
ময়মনসিংহ থেকে : পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের দুই সন্তানই ছিল খুব আদরের। আদর আর বায়নায় বাবা-মাকে সব সময়ই ব্যস্ত রাখতো মেয়ে ঐশী ও ছেলে ঐহী। বাবা-মা হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেয়ে ঐশী এখন জেলহাজতের চার দেয়ালে বন্দি থাকলেও তার ছোট ভাই ঐহী আছে ময়মনসিংহে ছোট চাচা মশিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে।
বাবা-মা ও বড় বোনকে ছাড়া কেমন আছে শিশু ঐহী? খোঁজ নিতে বাংলানিউজ যোগাযোগ করে নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মশিউর রহমানের সঙ্গে। কিন্তু ঐহীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছুতেই মিডিয়ার সামনে আনতে রাজি হচ্ছিলেন না তার ছোট চাচা। অবশেষে সব রকম নিশ্চয়তা পেয়েই তিনি রাজি হন ঐহীর বর্তমান অবস্থান জানাতে। ঐহীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলাতে।
বাবা-মায়ের আদরের ধন ঐহী এখন আর বায়না ধরে না। বেশিরভাগ সময় থাকে চুপচাপ। এক সময়ের অতিপ্রিয় ব্রান্ডের চকলেট দিলেও ফিরিয়ে দেয়। উচ্ছাসের ছিটেফোঁটাও নেই তার মধ্যে। হঠাৎ করেই কেমন যেন একটু বেশি বড় হয়ে গিয়েছে ঐহী। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ঝটপট উত্তর দেয়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উদাস ভঙ্গিতে। মায়াবী মুখ আর কপালে যেন উদ্বেগের ছাপ। সব মিলিয়ে প্রথম দেখাতেই যে কেউ বুঝতে পারবে, তেমন একটা ভালো নেই নিহত এসবি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান দম্পতির ছেলে ৯ বছর বয়সী ঐহী রহমান।
গত বছরের ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার চামেলীবাগের নিজ ফ্ল্যাটে ঐহীর বাবা এসবি পুলিশ পরিদশর্ক (রাজনৈতিক) মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে খুন করে তার বড় বোন ঐশী রহমান।বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর নয় বছরের ঐহীকে চাচা মশিউর রহমান তার কাছে নিয়ে আসেন। এতো অল্প বয়সে বাবা-মা হারানো ঐহীকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিজ গ্রাম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে নিয়ে যান মশিউর রহমান।
তবে জন্মের পর থেকেই শহুরে পরিবেশে বড় হওয়ায় গ্রামে মন টেকেনি ঐহীর। তাই কয়েক সপ্তাহ পরই তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে চলে আসেন মশিউর রহমান। ভ্যালুস এডুকেশন প্রোগ্রামের হালুয়াঘাটের কো-অর্ডিনেটর পদে কর্মরত মশিউর রহমান গত মঙ্গলবার বিকেলে ময়মনসিংহ শহরের একটি রেস্টুরেন্টে বাংলানিউজের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে আসেন ঐহীকে।
এই আড্ডার পুরোটা সময়ই গম্ভীর মুখ করে থাকা ঐহী ছিলেন আনমনা ও বিষাদগ্রস্ত। নিজ থেকে কিছুই বলে না সে। প্রশ্ন করলেই কেবল উত্তর দেয়।
কথার মাঝেই জানালো তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা। বাবার মতোই বড় অফিসার হতে চায় সে। তবে পুলিশে নয়, সেনাবাহিনীতেই আগ্রহ তার।
চাচা মশিউর জানান, প্রায় সময়ই ঐহী বলে, সে বাবার মতো অফিসার হবে। বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে ঐহী বলে, ‘আমি ক্যাডেটে পড়াশোনা করবো। আর্মি হবো’। এ সময় চাচা মশিউরের বেদনার ঝরে পড়ে চোখের জলে।
ক্যাডেটে পড়াশোনা করে সেনা কর্মকর্তা হওয়ার পরিকল্পনা সফলে ময়মনসিংহে পড়াশোনাও শুরু করেছে ঐহী। এবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার কথা থাকলেও পরিচয় গোপনের জন্য তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। আগামী বছর একেবারে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তির জন্য তাকে শহরের একটি কোচিং সেন্টারে দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠদান করানো হচ্ছে ।
পড়াশোনায় মেধাবী ঐহী সম্পর্কে তার চাচা মশিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ঐহীর রোল নম্বর ছিল ২।
এখনকার রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন ভোর ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে ঐহী। কাউকেই তাকে জাগানোর দায়িত্ব নিতে হয় না। সকালের নাশতা শেষে পুরোদমে পড়াশোনা করে চলে যায় বাসার পাশের কোচিং সেন্টারে। দুপুরে বাসায় ফিরেই চাচাতো ভাই ওয়াকিল রহমানের (৫) সঙ্গে খেলাধূলা। সন্ধ্যায় বাড়িতে একজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়া। তারপর রাতের খাবার আর ঘুম। তবে রাতে একা ঘুমায় না সে। গল্পচ্ছলেই ঐহী জানায়, ‘আমি চাচা-চাচীর সঙ্গে ঘুমাই। তারা আমাকে খুব আদর করেন’।
মাঝে মধ্যে গভীর রাতে একা একা ঘুম থেকে জেগে ওঠে ঐহী। ‘ঘুম থেকে জেগে কী করো তুমি’, এ প্রশ্ন করতেই তড়িৎ উত্তর ‘কিছুক্ষণ টিভি দেখি। এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়ি’।
বাবা-মায়ের কাছে কারণে-অকারণে বায়না করতো ঐহী। চকলেট খেতেও ভীষণ পছন্দ। মাঝে মধ্যেই ও বলে, বাবা আমার জন্য চকলেট আনতেন। আম্মু আমাকে আদর করে খাইয়ে দিতেন। কিন্তু এখন ও আর বায়না ধরে না, চকলেটও খায় না, বলেন ঐহীর চাচা মশিউর রহমান।
বড় বোন ঐশী রহমানের জেলখানায় থাকার কথা জানে না ঐহী। মশিউর রহমান আরও বলেন, প্রায়ই ঐশীর কথা জিজ্ঞেস করে। তাকে দেখতে চায়। তবে আমরা তাকে ঐশীর জেলখানায় থাকার কথা জানাইনি। আমরা বলেছি ঐশী অসুস্থ। ঢাকায় হাসপাতালে রয়েছে। চিকিৎসা শেষ হলেই চলে আসবে।
তবে চাচার অনুরোধে ঐহীর কাছে তার বাবা-মা সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি।
আড্ডা শেষে চলে আসার আগে ছবি তোলার সময় চাচার কথামতো হাসিমুখে পোজ দেয় ঐহী। কিন্তু সেই হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেও সময় লাগেনি। বিষন্ন দৃষ্টিতে অন্যমনস্ক হয়ে আবারো চাচার হাত ধরে হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে।
মশিউর রহমানের আক্ষেপ
পুলিশ দম্পতির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কেটে গেছে প্রায় ৬ মাস। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের পর পরই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমানের অভিজাত জীবন যাপন নিয়ে প্রকাশিত খবরে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিউর তাই বলেন, আমার ভাইয়ের বাসায় যে সোফাসেটটা ছিল, সেটি ছিল রেন্ট্রি কাঠের। ১৯৯৬ সালে জামালপুরের মেলান্দহ থানার সাব ইন্সপেক্টর পদে থাকার সময় এ সোফাসেট তৈরি করেন তিনি। বাসায় ছিল না দামি কোন আসবাবপত্র। ২৩ বছরের চাকরি জীবনে তিনি কখনো অভিজাত জীবন-যাপন করেননি।
এ সময় বাবা-মাহারা নিষ্পাপ ঐহীর জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৪