জীবনানন্দের রূপসী বাংলার বৃক্ষভুবন

মোকারম হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৪:১৭, অক্টোবর ২২, ২০১৩

ঢাকা: জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি ভাবনার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতায় তৈরি করেছেন নতুন বাঁক। শ্যামল বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য অসাধারণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন বর্ণিল ও বর্ণাঢ্যভাবে। তিনি কবিতায় যে সময়টা ধারণ করতে চেয়েছেন তা একাধারে বর্তমান ও ভবিষ্যতের। একারণে তার লেখার সমস্ত উপজীব্য দূর ভবিষ্যতেও থাকবে প্রাসঙ্গিক।

আমাদের উত্তর প্রজন্ম হয়তো বাংলার বিলুপ্ত কোনো ফুল-পাখি বা তৃণ-গুল্মের সন্ধান পাবে তার রচনা থেকে। ব্যাপকতার দিক থেকে তিনিই অন্যতম কবি, যিনি প্রকৃতির উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গগুলো গভীর অনুভব থেকে বহুমাত্রিকতায় তুলে এনেছেন।

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এসব উপাদানগুলোর এমন যথাযথ ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে বিরল। রূপসী বাংলা এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধুমাত্র রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্থে তিনি প্রায় ৮০টি ফুল-ফল-লতা-গুল্মের কথা বলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি সবকিছুই জেনে শুনে লিখেছেন। ব্যবহৃত উপমা বা উদ্ধৃতি কোনোটাই আরোপিত নয় বরং স্বত‍ঃস্ফূর্ত।
Shoti201Shoti201
জীবনানন্দ দাশ বাংলার নদী মাঠ জোছনা শিশির ভালোবেসে হৃদয়ের গহীনে যে শব্দমালা গেঁথেছেন তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়েছেন কাব্যের পরতে পরতে। বিচ্ছিন্নভাবে যদি আমরা শুধুমাত্র একটি পঙ্‌ক্তির কথাও ভাবি, সেখানেও বাংলার সমগ্র নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে পূর্ণমাত্রায় ছুঁয়ে দেখা যায়। প্রিয় মাতৃভূমিকে যথাযথভাবে অনুভব করতে ‘দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।’ কিংবা ‘পৃথিবীর কোনো পথে : নরম ধানের গন্ধ- কলমির ঘ্রাণ/ হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের/ মৃদু ঘ্রাণ...’  এর মতো দুচারটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশ এমন অজস্র পঙ্‌ক্তি দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন তার কাব্য সম্ভার। এসব রচনা-নিয়ে একদিকে যেমন পলিমাটির গন্ধ পাওয়া যায়, অন্যদিকে আবার সুরভিত পুষ্পোদ্যানের স্বর্গীয় সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। তবে রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্থে কবি এই চিত্র আরো স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুলে এনেছেন। বলেছেন তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা। একারণেই রূপসী বাংলা এখনো বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছে। কালক্রমে বনলতা সেনের পরে যে কাব্য পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি আদৃত হয়ে উঠেছিল, তা সম্ভবত রূপসী বাংলা।
ShimulShimul
রূপসী বাংলা নিয়ে এযাবৎ অনেক কাজ হয়েছে। বেরিয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র কবির ভাবনার পুষ্প-বৃক্ষ-লতা-গুল্মের প্রকৃত রূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। শুধুমাত্র রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ থেকেই অনুমেয় যে কবি তার ভাবনার সিংহাসনে কত বিচিত্র অনুষঙ্গ এনে জড়ো করেছিলেন। কত বিচিত্রতায় ভরিয়ে তুলেছিলেন তার প্রিয় রূপসী বাংলাকে। আর এভাবেই রূপসী বাংলা হয়ে ওঠে জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিকৃতির মুখচ্ছবি। আমরা সেখানে খুঁজে পাই আত্মপরিচয়ের শিকড়কাহিনী। জন্মমাটির প্রতি ভালোবাসার এক মহৎ সঙ্গীত এখানে উৎসারিত। মধুকূপী ঘাস, কাঁঠাল-অশ্বত্থ প্রভৃতি নাটা-পানেরবন-ধান-লেবুর শাখা-ঘাস এনেছে শ্যামলী বাংলায় অনুষঙ্গ; শঙ্খচিল-লক্ষ্মীপেঁচা-সুদর্শন নামক পতঙ্গ এনেছে প্রাণী-পতঙ্গের জীবলীলার ভেষজ সংবাদ।
 
রূপসী বাংলা প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর। তার মৃত্যুর তিন বছর পর (১৯৫৭) কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বইটি বেরুলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন কবি-সহোদর অশোকানন্দ দাশ। তিনি লিখেছেন, ‘এ কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলি সঙ্কলিত হলো, তার সবগুলিই কবির জীবিতকালে অপ্রকাশিত ছিল।’ খুব কাছাকাছি সময়ে পরিকল্পিতভাবে তার ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়েছিল। রূপসী বাংলার কবিতাগুলো ১৯৩৪ সালে লেখা বলেই ধারণা করা হয়। আবার দেখা যাচ্ছে : রূপসী বাংলার প্রচলিত সংস্করণ ও প্রতিক্ষণ- প্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ও পাঠান্তর সংস্করণ বেশ আলাদা।

অবশ্য দেবেশ রায় সম্পাদিত রূপসী বাংলার (প্রকাশিত-অপ্রকাশিত) পাণ্ডুলিপি ও পাঠান্তর সংস্করণ (১৯৮৪)-এর ভূমিকায় অনেক বিতর্কেরই সমাধান মেলে। প্রয়াজনীয় তথ্যগুলো অনেকটা এরকম:
anthal201c
১.
মূল পাণ্ডুলিপির খাতায় (ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে) দেখা যাচ্ছে ৭৩টি কবিতা। সেখান থেকে ৬১টি কবিতা নিয়ে রূপসী বাংলা তৈরি হয়েছিল। খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় জীবনানন্দ লিখে রেখেছেন March ১৯৩৪। তবে মার্চ মাসেই তিনি রূপসী বাংলার সবকটি কবিতা লিখেছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। খাতায় মোট পৃষ্ঠা ৭৬। কবিতাগুলো শিরোনমহীন এবং ক্রমিক সংখ্যা দেয়া আছে পরপর ৭৩ পর্যন্ত। তার মধ্যে ১ ও ২ নম্বর এবং ১৩ ও ১৪ নম্বর কবিতার পাতাদুটি ছেঁড়া, পাতার বাকি অংশ এখনও খাতায় লেগে আছে।

কবিতাগুলোয় ছোটোখাটো সংশোধন দেখেই বোঝা যায় কবি বড় কোনো সংস্কারে হাত দেননি। সংশোধন-পরিমার্জনের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার পরও অকস্মাৎ মৃত্যুর কারণে রূপসী বাংলার চূড়ান্ত পাঠ-সংস্কার কবি নিজে করে যেতে পারেননি। একারণে কবিকৃত পাণ্ডুলিপিতেই আমরা কোনো কোনো শব্দের উপরে-নিচে-পাশে বিকল্প শব্দ পাই।

২.
এতদিন রূপসী বাংলার ভূমিকা-কবিতা হিসেবে যে-কবিতাটি সবাই পড়ে এসেছে, মূল পাণ্ডুলিপিতে দেখা যাচ্ছে সেটা কোনো গোটা কবিতাই নয়। পাণ্ডুলিপির ৭৩ নম্বর কবিতাটি পাঁচটি টানা চরণের। কিন্তু কবিতাটি রূপসী বাংলায় ভেঙে ভেঙে ন’টি চরণে সাজানো হয়েছে। তার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে পাণ্ডুলিপির ৬৮ নম্বরের চার চরণের কবিতাটি।
Hijol
তাছাড়া রূপসী বাংলা নামটিও কবিকৃত নয়। তিনি নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘বাংলার এস্ত নীলিমা’। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে কবি এই ৭৩টি কবিতায় কোনো শিরোনাম ব্যবহার করেননি। কাজেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শিরোনাম ব্যবহারও অযৌক্তিক।

জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে প্রায় ৮০টি ফুল-ফল-বৃক্ষ ও লতা-গুল্মের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। শুধুমাত্র একটি কাব্যগ্রন্থে বিশাল উদ্ভিদজগতের এমন বিস্তার রীতিমতো বিস্ময়কর। অতি ক্ষুদ্র একটি বুনোফুল থেকে শুরু করে সুবিশাল বট-অশত্থও তার অন্তর্দৃষ্টি এড়ায়নি। বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্ম যেন পলিমাটির এসব আত্মজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিস্মৃত না হয় সেজন্য রূপসী বাংলা ঐতিহাসিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।

রূপসী বাংলার পুষ্প-বৃক্ষগুলো সচিত্রকরণ করতে গিয়ে কতগুলো নাম নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ি। কবি যে ফুলটিকে করবী বলেছেন আদতে তা কলকে। অবশ্য অনেকেই কলকে ফুলকে করবী নামে ডাকেন। আবার কবিতায় উল্লিখিত ‘চিনিচাঁপা’ নামে জানামতে কোনো বৃক্ষের খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে চিনিচাঁপা নামে এক প্রজাতির কলা আছে। একইভাবে ‘ক্ষিরুই’য়ের কথা বলা যায়। ক্ষিরুই উদ্ভিদবিজ্ঞানে প্রচলিত কোনো বৃক্ষ নয় তবে ক্ষিরি বা খিরনি বৃক্ষ আছে। আবার কবি বলেছেন দ্রোণপুষ্প। কিন্তু দ্রোণ সাধারণত সাদা ও লাল দুরকম। সাদাদ্রোণের আরেক নাম দণ্ডকলস। এসব নিয়ে হয়তো কারো দ্বিমতও থাকতে পারে। তবে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যথাযথ বৃক্ষকেই প্রাধান্য দেবার চেষ্টা করেছি।

জীবনানন্দ দাশ সমগ্র রূপসী বাংলায় একটি নির্দিষ্ট গাছের কথা ঘুরে ফিরে নানাভাবে নানা প্রসঙ্গে একাধিকবার বলেছেন। আবার একই বাক্যেও একাধিক গাছের প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু একাধিকবার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হননি। কোনো উপমাই অপ্রাসঙ্গিক বা অযৌক্তিক মনে হয়নি। উদাহরণ হিসেবে হিজলের কথা বলা যেতে পারে। কবি অন্তত ৯বার হিজলের কথা বলেছেন-

ক. বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে

খ. ওখানে হিজল গাছ ছিল এক-পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার
Bot201
গ.  চারি দিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের করে আছে চুপ

ঘ.  এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ

ঙ.  অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত

চ.  চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে-জামরুল হিজলের বনে

ছ.  কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান
সাপমাসী পোকাটিরে...

জ. ...সন্ধ্যায় ধূসর সজল
মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে

ঝ.  ... চোখে ক্লান্তি নাই
কাঠমল্লিকায়
কাঁঠালী শাখায়
করবীর বনে
হিজলের সনে....

কবি এখানে যতবার হিজলের কথা বলেছেন একবারও কি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে? আসলে এটাই কবির কবিত্ব। কবি যখন একটি তুচ্ছ কথাও বলেন তার মধ্যে শিল্প থাকে। ভাবনার খোরাক থাকে। আমরা এও জানি, একমাত্র জীবনানন্দ দাশই হিজলকে বৃক্ষ সভার একটি বর্ণাঢ্য আসনে স্থান দিয়েছেন। একইভাবে তিনি কাঁঠালের প্রসঙ্গ এনেছেন অন্ত সাতবার। হয়তো তিনি পুনর্জন্মেও কাঁঠালছায়ায় ফিরে আসতে চেয়েছেন বার বার। আবার তিনি ঘনায়মান সন্ধ্যায় কিংবা নিশুতি রাতে কাঁঠালশাখায় দেখেছেন লক্ষ্মীপেঁচার মায়াবি চোখ। দেখেছেন ভোরের আলতো বাতাসে হেলেদুলে নেমে আসছে একটি কিংবা দুটি স্নিগ্ধ কাঁঠালপাতা। কাঁঠালের সবটুকু বৈভব যেন তার হৃদয়ের গহীনে অলৌকিক ছবি এঁকে যায় বার বার-
Basok20
ক. কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়

খ. ......কাঁঠালশাখার থেকে নামি
পাখনা ডলিবে পেঁচা এই ঘাসে....

গ. সাতশো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে

ঘ. দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে

ঙ.  চারি দিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের করে আছে চুপ

চ.  অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত

ছ.  কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান
সাপমাসী পোকাটিরে...

শুধু হিজল আর কাঁঠালই নয়, জাম, অপরাজিতা, শটি, জামরুল, অশ্বত্থ, তমাল, ধান, কলমী, ধুন্দল, আম, নাটাফল, করবী, চাঁপা, কামরাঙ্গা, কদম, শেফালি, বাসক, শিমুল, কাঞ্চন, পলাশ, পদ্ম, ডুমুর, ফণীমনসাসহ আরো অসংখ্য পুষ্প-বৃক্ষ-লতাগুল্মের দীর্ঘ বর্ণালীতে সুসজ্জিত রূপসী বাংলা।


লেখক: মোকারম হোসেন, নিসর্গী
[email protected]   
 
বাংলাদেশ সময়: ০৪১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৩
এএ/আরকে


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান