
জলমুক্তা
খুব চাই, প্রতিদিন ভুলে যাও আমাকে। প্রথম থেকে, প্রতিদিন আমার সাথে পরিচয় হোক। নতুন ভাবে, আলাপে, গল্পে, কৌশলে। যতবার মুগ্ধ-চোখ আমাকে দেখে নেবে ততবার আমি জন্ম নেব। অথচ রাতের ঘুমগুলি ঝরে পড়ছে ঘড়ির ডায়াল থেকে। রেডিয়ামের উজ্জ্বল চোখ বেয়ে নেমে আসছে কিছু দুঃস্বপ্ন। আর ভোর-মেঘেদের সার্কাস খেলায় রূপালী ফিতায় ভর করে নামছে জলরাশি। গন্তব্যে ছুটতে চেপে বসা গাড়ির কাচে বিন্দু বিন্দু যে জলমুক্তা, তাকে সফল-ঘাম ভাবতেই আলোর শব্দে ফুটে উঠছে সহস্র ফুল। ঝর্ণায় গলছে বরফ; পথে পথে...
আমার রাত বেড়ে যায়
সূত্র ভুলে গেলে ভুল হয়ে যেতো অংক। আমি বহুদিন সূত্র লেখা পৃষ্ঠা ভাত টিপে টিপে দেয়ালে আটকে রেখেছি, আর ভুলে গেছি বারবার।
সময় হারিয়ে আরাম চেয়ারে, বন্ধ চোখে প্রশ্নের সাথে কানামাছি খেলে সূত্র লেখা পৃষ্ঠা।
ঐসব সূত্র কি নদীর ভাষা জানে? ঐসব সূত্র কি চাহিদা-সূত্র বোঝে?
ডাকাত সময় দক্ষ হাতে মুছে ফেলে পৃষ্ঠা ভরা সূত্র। তখন চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে শহরের দেয়াল ভরা ছায়াছবির রঙিন পোস্টার।
আমার রাত বেড়ে যায়...
সামগ্রিক তবে একটা কিছু
একটা রহস্য-গহ্বর মনোযোগে থাক আমাদের...
একটা অলস শামুক সবুজ আলোয় উজ্জ্বল হোক
একটা রাজহাঁস ফিরে পাক তাঁর নীল জলের প্রাসাদ
একটা লাল ঘুড়ি পরীদের হাত ঘুরে জাদুর বাক্সে থাক...
একটা মাছরাঙা দুপুর ভুলে কাঁটা-কম্পাস ঠোঁটে জন্মবৃত্ত আঁকুক
একটা কালো সন্ধ্যা রাতের গভীরে বোবা জোছনায় ভাসুক
একটা পাগল তাঁর হৃৎপিণ্ডে জ্যান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখুক।
নীল কাছিমের দ্বীপে
আজ আমি একাই চলে যাচ্ছি, তুমিও যাও। পরিপূর্ণ, একটি সুষম দিন। অবশেষে, খুঁজে পেলাম তোমার গভীরে বিফল বিষাদ।
সূর্যাস্তকে মাথায় নিয়ে অনাবিষ্কৃত নিঝুম দ্বীপে, উঠে আসছে নীল কাছিমের দল। জ্ঞানের অরগাজমে সবুজ বিষ-মোহে, আমার অদৃশ্য দার্শনিক তুমি।
তোমার ফেলে যাওয়া বিকল মুদ্রণযন্ত্র, প্রতিদিন লিখে যাচ্ছে, আবেগ উত্তরণের শেষে মাথাচাড়া দেয়া হাজানও আবেগের ঘনবসতি গল্প। হিমযুগ কাটিয়ে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় দৌড়, শাদা শাদা খরগোশ। শব্দ অক্ষরগুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে, ফাঁদ পেতে থাকে প্রতিচ্ছবি, জলের অবস্থান যেখানে। ভেসে থাকে জলের পারদে, সেই পথ, প্রতিদিন যে পথে ফিরতে হয় সন্ধ্যা হলে।
অসুখ সময়ে নীল কাছিমগুলো, সামুদ্রিক জল ঠেলে, বর্মখোলের নিচে, তলপেটে নুনজল মেখে মেখে জন্মবৃত্ত খোঁজে কাঁটা কম্পাসহীন।
দার্শনিক, তুমি যাও, একা হও, খুঁজে নাও, আমাকে হারিয়ে খুঁজে নাও, তুমি তোমাকে।
আনন্দের দিকে
ভয় পাচ্ছিস? ধুর! ভয় নেই, এই নে, হাত ধর। তবে যে বললি সাহসী তুই?
আবিষ্কারের অসুখ যে, জানিস না?
বাহ! তবুও ভয়! পাহাড়, সাগর, না কি ছোট ছোট টিলাগুলি?
০২.
আজ আমি জন্মান্ধ, প্রশ্ন নয় কোনো, সব দেখার নেশায় আদিম পর্যটক।
আর আমি বুঝি তোর পথ-প্রদর্শক?
হ্যাঁ, এই নবজন্ম আর আমার তাল তাল অন্ধকারের...
এই যে পথ, বিধবার সিঁথির মতো ফাঁকা করা আকাশ এখানে, গুঁটিসুটি মারা যত মেঘ ঝুর ঝুর করে নেমে আসছে, এটাই আমাদের আর্দ্র আনন্দপথ।
০৩.
কিন্তু অনেক সুখ, পালকের মতো উড়তে চায় অনুভব কর, তোকে কুর্ণিশ করছে সামনে ও পিছনের যত পাহাড় আর ছোট ছোট টিলা।
তাই বুঝি এই মৃত শরীর জুড়ে, রক্তকণিকারা রাজা হবার স্পৃহায় স্নায়ুর কোটরে দামামা বাজাচ্ছে!
এবার এখানে একটু আলতো হাত রাখ, একটা বৃত্ত বলতে পারিস, হ্যাঁ, এটাই হ্রদ।
০৪.
আমি রাজা থেকে মহারাজা হয়ে উঠছি
ভুল করে, আবার তুই এটাকে নরম কার্পেট কেন ভাবছিস? যে অরণ্যের সামনে এখন আমরা, নরম ঘাস কিংবা কদম-কেশর বলিস তারে।
কিছুই ভাবছি না, যা খুশি, যে কোনো, যা কিছু হতেই মন চাইছে। তোর মুখের মতো নম্র, অজস্র জুঁই টুপটাপ ঝরছে আর আদিম প্রাণ ভাসছে সুগন্ধিময় বাতাসে।
তবে, ওই যে পিঁপড়ের দল, সারি সারি চলছে, ওই পথ ধরেই আমাদের পথ। রক্তিম তিমিরে রেশ মিলিয়ে আসার আগেই পৌঁছতে হবে
নির্বাচিত ফুল
রক্তের আস্ফালন আর ঘরের পরিধি কমে আসে ছিন্ন সম্পর্কে, দেয়াল জুড়ে মাকড়সার বুনে যাওয়া বায়ু জালের আঠায় জড়িয়ে থাকে, ঝরে পড়া স্মৃতি পোকাদের পাঁপড়ি সামান্য! ফাঁকা আর একা লাগে আজ খুব, সত্যিই বড় ভুলভাবে ঝরে গেছে সমস্ত আবেগ। ভালোবাসা সব পারে, ইচ্ছে হলেই নিতে পারো তুলে, আলতো হাতে স্মৃতির ভেজানো দরজা খুলে—
করতলে ধরা কোন নির্বাচিত ফুল!
নির্জনতা
ব্যঞ্জনা থেকে দূরে ঐ ধ্বনি, উৎসব শেষের, আদিম, পরলোকের আলোয়, মৃত রক্তকণার মতো জেগে আছে অভিলাষে। সে কি তবে চোখ? মায়াবী আয়না? ভেঙে পড়ছে ঢেউ, নীল, নীল, নদী কি হৃদয় তবে? ভেঙে যাচ্ছে কূল, রাত্রি ও তরল... দ্বিধার চৌকাঠ পার হলো কি পারদ? তৃষ্ণার আগুন জ্বলে, জেগে থাকে আয়না জুড়ে, রক্ত ঝরে, মৃত কণা, বস্তুত তাকে বলি, নির্জনতা।
উৎসমুখ
ভূঁইচাঁপা নয়, পায়ে মাড়িয়ে যাকে চলে গেলে, সে আসলে তৃণলতা, গন্ধ নাও, দেখবে, তার শরীরে লেগে আছে মাটির গন্ধ, নাভিমূলে জেগে ওঠে শব্দের নিঃশ্বাস, খসে পড়ে সন্ধ্যাতারা, তাকে রেখে, পা বাড়িয়েছ অন্ধকার পথে, গ্রীবায় সেতার বাজাও, তৃষ্ণার্ত আঙুলে খোঁজো লাভাস্রোত, স্তব্ধ চোখে খুঁজে নাও উৎসমুখ, এ কেমন শিল্পবোধ! জলের অতল থেকে তুলে আনো আলো, আমি স্পর্শপ্রিয়, তোমার আঙুল থেকে তুলে আনি ঝরাপাতা, শুকোই রোদ্দুরে।
দুপুর বিলাস
আমার সকাল থেকে রাত, উন্মাদ পিয়ানোর মতো বাজে। তবু, কেবল দুপুরটুকু আমার কাছে বিস্ময়। বনসাই ছায়ারা এমন সারপ্রাইজ দেয়, যেন প্রাণটুকু ছোট হতে হতে আগুনরঙা ফুল ফোটায়। জন্ডিস-রোদ, শহরে কোন পাখি থাকে না। শুধু প্রচণ্ড তাপজ্বর নিয়ে জানালার পর্দা হয়ে যাই, আর গোপন করি যত ওপারের নদী।
দুপুরফুল, খোঁপায় গুঁজে, ডুব দেই লাল পুকুরে। জলের অতল থেকে, যমের অট্টহাসি আর দু’হাতে নরক নিয়ে, প্রাণপণে ডেকে চলে এক অচেনা পোয়াতি মাছ, যার মুখভর্তি থাকে ডিম। উড়ালসাঁতার উঠে আসি, পেছনে তাকাতেই দেখি শত শত রঙিন ম্যাজিক-বল আমাকে ধেয়ে আসছে।
আহা জল, সন্ন্যাসী জটাধারী জল। একমাত্র সত্যই জল। ডুবো পথ, যেন ফুটে থাকা জাম্বুরা ফুল। আমার আগুনঝরা যত দুপুর, ছায়াদের লিগামেন্ট শিথিল করা আলোয় মেলে দেই, প্রচ্ছায়ার পেখম।
মানুষ মাত্রই মৌসুমী অসুখে ভোগে।
দ্বিধা
আসমান থেকে নেমে আসা মেঘ-সিঁড়ি
দ্বিধা ভরাতুর পায়ে, সে কি ভেঙেছিল?
দিঘির শালুকে একা কাঁপছে সময়—
কাঁপছে খানিক জল, চোখের পাতায়!
মনে নেই, হাতে হাত রেখেছিলো কিনা—
রেখেছিলো কি না মন মনের ভেতরে।
রহিমা আফরোজ মুন্নী
‘আলিলুয়েভার হারানো বাগান’ পাণ্ডুলিপির ১০ কবিতা
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩