কবির বিরহী ডাহুক-ডাহুকী

আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৫:৩৩, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩

ঢাকা: চিরবিরহী পাখি ডাহুক। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জীবনানন্দ, ফররুখ, আল  মাহমুদের কাব্যের অন্যতম অলংকার। কখনো রূপকে, কখনো প্রতীকে। না বলা অনেক কথা, কথা হয়ে উঠেছে তাদের কবিতায় ডাহুক-ডাহুকীর ডাকে।

জলচর এই পাখিটি মায়ার ডালি। যখন সঙ্গীর খোঁজ না পায়, সারা দিন রাত ডাকতে ডাকতে গলা চিরে রক্ত উঠে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সত্যি কি মর্মান্তিক! তবু তাতেই স্বার্থক তাদের জীবন। ভালোবাসা অসীম, চিরন্তন।

পাখিটি খুব ভীরু প্রকৃতির। জলাভূমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা ডাহুক আকৃতিতে মাঝারি। লেজ ছোট। পা লম্বা। বেশ লম্বা পায়ের আঙুলও।

মানুষের সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়া এই পাখি নিয়ে আলা মাহমুদ  শেষবারের মতো খুঁজে ফিরেছেন তার স্মৃতি।
Dahuk-220
‘স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?’

ডাহুকের পিঠের রং ধূসর থেকে খয়েরি-কালো হয়। মাথা ও বুক সাদা। লেজের নীচের অংশে লালচে আভা। ঠোঁট হলুদ। ঠোঁটের উপরে আছে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ।

ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি। জল এদের প্রধান আশ্রয়। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল, নদীর গোপন লুকানো জায়গা এদের খুব প্রিয়।

মাঝে মাঝে পোষমানা ডাহুকের স্ত্রী পাখিকে বলা ডাহুকী। ডাহুকী নিয়ে প্রকৃতি, লুকানো জীবনের প্রাণবন্ত কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন,

‘মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,-
     নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
     বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে।’

কিন্তু পোষমানার পর আমাদের দেশের এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ এদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য ডাহুক পাখি শিকার করে। কারণ একটির ডাকে কাছাকাছি থাকা অন্য পাখিটি চলে আসে।
Dahuk-12013
বাসা তৈরি করে মাটিতে,ঝোপের তলায়। প্রজননকাল আষাঢ়-শ্রাবণ। এই সময় তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। ডিম পাড়ে ৬-৭টি । ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডিমে তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার বাচ্চাদের রং হয় কালো।

চণ্ডীদাস তার কবিতায় বলছেন,
‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে
শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাত না দেখিবোঁ যবেঁ কাহ্নাঞিঁর মুখ
চিনি-তে মোর ফুট জায়িবে বুক।’

অর্থাৎ কবি বলছেন, শিখি, মানে ময়ুর, ভেক ও ডাহুক পাখির কোলাহল এ সময় শোনা যায়। আসলেই, এ সময় নতুনভাবে সজীব হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কলকাকলি মুখর পরিবেশে নতুন কিছু খুঁজে থাকে সে। নতুন কিছু পাবার আর নতুন কিছু দেবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, ভাদ্র তার দান ভাণ্ডার খুলে বসে। প্রকৃতির কাছ থেকে তার অপার সৌন্দর্যকে নিয়ে, ভাদ্র বিলিয়ে দিতে চায় সবার কাছে। আর এই সময় সবাই মিলে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। ডাহুকের ক্ষেত্রে কথাটা একবারেই ঠিক।

শামুক, ক্ষুদ্র কীট, উদ্ভিদের ডগা এদের প্রিয় খাবার। ডাহুক অন্য পাখিদের মতো করে বচ্চাদের মুখে করে খাওয়ায় না। বিশেষ করে মা ডাহুকী কখনেই এটা করে না। প্রাকৃতিক নিয়মে বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বেরিয়েই লাফিয়ে পড়ে মাটিতে। তারপর মা-বাবার সঙ্গে পিছে পিছে ঘুরে খাবার খায়।

ডাহুকের বৈজ্ঞানিক নাম Amaurornis phoenicurus. গোত্র Rallidae. ডাহুকের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ লাললেজী কালো পাখি (গ্রিক: amauros = কালচে, ornis = পাখি; লাতিন: phoenicurus = লাল লেজের গির্দি)
রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চেনা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির,যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে এরা শ্বাস নেয়।
Dahuk-3
কিন্তু মায়াবী এই পাখিটি চোরা শিকারি আর বাসস্থানের অভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বিলুপ্তির পথে থাকা এই পাখিটিকে অন্যরা ভুললেও কবি, লেখকরা বোধহয় কোনোদিনই ভুলবেন না। কারণ ডাহুক-ডাহুকী-এদের ডাক, কষ্ট অনেকের আশ্রয়।

আর ফররুখ আহমেদ তার বিখ্যাত কবিতা ডাহুকে তো বলেইছেন-

গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম
নিভে যায় কামনা-চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
কোন্ ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখির
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে।

ডাহুকের ডাক আসলেই চিরন্তন। অন্য আবেদনের।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
এএ/আরকে


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান