
ঢাকা: এরপর বন্দুকধারীরা আমার বাবার চোখ বেঁধে নগ্ন পায়ে তাকে নিয়ে যায়। এটাই ছিলো আমার বাবা প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের শেষ যাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণের ঘটনার এমন মর্মষ্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন তার ছোট ছেলে তৌহিদ রেজা নূর।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা সঞ্চারণে সচেষ্ট থাকার কারণেই সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে আলবদর সদস্যরা অপহরণ করে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান তার বাবাকে অপহরণে জড়িত ছিলেন বলেও জানান সাক্ষী তৌহিদ রেজা নূর।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন এই সাক্ষী। তিনি আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৬ষ্ঠ সাক্ষী। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা শুরু করেছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত দুই আইনজীবী আশরাফুজ্জামান খানের পক্ষে আব্দুস শুকুর খান এবং চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের পক্ষে সালমা হাই টুনি। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বাসার শোয়ার ঘর থেকে বন্দুকের মুখে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মরদেহ পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। তার ছোট ছেলে তৌহিদ রেজা নূরের সে সময় বয়স ছিলো মাত্র তিন বছর। বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা পরবর্তীতে মা ও মেঝ ভাইয়ের কাছে বিস্তারিত শুনেছেন তিনি।
এর আলোকেই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তৌহিদ রেজা নূর আরও জানান, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘এতোদিনে’ শিরোনামে সিরাজ উদ্দিন হোসেনের লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই দৈনিক ইত্তেফাকে বিভিন্ন নিবন্ধ, প্রতিবেদনে এ যুদ্ধের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন করে লিখতেন তিনি। এমন কিছু প্রতিবেদনের প্রত্যুত্তরে জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন ও তার লেখাকে সরাসরি আক্রমণ করে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো।
বাবার অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করে সাক্ষী বলেন, ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (সাড়ে ১২টার দিকে) তাদের ঢাকার ৫ নম্বর চামেলীবাগের বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খোলেন সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন। তবে কাউকে দেখতে না পেয়ে দরজা বন্ধ করে বাড়ির সবাই ঘুমাতে চলে যান।
রাত ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে আবার দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনলে সাক্ষীর মেঝ ভাই শাহীন রেজা নূর উঠে বাড়িওয়ালার ডাক শুনতে পান। দরজা খুলে তিনি দেখতে পান, বন্দুকের মুখে বাড়িওয়ালা, তার দুই ছেলে এবং তার শ্যালক দাঁড়িয়ে আছেন।
সাক্ষী জানান, বন্দুকধারীরা ছিলেন ৬/৭ জন। তাদের কারো মাফলার বা অন্য ধরনের কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা ছিলো। কেউ কেউ মাংকি ক্যাপ পরা ছিলেন।
বন্দুকধারীরা আধো বাংলা আধো উর্দুতে বাড়িতে কে কে আছে জিজ্ঞেস করেন এবং জোরপূর্বক বাসার ভেতরে ঢুকে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিনের শোবার ঘরের সামনে চলে যান। এ সময় তার স্ত্রী বেগম নূরজাহান সিরাজী শোবার ঘরের দরজা খুলে দিলে তারা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েন।
ঘরে ঢুকেই তারা সিরাজ উদ্দিনকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করতে বলেন। এ সময় লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে থাকা সিরাজ উদ্দিন পাঞ্জাবি পরার জন্য আলনার দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পাঞ্জাবি পরতে পারেননি।
বন্দুকধারীরা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে পরিচয় জানতে চাইলে সিরাজ উদ্দিন পরিচয় দেন। পরিচয় পেয়ে তাকে তাদের সঙ্গে বাইরে যেতে বলেন এবং বাড়ির লোকজনের বাছে একটি গামছা চান।
তৌহিদ জানান, এ সময় সিরাজ উদ্দিনের পিছে পিছে কেউ কেউ যেতে চাইলে তাদের বন্দুকের মুখে ঘরের ভেতরে যেতে বলা হয়। এ সময় বেগম নুরজাহান সিরাজী তাদের হাতে একটি গামছা তুলে দিয়ে সবাই ঘরের ভেতরে চলে যান।
সাক্ষী বলেন, এরপর বন্দুকধারীরা আমার বাবার চোখ বেঁধে নগ্ন পায়ে তাকে নিয়ে যায়। এটাই ছিলো আমার বাবা প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের শেষ যাত্রা।
তিনি জানান, এরপর তাদের পরিবার জানতে পারেন, সিরাজ উদ্দিন হোসেনের মতো আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে একইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হক, নিজামউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ ছিলেন।
সাক্ষী তৌহিদ রেজা বলেন, ছোটবেলা থেকেই মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, ওই রাতে তাদের বাড়িতে যারা গিয়েছিলেন, তারা ছিলো আলবদর সদস্য। এছাড়া বিভিন্ন বইপত্র, পত্র-পত্রিকা পড়ে, বিভিন্ন তথ্যচিত্র দেখে এবং ‘প্রজন্ম ৭১’ নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে আরো জানতে পারি।
তিনি জানান, আমি ১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যের ‘টোয়েন্টি টোয়েন্টি’ টেলিভিশনের তথ্যচিত্র ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ তৈরির কাজে জড়িত ছিলাম। এই তথ্যচিত্রের গবেষণার কাজ করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খানের জড়িত থাকার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকার নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ছিলেন মৃত ডলি চৌধুরী (শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ভাইয়ের বউ), আ ন ম গোলাম রহমান (শহীদ বুদ্ধিজীবী আনম গোলাম মোস্তফার ভাই), মৃত আতিকুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
এছাড়া দৈনিক পূর্বদেশসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এই দুই ব্যক্তির বিষয়ে ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানান তিনি।
তৌহিদ রেজা নূর আরো জানান, ১৯৭২ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সংখ্যায় বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘাতক হিসেবে চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
গত ১৫ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও ৫ সাক্ষী। তারা হচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি মাসুদা বানু রত্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের ছেলে ড. এনামুল হক খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তাদেরকে জেরা শেষ করেছেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামিপক্ষের দুই আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।
১৫ জুলাইই প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিচার কাজ শুরু হয়। পলাতক এ দুই অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতেই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান।
গত ২৪ জুন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ও আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত ১৬ জুন তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৪ জুন বিদেশে পলাতক এ দুই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ২ মে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সম্ভাব্য ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশন জানানোর পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারকে দু’টি জাতীয় দৈনিকে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৫ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৩
এমএইচপি/এমএমএস/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]