
গল্পের গায়ে নানা সময়ের দাগ, ক্ষত, অহংকার স্বাভাবিকভাবেই লেগে আছে, থাকবে। এতে মানুষের মুক্তির লড়াই সংগ্রাম যেমন আছে, তেমনি মানববিকাশের নানান কথকতা এর গায়ে গেঁথে থাকবে— তাই তো স্বাভাবিক। ১৭৫৬, ১৮৫৭, ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০-এর রাজনৈতিক, সামাজিক কথকতা তো আছেই, আরও নানান ভূ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আবহ আমাদের গল্পে আছে। (কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ২০১২ : ১৯৭)
মূলত, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোটগল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। নানাভাবে গল্পে হাজির হয়েছে সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলো। জাতীয় জীবনে এ ঘটনাবলি প্রভাব বিস্তার করেছে নানাভাবে, চেতনায় জাগিয়ে গেছে মানুষকে, ভূগোল-প্রতিবেশ পাল্টে দিয়েছে আমূল, ফলে গল্পকাররা এইসব সোনালী দিনগুলোকে ফ্রেমবন্দি করেছেন গল্পে—
কখনো সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং তার ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তুদের জীবনসংকট, কখনো বাংলাভাষী মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের বহুবিধ প্রচেষ্টা, আবার কখনো মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা গল্পগুলোর উপজীব্য। (শফিকুর রহমান ২০০৩ : ২১৯)
এই রাজনৈতিক ধারাবহিকতা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ের সংঘাত, স্বদেশ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতিও গল্পে উঠে এসেছে শিল্পিত উপায়ে। নকশাল আন্দোলন, রাজনৈতিক ঘটনা থেকে উৎপাদিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন, পুলিশি নির্যাতন, সন্ত্রাস ও দস্যুতাও গল্পের উপজীব্য হয়েছে।
জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলন। এর প্রভাবে আন্দোলিত হয়েছে জাতীয় জীবন— শহর ও গ্রাম। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ছিল মুসলিম লীগ প্রস্তাবিত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন। তবে, প্রথম থেকেই এটি দ্বিজাতিতাত্ত্বিক হওয়ায়, এর আড়ালে স্ফূরিত ছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণও এটি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ঢাকা শহরের পাশাপশি সমগ্র বাংলাদেশকে আন্দোলিত করেছিল। পাকিস্তান শাসকদের বিভিন্ন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে এবং তাদের শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। এমন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ শহর-গ্রাম সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। তৈরি করে জাতীয় জীবনে সংকট ও সম্ভাবনা।
জাতীয় জীবনের এমন ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলো যাঁদের গল্পে শিল্পিত রূপ লাভ করেছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, মিন্নাত আলী, শওকত ওসমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সরদার জয়েনউদ্দীন, রাহাত খান, বশীর আল হেলাল, জহির রায়হান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, হরিপদ দত্ত, মামুন হুসাইন, শহীদুল জহির—
’৪৭ এর দেশভাগের পর তার (বাংলাদেশের ছোটগল্প) আমূল পালাবদল ঘটে। অবশ্য এই পালাবদল হঠাৎ করে ঘটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ফল— সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দীনতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ... ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৮৫’র সামরিক শাসন এবং পরবর্তীকালে ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০’ র সাধারণ নির্বাচন, ’৭১’র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রভৃতি ঘটনা শিল্পী সাহিত্যিকদের সংবেদনশীল হৃদয়ে ছায়া ফেলেছে। (সরিফা সালোয়া ডিনা ২০০৬ : ৬৩)
মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোটগল্প রচিত হয়েছে। প্রধান-প্রধান গল্পকার যেমন এর প্রেক্ষিতে গল্প রচনা করেছেন, তেমনি নবীন গল্পকাররাও মুক্তিযুদ্ধের উপাদান, অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন প্রবল উৎসাহের সঙ্গে। প্রধান গল্পকারদের অনেকেই যুদ্ধে সরাসরি অংশও নিয়েছিলেন, ফলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চিত্র উঠে এসেছে তাদের গল্পে। এইসব গল্পে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপ্লাবী বিকাশ যেমন আছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অনুষঙ্গ রূপায়িত হয়েছে অত্যন্ত শিল্পসফলভাবে।
শত্রু কবলিত নগরের অবরুদ্ধ মানুষের অসহায়ের চিত্র, স্বদেশভূমি থেকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পালিয়ে বাঁচা মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতা যেমন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে, তেমনি হানাদারের হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের চিত্র, সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব, আত্মদান, গৌরবময় ছবি ফুটে উঠেছে ছোটগল্পের ক্ষুদ্র ক্যানভাসে। (আহমেদ মাওলা ২০১২ : ২১৪)
এসব গল্পে একটা বিশেষ প্রবণতা লক্ষণীয়, যুদ্ধোত্তর সময়ে রচিত হওয়ায় অধিকাংশ গল্পই পেছনে ফিরে তাকানো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময়ের পাশাপাশি কোথাও কোথাও চোখে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমির চিত্রও। এছাড়া, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল প্রভৃতি গল্পে স্থান পেয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশুদ্ধ স্মৃতিকে ধারণ করে এদেশের গল্পকারদের মধ্যে যেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনার ঢল নামে। তখন সমাজ ও জীবনের অন্য কোনো পর্যায় গল্পকারদের তেমন আকর্ষণ করতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পের ধারা দুটি ভাগে বিভক্ত। আজহার ইসলামের (১৯৯৯) মতে, প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের পাকিস্তানী সৈন্য ও পকিস্তানপন্থীদের নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে যেসবগল্প রচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে যে শূন্যতা আসে হঠাৎ ক্ষমতা পাওয়ায় কিছু ব্যক্তির প্রভুত্ব বিস্তারে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়, এই অবস্থায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধদের হতাশা ও মানসিক বিপর্যয়, নয় মাসের প্রবাস জীবন শেষ করে স্বদেশে ফিরে আসা লোকদের দুর্দশা— এসব বিষয় নিয়ে যেসব গল্প রচিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের গল্পে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উজ্জ্বলভাবে বিধৃত হওয়ায় ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে সেসব গল্পের মূল্যায়ন বিশাল। প্রাসঙ্গিকভাবেই তাই এ পর্যায়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বের রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করবো, যার সরাসরি প্রভাব গল্পে পড়েছে।
মূলত, ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্রিটিশ সংস্কারের বিভেদনীতি, মুসলিমলীগের বিরোধিতা প্রকৃতির কারণে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যা লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ৫০ এর দশকের শুরু থেকেই বাংলার মুসলিমলীগ নেতৃত্বে দেখা দেয় দ্বিধাবিভক্তি। নানা রাজনৈতিক জটিলতার কারণে ১৯৪৬ সালে লাহোর প্রস্তাব বাতিল করা হয়। পরিশেষে ব্রিটিশ শক্তির নীল নকশা অনুযায়ী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় তথা ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত-বিভক্তি করে। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের। এর ফলে বিভক্তি ঘটে অখণ্ড ভারত রাষ্ট্রের ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলো। কিন্তু ধর্মের মিল ছাড়া এই রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। দেশবিভাগের পর থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র চলছিল। তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। এমনকি ২য় অধ্যায়ে ৬০-এর দশকের ছোটগল্পে জাতীয় জীবনের দৈনন্দিন অনুষঙ্গ আলোচনাকালে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) পর্যন্ত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। তবুও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পে জাতীয় জীবনের শিল্পরূপ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা আরো ধারণা নিতে পারি।
১৯৬২ সালে নতুন শাসনতন্ত্র চালু করেন (আইয়ুব খান)। চরম এককেন্দ্রিকতা, একনায়কতন্ত্র, পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রভৃতি সম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্টকেই কেবল মহাশক্তিধর ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। (রিষিল পরিমল ২০০৭ : ২৫৯)
যা পূর্ববাংলার জনগণ মেনে নেয় নি। ফলে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। এমন পরিস্থিতিতে স্বৈরশাসক আইয়ুক খান ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা করেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক (প্রগতিশীল) দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলে আইয়ুব সমর্থিত প্রার্থীরা সহজেই জয়লাভ করে। ৮ জুন তারিখে জাতীয় সংসদের সভা বসলো এবং ওই দিনই সামরিক আইন উঠে গিয়ে নতুন সংবিধান চালু হলো। এরপর ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী মারা গেলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার পদক্ষেপ নেন। ১৯৬৪ সাল থেকেই ১৯৬৫ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলে।
‘শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে লাহোর সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। আইয়ুব খান এই দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন।’ (প্রফেসর সালাহউদ্দীন ও অন্যান্য ১৯৯৭ : ১৩৩-১৩৫) ফলে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় আগরতলা মামলা। ছাত্ররা তাঁর মুক্তির জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। এরপর ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার গণআন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ইয়াহিয়া খানের কাছে। এরপর ’৭০ এর নির্বাচন নিয়ে নানা টালবাহানা। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে পূর্ববাংলা। প্রতিহত করতে ২৫ মার্চ রাতে বাংলা আক্রমণ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এরপর দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
আহমেদ মাওলা (২০১২) তথ্য দেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম গল্পসংকল্পন করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী— বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১)। এটি কোলকাতা থেকে বের হয়, পরে অবশ্য বাংলাদেশ সংস্করণ হয়। এছাড়াও রয়েছে আবিদ রহমান সম্পাদিত প্রেক্ষাপট ৭১ (১৯৭৯); শওকত ওসমান ও শামীমা হাসিন সম্পাদিত প্রতিবিম্বে প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৮২); আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩); হারুন হাবীব সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫) প্রভৃতি সংকলন। এছাড়া গল্পকারগণ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচনা করেছেন একক গল্পগ্রন্থ। এদের মধ্যে শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), আলাউদ্দিন আল আজাদের আমার রক্ত স্বপ্ন আমার (১৯৭৫), হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), বিপ্রদাস বড়ুয়ার যুদ্ধ জয়ের গল্প (১৯৮৫), এহসান চৌধুরীর একাত্তরের গল্প (১৯৮৩), আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭), আবু বকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তবে বিশ্বজিৎ ঘোষের (২০১২) তালিকাটি আরো বড়, সেখানে আরো যাদের নাম আছে তারা হলেন— সৈয়দ শামসুল হক (জলেস্বরীর গল্পগুলো, ১৯৯০), এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে যেসব গল্প বিশেষভাবে স্মরণীয় তার একটি তালিকা করেছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ (২০১২), সত্যেন সেন (পরিবানুর কাহিনী), তাজুল ইসলাম ফিরোজ (সপ্তর্ষী অনেক দূরে), মঞ্জু সরকার (শক্তি বর্ধিত হোক), শওকত আলী (সোজা রাস্তা অকাল দর্শন), আফসান চৌধুরী (ফাটা শহরের গল্প), সিরাজুল ইসলাম (দূরের বেলা), রাহাত খান (মাঝখানের চর), রশীদ হায়দার (কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা), মীর নূরুল ইসলাম (স্বৈরিণী ফিরে এলো), কায়েস আহমেদ (আসন্ন), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (অপঘাত), সেলিম হোসেন (আমিনা ও মদিনার গল্প), মাহমুদুল হক (কালো মাফলার), মঈনুল আহসান সাবের (কবেজ লেঠেল, ভুল বিকাশ), সুচরিত চৌধুরী (নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত), আবদুল গাফফার চৌধুরী (কেয়া আমি এবং জারমান মেজর), জহির রায়হান (সময়ের প্রয়োজনে), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (পুঁই ডালিমের কাব্য), আমজাদ হোসেন (উজানে ফেরা), হুমায়ূন আহমেদ (শীত, উনিশ’শ একাত্তর), রিজিয়া রহমান (ইজ্জত), হুমায়ুন আজাদ (যাদুকরের মৃত্যু), মামুন হুসাইন (মৃত খড় ও বাঙাল একজন) প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ছোটগল্পগুলোতে যে চিত্র পাওয়া যায় তা খণ্ড খণ্ড চিত্র, সামগ্রিক চিত্র নয়। যদিও সবগুলো গল্প মিলিয়ে দেখলে এর মাধ্যমেও মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতা ও জাতীয় জীবনের প্রভাব অনেকটা স্পর্শ করা সম্ভব। শফিকুর রহমান (২০১৩) তথ্য দেন যে, নিম্নলিখিত ছোটগল্পগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লিখিত হয়েছে কিংবা প্রাসঙ্গিকতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তাই নয়, বরং এগুলো যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গ্রামজীবনের বাস্তবিক চিত্রকে বহু দিক দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নীরবতা’, ‘দূরযাত্রা’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘দেওনিয়া’, মিন্নাত আলীর ‘জতুগৃহ’, ‘সব দৃহী বাত’, হাসান আজিজুল হকের ‘ফেরা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘রফি’, ‘ঘর গেরস্থি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না’, ‘আজাহারের মাতৃশোক’, ‘জলেশ্বরীর দুই সলিম’, রাহাত খানের ‘দুঃখিনী কমলা’, ‘এই বাংলায়’, সেলিনা হোসেনের ‘পরজন্ম’, ‘ঘৃণা’, ‘ভিটেমাটি’, রশীদ হায়দারের ‘চেহারা’, ‘সাঁকো’, রিজিয়া রহমানের ‘জামালপুরের চিঠি’, ‘সেই পাখির গান’, সুশান্ত মজুমদারের ‘নিজস্ব মেদিনী’, ‘একাকার’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’, মহীবুল আজিজের ‘হোমো সেপিয়েন্সে’, মুস্তফা পান্নার ‘রথমেলা’, হরিপদ দত্তের ‘জোয়াল ভাঙার পালা’, ‘ধ’, মামুন হুসাইনের ‘এ এক পুনরুত্থান’ প্রভৃতি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী নানা ঘটনার রূপায়ণ দেখা যায় আলাউদ্দিন আল আজাদের বেশ কয়েকটি গল্পে। গল্পগুলো হলো— ‘রূপান্তর’, ‘নীরবতা’, ‘দূরযাত্রা’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘সংক্ষিপ্ত রূপ’, ‘যুদ্ধ নয়’, ‘বিস্ফোরণ’, ‘আগন্তুক’, ‘আমার রক্ত’, ‘আমাকে একটি ফুল দাও’, ‘নাকফুল’, ‘স্বপ্ন আমার’, ‘জলনাঙ্ক’, ‘কাক’ প্রভৃতি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে বর্বর পাকবাহিনীর নারকীয় গণহত্যার কাহিনী নিয়ে ‘যুদ্ধ নয়’ গল্পটি রচিত। ‘জন’ নামক একটি কুকুরের জবানীতে গল্পের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এখানে ২৫ মার্চের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ছাড়া আরো যে সমস্ত প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে তা হল ১৯৭০ সালের নির্বাচন উত্তর ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। ষড়যন্ত্র ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রক্রিয়া প্রভৃতি। সেই ভয়াল দৃশ্য—
কয়েকটি মুহূর্ত, সশব্দে এসে একটি জিপ থামলো কিছু দূরে তারপর একটি ক্রুদ্ধস্বর সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলোর দৌড়াদৌড়ি আর্তচিৎকার কিন্তু পালাবে কোথায়? পেট্রোল ছড়িয়ে মারছে ধুমসে আগুনের গোলা, অল্পক্ষণেই দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো সারাগলি। (আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০০ : ২৬৪)
‘বিস্ফোরণ’ গল্পটি মার্চের কাহিনী নিয়ে রচিত। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও ক্ষমতালোভী পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এঁদের এই ষড়যন্ত্রমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। সমস্ত দেশবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। মূলত লাখো জনতার সে বিস্ফোরণই এখানে শিল্পরূপ লাভ করেছে—
বিস্ফোরণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই এখন এবং শেষ মুহূর্তে ঘটলোও তাই। আলোচনার জন্য ভাওতামাত্র। সময় ক্ষেপণের ভাওতা, সময় প্রস্তুতির জন্য। ফিলসফির ছাত্র কেমন করে হলো এমন গাণিতিক। কিন্তু চিবুকটা ক্রমে কঠিন হয়ে উঠেছিল, সে বিড়বিড় করলো, অস্ত্র কিনেছে আমাদেরই ঘামের পয়সায় এবং সেই অস্ত্র আমাদেরই বুকে মারছে ওরা। (আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০০ : ২৬৬)
‘নীরবতা’ গল্পে আছে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের চিত্র। তুফানী নামক এক তরুণী দখলদার পাক সেনাদের বিকৃত লালসার শিকারে পরিণত হয়। তুফানীর ভাই মুক্তিফৌজ, আর সে কারণেই তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাকে জীবিত অবস্থায় পেতে হলে ক্যাম্পে যেতে হবে তুফানীকে। ‘নুরা’ নামক এক রাজাকার দালাল এসে খবর দেয় যে, তুফানী মেজরের নৌকায় গেলে তার ভাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। সত্যিকার অর্থেই তুফানী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজির হয় মেজরের নৌকায় এবং সেই মেজরকে সঙ্গে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়। নদীর খরস্রোতে দু’জনেই ভেসে যায়। গল্পের ভাষায়—
আমি জানি কেউ বলবে না তুফানীর কথা, উচ্চরণ করবে না নাম ওর, ছবি ছাপা হবে না তরুণ সাংবদিকের রোমাঞ্চকর গল্পের সংবাদপত্রের শেষের পাতায়। স্মরণ করবে না জিভে জিভে প্রশংসিত আধুনিক কবি, কিন্ত তার জন্য থোরাই কেয়ার, সভ্যতার বহু দূরে শস্য গাছ-গাছালি পাখির গলায় হলুদে সবুজে এবং সাগরের টানে অনিঃশেষ নিরিবিলি স্রোতে যে নীরবতা, তাই ওর অমর জীবনচরিত। (আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০২ : ২৪১)
সৈয়দ শামসুল হকও মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বেশ কিছু গল্প রচনা করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয় জীবনের যে চিত্রগুলো এঁকেছেন তা দেশের সমকালীন প্রত্যেকটি অনুভূতিশীল মানুষের স্মৃতিপটে আজো জ্বলজ্বল করছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে এমন গল্প ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’। মুক্তিযুদ্ধের সময় জনৈক যুবক আকবর হোসেন মাদারবাড়ি ঢুকবার মুখে অশ্বথ গাছের ডালে তিনদিন তিনরাত অপেক্ষা করে পাকিস্তানী সৈন্যকে খতম করে। এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিরোমন্থন করে গ্রামবাসী—
আকবর হোসেন মাদারবাড়ি ঢুকবার মুখেই অশ্বথ গাছের ডালে তিন দিন তিন রাত অপেক্ষা করেছিল এবং তিন দিনের পরে সেই অশ্বথের নিচে যখন বিশ্রাম নিতে বসেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা, একা সে তাদের প্রত্যেককে খতম করেছিল বহু বৎসর আগে। (সৈয়দ শামসুল হক ২০১০ : ৪২৪)
বর্তমানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হলেও পাকিস্তানি মৌলবাদী আগ্রাসন থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। সমাজের এরকম একটি নিরীক্ষণ ফুটিয়েছেন লেখক ‘জলেশ্বরীর দুই সলিম’ গল্পে। প্রকাশ্যে জন সভায় মৌলবাদী শ্রেণিরই একজন পাকিস্তানি শাসন কায়েমের শ্লোগান দেন। তার এই শ্লোগান বাঙালি জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, প্রশ্নবিদ্ধ হন লেখক নিজেও—
ব্যাপারটা হচ্ছে জলেশ্বরীতে এক সভা, বেশ বড়সড় এক হুজুর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, বক্তৃতার শেষে তিনি বলে বসলেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। এখন কথা হচ্ছে, দেশটা পাকিস্তানের নয়, বাংলাদেশ। বক্তৃতা তিনি দিচ্ছেন বাংলাদেশে আর বাংলাদেশ হয়েছেও বছর পনের। হুজুর কি করে এখানে বাংলাদেশের বদলে পাকিস্তান দেখলেন? (সৈয়দ শামসুল হক ২০১০ : ৪৩৯)
হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ক গল্প নিয়ে সরিফা সালোয়া ডিনা (২০০৬) তথ্য দেন যে, হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত গল্পগুলো তিনটি গ্রন্থে গ্রন্থিত, নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৯), এবং রোদে যাবো (১৯৯৫)। নামহীন গোত্রহীন গ্রন্থে গল্পের সংখ্যা সাত। সবকটি গল্পের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। ঘটনার প্রবহমানতার দিক দিয়ে এই সাতটি গল্প প্রাসঙ্গিক যোগসূত্রে গ্রথিত। গল্পগুলোতে যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কাল এবং পরবর্তী কিছু সময়ে এদেশের অবস্থা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিধৃত হয়েছে। গ্রন্থের শুরুর গল্প থেকেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দানা বেঁধে ওঠে। এসব গল্পে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বস্তুনিষ্ট বিবরণ ও শত্রু-প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড চিত্র অঙ্কিত। লেখকের চিত্রিত শ্রেণিতে ‘আশা’ মূল বিষয়। তারা হতাশ নয়; হতাশা এলেও তার দ্রুত উপশম ঘটায়— মোটকথা তারা সম্ভাবনাময়। আমরা অপেক্ষা করছি গ্রন্থের সাতটি গল্পের মধ্যে ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ ও ‘মাটির তলার মাটি’ গল্পে যুদ্ধোত্তর বালাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত ও স্বৈরশাসন উপজীব্য। এই গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প দুটিতে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে স্বাধীন দেশের বিভিন্ন অসংগতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক দুরবস্থা, জীবননাশের অব্যবস্থা প্রকৃতি ও নব্য সৃষ্ট শোষকগোষ্ঠীর উৎখাতে বিপ্লববাদে বিশ্বাসী যোদ্ধাদের যুদ্ধও বর্ণিত হয়েছে। রোদে যাবো গ্রন্থের ‘ঝড়’, ‘নবজাতক’ ও ‘নিশীথ ঘোটকী’ শীর্ষক গল্প তিনটির বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের প্রেক্ষিতে ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষের পলায়ন, নিরাপত্তাহীনতা, হত্যাযজ্ঞ প্রভৃতি গল্পগুলোর উপজীব্য।
‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রামাণ্য দলিল স্বরূপ। গল্পের ‘লোকটা’র স্পষ্ট কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সে শহরকে জনমানবশূন্য দেখে, বন্ধুর বাড়িতে খুঁজে কাউকে পায় না, নিজ বাড়িতে স্ত্রী মমতা ও ছেলে শোভনের পুঁতে রাখা মৃতদেহের হাড়গোড় খুঁজে বের করে। এ থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধের প্রাক্কালে লোকটা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার স্ত্রী-পুত্র পাকিস্তানি বহিনীর নির্যাতনের শিকার। দীর্ঘদিন পর, সম্ভবত নভেম্বর মাসে, লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের ধরন অনুধাবন করা যায়। গল্পের শেষে কোদাল চালিয়ে সে পুত্র-স্ত্রীর হাড়গোড় উদ্ধার করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারায়—
সে প্রচণ্ড কোদাল চালাচ্ছে। ...খুঁজতে খুঁজতে একা ছোট্ট হাড় পেয়ে গেলে সেটাকে তুলে আপনমনেই লোকটা বলল, শোভন, শাবাশ। ...ছোট ছোট পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত নিতম্বের হাড় তারপর একটি করোটি। ...মমতা লোকটা বললো। বলে সেটা পাশে নামিয়ে রেখে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে মাটি খুঁড়তে লেগে গেল। পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ সে বাইরে বের করে আনবে। (হাসান আজিজুল হক ২০০৮ : ১৮২)
যুদ্ধ অবরুদ্ধ এদেশের শপথদৃপ্ত পাঁচ তরুণের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পে। জামিল ইউনিভার্সিটির ছাত্র, একরাম স্কুলছাত্র, মতিয়ুর ক্ষেতমজুর, শহীদ কলেজ ছাত্র আর রহমান চাষী। এদের সবার মধ্যে জামিলেরই যুদ্ধ সম্পর্কে সম্যক ও স্পষ্ট উপলব্ধি রয়েছে। জামিল যুদ্ধের বীরত্বের ঘটনা শোনায়। তাদের পিছনে ধাবমান সেনাবাহিনীর বহর তাদের না পেয়ে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। নির্বিচারে মানুষকে গুলি করে, নারীদের ধর্ষণ করে ও ধনসম্পদ লুট করে। শেষ পর্যন্ত এই যোদ্ধাদল পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা ঘেরাও হলে জামিল ছাড়া বাকি চারজন গুলিতে নিহত হয়। জামিল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যায়। তার বেঁচে যওয়ার মুহূর্তের ঘটনা—
ক্রমাগত রাইফেলের আওয়াজ হতে থাকলো। আট দশটা রাইফেল এক সঙ্গে গজরাচ্ছে। সাঁই-সাঁই করে মাথার উপর দিয়ে বুলেট যাবার শব্দ পেল জামিল। তার শরীর থেকে পাঁচ দশ ইঞ্চি দূরে দূরে বুলেট জলে পড়ছে তাও টের পেল সে। (হাসান আজিজুল হক ২০০৮ : ১৯৯)
‘ফেরা’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের মুক্তিযোদ্ধাদের চরম হতাশা-নৈরাশ্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। যুদ্ধ শেষে কৃষক আলেক গৃহে ফিরে আসে। যুদ্ধে পায়ে গুলি লাগায় অপারেশনের মাধ্যমে সেলাই দেওয়ায় পা কিছুটা ছোট হয়েছে। কিন্তু বেনেপুরের আমিনের ডান পা কেটে ফেললে সমস্ত শরীর পঁচে সে মারা যায়। যুদ্ধফেরত ছেলেকে নিয়ে পরিবারের মা ও স্ত্রী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। এবার সরকার তাকে পুরস্কৃত করবে, কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না তাদের। অথচ কয়েক দিনের মধ্যেই উচ্ছ্বাসটা পানসে হয়ে যায়। একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিনের মধ্যে অস্ত্র ফেরত দিতে বলা হয়, কিন্ত আলেক ফেরত না দিয়ে বাড়ির পাশের ডোবায় রাইফেলটি ছুঁড়ে ফেলে যাতে প্রয়োজনের সময় খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়। মূলত, আলেক জীবনজিজ্ঞসার সম্মুখে অসহায় হয়ে হতাশায় এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ নয়, সে ক্ষুব্ধ সমাজে নতুন জন্ম নেওয়া শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। তাই আলেক বিপ্লবের লক্ষ্যে সর্বহারা মানুষের সহযাত্রী। তাকে ঘিরে মায়ের কত নতুন স্বপ্ন ছিল, কিছুই পূরণ হলো না নতুন বাস্তবতার মুখে—
আমি আমার এই ভিটের চেহেরা ফেরাবো আলেক কয়ে দেলাম আর জমি নিবি এট্টু। এট্টা গাই গরু আর দুটো বলদ কিনবি। (হাসান আজিজুল হক ২০০৮ : ২০৬)
এভাবেই গল্পকার মুক্তিযুদ্ধকে এদেশের নাম গোত্র বাস্তুহীন অসংখ্য মানুষের জীবনাবর্তন পরিবর্তনের প্রত্যাশার সাথে একাত্ম করে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটে নি। তবুও আশা ও হতাশা ছাড়ে না মানুষরা।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘রেইনকোর্ট’, ‘অপঘাত’ প্রভৃতি গল্পে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও ঘটনাবলি স্বতন্ত্র মাত্রা লাভ করেছে।
রেইনকোর্টের প্রতীক গল্পকার মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষের অবিনাশী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার রূপ দিয়েছেন। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ গল্পে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নানা সমস্যা, এক শ্রেণির মানুষের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার নেশা স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ম্লান করে দিয়েছিল। আব্বাস পাগলা এ গল্পে (২০১০) অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষগুলোর প্রতিনিধি, সে বিকৃত মস্তিষ্ক অবস্থায় দেশের কথা ভাবে কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর ভণ্ডামী তাকে গ্রাস করে।
‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ গল্পের মধ্য দিয়ে দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করতে পারা যায়, ৭১ এবং বর্তমানকে। পুরনো ঢাকার দুই বন্ধু ইমামুদ্দিন ও লালমিয়া দুজনই বাল্যবন্ধু ছিলো। ইমামুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, দেশ মাতৃকাকে বাঁচাতে সে এগিয়ে যায়, কিন্তু লালমিয়া যায় রাজাকারদের দলে। ইমামুদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ কাসেম ওরফে বুলেট সাহসী পিতার সন্তান হয়ে বেঁচে থাকে। এ গল্পে (২০১০) আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ঘৃণ্য রাজাকারদের দিকে তাক্ করে ঘৃণার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত কায়েস আহমেদের গল্প ‘পরাণ’। দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু স্বাধীন হলো না দেশের মানুষ। দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ, চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, খুন, ধর্ষণের মাধ্যমে ঘটলো মানবতার চরম বিপর্যয়। তাই সংখ্যালঘু হরেন্দ্র মাঝি ক্ষোভ প্রকাশ করে—
এই দ্যাশে আর থাকোন যাইবো না, ... শ্যাক সাবরে ভোট দিলাম সুখে থাকনের লেইগ্যা.. অহন দ্যাখতাছি চোর দাউরের রাজত্ব। (কায়েস আহমেদ ১৯৯৩ : ১১৭)
এই ভয়ঙ্কর কালের থাবায় ভেস্তে যাচ্ছে হিন্দু জেলেজীবনের আনন্দ আয়োজন। আলোরানীদের হতে হয় ধর্ষিত।‘নচিকেতাগণ’ গল্পে তিনি ২৫ শে মার্চ কালোরাতের গণহত্যার বীভৎস রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। সরু একটি বাথরুমে বন্দী কলেজ ছাত্র শাহীন, ‘জুলিয়াস ফুচিক’, আতিক ভাই গল্পের কথকসহ ১৬ জন। এদের মধ্য দিয়ে কায়েস আহমেদ উপস্থাপন করেছেন পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচারের বীভৎস রূপ। কিন্তু শত অত্যাচার দমিয়ে দিতে পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে—
চোখ উপড়ে নিয়েছে, দু’হাতের সবগুলো আঙ্গুল কেটে ফেলে দিয়েছে...। ওই যে শাহীন ভয়ে গোঙাচ্ছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে ওর প্রতিটি গোঙানি, শরীরের প্রতিটি কম্পনের মধ্যে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। (কায়েস আহমেদ ১৯৯৩ : ২০৫)
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘মুক্তিযোদ্ধারা’ গল্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নভঙ্গের গল্প। এই গল্পের কথক, রেণু, মনোয়ারা, বাদল প্রমুখ বিদেশে বসবাসরত বাঙালিরা প্রচারপত্র, পুস্তিকা নিয়ে যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য ভিন্ন শহরে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যে গাড়ি বাস্ট হওয়ার কারণে তারা আশ্রয় নেয় এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায়। আশ্রয়কর্তা তাদের উদ্দেশ্যাবলী জানতে পারলে তাদের প্রতি বিরাগভাজন হয়। এতে তারা সে স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বৎসর পরে যখন এক ২৬ শে মার্চ সেই শহরে স্বাধীনতা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিল সেই স্বাধীনতা বিরোধী লোকটি। অথচ একদিন আশ্রিতদের প্রতি তার প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম—
সম্ভবত আমাদের গন্তব্য অমন ভাবাচ্ছে তাকে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলা প্রচারপত্র, পুস্তিকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম, সে সব দেখে তার মুখ আরও গম্ভীর হয়েছিল। আমার অসুবিধা আছে— সংক্ষেপে মন্তব্য করলেন তিনি। (জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ২০০৮ : ১৫০)
এভাবেই এককালের স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বাধীনতা লাভের পর দেশপ্রেমের মুখোশ পরে সুবিধা নিতে থাকে, আর প্রকৃত যোদ্ধারা হতাশা আর গ্লানিতে চোখ বন্ধ করে নীরবে সহে।
মাহমুদুল হকের ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পের সবুজ ও আলতাফ চরিত্র দুটিতে— সবুজ যে কিনা একসময় ছিল চৌকষ খেলোয়াড়, বিতার্কিক, যে কিনা ভালো ছবি আঁকতো, কবিতা পড়তো, আজ সেই হয়ে গেছে নিষ্ক্রিয়—
আমি মৃত্যুকে ভয় পাই আলতাফ। সত্যি বলছি ভয় পাই। পঁচিশ মার্চের ক্র্যাক ডাউন না হলে কখনো হয়তো জানতেও পারতাম না, জীবনকে এতো ভালোবাসি; এবং ভয় করি মরণকে। (মাহমুদুল হক ২০১০ : ১২৩)
অন্যদিকে আলতাফও উত্তর দেয়—
চিলমারী অপারেশনে থাকলে বুঝতিছ, মৃত্যু কত তুচ্ছ ব্যাপার, মৃত্যুকে নিয়ে কিভাবেই না ছেলেখেলা করেছিলাম আমরা, প্রাইভেট আর্মির দস্যুরা। মরণকে আবার ভয় কি রে? (মাহমুদুল হক ২০০০ : ১২৩)
জহির রায়হান ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধার ডায়রি তুলে ধরেছেন; তাতে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানিদের বর্বরতার পরিচয় আছে, আছে বাংলাদেশের ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের পলায়নের চিত্র।
সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’ গল্পে স্বাধীনতাবিরোধী এক রাজাকার জগলুর উত্থানের কাহিনী এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালেও তার প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্বের কথা বলা হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার দোকানের সামনে তার চাল ডালের বিরাট আড়ত।
গ্রামের সবাই জানে রাতের অন্ধকারে ট্রাক ভর্তি চাল সীমান্তের ওপারে যায়। ওর গায়ে হাত দেবার ক্ষমতা কারো নেই। লতিফের বয়সী জগলুর এখন দবদবা অবস্থা। মোটা শরীরে অঢিল চিকনাই। অনেক খুঁজে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করেছে। ছেলের বাপ হয়েছে। ওর মা চিকন পাড়ের শাড়ি পরে। (সেলিনা হোসেন ১৯৯৩ : ১৭৭-১৭৯)
সেই জগলু ঘোষণা করে ওর দোকানের আশপাশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার দোকান থাকতে পারবে না। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পরে একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম অনুসারে ছেলেরা বাজারের নাম দিয়েছিল শহীদ লতিফ সড়ক। স্বাধীন দেশে প্রভাবশালী এই রাজাকার জগলু সেই ফলক ভেঙে ফেলে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যে পাকহানাদারদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু ছিলো এবং বাঙালি মুলমান সম্প্রদায়কে যে তারা পুরোপুরি মুসলমান মনে না করে হিন্দু সংশ্লিষ্ট মুসলমান মনে করতো, সেটার ইঙ্গিত পাওয়া যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’ গল্পে। গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে শাহজাহান টাইফয়েডে মৃত্যুবরণ করলে তার স্বাভাবিক দাফন-কাফনে বাধা দেয় হানাদার বাহিনী। তাদের ভাষায়—
** বাকি অংশ