পদটি পাবেন। বিবাদমান দুটি পক্ষের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে দুটি পক্ষই নিজেদের কাউকে ওই পদে দেখতে চায়। বিবাদমান দুটি পক্ষ হচ্ছে ‘ভিএক্স’ (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) এবং ‘সিএফসি’ (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার)।
নব্বইয়ের দশক থেকে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ দু’টি নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা ভাগ করে নিয়েছে। একবার সভাপতি আজম নাছিরের অনুসারী হলে পরের বার মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এ পদ পান। সে হিসেবে এবার সাধারণ সম্পাদকটি পেতে উভয় গ্রুপ বারবার বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
উপাচার্যের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে হওয়া
২০১১ সালের ১৫ জুন উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে উপাচার্যকে চাপে রাখতে চায়। যাতে উপাচার্যের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়। এর ফলে ছাত্রলীগ বারবার অন্তর্কোন্দলে জড়াচ্ছে। আর এর পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক বেশ কয়েকজন নেতা।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বাংলানিউজকে বলেন,‘উপাচার্যের মেয়াদ এ বছরের জুনে শেষ হয়ে যাবে। তিনি পুনরায় উপাচার্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থিতিশীল রাখার জন্য ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে সকলের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। যার কারণে তাকে চাপে রেখে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির করে ছাত্রলীগের একটি অংশ অনৈতিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। উপাচার্য যদি কোন অনৈতিক সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন তারা (ছাত্রলীগ) গণ্ডগোল পাকায়।’
ছাত্রলীগের উপর স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুরে অবস্থিত হওয়ায় ছাত্রলীগের উপর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের প্রভাব ছাড়াও স্থানীয় নেতাদের প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে ছাত্রলীগের বিবাদমান গ্রুপটি হল ভিএক্স ও সিএফসি।
এর মধ্যে ভিএক্স নিয়ন্ত্রণ করে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন। অন্যদিকে সিএফসি নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির হায়দার করিম বাবুল। তাছাড়া এ গ্রুপটিকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চবির সাবেক সহ সভাপতি আবুল মনছুর জামশেদ।
এসব স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। নিয়ন্ত্রণকারী নেতাদের মধ্যে রয়েছে পরষ্পর বিরোধী সম্পর্ক। এর ফলে একই সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা সাপে-নেউলের মতো। তাই স্থানীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গ্রুপগুলো অন্তর্দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে নাছির হায়দার করিম বাবুল বাংলানিউজকে বলেন,‘আমার উপর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোন সাংগঠনিক দায়িত্ব নেই। ছোট ভাইরা যদি কোন কাজে সহযোগিতা চায়, আমি তাদেরকে সাহায্য করি। গ্রুপিং বা উপগ্রুপিং আমিও পছন্দ করি না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নই আসে না। ’
এরশাদ হোসেন বলেন,‘আমি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা তাই সংগঠনটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে। যারা প্রকৃত ছাত্রলীগ করে তাদেরকে আমি সহযোগিতা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্কোন্দলের পেছনে কিছু লোভী সাবেক নেতা আছে। তারা অনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে সংঘর্ষ লাগিয়ে রাখে। ’
প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। রাজনৈতিক নেতাদের জন্য কঠোর কোন সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। প্রশাসন বলছে কোন্দল যেহেতু ছাত্রলীগের তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখানে কি করার আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ বাংলানিউজকে বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল কিভাবে নিরসন করবে? এটি নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। যারা ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করে। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫