
নিউইয়র্ক: পবিত্র কোরআন, হাদিস আর ধর্মীয় ইতিহাসের নানা অজানা কাহিনী পালা গানের বাহাসের উপজীব্য। কাজল দেওয়ানরা সেই জ্ঞানগর্ভ বাহাসের নায়ক।
বাংলার পালাগানের প্রিয় নাম কাজল দেওয়ারনের সঙ্গে কথা হয় নিউইয়র্কে। বেশভূষায় রীতিমত আধুনিক কাজল দেওয়ানের সাথে আলাপচারিতায় জানাগেল অনেক তত্বকথা। নিজেকে বাউল দাবি করে কাজলের কথা “সব থুয়ে যার কিছু নেই সে বাউল”।
শাহ আব্দুল করিমকে তেমনই এক বাউল উল্লেখ করে কাজল বলেন, তিনি নিজেই তার গানে বলে গেছেন ” বাউল আব্দুল করিম বলে রঙের গান আর গাইনা...।”
ধর্ম, সুফিবাদের অনেক গভীরের কথা জানা গেলো কাজল দেওয়ানের সঙ্গে কথা বলে। সুরা আল বাকারার সাবলীল তরজমা করে গেলেন। বললেন, শ্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠত্বের কথা “আমি যাহা বুঝি, তোমরা তাহা বুঝনা।”
সুফি মতবাদকে ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, শ্রষ্ঠা আল্লাহ আমার মধ্যেই বিরাজ করে। লালনের ভাষায় ‘সে আর লালন এক ঘরে রয় লক্ষ যোজন দুরে’ এভাবেই মহান শ্রষ্ঠা আর তার সৃষ্টির অবস্থান।
“মান্ আরাফা নাফসাহু ফাকাত আরাফা রাব্বাহু”... যে নফসে চিনেছে সে রবকে চিনেছে। কাজল দেওয়ান বলেন, মানব ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। শ্রষ্ঠা সবাইকে তৈরি করেছেন। তিনি মানুষকেই সর্বশ্রেষ্ঠ করে তৈরি করেছেন। তাই কোন মানুষের মনেই কষ্ট দেয়া অন্যায়। এনিয়ে কাজল দেওয়ান গাইলেন- “এই সুরত দোজখে যাবে যে বলবে সে গুনাহগার, কি সুরত বানাইলো আল্লাহ রুপ মিলাইয়া আপনার”। তার বাউল কন্ঠ আরও গেয়ে উঠলো, ”আল্লাহ রসুল কৃষ্ণ, কালি নামের গৌরব কেন কর? কোন জাতি মোর সাঁই নিরঞ্জন কেউ কি বলতে পারো?”
সুফিবাদের আরেক তত্ব গাইলেন কাজল দেওয়ান, “মন মানুষ হইতে চাও, জাতি ধর্ম ছেড়ে দিয়ে সরল দেশে যাও। গিয়ে দেখো খেয়া ঘাটে নদীর কিনারায়, হিন্দু বৌদ্ব খ্রীষ্টান মুসলিম সব চড়ে এ নাওয়ে।”
কাজল দেওয়ান তার পালা গানকে সুফিবাদেরই প্রচার বলে উল্লেখ করে বলেন, এর মাধ্যমে গ্রাম বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধর্ম এবং সৎ ও সুন্দর জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেকেই জীবনের সরল পথে ফিরে আসে।
নিজের জীবনে তার বাবার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করারা চেষ্টা করেন জানিয়ে কাজল বলেন, যারা বাবা মাকে খেদমত করেনা, তাদেরকে বলবো, আমার গান না শোনার জন্য।
দেশের স্বনামখ্যাত ‘মাতাল রাজ্জাক’ এর সন্তান এই কাজল দেওয়ান। ‘মাতাল রাজ্জাক’ প্রখ্যাত শিল্পী মমতাজের গুরুই শুধু নন, তিনি মহান মুাক্তযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও বহুল আলোচিত। বংশ পরম্পরায় দুই পুরুষের বাউল কাজল দেওয়ান।
ধর্ম ও গানে দ্বন্দ্ব নেই দাবি করে কাজল দেওয়ান বলেন, গান যদি হয় শ্রষ্ঠার উপাসনায়, আরাধনায়, বাবা মায়ের প্রতি ভক্তি, গুরু দক্ষিণার গান, সে গান কেন ধর্মের বিপরীতে দাড়াবে?
ইউরোপে পুরোদস্তুুর বিদেেিদর আয়োজনে রাশিয়া, সুইডেন, লন্ডন ও অষ্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফোক গানের ফেস্টিভালে পাঁচবার যোগ দিয়েছেন কাজল দেওয়ান। তিনি জানালেন, বিশ্বের ১৯টি দেশের ফোক শিল্পীরা এসব ফেস্টিভালে যোগ দেয়।
কাজল দেওয়ান আক্ষেপ করে বলেন, বিদেশিরা আমাদের এই বেহালা, দোতারা, একতারাসহ ফোক বাদ্য যন্ত্রানুসঙ্গ ও বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ভীষণ পছন্দ করেন। অথচ অমাদের বাঙালীরা হিন্দি সংস্কৃতির চর্চা করছেন। এরচেয়ে কষ্টের আর কিছু হতে পারেনা ।
তিনি আরো বলেন, ভারতীয় কোন শিল্পী বাংলাদেশের গীতিকারদের বা জনপ্রিয় গানগুলো গায়না। শুধু আমরা বাঙালীরাই নিজেদেরকে ছোট করছি।
চেতনায় দেশপ্রেমকে সদাজাগ্রত রেখে দেশকে ভালবাসতে প্রবাসীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সময় ১২৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩
এমএমকে