ভালো থেকো, আমি আবার ফিরে আসবো

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৭:০৪, আগস্ট ১৯, ২০১৩

ঢাকা: খালেক মজুমদারকে জহির রায়হানসহ অন্যরা প্রহার করলে এক পর্যায়ে সে বলে, শহীদুল্লাহ কায়সারকে সে হত্যা করেনি। সে শুধু তাকে ধরে নিয়ে আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের হাতে তুলে দিয়েছিলো। আমি অস্পষ্টভাবে এ কথাগুলো শুনতে পাই। আমি আরেকজনের নাম শুনেছিলাম, যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তার নাম আশরাফুজ্জামান খান। সে ওদেরই নেতা ছিলো।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন শহীদ সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী অধ্যাপিকা পান্না কায়সার। তিনি ওই দুইজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী।

সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন অধ্যাপিকা পান্না কায়সার। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এই সাক্ষীকে জেরা করেন পলাতক চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী সালমা হাই টুনি।

আগামী বুধবার ২১ আগস্ট চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ১৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

পান্না কায়সার তার সাক্ষ্যে বলেন, আলবদররা শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো, আমি আবার ফিরে আসবো’।

বর্তমানে ৬৩ বছর বয়সী অধ্যাপিকা পান্না কায়সার সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তার স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার, শ্বাশুড়ি ও স্বামীর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ঢাকার কায়েতটুলীর ২৯/বি/কে গাঙ্গুলী লেনের শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। ওই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদররা শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। একটি কাঁদামাখা মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি দেশবরেণ্য এই সাংবাদিক-সাহিত্যিকের।

স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন বধ্যভূমিসহ সর্বত্র স্বামীকে খুঁজে ফেরেন পান্না কায়সার। কিন্তু তার মরদেহ পর্যন্ত পাননি এই শহীদ জায়া।   

স্বামীকে অপহরণ ও হত্যার কারণ সম্পর্কে পান্না কায়সার তার সাক্ষ্যে বলেন, শহীদুল্লাহ কায়সার ব্ল্যাকআউটের সময় মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতেন যা মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতো। গোপনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি শহীদ চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বি, জাতীয় অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম, ডা. ইব্রাহিমদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের কাছ থেকে ওষুধপত্র, অনেকের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে পাঠাতেন।

শহীদুল্লাহ কায়সার তখন দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে বিভোর ছিলেন। শুধু তার প্রিয় পত্রিকা সংবাদের হেডলাইন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখতে থাকতেন, দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে এগুলো পত্রিকায় ছাপা হবে সে আশায়।

এ কারণেই তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের টার্গেটে পরিণত হন।

সাক্ষী পান্না কায়সার তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৬৯ সালে যেদিনটিতে সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়েছিলো, সেদিনই শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেদিন শহরে কারফিউ জারি করা ছিলো। তাই কারফিউয়ের মধ্যে কারফিউ পাস নিয়ে শহীদুল্লাহ কায়সার আরামবাগস্থ আমার বোনের বাসায় আসেন এবং সেই কারফিউ চলাকালে আমি বধূবেশে আমার শ্বশুরবাড়ি যাই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ আরেক কারফিউয়ের মধ্যে আমি আমার স্বামীকে হারাই।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমরা তখন কায়েতটুলীর ২৯/বি/কে গাঙ্গুলী লেন থেকে অন্যত্র সরে গিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে অন্যত্র যাওয়ার আগে জহির রায়হানের (শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোটভাই) সঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সার কিছু আলাপ-আলোচনা করে করণীয়-কর্তব্য ঠিক করেন। শহীদুল্লাহ কায়সার জহির রায়হানকে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধ করো। সাত কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে যেতে পারবে না। যারা দেশে থাকবে, দেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে করবে, আমি তাদেরকে আমার লেখনীর মাধ্যমে এবং অন্যান্য সব উপায়ে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাবো’।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর ২৭ মার্চ কায়েতটুলীর বাসায় শাশুড়িকে রেখে নিজেরা বিভিন্নজনের বাসায় থাকতাম। আমার স্বামী অত্যন্ত মাতৃভক্ত সন্তান ছিলেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কায়েতটুলীর বাসায় মায়ের কাছে ফিরে যাবেন। আমি সাধারণতঃ তার কথায় বাধা দিতাম না। তার বিশ্বাস ছিলো, মায়ের দোয়াতেই তার সমস্ত বিপদ কেটে যাবে। সেই বিশ্বাস থেকেই নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আমরা কায়েতটুলীর বাসায় চলে আসি।

আমাদের কায়েতটুলীর বাসায় আসার ব্যাপারে প্রখ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী (শহীদুল্লাহ কায়সারের মামা) আপত্তি করেছিলেন যে, এতে শহীদুল্লাহ কায়সারের বিপদ হতে পারে। সেই সময় রাজাকার-আলবদররা একটি নীলনকশার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল, যাতে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির একটি চরম ক্ষতিসাধন করা যায়।

শহীদ জায়া পান্না কায়সার বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, তখন শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। তখন শহীদুল্লাহ কায়সার বিশ্বাস করতেন, খুব তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হবে।

এরই মধ্যে ৬/৭ ডিসেম্বর রাজাকার, আলবদরদের হাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি শহীদুল্লাহ কায়সার জানতেন, কিন্তু আমি ভয় পেতে পারি ভেবে আমাকে বলেননি।

১০ ডিসেম্বর আমাদের সবার প্রিয় শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন সাহেবকে আলবদররা বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আমার স্বামী এই কথাটিও আমাকে বলেননি। পরে বিষয়টি জানতে পারি।

সাক্ষী বলেন, ১২ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম (গণতন্ত্রী পার্টির প্রয়াত সভাপতি) আমাদের বাসায় আসেন। শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেন। তিনি চলে যান। তিনি চলে যাওয়ার পর আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন, নুরুল ইসলাম তাকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলেছেন। আমি না বুঝেই তাকে বললাম, ‘তুমি না বলো, দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, তাহলে বাড়ি ছেড়ে যাবে কেন’? তিনি বললেন, ‘আলবদরদের অত্যাচার বেড়ে গেছে। তাই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়’।

১৩ ‍ডিসেম্বর দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে শহীদুল্লাহ কায়সার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে তার মায়ের পরামর্শমতো বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় ক্রন্দনরত মা ও আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমরা কাঁদছো কেন? দু-একদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, আমি চলে আসবো’। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিনি জোরে জোরে ‘জয় বাংলা’ বলছিলেন।

কিছুক্ষণ পর তিনি আবার ফিরে চলে আসেন এবং বলেন, ‘যেখানে যেতে চেয়েছিলাম সেখানে তারা আমাদের সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তাই আমরা আগামীকাল সবাই সেখানে যাবো। মা, আপনি পান্নাসহ তৈরি হয়ে নেন। কাল কারফিউ উঠলেই আমরা চলে যাবো।’

আমরা তৈরি হয়ে ছিলাম। আর শহীদুল্রাহ কায়সার বিজয় আনন্দে বিভোর ছিলেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা, গান গাওয়া, কবিতা পড়া- এগুলো করছিলেন। তিনি একটা বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিলেন।

পান্না কায়সার বলেন, ১৪ ডিসেম্বর কারফিউ আর শিথিল হয়নি। ওই দিনই আমি আসরের নামাজ পড়ে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওই সময় দেখি, চার-পাঁচজন যুবক বাসার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করছে।

আমি ওই যুবকদের ইশারাটা সন্দেহজনক মনে করে বিষয়টি শহীদুল্লাহ কায়সারকে জানাই। তিনি তখন আমাদের বসার ঘরে আমার চাচা শ্বশুর সিদ্দীকুল্লাহর (শাহরিয়ার কবিরের বাবা) সঙ্গে বসে রেডিও শুনছিলেন। তারা ৫টা-সোয়া ৫টার দিকে রেডিওতে বিবিসি অথবা ভয়েস অব আমেরিকা শোনার চেষ্টা করছিলেন।

আমি ওই যুবকদের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চমকে ওঠেন। আমি আর কি কি দেখেছি তা জিজ্ঞেস করেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলে মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। এ সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ভালো করে দোয়া করো’।

সাক্ষী আরও বলেন, নামাজ শেষ করে এসে দেখি আমার ছেলেটি (অমিতাভ কায়সার) সোফায় তার পাশে শুয়ে আছে। আমি নিচে পাটিতে বসে মেয়েকে (শমী কায়সার) দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এ সময় আমার চতুর্থ দেবর ওবায়দুল্লাহ এসে আমার স্বামীকে বলেন, ‘বড়দা, কয়েকজন যুবক আমাদের বাড়ির গেটে কড়া নাড়ছে, কি করবো’? তখন তিনি বলেছিলেন, ‘খুলে দাও, দেশ বোধহয় স্বাধীন হয়ে গেছে’।

দুই-এক মিনিট পর চার-পাঁচজন যুবক মুখ বাঁধা অবস্থায় ওপরে উঠে আসে। রুমে ঢুকেই তারা প্রশ্ন করে, ‘এখানে শহীদুল্লাহ কায়সার কে’? শহীদুল্লাহ কায়সার ভেবেছিলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আমিই শহীদুল্লাহ কায়সার’। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে থেকে একজন শহীদুল্লাহ কায়সারের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়।

সে সময় আমিও বারান্দায় গিয়ে আমার স্বামীর হাত ধরি এবং আরেক হাত দিয়ে বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ অন করি। আমি চিৎকার করে কি বলেছিলাম আমার মনে নাই। তখন আমার সন্তানসম্ভবা ননদ দৌঁড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। এ সময় মুখোশধারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে একপর্যায়ে আমি ও আমার ননদ একজনের মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলে তার মুখ দেখতে পেয়েছিলাম।

আমরা বাঁধা দেওয়ার পরেও আমার স্বামীকে নিয়ে তারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যায়। এ সময় আমার স্বামীর হাত থেকে আমার হাত বিচ্ছিন্ন হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো, আমি আবার ফিরে আসবো’।

পান্না কায়সার বলেন, বাড়ির সামনের আমার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে পরবর্তীতে জানতে পেরেছি, আমার স্বামীকে একটি কাঁদামাখা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। ইমাম সাহেব আরো বলেছিলেন, শহীদুল্লাহ কায়সার গাড়িতে ওঠার আগে ওই মসজিদের দেয়াল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন।

তিনি বলেন, আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীকে ফোন করে ঘটনাটি জানাই। তিনি আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেন, কোতোয়ালি থানায় ফোন করে তার অবস্থান জানার চেষ্টা করতে পারো।

তার কথামতো কোতোয়ালি থানায় ফোন করলে মেজর বশির নামের এক অবাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ইংরেজিতে কথোপকথন হয়। ওই অফিসার আমাকে থানায় যেতে বলেন। আমি যেতে না চাইলে তিনি বলেন, শহীদুল্লাহ কায়সারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি তার কথায় আশ্বস্ত হয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ১০টার দিকে আমার তৃতীয় দেবর জাকারিয়া হাবিবের সঙ্গে মামা জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় যাই। তিনি আমাকে স্বান্তনা দিয়ে শক্ত থাকার জন্য বলেছিলেন। জাকারিয়াকে বলেছিলেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে শহীদুল্লাহ কায়সারকে নিয়ে আসতে।

জাকারিয়ার সঙ্গে একটি রিকশায় করে রায়েরবাজার বধ্যভূমির দিকে যাওয়ার সময় অনেককে বিজয়োল্লাস করতে দেখি, কিন্তু আমি সেই বিজয় উদযাপন করতে পারিনি।

সাক্ষী বলেন, রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরীর স্বজনেরাসহ অনেক বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়-স্বজনেরা কান্নাকাটি করছে। আমার দেবর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে কর্দমাক্ত গর্তে নেমে আমাকেও নামতে বললেন। আমি সেখানে অনেক গলিত বিকৃত লাশ উল্টে-পাল্টে দেখেছি, কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ পাইনি।

এরপর ১৮ ডিসেম্বর জহির রায়হান কলকাতা থেকে ফিরে এসে একটি কমিটি করে রাজাকার, আলবদরদের অবস্থান জানার চেষ্টা করেছিলেন। এক পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে একটি লোককে ধরে নিয়ে এসে আমাদের বাসায় জহির রায়হান আমার সামনে হাজির করেন। আমি তার চেহারা দেখামাত্রই চিনতে পারি যে, এই লোকটির মুখের কাপড়ই আমরা সরিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিনই জানতে পারি, লোকটির নাম খালেক মজুমদার।

পান্না কায়সার বলেন, খালেক মজুমদারকে জহির রায়হানসহ ওই কমিটির ও বাড়ির অন্যরা প্রহার করলে এক পর্যায়ে সে বলে, শহীদুল্লাহ কায়সারকে সে হত্যা করেনি। সে শুধু তাকে ধরে নিয়ে আলবদরের অপারেশন-ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের হাতে তুলে দিয়েছিলো। আমি অস্পষ্টভাবে এ কথাগুলো শুনতে পাই। আমি আরেকজনের নাম শুনেছিলাম, যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তার নাম আশরাফুজ্জামান খান। সে ওদেরই নেতা ছিলো।

১৯৭২ সালে দালাল আইনে খালেক মজুমদারের বিচার শুরু হলে আমি সেই মামলায় সাক্ষ্য দেই। খালেক মজুমদার সেই মামলাতেই এই অজুহাত দেয় যে, সে শহীদুল্লাহ কায়সারকে শুধু ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। সে ওনাকে (শহীদুল্লাহ কায়সারকে) তার নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরুফুজ্জামানের হাতে তুলে দিয়েছিলো।

আমি পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকায় আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিনের ছবিসহ প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারি, এরা আমার স্বামীসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলো।

গত ১৫ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর থেকে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে এর আগে রাষ্ট্রপক্ষের আরও ১২ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ম সাক্ষী শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর মেয়ে ড. নুসরাত রাব্বি অসমাপ্ত সাক্ষ্য দেন।  অন্য ১১ জন সাক্ষী হচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি মাসুদা বানু রত্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের ছেলে ড. এনামুল হক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের ছোট ছেলে তৌহিদ রেজা নূর, শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল, শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ভাই আ ন ম গোলাম রহমান দুলু, শহীদ ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. ফারজানা চৌধুরী নিপা, শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাতিজা ইফতেখার হায়দার চৌধুরী এবং শহীদ সাংবাদিক আনম মোস্তফার ছেলে অধ্যাপক অনির্বাণ মোস্তফা।

তাদের জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত দুই আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।

১৫ জুলাইই প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিচার কাজ শুরু হয়। পলাতক এ দুই অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতেই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান।

গত ২৪ জুন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ও আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত ১৬ জুন তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৪ জুন বিদেশে পলাতক এ দুই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
 
গত ২ মে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সম্ভাব্য ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশন জানানোর পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারকে দু’টি জাতীয় দৈনিকে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়।
 
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ২৫ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৩/ আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা
এমএইচপি/ এমএমএস/ এএসআর/এডিবি


সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান