
যারা নিজ হাতে ত্বকীকে খুন করেছে আমি মনে করি তারা নিতান্তই টাকার জন্যে করেছে। শিক্ষার অভাব তাদের মানবতাকে করেছে ধ্বংস। এতটাই বিবেকহীন বর্বরে পরিণত করেছে যে একটা নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি তারা। কিন্তু যারা এ খুন করিয়েছে তারা? তাদের কি প্রয়োজন? আরও টাকা, ক্ষমতা, নাকি অন্য কিছু...? কিসের প্রয়োজনে এ নোংরা রাজনীতি?
রাজনীতির প্রয়োজন দেশের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু এ খুনের রাজনীতি, লাশের রাজনীতি যারা করছে তারা কি আদৌ ভাবে দেশের উন্নয়ন বা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে? যে ভবিষ্যতের উন্নয়নে ত্বকী হতে পারত অন্যতম মেধা? তাহলে তারা কি চায়, আর দিনের পর দিন কেনই বা এই ক্ষমতালিপ্সু অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয় না, দেওয়া হয় না শাস্তি? আমরা জেনে আসছি ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।
তবে কি অলিখিতভাবে এ নীতি উল্টে গেল? হয়ে গেল দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়! চারদিকে যখন জাগরণ শুরু হলো অপরাধের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তখনি সুযোগসন্ধানী ক্ষমতালিপ্সুরা এই সময়টাকে নোংরাভাবে কাজে লাগানোর পাঁয়তারা করে খুন করল নিষ্পাপ ত্বকীকে। কারণ ত্বকীর বাবা আগে থেকেই কাজ করে আসছিলেন তার এলাকার মানুষের জন্য, তার এলাকার জাগরণে। আর বর্বর ক্ষমতালিপ্সুরা জানে মানুষ যত অন্ধকারে থাকবে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করা তত সহজ হবে। তাই ধ্বংস করে দিতে হবে আলোকিত মানুষদের। এ নোংরা রাজনীতির অবসান প্রয়োজন। এর অবসান চাই আমরা।
ত্বকী শব্দের অর্থ আলো । ত্বকীর মা ত্বকীকে নিয়ে গান গাইতেন ‘ত্বকী আমার ত্বকি ওগো ত্বকি ভুবন ভরা.....ত্বকী আমার ত্বকি ওগো ...’ আর আদুরে মিটিমিটি হাসতো ডাগর মায়াবি চোখের শান্ত ত্বকী । আলো অর্থের অসংখ্য সমার্থক শব্দ দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নাম। এত এত আলো অর্থ বহনকারী নাম রেখে ত্বকীর মা-বাবা এ নামটা বেছে নিয়েছেন কেন? তবে কি মায়ের নাড়িছেঁড়া ত্বকী সবার চেয়ে আলাদা হয়ে আরও উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হবে সেই স্বপ্নে মা-বাবা ত্বকী শব্দটা বেছে নিয়েছেন! এটুকু বয়সে ত্বকীর মেধার স্বীকৃতির চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘর জুড়ে ।
হয়তো এই মেধা একদিন আলোকিত করে তুলতো সারা বাংলাদেশ...সারা বিশ্ব। কিন্তু অঙ্কুরেই হত্যা করা হলো সে মেধাকে, শিউরে উঠলাম আমরা। এতটুকু একটা নিষ্পাপ বাচ্চার ওপর কীভাবে নির্যাতন করে মানুষ! কেঁপে ওঠেনা ওদের বিবেক! মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ত্বকী নিশ্চয় ওদের হাত পা ধরে কাঁদছিল ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য, বাঁচার জন্য! ওরা শোনেনি! ত্বকী লাশ হয়ে আসার পর ওর একটা চোখের মণি বের হয়ে ছিল। ওরা কি জীবিত অবস্থায় ত্বকীর চোখটা উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল! ত্বকী নিশ্চয় সহ্য না করতে পেরে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করছিল আর কেউ শুনতে পায়নি কারণ ওরা হয়তো ত্বকীর মুখ চেপে ধরেছিল! ত্বকীর আর্তচিৎকার টলাতে পারেনি পশুগুলোর মন! নির্মম যন্ত্রণা পেতে পেতে চলে গেল ত্বকী। খালি হলো একটা মায়ের বুক, বাবার স্বপ্ন, একটা পরিবারের ভালোবাসা।
আমরা চাই আর কোনো মায়ের বুক খালি না হোক, স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক, ত্বকিরা বেঁচে থাক, সারা বিশ্বজুড়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে। যে মানসিক অন্ধকারের জন্য এই খুনোখুনি, মারামারি, জ্বালানো-পোড়ানো, ভাঙচুর তার অবসান ত্বকীরাই করবে। হয়তো আমাদের এই ত্বকীটা থাকলো না আমাদের মাঝে কিন্তু আমরা লড়াই করে যাবো সব ত্বকীদের বেঁচে থাকার জন্য, বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য, মেধাকে বিকশিত করার জন্য।
ত্বকীর জন্য আমাদের সবার বুকেই এক রকম যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে। তাই হয়তো চোখে ভাসতে থাকে পত্রিকায় ছাপানো ত্বকীর মায়াবী মুখ। ত্বকীর সঙ্গে ব্যাক্তিগত কিছু সাদৃশ্য রয়েছে আমার। আমাদের দু’জনের নামের একই অর্থ। আমার চোখের সাথেও মেলে ত্বকীর চোখ। আর তাই মনে হয় আমারও সন্তান হলে ত্বকীর মতোই মায়াভরা চোখ আর নিষ্পাপ মুখ নিয়ে জন্মাবে!! আমিও রাখবো ত্বকীর মতোই একটি আলোকিত নাম। ত্বকীর মা-বাবার মতোই আমিও স্বপ্ন দেখব বিশ্ব জয় করবে আমার সন্তান।
কিন্তু এখন আমি শিউরে উঠি! ত্বকির মতো পরিণতি হবে না তো আমার সন্তানের! ত্বকীর বাবার আদর্শ, মননশীল, মানবিক কাজের জন্য হারাতে হয়েছে ত্বকীকে। আমিও স্বপ্ন দেখি আলোকিত আদর্শে মানুষ করে গড়ে তুলব আমার সন্তানকে। আর তাতেই বাধ সাধে অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষগুলো। এ পরিস্থিতিতে এক অজানা ভয় কাজ করে সব বাবা-মায়ের মনে। কিন্তু ত্বকীর মা-বাবা দমে যাননি, সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছেন অপশক্তির। আমরাও দমে যাওয়ার জন্য জাগরিত হইনি। যুদ্ধ চালিয়ে যাব আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের প্রয়োজনে একটি নিরাপদ, সুন্দর বাংলাদেশের জন্য, ত্বকীদের সুন্দর পৃথিবীর জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৩
এমকে/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর