
ফরিদপুর: ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা) আসনে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মদলের সভাপতি শামা ওবায়েদ রিংকুর সঙ্গে ওবায়দুর রহমানের ছোট ভাই ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কে এম জাহাঙ্গীরের দ্বন্দ্ব এখন চরমে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ২১ মার্চ ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুর পর গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিবার থেকে তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন, স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদ ও মেয়ে শামা ওবায়েদ রিংকু প্রার্থী হন।
নির্বাচনে প্রথমে জাহাঙ্গীর ও পরে শামা ওবায়েদ মনোনয়ন পান। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর শামার বিরোধীতা করায় চাচা ভাতিজির দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে গত ২২ নভেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক রুহুল কবীর রিজভী এম জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের চিঠি প্রেরণ করেন।
কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই দলীয় গঠনতন্ত্র না মেনে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করা হয়েছে দাবি করে তার সমর্থকেরা বলছেন বহিষ্কার আদেশের নেপথ্যে তার ভাতিজি শামা ওবায়েদ রিংকুর হাত রয়েছে।
আর জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশ আসার পরে চাচা ভাতিজির সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তবে চাচা-ভাতিজি দ্বন্দ্ব না কমলেও থেমে নেই তাদের সমর্থকেরা। বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে সম্প্রতি ফরিদপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন, উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে চলেছে জাহাঙ্গীরের সমর্থকেরা।
এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বিকেলে লস্করদিয়ায় কে এম ওবায়দুর রহমানের বাড়িতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সালথা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আতিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেতা রফিকুজ্জামান অনু, ফিরোজ খান, আব্দুস সালাম, শাহীনুজ্জামান শাহীন, আব্দুল কুদ্দুস প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল লস্করদিয়া বাজার প্রদক্ষিণ করে, জাহাঙ্গীর সমর্থকরা শামা ওবায়েদ রিংকুর কুশপুতুল পোড়ায়।
এদিকে বুধবার শামার সমর্থকেরা চাচা জাহাঙ্গীরের একটি ট্রাক ও ভেকুতে (মাটি কাটা মেশিন) অগ্নিসংযোগ ও অপর একটি ট্রাকে ভাঙচুর চালায়। এসময় জাহাঙ্গীরের সমর্থকেরা এগিয়ে আসলে তাদের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন।
সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর মিয়ার সমর্থক ওদুদ মাতুব্বর (৫০) গুরুতর আহত বলে জানা গেছে। এ নিয়ে ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কে এম জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, শামা ওবায়েদ রিংকুর নির্দেশে তার লোকজন হামলা চালিয়ে আমার ইটের ভাটার সামনে ট্রাক, বেকু পুড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আমার অফিস কক্ষে ভাঙচুর চালিয়েছে। এতে আমার প্রায় ৪০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সদস্য ওবায়েদ সৈনিক বর্তমান শহীদনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুজ্জামান অনু (জাহাঙ্গীর সমর্থক) বাংলানিউজকে বলেন, জাহাঙ্গীর বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আমরা আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু দলের মধ্যে কিছু নেতা তা মানতে পারছেন না।
অনু বলেন, গত ৩৫ বছর রক্ত পানি করে জননেতা ওবায়দুর রহমানের পাশে থেকে জাহাঙ্গীর মিয়া এই আসনে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছে। এই আসনে এই নেতার মনোনয়ন চাওয়া তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নির্দেশে ওবায়দুর রহমানে ভাই জাহাঙ্গীর ও শামা ওবায়েদ মনোনয়নপত্র জমা দেন। সে সময়ে প্রথমে জাহাঙ্গীর মনোনয়ন পেলেও দ্বিধাবিভক্ত উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের অব্যহত আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল করে শামাকে দেওয়া হয়।
অনু বলেন, সে সময় থেকেই মূলত তাদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করে। এর পর থেকে যে যার মতো দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে শামা ওবায়েদ রিংকুর কেন্দ্র ভাল অবস্থান থাকায় জাহাঙ্গীর সমর্থকদের কোনঠাসা করে রেখেছেন।
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান বুলু (শামা ওবায়েদ সমর্থক) বলেন, ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুর পরে তার শূন্যস্থান পূরণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তার কন্যা শামা ওবায়েদ রিংকু। এই অঞ্চলের মানুষ তাকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর মিয়া দলে থেকে আমাদের বাধার কারণ ছিলেন। সে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি রাখতেন যাতে করে রিংকুকে চাপে রাখা যায়।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি দলে থাকাকালীন দলের তেমন কোনো কাজে আসে নাই। নামমাত্র দলে ছিলেন। তার বহিষ্কার কেন্দ্রে থেকে করা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
বুলু বলেন, অবরোধ চলাকালে কে বা কারা নাকি আওয়ামী লীগের লোকজন তার গাড়ি পুড়িয়েছে তা বলতে পারবো না।
কে এম জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুর-২ আসনের বিএনপির অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। ১৯৯১ থেকে এই পযর্ন্ত মাঠে মাঠে কাজ করে দলকে শক্ত অবস্থানে এনেছি। গত নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে মন কষাকষির সৃষ্টি হয়। তবে রিংকুর আচার আচরণে ক্ষুদ্ধ নেতা-কর্মীদের অনুরোধেই আবারো জোরে সোরে মাঠে নেমে দলকে সুসংগঠিত করতে থাকি। এটাই রিংকু সহ্য হয়নি, রিংকু ভেবেছে সব লোক আমার দিকে চলে আসছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে কে মনোনয়ন পাবে না পাবে তা পরের কথা। বর্তমানে রিংকুর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও হঠকারীরতার জন্য এমন অবস্থার সৃস্টি হয়েছে।
দল থেকে তাকে বহিষ্কার করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে এখনো কোনো চিঠি পাইনি। তবে শুনেছি রুহুল কবীর রিজভী আমাকে বহিষ্কার করেছেন। এ বিষয়টি দলের অন্য কোনো নেতা এমনকি খালেদা জিয়াও জানে না। রিংকু কিভাবে এটা করিয়েছে তা বুঝতে পারছি না।
এ বিষয়ে শামা ওবায়েদ রিংকু বাংলানিউজকে বলেন, কে এম জাহাঙ্গীরের অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে কেন্দ্র থেকে। তার একটি কপি আমাকেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বহিষ্কারের আদেশের কপিতে আমার কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে এমন কিছু উল্লেখ নেই।
জাহাঙ্গীরের গাড়িতে আগুন ভাঙচুরের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ঢাকায় রয়েছি তাই ফরিদপুরে কি ঘটনা ঘটেছে তা আমি জানি না। তাছাড়া অবরোধ চলাকালে কে বা কারা করেছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর