লাশের দেশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ২০:১৫, এপ্রিল ২৫, ২০১৩

১.
হুড়োহুড়ি... ওড়াওড়ি সকলের মাঝে... চলছে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি। মহা হুল্লোড়ে মেতেছে সবাই। কেউ কি আর সুযোগ হারাতে চায়? একটু দেরি হলেইতো বাদ পড়ে যাবে! তখন বসে বসে মুখে আঙুল পুড়ে দেখা ছাড়া কোন কাজ থাকবে না। সবাই মহা আনন্দ নিয়ে খুটে খুটে চামড়া, মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি, কলিজা, মগজ খাবে, তাজা রক্ত চাটবে আর ডানা তুলে ভ্যাঙাবে। শোনা যাচ্ছে, আজকেরটা নাকি দারুণ! একদম ফুলে ফেঁপে ওঠা, থলথলে মাংস, নরম চামড়া, নাড়ি-ভুঁড়িও বেশ দশাসই হয়ে আছে। আহা!...সবার মধ্যেই একটা “চলো চলো, খাবো খাবো” রোল পড়ে গেছে। আজকেরটার নিশ্চয়ই রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে, অতএব তাজা রক্তের আশা বাদ, আর দেরি হয়ে গেলে আবার নাড়ি-ভুঁড়িটার মজার অংশটাই পাওয়া যাবে না এমনকি ভালো মাংসটাও না, তখন শুধু চামড়া আর খুলিতে ঠোকাঠুকি। ওড়ো, ওড়ো...তাড়াতাড়ি! বাদ পড়া যাবে না আজকে।

আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে
হাটে মাঠে, পথে ঘাটে, কত শোভা লাশে লাশে!

হুমম! সাবাই খাচ্ছে... দারুণ মজা! উহুমম! এত বিশাল লাগছে লাশটাকে! জিন্দা থাকতেও লোকটা মনে হয় বেশ উচা-লম্বা ছিলো। আর এখন তো সাইজে দুই গুণ। কত দিন ধরে নদীর পানি খেয়েছে কে জানে? পেটের ডান পাশে একটা ফুটা আছে লাশটার, সেটা নাকি গুলির। কী সুন্দর! ওই ফুটা দিয়ে একজন আবার তার কালো আর চিকন ঠোঁটটা সেঁধিয়ে দেয়। যখন বের করে আনে সবাই উৎসুক হয়ে দেখে তার ঠোঁটে নুডলসের মতো পেচিয়ে আছে কী যেন। ফুড়ৎ করে ও যখন এক টানে খেয়ে নেয় আর চোখ-মুখ নাচিয়ে তোলে খুশিতে, সবারই তখন বেশ আনন্দ লাগে, একটু হিংসা যে লাগে না, তাও না!

প্রাণেশ্বরী নদীর ঢেউয়ে আছাড় খেতে খেতে এখানে ধাক্কা খেয়েছে এই লাশটা। ওরা বলাবলি করে, বেশ চুপি চুপি ফিসফাস করে- কালো পট্টি, বুট আর চশমাওয়ালারা নাকি তুলে নিয়ে গিয়েছিল লোকটাকে। পণ্ডিত বলে- ‘এই ধরণীতে আমরাই কেবল কালো নই, আমাদের মতো ওদেরও সারা শরীর, আগাপাছতলা কালো। এই জন্যই বলি- কালোই ভালো!’

পণ্ডিতকে নিয়ে এই হলো সকলের জ্বালা...ব্যটা সুযোগ পাইলেই খালি জ্ঞান ছাড়ে...বুদ্ধিজীবী হইছে!

আরে ভাই কালো লোকগুলা এই ব্যাটারে তুইলা নিয়া কী করলো!
‘ঠিক ঠিক’- মহা কৌতুহলে শুনতে চায় অন্যরা।

আর কি? শুরু হয় খোঁজাখুজি...ওই ব্যাটার বাপ-মা, আত্মীয়-পরিজন সবাই খোঁজে। নাই, নাই। থানা-হাজত, হাসপাতাল, এমনকি কালো পট্টিওলাদের দপ্তর কোনোখানেই নাই। আরে পট্টিওলারাতো বলে- হ্যারা নাকি এই ব্যাটারে আনেই নাই।

হা...হাহা... কা..কাকাকা... অট্টহাসিতে ডানা ঝাপটায় সবাই।
তারপর? তারপর?

তারপর আরকি! সাড়ে নয় দিন পর পাওয়া গেছে প্রাণেশ্বরীর ধারে, ভাসতে ভাসতে আমাদের কাছে।
দারুণ! দারুণ! কী সুন্দর কাম করে আমাদের কালো পট্টিওলারা। হরষে-পুলকে ওরা খায় আর গায়-

লাশ ভাইসাছে রে মওলা
লাশ ভাইসাছে...
প্রাণেশ্বরী নদীর বুকে
লাশ ভাইসাছে।
এই লাশেরই এমন ধারা...
মরার আগে মরছে তারা...

২.
শুধু কি এইটাই! এরকম আরও অনেক অনেক লাশের নহর এই ভাগাড় জুড়ে। মুর্দ্দা লাশের সাথে সাথে আছে জিন্দা লাশও। খাই-দাইয়ের অভাব নাই। ক্যান খাবে আর পঁচা বাসি, ময়লা-আবর্জনা কিংবা মানুষের উচ্ছিষ্ট? আস্ত লাশইতো সবচেয়ে সস্তা এখন। আকাশে উড়তে উড়তে, এই বিল্ডিং থেকে ওই বিল্ডিঙে উড়ে উড়ে, লোভনীয় কিছুর জন্য কাউকে তাড়া করে বা কখনও কারো তাড়া খেয়ে, নিজেরা পরস্পর মারামারি আর কাড়াকাড়ি করতে করতে, কিংবা দালানের ছাদে ও ইলেকট্রিকের তারে বসে বসে প্রতিদিন অপেক্ষা করা লাশের জন্য। অবশ্য অপেক্ষা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। লাশ আসবেই। নিশ্চিত। নানা কিছিমের লাশ। খাওয়া-দাওয়া কিংবা ভোজন অথবা অতিথি ভোজন সবকিছুতেই এখন শুধুই লাশ। কেউই এখন আবর্জনার স্তুপ বা ভাগাড়ের অন্য কোনকিছুর দিকে ফিরেও দেখে না। দরকারটাই বা কী! ভাগাড় এখন সুখের রাজ্য, একেবারে স্বপ্নপুরী।

আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী...
লাশে ঘেরা স্বপ্নপুরী...
মরা লাশ, জ্যাতা লাশ, আধা লাশ, পুরা লাশ
হরেক লাশের স্বপ্নপুরী

আসছে...আসছে... আরও একটা!!! ভেসে উঠেছে নদীর এক কোণায়। কী মজা! কী মজা!! আবার হুড়োহুড়ি...ওড়াওড়ি সকলের মাঝে...চলছে দিগি¦দিক ছুটোছুটি সেইদিকে। ওমা! এ দেখি ছোট্ট সাইজের একটা লাশ। নাহ্ মজা লাগবে না। হাড় মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি, মগজ-কলিজা সবই তো পরিমাণে কম। কয়জন খাবে? দূর! তবে এর মধ্যেই কয়েকজন আবার চোখ আর পেটের মধ্যে ঠোকাঠুকি শুরু করে দিয়েছে। তারা সবাই শিশু। তাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ দেখা যাচ্ছে। তাই দেখে সবচেয়ে মুরুব্বি, ভূষণ্ডি বললো- ‘থাক এই মিনি সাইজেরটা আমাদের মিনিদের জন্যই থাক’। চলে যায় সবাই। শুরু হয় মিনিদের মধ্যে মহাভোজ। কী দারুণ! সে এক দেখার মতো ব্যাপার! পেট আর চামড়ায় ঠোকাঠুকি।

শিশুদের এই উচ্ছৃঙ্খল কোলাহলে, তাদের অশিক্ষিতের ন্যায় আচরণে মেজাজ বিগড়ে যায় পণ্ডিতের। ক্রুব্ধ হয়ে বলে- ‘কেবলই পেট আর চামড়ায় কী আছে? আরে মাথাটায় দ্যাখ...এ মাথা যেনতেন মাথা নারে...মেধাবী মাথা...রেকর্ড মার্কসে পাস দিয়েছে...ওর মগজটা আর খুলিটা নিজের পেটে নিতে পারলে কিছু বিদ্যে-বুদ্ধি হবে তোদের। খারে খা...মাথাটা খা’

এই নির্দেশে মাথায় ঠোকাঠুকি করে শিশুরা। খুটিয়ে খুটিয়ে খেয়ে চলে। আহ! ভোজের মহা উল্লাস যেন! মিনি সাইজ এক মেধাবী মাথাটাকে মহা আনন্দে কালো ঠোঁটে ছেঁড়া-ফাঁড়া করে শিশুরা।

আমরা আছি বেশ
সোনার লাশের দেশ
খ্যাকশিয়ালে কামড়ালো
ত্বকীর মতো কোলের আলো
কেড়ে নিলো, ছড়িয়ে দিলো
প্যাঁচার আঁধার রেশ
তবুওতো ছোঁয়া না গেলো
ওই পশুদের কেশ

আহা! আমার আছি বেশ
সোনার লাশের দেশ...


৩.
কাঁদে এক শিশু। কা...কাআআ...কাহুউউ...কা..কা...
আহারে! কী হয়েছে? এগিয়ে আসে দাঁড়। শিশু জানায় তাকে, যে অন্য সবার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে ওই মিনি লাশটার কোনো কিছুই সে ভাগে পায়নি। এই শুনে দাঁড় বলে- কাঁদিস না, কাঁদিস না সোনা, তোকে একটা আস্ত লাশ খাওয়াবো। একেবারে তাজা, কাঁদিস না... এই শুনে সে কি আনন্দ শিশুটার। তার সাথে জুটে যায় আরও শিশুরা। সকলে মিলে কোরাস করে উড়ে যায় আর গায়-

ভাগাড় জুড়ে লাশের নহর,
মরছে কত রোজ
তাই দিয়ে আজ হবে
মহা এক ভোজ
আজকে বকর, কাল জুবায়ের
মরছে হামেশাই
উধাও পরেশ রিছিল আরও
কল্পনাও নাই
আগুন পোড়া ছাই-ভস্ম
সরেন নেতার দেহ
এমনি করে নতুন মরা
মরবে কেউ না কেহ

ওরা উড়ে চলে। উড়ে গিয়ে বসে প্রধান সড়কের পাশে এক খাম্বার তারে। অনেক উঁচু। সেখান থেকে বেশ ভালোভাবেই প্রায় পুরো শহরটাই দেখা যায়। অনেক দূর পর্যন্ত। তারা অপেক্ষা করে। তাদের চোখে মুখে প্রতীক্ষার ছাপ। কখন একটি লাশ পড়বে ভাগাড়ে। আর তাই নিয়ে মহাভোজ করবে শিশুরা। সামনে-পিছনে, ডানে-বাঁয়ে সবদিকে তাকিয়ে থেকে অনেকটাই বিরক্ত শিশুরা। ওফ কখন হবে একটা লাশ। ভাগাড়ের মরায় কি আজ ভাটা পড়লো তবে! দাঁড় বোঝায় তাকে, ‘আহা ভালো কিছুর জন্য একটু প্রতীক্ষা করো না!’ সন্দেহ জাগে শিশুর মনে- ‘আজ যদি নাই মিলে কোনো মরা ভাগাড়ে?’
মহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে দাঁড়- ‘তাই কি হয়! একটা না একটা লাশ তো পড়বেই এখানে’। তারের ওপরে বসে বসে পুরো সড়কটা দেখতে দেখতে, প্রবোধ দেয় শিশুকে- ‘ওই দ্যাখো, একটা গাড়ি কী টান টানছে...আরেকটা দ্যাখো...ওই যে ছোটা ছুটছে...সামনেই পুকুর, পড়লেই হয়, একসাথে সত্তরটা...আহা! কপালে থাকলে ঠেকায় কে?’ আবার দ্যাখো একজন দৌড় দিল গাড়ির সামনে দিয়ে। আহাহাহা একটুর জন্য মরলো নারে! কী আফসোস! আকাশের দিকে তাকায় দাঁড়। ‘উঁচা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটি ইটের আধলাও কি পড়তে পারে না। তাইলেওতো হয়। দূর, কী যে দিনকাল পড়লো?’

এমন সোনার ভাগাড়
এখন শুধুই হাহাকার...


৪.
আর নয় হাহাকার, আর নয় ক্রন্দন। ওইতো...মিলেছে। লাশ মিলেছে। হ্যা বিশাল আয়োজন মনে হচ্ছে। অনেক লোকের ভিড়। সড়কের পাশে বিশাল খাম্বার তিন তারের ওপরের তারে বসে দাঁড় আর শিশুরা দেখে পৃথিবীর মানবশিশুদের হোলিখেলা। প্রাণপণে ছুটে চলে একজন... তার পেছনে রক্তাক্ত আর সূর্যালোক প্রতিফলিত ঝা চকচকে মৃত্যুনিশান। নিশানের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে আপ্রাণ ছুটে চলে লোকটা! আকুতি ছোড়ে দুই হাত করজোড়ে- ‘আমি বিশ্বজিৎ...আমি হি..আ..আআআআআ...’

মাটির মানবের উন্মত্ত হোলিখেলার উল্লাস আর আর্তনাদ ধ্বনি এবং রক্তাক্ত আবিরে রাঙা হয়ে ওঠে কালো আকাশ। তাতে রাঙা হয় ওদের মন। দারুণ! দারুণ!!! আনন্দে ডানা ঝাপটায় শিশুরা। আর মুখ ভেঙচিয়ে বলে- ইস! বিশ্বজিৎ হও আর হি বা মি যেই হও বাঁচতে তুমি পারবা না। তুমি বাঁচলে আমরা খাবো কী? তার সাথে বাকীরাও যোগ করে-

ক্ষমতার হোলিখেলায়
আহা কি অবলীলায়
আবির রাঙা হয়ে নয়
পুঁজ মাখা হাতের তলায়
বিশ্বজিৎ বলি হয়ে যায়

আকাশে যখন ওদের উল্লাসের কোরাস চলে, মাটির দুনিয়ায় কোথাও কি এক বিলাপের চিকন সুর শোনা যায়? যে সুর সকল শোক কাটিয়ে, মাটির দানবদের রুখে দেয়ার শক্তি অর্জনের কোরাস হতে পারে! হয়তো...

৫.
কিন্তু তার আগেই যে উল্লাসের হর্ষধ্বনি ওঠে পুনর্বার। খবর আসে- আরও লাশ- ওহো! লাশ! লাশ!! লাশ!!!

আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ কাঁপিয়ে দেয় চারধার। হঠাৎ-ই আলোর ঝলকানি...আগুনের হলকা আকাশে... আহা! সে কি উল্লাস সবার মাঝে! আগুন দেখে প্রথমটায় সবাই ভয় পায় কিন্তু আচমকাই খবর আসে এক মহাভোজের সম্ভাবনার। জানা গেল অনেকগুলো লাশ হয়েছে...অনেক...অ..নে..ক...আজ আর কেউ বাদ যাবে না ভোজ থেকে। ওরে মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে... না না...আগুন দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়। যে দালানে উঠেছে এই লেলিহান শিখা, সেটি যাদের রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে আকাশমুখী হয়ে উঠেছে, নামমাত্র জীবিকায় যাদের জীবনটাই কেড়ে নেয় এই দালান- সেইসব মানুষের রুগ্ন দেহ এই দালানে খুব অল্প তাপেই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়ে যাবে এই-ই স্বাভাবিক।

দারুণ ভোজের আয়োজন ওদের মাঝে বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। কিছুদিন আগের অপূর্ব এক ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ডিনারের কথা মনে পড়ে যায় ভূষণ্ডির। আহ! সে এক দুর্দান্ত ভোজ! গদগদ ভঙ্গিতে একজন জানতে চায়- ‘কোন ভোজ? কোন ভোজ?’

আরে ওই যে ওরা তিন মাল- আমিন, তরিকুল আর সালেকিন। ওগো রসায়া রসায়া খাইলাম, মনে নাই! বেচারারা কয়লার জন্য নিজেরাই কয়লা হইয়া গেল। সেদিন ছিল চমৎকার সময়, কী ভোজ...কী গান...কী আনন্দ...

আমিন, সালেকিন আর তরিকুল
বোকার দল ওরা, করিলো কী ভুল
কালো ফুলে ঘেরা ছিলো ফুলের বাগান
সবারে বাঁচাতে দিলো নিজেদের জান
এমন না করলে, হতো কি ঝাক্কাস!
ওদের ছাড়াও খেতাম আরও কত লাশ!

যাক এবার সেই ‘আরও কত লাশ’ খাওয়ার আক্ষেপ মিটলো বুঝি। ৩টা না, ৪টা না...১০টা না ২০টা না...একেবারে ১১১টা... বুড়ি একজনের চিকন হাহাকার শোনা যায়- ‘আমারে একটা দিস, একটু তাপ দিয়া, ভাপে রাইখা লবণ মাখায়া খামু নে...’

কিন্তু নাহ্! এত সুখ আর বুঝি করা হইলো না। আগুনের এত তাপ, এত তাপ যে তার মধ্যে পড়ে লাশগুলো এত্ত বেশি ফ্রাই হয় যে, এক্কেরে খাওয়াই গেল না। এত্ত লাশ, একদম ফ্রাই...কিন্তু খাওয়াই গেল না

তাতে কী? পণ্ডিত সবাইকে কণ্ঠে দৃঢ়তা আর আশার রেশ নিয়ে বাণী শোনায়, ‘হতাশ হইও না, এই সংকট সাময়িক। খাদ্যে আমরা দিনদিন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। আর এইটা কি বাংলাদেশ নাকি, যেখানে খাওয়ার জিনিসের হয় অভাব, নয়তো অনেক দাম; যেখানে মানুষ খাওয়া চোখেই দেখে না, নইলে কেনার সাধ্য নাই। এটি আমাদের সোনার ভাগাড়।’

এই না সোনার ভাগাড়ে
কী আনন্দ আহারে!

৭.
নাচতে নাচতে, ঢোল পেটাতে পোটাতে খবর ছড়িয়ে দেয় একজন- আসছে...আসছে...আরও অনেক নতুন নতুন লাশ, লাশ আর লাশ...! মহাভোজ সকলের জন্য। সত্যিই! আমাদের এখন মহা সুসময়, কোনো সংকট নেই। কারও আর দুঃখ নেই। চারদিকে সুখ আর সুখ...

সকলের মাঝে মহাউল্লাস। ওরে বাব্বাহ্! এবার মনে হয় ১১১ কেও ছাড়িয়ে যাবে। আবর সেই দালান! সেই রুগ্ন মানুষের জীবনখেকো দালান। সেই মুনাফাখেকো দানবদের দালান।

আবার! ভাইরে আবার
উইড়া চলো সাভার
লোভের চাকায় পিষ্ট মানুষ
পুরাই মরলো এবার।

সবাই উড়ে চলে সেইদিকে। বলাবলি করে- সবগুলোই তাজা...গরম, গরম...নাড়ি-ভুঁড়ি এক্কেরে ইনট্যাক...ওরা খায়, চোখে-মুখে আনন্দ...

এই না সোনার ভাগাড়ে
কী আনন্দ আহারে!

বাঁধনহারা, উন্মাতাল করা আনন্দ সবার মাঝে। হঠাৎ-ই একটু যেন ভাটা পড়ে একটি খবরে। সকলের দৃষ্টি ঘুরে যায় ভাগাড়ের পাশে সড়কের ধারে খাম্বার তার বা লোহার বেড়ার দিকে- কী ওটা? কী ঝুলছে? আরও একটি লাশ? না কি ওদেরই কেউ! যেমন করে ওরা ঝুলে পড়ে কখনও কখনও, যখন ওরা লাশ হয়।

ওরা বিস্মিত! ওরা স্থবির। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় উল্লাস-আনন্দ। বুঝে উঠতে পারে না যেন?
ওটা লাশ! আরেকটি লাশ। বুঝতে পারে সবাই। তবে বেদনার্ত কণ্ঠে তাদের জিজ্ঞাস্য- তবে কেন ঝুলছে ওমন করে? ওদের মতো করে?

পণ্ডিত আবিষ্কার করে ওটা লাশ! আরও একটি লাশ! বাহ্! বাহ্! কী আনন্দ... আনন্দ-উল্লাস এবার যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। তবে তা আরও একটি লাশ পাওয়ার জন্য, না কি নিজেদের নিয়ে হঠাৎ যে দুঃস্বপ্নের ঘোর তৈরি হয়েছিল তা থেকে মুক্তি পাওয়ার, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য মুছে ফেলার আনন্দে তা বোঝা যায় না। আত্মহারা ফূর্তির জোয়ারে ভেসে গিয়ে ওরা গেয়ে ওঠে-

ভাইজান দ্যাখছো নি, বইনগো হুনছো নি
কাটা তারে, কাউয়ার লাখান ঝুইলছে ফেলানি
আরে! কাটা তারে আমরার লাহান ঝুইলছে ফেলানি


৮.
লাশের দেশ বা ভাগাড়ে এই উল্লাস আকাশ-বাতাসে যেন এক নতুন রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। লাশের নহরে ভেসে আসছে, জেগে উঠছে ওদের প্রাণের জোয়ার। ওরা হাসে-গায় আর লাশ খায়। আর আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে নতুন নতুন লাশের। ওরা নিশ্চিত, লাশ আসবেই, নহরে ভেসে আসবেই এক বা একাধিক লাশ। এই ভাগাড়ে লাশের যোগানদারেরা কখনোই ক্লান্ত হবে না, রুখবে না কারণ তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা তো বেঁচেই আছে লাশের যোগান দিতে। তারা বেঁচেই থাকে লাশ হয়ে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তারা বেঁচে থাকে লাশের মতো।

ওরা জানে, ওরা দেখে তাদের।
ওরা দেখে, লাশের মিছিল। মরা লাশ, জীবিত লাশ...
ওরা দেখে, প্রতিদিন কত সহজে কত অনায়াসে আর অপ্রয়োজনেই তারা লাশ হয়ে যায়...
ওরা দেখে, লাশের নহরে জোয়ার বইয়ে দিতে তাদের কত শত আয়োজন...

ওরা জানে, সেই আয়োজনে তারা ক্রমাগত অংশ নিবে, যতক্ষণ না তারাও লাশ হয়ে যায়...
ওরা জানে, একটি লাশের শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা আরও লাশের যোগান দিবে...
ওরা জানে, এখানে জীবন মানে শুধুই লাশ হয়ে থাকা, মৃত অথবা জীবিত...

আর তাই ওরা মৃত লাশ নিয়ে উল্লাস করতে করতে, খেয়ে-দেয়ে হজম করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে, স্ফূর্তিতে উড়তে উড়তে চেয়ে থাকে জীবিত লাশেদের দিকে। ওদের বোধহয় একটুও ভয় হয় না, একটুও সংকুচিত হয় না ওরা এই ভেবে যে, যদি তারা- ওই লাশের যোগানদারেরা রুখে দেয় লাশের নহর!

কিন্তু তা-ই কি পারবে তারা? লাশের যোগানদার ওই জীবিত লাশের দল?

নিশ্চিত ভঙ্গিতে ওদের কালো ডানা ঝাপটানো আর উল্লসিত প্রাণে গেয়ে ওঠা সুর ছাড়া আর কোনো দৃশ্য কি কোথাও দেখা যায়? আর কোনো ধ্বনি কি কোথাও কেউ শুনতে পায়?


বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ২৫ এপ্রিল ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, [email protected]মনিরুল ইসলাম রুবেল-এর নাটক
লাশের দেশ


১.
হুড়োহুড়ি... ওড়াওড়ি সকলের মাঝে... চলছে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি। মহা হুল্লোড়ে মেতেছে সবাই। কেউ কি আর সুযোগ হারাতে চায়? একটু দেরি হলেইতো বাদ পড়ে যাবে! তখন বসে বসে মুখে আঙুল পুড়ে দেখা ছাড়া কোন কাজ থাকবে না। সবাই মহা আনন্দ নিয়ে খুটে খুটে চামড়া, মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি, কলিজা, মগজ খাবে, তাজা রক্ত চাটবে আর ডানা তুলে ভ্যাঙাবে। শোনা যাচ্ছে, আজকেরটা নাকি দারুণ! একদম ফুলে ফেঁপে ওঠা, থলথলে মাংস, নরম চামড়া, নাড়ি-ভুঁড়িও বেশ দশাসই হয়ে আছে। আহা!...সবার মধ্যেই একটা “চলো চলো, খাবো খাবো” রোল পড়ে গেছে। আজকেরটার নিশ্চয়ই রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে, অতএব তাজা রক্তের আশা বাদ, আর দেরি হয়ে গেলে আবার নাড়ি-ভুঁড়িটার মজার অংশটাই পাওয়া যাবে না এমনকি ভালো মাংসটাও না, তখন শুধু চামড়া আর খুলিতে ঠোকাঠুকি। ওড়ো, ওড়ো...তাড়াতাড়ি! বাদ পড়া যাবে না আজকে।

আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে
হাটে মাঠে, পথে ঘাটে, কত শোভা লাশে লাশে!

হুমম! সাবাই খাচ্ছে... দারুণ মজা! উহুমম! এত বিশাল লাগছে লাশটাকে! জিন্দা থাকতেও লোকটা মনে হয় বেশ উচা-লম্বা ছিলো। আর এখন তো সাইজে দুই গুণ। কত দিন ধরে নদীর পানি খেয়েছে কে জানে? পেটের ডান পাশে একটা ফুটা আছে লাশটার, সেটা নাকি গুলির। কী সুন্দর! ওই ফুটা দিয়ে একজন আবার তার কালো আর চিকন ঠোঁটটা সেঁধিয়ে দেয়। যখন বের করে আনে সবাই উৎসুক হয়ে দেখে তার ঠোঁটে নুডলসের মতো পেচিয়ে আছে কী যেন। ফুড়ৎ করে ও যখন এক টানে খেয়ে নেয় আর চোখ-মুখ নাচিয়ে তোলে খুশিতে, সবারই তখন বেশ আনন্দ লাগে, একটু হিংসা যে লাগে না, তাও না!

প্রাণেশ্বরী নদীর ঢেউয়ে আছাড় খেতে খেতে এখানে ধাক্কা খেয়েছে এই লাশটা। ওরা বলাবলি করে, বেশ চুপি চুপি ফিসফাস করে- কালো পট্টি, বুট আর চশমাওয়ালারা নাকি তুলে নিয়ে গিয়েছিল লোকটাকে। পণ্ডিত বলে- ‘এই ধরণীতে আমরাই কেবল কালো নই, আমাদের মতো ওদেরও সারা শরীর, আগাপাছতলা কালো। এই জন্যই বলি- কালোই ভালো!’

পণ্ডিতকে নিয়ে এই হলো সকলের জ্বালা...ব্যটা সুযোগ পাইলেই খালি জ্ঞান ছাড়ে...বুদ্ধিজীবী হইছে!

আরে ভাই কালো লোকগুলা এই ব্যাটারে তুইলা নিয়া কী করলো!
‘ঠিক ঠিক’- মহা কৌতুহলে শুনতে চায় অন্যরা।

আর কি? শুরু হয় খোঁজাখুজি...ওই ব্যাটার বাপ-মা, আত্মীয়-পরিজন সবাই খোঁজে। নাই, নাই। থানা-হাজত, হাসপাতাল, এমনকি কালো পট্টিওলাদের দপ্তর কোনোখানেই নাই। আরে পট্টিওলারাতো বলে- হ্যারা নাকি এই ব্যাটারে আনেই নাই।

হা...হাহা... কা..কাকাকা... অট্টহাসিতে ডানা ঝাপটায় সবাই।
তারপর? তারপর?

তারপর আরকি! সাড়ে নয় দিন পর পাওয়া গেছে প্রাণেশ্বরীর ধারে, ভাসতে ভাসতে আমাদের কাছে।
দারুণ! দারুণ! কী সুন্দর কাম করে আমাদের কালো পট্টিওলারা। হরষে-পুলকে ওরা খায় আর গায়-

লাশ ভাইসাছে রে মওলা
লাশ ভাইসাছে...
প্রাণেশ্বরী নদীর বুকে
লাশ ভাইসাছে।
এই লাশেরই এমন ধারা...
মরার আগে মরছে তারা...

২.
শুধু কি এইটাই! এরকম আরও অনেক অনেক লাশের নহর এই ভাগাড় জুড়ে। মুর্দ্দা লাশের সাথে সাথে আছে জিন্দা লাশও। খাই-দাইয়ের অভাব নাই। ক্যান খাবে আর পঁচা বাসি, ময়লা-আবর্জনা কিংবা মানুষের উচ্ছিষ্ট? আস্ত লাশইতো সবচেয়ে সস্তা এখন। আকাশে উড়তে উড়তে, এই বিল্ডিং থেকে ওই বিল্ডিঙে উড়ে উড়ে, লোভনীয় কিছুর জন্য কাউকে তাড়া করে বা কখনও কারো তাড়া খেয়ে, নিজেরা পরস্পর মারামারি আর কাড়াকাড়ি করতে করতে, কিংবা দালানের ছাদে ও ইলেকট্রিকের তারে বসে বসে প্রতিদিন অপেক্ষা করা লাশের জন্য। অবশ্য অপেক্ষা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। লাশ আসবেই। নিশ্চিত। নানা কিছিমের লাশ। খাওয়া-দাওয়া কিংবা ভোজন অথবা অতিথি ভোজন সবকিছুতেই এখন শুধুই লাশ। কেউই এখন আবর্জনার স্তুপ বা ভাগাড়ের অন্য কোনকিছুর দিকে ফিরেও দেখে না। দরকারটাই বা কী! ভাগাড় এখন সুখের রাজ্য, একেবারে স্বপ্নপুরী।

আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী...
লাশে ঘেরা স্বপ্নপুরী...
মরা লাশ, জ্যাতা লাশ, আধা লাশ, পুরা লাশ
হরেক লাশের স্বপ্নপুরী

আসছে...আসছে... আরও একটা!!! ভেসে উঠেছে নদীর এক কোণায়। কী মজা! কী মজা!! আবার হুড়োহুড়ি...ওড়াওড়ি সকলের মাঝে...চলছে দিগি¦দিক ছুটোছুটি সেইদিকে। ওমা! এ দেখি ছোট্ট সাইজের একটা লাশ। নাহ্ মজা লাগবে না। হাড় মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি, মগজ-কলিজা সবই তো পরিমাণে কম। কয়জন খাবে? দূর! তবে এর মধ্যেই কয়েকজন আবার চোখ আর পেটের মধ্যে ঠোকাঠুকি শুরু করে দিয়েছে। তারা সবাই শিশু। তাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ দেখা যাচ্ছে। তাই দেখে সবচেয়ে মুরুব্বি, ভূষণ্ডি বললো- ‘থাক এই মিনি সাইজেরটা আমাদের মিনিদের জন্যই থাক’। চলে যায় সবাই। শুরু হয় মিনিদের মধ্যে মহাভোজ। কী দারুণ! সে এক দেখার মতো ব্যাপার! পেট আর চামড়ায় ঠোকাঠুকি।

শিশুদের এই উচ্ছৃঙ্খল কোলাহলে, তাদের অশিক্ষিতের ন্যায় আচরণে মেজাজ বিগড়ে যায় পণ্ডিতের। ক্রুব্ধ হয়ে বলে- ‘কেবলই পেট আর চামড়ায় কী আছে? আরে মাথাটায় দ্যাখ...এ মাথা যেনতেন মাথা নারে...মেধাবী মাথা...রেকর্ড মার্কসে পাস দিয়েছে...ওর মগজটা আর খুলিটা নিজের পেটে নিতে পারলে কিছু বিদ্যে-বুদ্ধি হবে তোদের। খারে খা...মাথাটা খা’

এই নির্দেশে মাথায় ঠোকাঠুকি করে শিশুরা। খুটিয়ে খুটিয়ে খেয়ে চলে। আহ! ভোজের মহা উল্লাস যেন! মিনি সাইজ এক মেধাবী মাথাটাকে মহা আনন্দে কালো ঠোঁটে ছেঁড়া-ফাঁড়া করে শিশুরা।

আমরা আছি বেশ
সোনার লাশের দেশ
খ্যাকশিয়ালে কামড়ালো
ত্বকীর মতো কোলের আলো
কেড়ে নিলো, ছড়িয়ে দিলো
প্যাঁচার আঁধার রেশ
তবুওতো ছোঁয়া না গেলো
ওই পশুদের কেশ

আহা! আমার আছি বেশ
সোনার লাশের দেশ...


৩.
কাঁদে এক শিশু। কা...কাআআ...কাহুউউ...কা..কা...
আহারে! কী হয়েছে? এগিয়ে আসে দাঁড়। শিশু জানায় তাকে, যে অন্য সবার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে ওই মিনি লাশটার কোনো কিছুই সে ভাগে পায়নি। এই শুনে দাঁড় বলে- কাঁদিস না, কাঁদিস না সোনা, তোকে একটা আস্ত লাশ খাওয়াবো। একেবারে তাজা, কাঁদিস না... এই শুনে সে কি আনন্দ শিশুটার। তার সাথে জুটে যায় আরও শিশুরা। সকলে মিলে কোরাস করে উড়ে যায় আর গায়-

ভাগাড় জুড়ে লাশের নহর,
মরছে কত রোজ
তাই দিয়ে আজ হবে
মহা এক ভোজ
আজকে বকর, কাল জুবায়ের
মরছে হামেশাই
উধাও পরেশ রিছিল আরও
কল্পনাও নাই
আগুন পোড়া ছাই-ভস্ম
সরেন নেতার দেহ
এমনি করে নতুন মরা
মরবে কেউ না কেহ

ওরা উড়ে চলে। উড়ে গিয়ে বসে প্রধান সড়কের পাশে এক খাম্বার তারে। অনেক উঁচু। সেখান থেকে বেশ ভালোভাবেই প্রায় পুরো শহরটাই দেখা যায়। অনেক দূর পর্যন্ত। তারা অপেক্ষা করে। তাদের চোখে মুখে প্রতীক্ষার ছাপ। কখন একটি লাশ পড়বে ভাগাড়ে। আর তাই নিয়ে মহাভোজ করবে শিশুরা। সামনে-পিছনে, ডানে-বাঁয়ে সবদিকে তাকিয়ে থেকে অনেকটাই বিরক্ত শিশুরা। ওফ কখন হবে একটা লাশ। ভাগাড়ের মরায় কি আজ ভাটা পড়লো তবে! দাঁড় বোঝায় তাকে, ‘আহা ভালো কিছুর জন্য একটু প্রতীক্ষা করো না!’ সন্দেহ জাগে শিশুর মনে- ‘আজ যদি নাই মিলে কোনো মরা ভাগাড়ে?’
মহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে দাঁড়- ‘তাই কি হয়! একটা না একটা লাশ তো পড়বেই এখানে’। তারের ওপরে বসে বসে পুরো সড়কটা দেখতে দেখতে, প্রবোধ দেয় শিশুকে- ‘ওই দ্যাখো, একটা গাড়ি কী টান টানছে...আরেকটা দ্যাখো...ওই যে ছোটা ছুটছে...সামনেই পুকুর, পড়লেই হয়, একসাথে সত্তরটা...আহা! কপালে থাকলে ঠেকায় কে?’ আবার দ্যাখো একজন দৌড় দিল গাড়ির সামনে দিয়ে। আহাহাহা একটুর জন্য মরলো নারে! কী আফসোস! আকাশের দিকে তাকায় দাঁড়। ‘উঁচা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটি ইটের আধলাও কি পড়তে পারে না। তাইলেওতো হয়। দূর, কী যে দিনকাল পড়লো?’

এমন সোনার ভাগাড়
এখন শুধুই হাহাকার...


৪.
আর নয় হাহাকার, আর নয় ক্রন্দন। ওইতো...মিলেছে। লাশ মিলেছে। হ্যা বিশাল আয়োজন মনে হচ্ছে। অনেক লোকের ভিড়। সড়কের পাশে বিশাল খাম্বার তিন তারের ওপরের তারে বসে দাঁড় আর শিশুরা দেখে পৃথিবীর মানবশিশুদের হোলিখেলা। প্রাণপণে ছুটে চলে একজন... তার পেছনে রক্তাক্ত আর সূর্যালোক প্রতিফলিত ঝা চকচকে মৃত্যুনিশান। নিশানের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে আপ্রাণ ছুটে চলে লোকটা! আকুতি ছোড়ে দুই হাত করজোড়ে- ‘আমি বিশ্বজিৎ...আমি হি..আ..আআআআআ...’

মাটির মানবের উন্মত্ত হোলিখেলার উল্লাস আর আর্তনাদ ধ্বনি এবং রক্তাক্ত আবিরে রাঙা হয়ে ওঠে কালো আকাশ। তাতে রাঙা হয় ওদের মন। দারুণ! দারুণ!!! আনন্দে ডানা ঝাপটায় শিশুরা। আর মুখ ভেঙচিয়ে বলে- ইস! বিশ্বজিৎ হও আর হি বা মি যেই হও বাঁচতে তুমি পারবা না। তুমি বাঁচলে আমরা খাবো কী? তার সাথে বাকীরাও যোগ করে-

ক্ষমতার হোলিখেলায়
আহা কি অবলীলায়
আবির রাঙা হয়ে নয়
পুঁজ মাখা হাতের তলায়
বিশ্বজিৎ বলি হয়ে যায়

আকাশে যখন ওদের উল্লাসের কোরাস চলে, মাটির দুনিয়ায় কোথাও কি এক বিলাপের চিকন সুর শোনা যায়? যে সুর সকল শোক কাটিয়ে, মাটির দানবদের রুখে দেয়ার শক্তি অর্জনের কোরাস হতে পারে! হয়তো...

৫.
কিন্তু তার আগেই যে উল্লাসের হর্ষধ্বনি ওঠে পুনর্বার। খবর আসে- আরও লাশ- ওহো! লাশ! লাশ!! লাশ!!!

আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ কাঁপিয়ে দেয় চারধার। হঠাৎ-ই আলোর ঝলকানি...আগুনের হলকা আকাশে... আহা! সে কি উল্লাস সবার মাঝে! আগুন দেখে প্রথমটায় সবাই ভয় পায় কিন্তু আচমকাই খবর আসে এক মহাভোজের সম্ভাবনার। জানা গেল অনেকগুলো লাশ হয়েছে...অনেক...অ..নে..ক...আজ আর কেউ বাদ যাবে না ভোজ থেকে। ওরে মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে... না না...আগুন দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়। যে দালানে উঠেছে এই লেলিহান শিখা, সেটি যাদের রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে আকাশমুখী হয়ে উঠেছে, নামমাত্র জীবিকায় যাদের জীবনটাই কেড়ে নেয় এই দালান- সেইসব মানুষের রুগ্ন দেহ এই দালানে খুব অল্প তাপেই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়ে যাবে এই-ই স্বাভাবিক।

দারুণ ভোজের আয়োজন ওদের মাঝে বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। কিছুদিন আগের অপূর্ব এক ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ডিনারের কথা মনে পড়ে যায় ভূষণ্ডির। আহ! সে এক দুর্দান্ত ভোজ! গদগদ ভঙ্গিতে একজন জানতে চায়- ‘কোন ভোজ? কোন ভোজ?’

আরে ওই যে ওরা তিন মাল- আমিন, তরিকুল আর সালেকিন। ওগো রসায়া রসায়া খাইলাম, মনে নাই! বেচারারা কয়লার জন্য নিজেরাই কয়লা হইয়া গেল। সেদিন ছিল চমৎকার সময়, কী ভোজ...কী গান...কী আনন্দ...

আমিন, সালেকিন আর তরিকুল
বোকার দল ওরা, করিলো কী ভুল
কালো ফুলে ঘেরা ছিলো ফুলের বাগান
সবারে বাঁচাতে দিলো নিজেদের জান
এমন না করলে, হতো কি ঝাক্কাস!
ওদের ছাড়াও খেতাম আরও কত লাশ!

যাক এবার সেই ‘আরও কত লাশ’ খাওয়ার আক্ষেপ মিটলো বুঝি। ৩টা না, ৪টা না...১০টা না ২০টা না...একেবারে ১১১টা... বুড়ি একজনের চিকন হাহাকার শোনা যায়- ‘আমারে একটা দিস, একটু তাপ দিয়া, ভাপে রাইখা লবণ মাখায়া খামু নে...’

কিন্তু নাহ্! এত সুখ আর বুঝি করা হইলো না। আগুনের এত তাপ, এত তাপ যে তার মধ্যে পড়ে লাশগুলো এত্ত বেশি ফ্রাই হয় যে, এক্কেরে খাওয়াই গেল না। এত্ত লাশ, একদম ফ্রাই...কিন্তু খাওয়াই গেল না

তাতে কী? পণ্ডিত সবাইকে কণ্ঠে দৃঢ়তা আর আশার রেশ নিয়ে বাণী শোনায়, ‘হতাশ হইও না, এই সংকট সাময়িক। খাদ্যে আমরা দিনদিন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। আর এইটা কি বাংলাদেশ নাকি, যেখানে খাওয়ার জিনিসের হয় অভাব, নয়তো অনেক দাম; যেখানে মানুষ খাওয়া চোখেই দেখে না, নইলে কেনার সাধ্য নাই। এটি আমাদের সোনার ভাগাড়।’

এই না সোনার ভাগাড়ে
কী আনন্দ আহারে!

৭.
নাচতে নাচতে, ঢোল পেটাতে পোটাতে খবর ছড়িয়ে দেয় একজন- আসছে...আসছে...আরও অনেক নতুন নতুন লাশ, লাশ আর লাশ...! মহাভোজ সকলের জন্য। সত্যিই! আমাদের এখন মহা সুসময়, কোনো সংকট নেই। কারও আর দুঃখ নেই। চারদিকে সুখ আর সুখ...

সকলের মাঝে মহাউল্লাস। ওরে বাব্বাহ্! এবার মনে হয় ১১১ কেও ছাড়িয়ে যাবে। আবর সেই দালান! সেই রুগ্ন মানুষের জীবনখেকো দালান। সেই মুনাফাখেকো দানবদের দালান।

আবার! ভাইরে আবার
উইড়া চলো সাভার
লোভের চাকায় পিষ্ট মানুষ
পুরাই মরলো এবার।

সবাই উড়ে চলে সেইদিকে। বলাবলি করে- সবগুলোই তাজা...গরম, গরম...নাড়ি-ভুঁড়ি এক্কেরে ইনট্যাক...ওরা খায়, চোখে-মুখে আনন্দ...

এই না সোনার ভাগাড়ে
কী আনন্দ আহারে!

বাঁধনহারা, উন্মাতাল করা আনন্দ সবার মাঝে। হঠাৎ-ই একটু যেন ভাটা পড়ে একটি খবরে। সকলের দৃষ্টি ঘুরে যায় ভাগাড়ের পাশে সড়কের ধারে খাম্বার তার বা লোহার বেড়ার দিকে- কী ওটা? কী ঝুলছে? আরও একটি লাশ? না কি ওদেরই কেউ! যেমন করে ওরা ঝুলে পড়ে কখনও কখনও, যখন ওরা লাশ হয়।

ওরা বিস্মিত! ওরা স্থবির। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় উল্লাস-আনন্দ। বুঝে উঠতে পারে না যেন?
ওটা লাশ! আরেকটি লাশ। বুঝতে পারে সবাই। তবে বেদনার্ত কণ্ঠে তাদের জিজ্ঞাস্য- তবে কেন ঝুলছে ওমন করে? ওদের মতো করে?

পণ্ডিত আবিষ্কার করে ওটা লাশ! আরও একটি লাশ! বাহ্! বাহ্! কী আনন্দ... আনন্দ-উল্লাস এবার যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। তবে তা আরও একটি লাশ পাওয়ার জন্য, না কি নিজেদের নিয়ে হঠাৎ যে দুঃস্বপ্নের ঘোর তৈরি হয়েছিল তা থেকে মুক্তি পাওয়ার, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য মুছে ফেলার আনন্দে তা বোঝা যায় না। আত্মহারা ফূর্তির জোয়ারে ভেসে গিয়ে ওরা গেয়ে ওঠে-

ভাইজান দ্যাখছো নি, বইনগো হুনছো নি
কাটা তারে, কাউয়ার লাখান ঝুইলছে ফেলানি
আরে! কাটা তারে আমরার লাহান ঝুইলছে ফেলানি


৮.
লাশের দেশ বা ভাগাড়ে এই উল্লাস আকাশ-বাতাসে যেন এক নতুন রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। লাশের নহরে ভেসে আসছে, জেগে উঠছে ওদের প্রাণের জোয়ার। ওরা হাসে-গায় আর লাশ খায়। আর আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে নতুন নতুন লাশের। ওরা নিশ্চিত, লাশ আসবেই, নহরে ভেসে আসবেই এক বা একাধিক লাশ। এই ভাগাড়ে লাশের যোগানদারেরা কখনোই ক্লান্ত হবে না, রুখবে না কারণ তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা তো বেঁচেই আছে লাশের যোগান দিতে। তারা বেঁচেই থাকে লাশ হয়ে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তারা বেঁচে থাকে লাশের মতো।

ওরা জানে, ওরা দেখে তাদের।
ওরা দেখে, লাশের মিছিল। মরা লাশ, জীবিত লাশ...
ওরা দেখে, প্রতিদিন কত সহজে কত অনায়াসে আর অপ্রয়োজনেই তারা লাশ হয়ে যায়...
ওরা দেখে, লাশের নহরে জোয়ার বইয়ে দিতে তাদের কত শত আয়োজন...

ওরা জানে, সেই আয়োজনে তারা ক্রমাগত অংশ নিবে, যতক্ষণ না তারাও লাশ হয়ে যায়...
ওরা জানে, একটি লাশের শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা আরও লাশের যোগান দিবে...
ওরা জানে, এখানে জীবন মানে শুধুই লাশ হয়ে থাকা, মৃত অথবা জীবিত...

আর তাই ওরা মৃত লাশ নিয়ে উল্লাস করতে করতে, খেয়ে-দেয়ে হজম করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে, স্ফূর্তিতে উড়তে উড়তে চেয়ে থাকে জীবিত লাশেদের দিকে। ওদের বোধহয় একটুও ভয় হয় না, একটুও সংকুচিত হয় না ওরা এই ভেবে যে, যদি তারা- ওই লাশের যোগানদারেরা রুখে দেয় লাশের নহর!

কিন্তু তা-ই কি পারবে তারা? লাশের যোগানদার ওই জীবিত লাশের দল?

নিশ্চিত ভঙ্গিতে ওদের কালো ডানা ঝাপটানো আর উল্লসিত প্রাণে গেয়ে ওঠা সুর ছাড়া আর কোনো দৃশ্য কি কোথাও দেখা যায়? আর কোনো ধ্বনি কি কোথাও কেউ শুনতে পায়?

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ২৫ এপ্রিল ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, [email protected]


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান