
ছবি : নূর /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আবদুল্লাহ জহির বাবু। বর্তমান সময়ে বাংলা সিনেমার সবচেয়ে ব্যস্ত কাহিনী লেখক। ১৯৯২ সাল থেকে আজ অবধি টানা ছবির গল্প লিখে আসছেন। তার লেখা এখন পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ২৪৭। ‘কুলি’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘দুই বধু এক স্বামী’, ‘অন্ধ ভালোবাসা’ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে ‘অগ্নি’, ‘রাজত্ব’সহ অসংখ্য হিট ছবি উপহার দিয়ে আসছেন দর্শকদের।
বাংলানিউজের বিনোদন বিভাগ তার সাথে বাংলাছবির কাহিনী লেখা, ব্যক্তিগত জীবন এবং বর্তমান ব্যস্ততাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছে।
লেখালেখির শুরুটা কি সিনেমা লেখার মাধ্যমে?
বাবু : আমার বাবা মরহুম জহিরুল হক ছিলেন একজন মুভি পাগল লোক। তিনি পিডব্লিউডি’র ইঞ্জিনিয়ার থাকার পরেও তা ছেড়ে দিয়ে অভিনয় ও ডিরেক্টরের খাতায় নাম লেখান। আর বাবার সাথে সাথে আমি ১৯৭৬ সাল থেকে ছবি দেখা শুরু করি।
আমার বয়স তখন ৬ থেকে ৭ বছর হবে। বাবা আমাকে ছবি দেখার পর গল্পটা ভালোভাবে বুঝাতেন। এই যেমন কোন আর্টিস্ট এর অভিনয় ভালো, কিভাবে কাহিনীতে কি ঘটল-এসব আর কি। আর আমরা ৭৮-৭৯ সালে যখন বাসায় ভিসিআর হাতে পেলাম, তখন ছবি দেখার পরিমাণও বেড়ে গেল। বিশেষ করে আমার বাবা এমন কোন দেশের বিখ্যাত ছবি নাই যেগুলো আমাকে দেখান নি। প্রতি রাতে আমরা প্রায় ৩টা করে মুভি দেখতাম। এটা তো গেল ছবি দেখার কথা, আর লেখার সুযোগটা কিভাবে শুরু হলো ?
বাবু : সেটা ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাস হবে। তখন বাবা তার পরিচালিত শেষ ছবি ‘তুমি আমার’ পরিচালনা করবেন। আমি দেখলাম সেসময় বাবা খুব চিন্তিত। জানতে চাইতেই বললেন প্রযোজককে গল্প শুনাতে হবে-এ ছবির গল্প লেখা নিয়ে টেনশনে আছি। তারপর আমি বললাম গল্প আমার কাছে আছে। এরপর বাবাকে গল্পটা শুনালাম। বাবা শোনামাত্র আমাকে রাতের মধ্যে লাইনআপ তৈরি করতে বললেন। এরপর সারারাত ধরে লিখলাম। আমি ও আমার বোন (মেহজাবিন) মিলে গল্পটা লিখে শেষ করি। সেটাই ছিল আমার জীবনের লেখা প্রথম কোন ছবির লাইনআপ। প্রযোজক ছবিটির গল্প পছন্দ করলেন। এরপর তো শুটিং শুরু।
বাবাই কি ফিল্মে আসার পেছনে বড় অবদান হিসেবে ছিলেন?
বাবু: অবশ্যই। বাবা আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বাবা আমার জীবনে ছবি দেখার অনুপ্রেরণা থেকে শুরু করে প্রথম প্রেমের উপন্যাস, এডাল্ট বই পর্যন্ত হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এর বাইরে ফিল্মে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল একে এম জাহাঙ্গীর আর পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবরের।
ক্যারিয়ারে আপনার লেখা হিট ছবিগুলোর মধ্যে কি কি ছিল?
বাবু : অনেক ছবিই তো ছিল। এরমধ্যে শুরুর দিক থেকে ‘তুমি আমার’, ‘কুলি’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘বিচ্ছু বাহিনী’, ‘দুই বধু এক স্বামী’, ‘মনের জ্বালা’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’, ‘ভয়ংকর বিষু’, ‘কাজের মানুষ’, ‘কি যাদু করিলা’, ‘সন্তান আমার অহংকার’, ‘ভালোবাসার রং’, ‘অন্যরকম ভালোবাসা’, ‘পোড়ামন’, ‘অগ্নি’, ‘রাজত্ব’ সবইতো আমার লেখা। আর এপ্রিলে মুক্তি পাচ্ছে 'দবির সাহেবের সংসার'।
পড়াশুনা কোথায় ছিল ?
বাবু: ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি। তবে চলচ্চিত্রের কারণে কোন চাকরি করা হয়ে ওঠেনি।
বর্তমান সময়ে যে গল্পগুলো লিখছেন সেগুলোর কি বছরজুড়ে পরিকল্পনা থাকে?
বাবু: আমি একটু বলি; আল্লাহর অশেষ কৃপায় শাহিন-সুমনের শাহিন ভাইয়ের মাধ্যমে জাজ এর আব্দুল আজিজ ভাই এর সাথে আমার দেখা হয়। ২০১০ সালে তখন আমি রীতিমত চাকরি খুঁজছিলাম। ছবি হচ্ছিল না তখন, আমি লিখে কি করব। শীষ মনোয়ার ও আজিজ ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের পর দেখলাম আজিজ ভাই এর স্টোরি লাইন এর চয়েজটা একটু ভিন্ন। তারপর থেকে তাদের সাথে আমার স্টোরি আইডিয়া শেয়ার করা শুরু। এরপর তো ‘ভালোবাসার রং’, ‘অন্যরকম ভালোবাসা’, ‘পোড়ামন’, ‘দবির সাহেবের সংসার’সহ বেশকিছু ছবির কাহিনী লিখি। ছবির কাহিনী লেখা, জমা দেওয়া ও শুটিং শুরু করাসহ অনেক কিছু মিলে পুরো বছরের একটা পরিকল্পনা থাকে।
বর্তমানে কি রকম ব্যস্ততা?
বাবু: ব্যস্ততাও অনেক। এ বছর জাজ এর বেশকিছু ছবির কাজ হাতে নিয়েছি। ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অগ্নি-২’, ‘ড্রিমগার্ল’, ‘আই ডোন্ট কেয়ার’, ‘প্রেমের কাজল’, ‘ওয়ানওয়ে’। এছাড়া ইফতেখার চৌধুরী, জাকির হোসেন রাজু, ওয়াজেদ আলী সুমন, সাফিউদ্দিন সাফি এবং শাহাদৎ হোসেন লিটন এর দুটি ছবি নিয়েও কাজ করছি।ভিন্ন একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই, লেখক হিসেবে নতুনরা কেন উঠে আসছে না?
বাবু: নতুনরা পরিশ্রম করতে চায় না। তারা মনে করে, আজ স্ক্রীপ্ট লিখবো কাল জহির বাবু, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী হয়ে যাবো। লিখলেই দেড়লাখ টাকা করে পাবো প্রতি স্ক্রীপ্ট-এ। আর তারা পুরোপুরি আমাদের দেশের হলের দর্শকের টেস্ট ধরতে পারে না। নকল হচ্ছে, আমরাও করি। তবে সহজ গল্প নকল করেও কাহিনীর ব্যালেন্স করতে পারে না। অডিয়েন্স কি দেখেছে কি দেখেনি তা মিলাতে পারে না।
তাদের জন্য কোন সাজেশন?
বাবু: সাহিত্য নিয়ে নতুনদের বেশিরভাগের জানাশোনা নেই। আর না জানার পাশাপাশি নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনাও কম। অনেক ধরনের ঝামেলা আছে। এরা মূলত পড়তে চায়না। কেউ কেউ এইট পাশ, এস এস সি পাশ, আবার কেউ ইন্টার পাশ করে এসে লেখক হতে চান।
আপনার লেখা অনেক ছবির কাহিনী তো তেলেগু, হিন্দি ছবির কপি থাকে। অনুমতি না নিয়ে কপি করছেন-এটা নিয়ে কোন চিন্তা আসে না?
বাবু: আপনার ঘরে যদি আমি চুরি করি, তাহলে আপনি যদি কমপ্লেইন না করেন তাহলে চোর না। তারা এসব নিয়ে কেয়ার করে না। আমাদের সিনেমার ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ তাদের কাছে কিছুই না।
তাই বলে কি আমাদের নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না ?
বাবু: কোন দেশের ছবির কাহিনী নকল হচ্ছে না? বলিউড হলিউডের ছবি, কলকাতার দেব বা জিৎ এর বেশিরভাগ ছবি সাউথের ছবির নকল। যেমন আমাদের দেশে পোড়ামন ছবির কাহিনী ‘মাহিনা’র কপি ছিল। তামিল ছবিটা চলেনি। কিন্তু বাংলায় পোড়ামন অনেক ব্যবসা করেছে। আমাদের দেশে তামিল ছবিটির কাহিনীর নকল হলেও প্রেজেন্টেশন ছিল আলাদা। অগ্নিরও মেকিং ভালো হবার কারণে দর্শকরা গ্রহণ করেছে।
প্রযোজকরা কি ধরনের গল্প চান বেশি ? লেখার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা থাকে আপনার?
বাবু: সবার আগে প্রযোজকরা চায় লগ্নিকৃত টাকার ফেরত পাবার ওয়ারেন্টি। এটা থেকে আমরা বাহির হতে পারিনি। সব প্রযোজকরা তো আর আজিজ ভাই এর মত না। একেকটা প্রযোজক বা পরিচালক একেকরকম গল্প চান। আমরা টিকে আছি কারণ যখন যেখানে তখন সেভাবে চলার চেষ্টা করি। না হলে তো আমরা চলতে পারব না। জীবন বাঁচবে না।
গল্পের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এর ছবি বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে?
বাবু: ভালোবাসার রং, অন্যরকম ভালোবাসা ছবির স্টোরিলাইন নতুন। পোড়ামন আমার সবচেয়ে বড় নকল ছবি, কিন্তু সবচেয়ে হিট ছবি। এখন কি বলবেন, কারণ সব প্রযোজকরা এসে পোড়ামন ছবির মত গল্প চায়। আর এ ছবিটা হিট হবার পর তো অনেকেই ছবি বানানো বা প্রযোজনার আগ্রহে এগিয়ে আসল। হার্টবিট ফিল্মস এর তাপসী ঠাকুর, শাহিনসহ অনেকেই রয়েছেন যারা একটু অন্য ধরনের গল্প চান।
প্রিয় লেখক কারা ?
বাবু : ভালো লাগে সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যয় এর লেখা। বাংলা চলচ্চিত্রে অসম্ভব ভালো সংলাপ লিখেন রফিকুজ্জামান। স্ক্রীন প্লেতে অসাধারণ কাজ করতেন আমার বাবা। আমার বাবা আরেকজন রাইটারের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি হচ্ছেন কলকাতার সুবোধ ঘোষ। আমি যখন আবু সাঈদ খানের সাথে কাজ করেছি তখন শিখেছি যাত্রা নির্ভর সংলাপ বানায় কিভাবে। আমাদের দেশের ফিল্ম কিন্তু যাত্রা নির্ভর অডিয়েন্স। লাউড অ্যাকটিং শিখেছি আবু সাঈদ খানের কাছে। ছটকু আংকেল কথার পিটে কথা দিতে খুব পছন্দ করেন। উনি খুব সুন্দর কথা লিখতে পারেন কিন্তু সাজাতে পারতেন না। রফিকুজ্জামান সবচেয়ে কম শব্দ দিয়ে সুন্দর ভাষা তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তার প্রচুর সময় লাগে। অনেকের কাছে শিখতে বা জানতে পেরেছি।
কতদিনে একটা ছবির কাহিনী লেখা শেষ করেন?
বাবু : আজ ১৭ মার্চ। আগামী ১ এপ্রিলের মধ্যে একটি নতুন ছবির লাইন আপ রেডি চান এক পরিচালক। তাহলে বোঝেন কতদিন সময় আছে আমার হাতে? প্রযোজকদের চাহিদা অনুযায়ী গল্প লিখতে হয়।
কিন্তু এত অল্প সময়...
বাবু : আমাদের দেশের ছবির পরিচালকদের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটির অভাব আছে। পরিচালকরা এক ডাইসে শুটিং করতে করতে ওটার বাইরে নতুন কিছু ভাবতে পারে না।
এত কাজের চাপে বর্তমানে কি ছবি দেখার সময় পান?
বাবু : আমার যত কাজই থাক না কেন প্রতি রাতে একটা ছবি না দেখে আমি ঘুমাই না। বেশিরভাগই হলিউডের ছবি দেখা হয়।
বর্তমানে পরিবারে কে কে আছেন?
বাবু : মা সেলিনা জহির, স্ত্রী ফারজানা, এক ছেলে ওয়াছেক ও এক মেয়ে কাইনাত নিয়েই আমার বর্তমান সংসার।
ভাই-বোন?
বাবু: দুই বোন ও এক ভাই। বড়বোন ডাক্তার মেহজাবিন ও ছোটবোন মেহবুবা জহির।
জন্মস্থান কোথায়?
বাবু : ঢাকার মিডফোর্ডে ১৯৭১, ১৯ সেপ্টেম্বর।
আগামী পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই?
বাবু : যে যাই বলুক, লিখে যেতে চাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৪