
ঢাকা: “আমি আমার রুমের বেডে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গুরুতর আহত অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখি। যতোদূর মনে পড়ে, তার পায়ে যখম ছিল। তখন আমরা তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেই। এরপর তিনি আরো ৩/৪ দিন হাসপাতালে ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় বলে শুনেছিলাম।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দিতে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় আহত সাকা চৌধুরীর অবস্থার এমনই বর্ণনা দিয়েছেন ডা. এ কে এম শফিউল্লাহ। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাহউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২৭তম সাক্ষী।
রোববার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে ডা. এ কে এম শফিউল্লাহের। সাক্ষ্য দানকালে তিনি আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত সাকা চৌধুরীকে সনাক্তও করেন। পরে তাকে জেরা করেন সাকা চৌধুরীর আইনজীবী এএসএম আহসানুল হক হেনা।
সোমবার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৮তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ২ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। তিন সদস্যের মধ্যে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন অনুপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে ৬৭ বছর বয়সী ডা. এ কে এম শফিউল্লাহ চট্টগ্রামের শহরের ব্রেভারলি হিল আবাসিক এলাকায় থাকেন। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ১৯৭০ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জিকাল ইউনিক-১ এ ইন্টার্নি হিসেবে যোগদান করেন। আগস্ট মাসে ওই ওয়ার্ডেই সহকারী রেজিস্টার হিসেবে যোগ দেন তিনি।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় সাকা চৌধুরীর পিতা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বন্ধু ছমির উদ্দিনের বাসার কাছে গাড়িতে অ্যাম্বুশ করে সাকাকে হত্যার চেষ্টা চালান মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের গুলি ও গ্রেনেড চার্জে গাড়ির চালক মারা গেলেও সাকা প্রাণে বেঁচে যান। মারাত্মক আহত হয়ে সাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিৎসা নেন।
সাক্ষী ডা. এ কে এম শফিউল্লাহ সে সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে সাকার চিকিৎসা করেন। সে ঘটনারই বর্ণনাকালে তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, “১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে কোনো এক রাতে আনুমানিক রাত ১০টার দিকে আমাকে কল মেসেজ দিয়ে আমার ওয়ার্ডে আসতে বলা হয়। আধ ঘন্টার মধ্যে আমি আমার ওয়ার্ডে পৌঁছাই।”
সাক্ষী বলেন, “ওয়ার্ডে এসে আমি দেখি, আর্মি, পুলিশসহ ওয়ার্ডে অনেক লোক। এ সময় আমি আমার রুমের বেডে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গুরুতর আহত অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখি। যতোদূর মনে পড়ে, তার পায়ে যখম ছিল। তখন আমরা তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেই। এরপর তিনি আরো ৩/৪ দিন হাসপাতালে ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় বলে শুনেছিলাম।”
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও ২৬ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন, বাংলা একাডেমীর সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি, শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ ও পুত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ, শহীদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা, আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ (আব্বাস চেয়ারম্যান), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য মোঃ সালেহ উদ্দিন, ব্যবসায়ী পরাগ ধর (ক্যামেরা ট্রায়াল), চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক ছাত্রনেতা কাজী নূরুল আফসার, মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপ কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, শহীদ পরিবারের সদস্য অরুণাংশু বিমল চৌধুরী ও তার ভাতিজা আশীষ চৌধুরী, অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র দাশ, সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী, একজন ক্ষতিগ্রস্ত নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), শহীদ পরিবারের সদস্য দেবব্রত সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগীত শিল্পী সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনু, শহীদ পরিবারের সদস্য শেখ মোরশেদ আনোয়ার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর, শহীদ পরিবারের সদস্য অনিল বরণ ধর, মুক্তিযোদ্ধা বনগোপাল দাশ, শহীদ পরিবারের সদস্য বাবুল চক্রবর্তী বুলবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের চৌধুরী এবং মো. সোলায়মান।
তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ।
২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যুষে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত দল। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ। ৩ মে ও ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাকা চৌধুরীর বিচার।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৩
এমএইচপি/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]