জামায়াতকর্মের প্রমাণ তদন্ত সংস্থায়

মেহেদী হাসান পিয়াস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৩:৫২, অক্টোবর ১৭, ২০১৩

ঢাকা: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তাছাড়া একই নীতি আদর্শের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে সংস্থাটি।

গত ১৮ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া তদন্তে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্র, সরকারি প্রতিবেদন, মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র, গবেষণাধর্মী বই থেকে দলটির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সরেজমিন তদন্ত ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষক, বিশিষ্টজনদের সাক্ষাৎকার এবং সংশ্লিষ্ট অনেককে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে এসব তথ্য প্রমাণ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদনে জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মো. আব্দুল হান্নান খান এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে তদন্ত এটিই প্রথম। এ অপরাধের দায়ে যাদের দণ্ড হয়েছে বা যাদের বিচার চলছে তাদের প্রায় সকলেই জামায়াতের শীর্ষ নেতা।

তিনি বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী সংগঠিতভাবে অপরাধ সংঘটিত করেছে। ধর্মাশ্রয়ী এ দলটি শুরু থেকেই দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী স্বাধীনতাকামী আপামর মানুষদের তারা ভারতের দালাল আখ্যা দিয়েছে।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সাংগঠনিক নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে দলীয় সিদ্ধান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন আধা সামরিক বাহিনী (প্যারা মিলিটারি ফোর্স) গঠন করেছে। এসব সহযোগী বাহিনীর প্রধান হিসেবে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা জামায়াতেরই শীর্ষ নেতা।”

হান্নান খান বলেন, “এসব সহযোগী বাহিনী সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।  সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে দলটির শীর্ষ নেতাদের যেমন এসব অপরাধের দায় অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি দলগতভাবেও নেই।” তাই ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনেরও বিচার হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

তদন্তের অগ্রগতি: গত ১৮ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তবে ব্যাপক পরিসরে এর তদন্ত চলায় তদন্ত সমাপ্ত হতে আরও সময়ের প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

কতদিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “এখনও নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম তদন্ত। স্বাভাবিকভাবেই অন্যসব মামলার তদন্ত কাজের চেয়ে এ মামলার তদন্ত একটু ব্যতিক্রম।”

তিনি জানান, “জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর তথ্য-প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এখন সেগুলোর যাছাই-বাছাই, পর্যালোচনা ও সন্নিবেশনের কাজ চলছে। পাশাপাশি তদন্তের কাজও অব্যাহত রয়েছে।”

সাক্ষ্য প্রমাণ: তদন্তকালে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দেয়া ব্যক্তিদেরই পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী করা হয়ে থাকে। এ মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে তেমন কারো জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়ে কিনা জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধে অন্যান্য মামলার তদন্তকালে যেমন বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য বা জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে, এ মামলার ক্ষেত্রেও তেমনটি করা হচ্ছে।“

তবে কাদের জবানবন্দি গ্রহন করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। তদন্তের স্বার্থে এসব সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা উচিত হবে না বলে জানান তিনি।

মতিউর রহমান জানান, “জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের জন্য জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশনাই যথেষ্ট। তারপরও সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ আরও গ্রহণযোগ্য, যৌক্তিক করে তুলতে একাত্তরে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ, দৈনিক পয়গাম ও অবজারভারে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ, প্রতিবেদন আমরা সংগ্রহ করেছি।”

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকেও জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। যা ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ অ্যাবস্ট্রাক্ট অব ইন্টিলিজেন্স-১৯৭১’ শিরোনামে দালিলিক প্রমাণের সঙ্গে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফোর্টনাইটলি রিপোর্ট অন পলিটিক্যাল সিচ্যুয়েশন-১৯৭১’ শিরোনামের আরেকটি প্রতিবেদন।

অপরাধের ধরন: মতিউর রহমান বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩’র ৩ (২) ধারা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী সকল ধরনের অপরাধের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্ত চলছে।”

তিনি জানান, তদন্তে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণ হয় জামায়াতে ইসলামী স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে মানবতার বিরুদ্ধে সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত করেছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে, খুন, ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি।

তদন্তকারী এ কর্মকর্তা বলেন, “জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে একটি সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী সংগঠন। তাই একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের তদন্তের পাশাপাশি স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের অপরাধমূলক সকল কর্মকাণ্ডেরই তদন্ত চলছে।” জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়, বরং একাত্তরে সংঘটিত অপরাধেরই ধারাবাহিকতা, সে বিষয়টিও তদন্তে তুলে আনা হবে জানান তিনি।

অপরাধের দায়: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রণোদনাতেই গঠন করা হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বিভিন্ন বাহিনী। এসব বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী। এছাড়া স্থানীয়ভাবেও কোনো কোনো জামায়াত নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর আদলে স্থানীয় বাহিনীও গঠন করেছিল। আর এসব বাহিনী যে অপরাধ সংঘটিত করেছে তার দায় অবশ্যই জামায়াতকে নিতে হবে মনে করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

ট্রাইব্যুনালের বিগত কয়েকটি রায়ের পর্যালোচনাতেও জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই দলের নেতা-কর্মীদের নিয়োগ না দেয়ারও সুপারিশ করা হয়। তাই অনেকেই মনে করে থাকেন রায়ের এসব পর্যালোচনা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়টিকে প্রশস্ত করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৩
এমএইচপি/আরআই/জিসিপি


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান