চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০২:৩৫, মে ৮, ২০১৩

রাত্রি হলো ভোর।/আজি মোর/জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,/প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি/হাতে করে আনি/দ্বারে আসি দিল ডাক/...উদয় দিগন্তে ওই শ্রভ্র শঙ্খ বাজে।/মোর চিত্ত-মাঝে/চির নূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ। হ্যাঁ, আবারও এসেছে সেই দিন।

আজ (৮ মে) পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী। ১৫১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল তার জন্মদিনের। তবুও বাঙালি মানসে এখনো তিনি দিবাকরের মতো সমান সমুজ্জ্বল, তার কিরণ এতোটুকু ম্লান হয়নি।
প্রতি বছরই এ দিনটি আসে, চলেও যায়; কিন্তু আমাদের নতুন করে দিয়ে যায় আত্মপরিচয়ের তাগিদ। আত্মশক্তির উদ্বোধনের আহ্বান, মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসার বারতা। এদিনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের শুভদিন, জাতি হিসেবে আমাদের শুভ সংকল্পগুলো নবায়নেরও দিন।

রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বিরাট প্রেরণা হয়ে ছিল। বিশ্বে খুব কম কবিই এরকমভাবে কোনো দেশের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। বাঙালি জাতির অহংকার তিনি।
বহুমাত্রিক পরিচয় তার। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার,  প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও একজন দার্শনিক। শুধু তা-ই নয়, তিনি মানবতাবাদের এক অবিস্মরণীয় ধারক। বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসে তাদের আত্মপ্রকাশের সহযাত্রী।
 
কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর বছরব্যাপী মহাযজ্ঞের সমাপ্তি আর এ উপলক্ষে আজ নগরের অনেক মিলনায়তনে বাজবে তার গান। সেখান থেকে নৃত্যের তালে আর নূপুরের নিক্কনে ছড়িয়ে পড়বে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। নাচে, গানে আলোচনায় বাঙালি জাতি আজ স্মরণ করবে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ
বাঙালির চিন্তায়, চেতনায়, মননে--- এক কথায় সমগ্র সত্তাজুড়েই রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে বিরাজমান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে এবং বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারটি ছিল একাধারে ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান। তাদের বংশগতভাবে তারা ছিলেন আসলে  পিরালী ব্রাহ্মণ । পরে তাদের নামের সঙ্গে ``ঠাকুর`` কথাটি যুক্ত হয়। কবিগুরুর ছদ্মনাম ভানুসিংহ ঠাকুর। কৈশোরকালে তিনি এই ছদ্মনামে লিখতেন। তখনকার লেখা কবিতা ``ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি`` নামে ছাপা হয়।

বাল্যকালে স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি। গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই বিভিন্ন বিষয়ে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনকি শরীরচর্চা ও মল্লক্রীড়াও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’তে তার ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা।

 ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার শশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহিতে।

 ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।

১৯০২ সালে তার স্ত্রী মৃণালিনী মারা যান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কবি। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের  জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন কবি।

১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে তিনি বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন ‘শান্তি নিকেতন’।১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী।  দীর্ঘ জীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।

তার সম্পাদনায় ভারতী, সাধনা, বঙ্গদর্শন প্রভৃতি পত্রিকা বের হয়। ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘মানসী’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘সোনার তরী’ ‘বলাকা’, ‘গীতবিতান’, ‘নৈবেদ্য’, ‘গীতাঞ্জলি’ তার কাব্য। ‘শেষের কবিতা’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’, ‘চতুরঙ্গ’ তার রচিত উপন্যাস। ‘ছিন্নপত্র’ তার অবিস্মরণীয় পত্রসাহিত্য।

বাহান্ন বছর বয়সে ১৯১৩ সালে তিনি তার গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য বিশ্বসাহিত্যের সবচে সম্মানজনক পদক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

নওগাঁর পতিসরে নিজের জমিদারির গরিব প্রজাদের নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে তিনিই প্রথম গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও পাবনার শাহজাদপুরে তার জমিদারিতে প্রজাদের কল্যাণের স্বার্থে আরও অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।বহুবার প্রজাদের খাজনা মওকুফ করে নিজে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। নিজের অর্থে প্রজাদের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন।

৮০ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কলকাতার, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য- ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা।

বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবিগুরুর ১৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারত নানা আয়োজনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন করছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক।

কর্মসূচী ॥ বুধবার ছায়ানট প্রকাশ করছে ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’ শীর্ষক গীতি-আলেখ্য। সন্ধ্যা ৭টায় ছায়ানট মিলনায়তনে এ অডিও সিডির উন্মোচন করবেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

বিকেলে জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করবে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা। সঙ্গীত ও নৃত্যসহ নানা আয়োজন দিয়ে সাজানো হবে অনুষ্ঠান। উৎসবের উদ্বোধন করবেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সভাগৃহে একক বক্তৃতা, রবীন্দ্র-পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বাংলা একাডেমী। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। ‘একবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা প্রদান করবেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

ঢাকার বাইরে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার ৩ দিনব্যাপী রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী এবং নোবেল প্রাপ্তির ১০০তম বছর উদযাপিত হবে অনুষ্ঠানে।

সহায়ক সূত্র:
•বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৬ সংস্করণ, পৃ. ১
•বঙ্গসাহিত্যাভিধান, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯২, পৃ. ৫০

 বাংলাদেশ সময়: ০১২০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৩
এডিএ


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান