
ভাষার মাসে গান কেবল গান নয়। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলার হাতিয়ার। ভাষার মাসে হাওয়ায় ভাসা একুশের গানে এখন ভাষাবন্দনা আর শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার ছোঁয়া। এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার গুন গুনানিতেও এখন মাতৃভাষা কিংবা একুশের গান। তারা কেবল রাজপথে আলপনা আঁকে না, এখন মুখে, হাতে মাতৃভাষার শব্দের নানা বর্ণের নামাবলি আঁকে। এসব একুশের গানের উদাস করা সুরে ভেসে এগিয়ে চলেছে বাংলা ভাষা। দেশ থেকে দেশে, কাল থেকে কালে উজ্জীবিত করে মানুষকে।
এখন ফেব্রুয়ারি মাস, ঘরের দরজা খোলার মাস, ঘর থেকে রাজপথে বেরিয়ে আসার মাস, প্রতিবাদের মাস, সংগ্রামের মাস, ভাষার মাস, জাতীয় কবিতা উৎসবের মাস, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালার মাস, ভাষা শহীদ কিংবা ভাষা সৈনিকদের স্মরণ করার মাস, বাংলা একাডেমীর ধুলো মাঠে বইমেলার মাস, লেখক, পাঠকদের মহামিলনের মাস। এ মাস একুশের গানের মাস। শিল্পের বিভিন্ন শাখার মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে কবিতা ও গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনেক গান ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য আন্দোলন সংগ্রামে অভূতপূর্ব প্রেরণা যুগিয়েছে। বলা যায় সংগ্রামী প্রেরণা সৃষ্টিতে এই সঙ্গীতগুলো প্রথম বীজ অঙ্কুরিত করে। সৃষ্টি করে আলাদা ব্যঞ্জনা। যা চেতনাকে মোহিত করে।
বাস্তবতাকে অতিক্রম করে ভিন্ন একটি মানসিক অবস্থার জন্ম দেয় এই গান। তাই এসব সঙ্গীতের সামাজিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ সঞ্চারী। সঙ্গীতের এই স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনীন আবেগ সৃষ্টিতে অনেকেই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। এর মধ্যে যে সঙ্গীতগুলো আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত এবং উদ্বেলিত করে তার মধ্যে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” গাজীউল হক রচিত ও নিজামুল হক সুরারোপিত “ভুলবো না, ভুলবো না সে একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না” মোশারফ হোসেনের লেখা ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত “মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে,” আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এবং আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত “রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা ফাল্গুনে আজ চিত্ত আত্মভোলা”, আবদুল লতিফ রচিত ও সুরারোপিত “ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়” “রফিক, শফিক বরকত নামে বাংলা মায়ের দুরন্ত কটি ছেলে, স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে” কিংবা ও আমার এই বাংলা ভাষা, এ আমার দুঃখ ভুলানো, বুক জুড়ানো লক্ষ মনের লক্ষ আশা, বদরুল হাসান রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘ঘুমের দেশে গুম ভাঙ্গাতে ঘুমিয়ে গেল যারা, শামসুদ্দিন আহমেদ রচিত, সুরারোপিত এবং পরবর্তী পর্যায়ে আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি,’ নাজিম মাহমুদ রচিত ও সাধন সরকার সুরারোপিত ‘কৃষ্ণচূড়া আর রক্ত পলাশের, রঙিন জালবুনে,’ একুশে এসো আজ শান্ত পায়ে পায়ে, নতুন ফালগুনে, এবং আমাদের চেতনার ঢেউ মাথা কুটলো; নাজিম সেলিম বুলবুলের, নিষ্ফল কভু হয় না রক্তের প্রতিদান, কবিয়াল রমেশশীলের ভাষার জন্যে জীবন হারালি, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘মিলিত প্রাণের কলরবে,’ যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে, শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত ‘কোকিলরে তুই এমন করে ফাগুন মাসে ডাকিস নারে আর,’ শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ঐতিহাসিক ‘ঢাকার ডাক’, শোন দেশের ভাই ভগিনী শোন আচানক কাহিনী কান্দে বাংলা জননী ঢাকার শহরে, সত্যেন সেনের “আগুন নিভাই বো কেরে, এ আগুন নেভে না নেভে না,” ফজলে লোহানীর কবিতা, “শীতল পৃথিবী অবশনগর” খান আতাউর রহমানের সুরে বাঙময় হয়ে ওঠে, ইন্দু সাহার লেখা এবং শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুধাল ভোরে, মিনার এবার বাঙময় হয়ে ওঠো। সংগৃহীত একটি গান এই পথ এই কালো পথ, যে গানের সুর দিয়েছিলো মহামুদন্নবী, এমনি আরও অনেক গান একুশের চেতনা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিল, এছাড়া আবদুল লতিফের লেখা এবং সুরারোপিত এই নিবন্ধের লেখকের গাওয়া ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা,’ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কথা ও সুরের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ কবির সুমনের ‘সে ভাষার জন্যে এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম, গানগুলো যুগ যুগ ধরে হৃদয় থেকে হৃদয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। বাংলা ভাষীদের জুগিয়ে এসেছে এগিয়ে চলার প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের মাইলফলক একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তেভেজা প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় কবিতা আর গান রচনা। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ শোককে যিনি শক্তিতে পরিণত করে এই কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি চট্টলার বীর সন্তান কবি মাহবুবুল আলম, ভাষা আন্দোলনের উপর লেখা এটাই হয়তো প্রথম কবিতা। তার জীবিতকালেই ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী এই কবিতার সুরারোপ করে তাকে শুনিয়েছেন, মানুষকে শোনাচ্ছেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে শহীদ বরকতের রক্তে ভেজা লাশ দেখে আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন একটি কবিতা- আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের ছাত্ররা একটি লিফলেট প্রকাশ করেছিল। সেখানে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। এরপর কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারি সঙ্কলনে ‘একুশের গান’ হিসেবে এটি ছাপা হয়। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। ঢাকা কলেজের নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আবদুল লতিফের কণ্ঠে ও সুরে কবিতাটি প্রথম গাওয়া হয়। তখন অন্যদের সঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন, এক মাস বিনা বিচারে জেল খাটেন। আরও পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ কবিতাটিতে দেন জাদুকরি সুরের স্পর্শ। সেই সুরেই এখন পর্যন্ত একুশের মূল সঙ্গীত হিসেবে গানটি প্রতিষ্ঠিত। তবে এ নিয়ে লতিফ ভাইর কোন আক্ষেপ ছিল না, অভিযোগ ছিল না, ছিল অভিমান। তবে প্রথম সুরারোপ করার জন্যে তার প্রতি সঠিক মূল্যায়ন প্রয়োজন। ১৯৫৩ সালে প্রথম প্রভাতফেরিতে কোন্ গানটি গাওয়া হয়েছিল, অনেকেই এখন আর তা মনে করতে পারেন না। বরিশালের মোশাররফ উদ্দিন আহমদ লিখেছেন, মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে/কোথায় বরকত, কোথায় সালাম/ সারা বাংলা কাঁদিয়ে মরে/আজিকে স্মরিও তারে। এই গানটি প্রথম প্রভাতফেরির অনেক মিছিলে গাওয়া হয়েছিল। গানটির প্রথম সুর করেছিলেন গীতিকার নিজেই, পরে আলতাফ মাহমুদ সুর করেন, শেখ লুৎফর রহমান তা আরেকটু ঘষামাজা করেন। প্রভাতফেরির গানের কথায় আসা যাক। কখনও প্রভাতফেরিতে বদরুল হাসানের লেখা আলতাফ ভাইয়ের সুরারোপিত ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙ্গাতে’ গানটিও বেশ গাওয়া হতো। এ ছাড়া আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো গানটিতো সব সময়ই গাওয়া হতো। বিশেষ করে ১৯৮১ সালে ঢাকার ডাকের অমর শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস ঢাকায় এলে, তাঁকে নিয়ে তাঁর লেখা শোন দেশের ভাই ভগিনী গানটি গেয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলের অর্ঘ্য দেয়ার স্মৃতি কোনদিন ভোলার নয়। গাজীউল হকের লেখা ‘ভুলবো না, ভুলবো না গানটি সুর করলেন তাঁর ভাই গানশিল্পী ও নৃত্য পরিচালক নিজামুল হক, তৎকালীন জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের গান ‘দূর হটো দূর হটো এ দুনিয়া ওয়ালে’ এর সুরে। প্রথম প্রথম কয়েক বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ গানটি নিয়মিত গাওয়া হতো। ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে র্মর্মস্পর্শী হৃদয়বিদারক গান রচনা করলো খুলনা বাগেরহাট অঞ্চলের এক তেল ব্যবসায়ী শামসুদ্দিন আহম্মদ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী তোরা চাকার শহর রক্তে ভাসাইলি। এ গান গেয়ে গেয়ে সে হাটবাজারে তেল বিক্রি করতো। রমেশশীল এবং আবদুল লতিফ তাঁদের গানের মাধ্যমে গণজাগরণ গড়ে তুললেন। চারণ কবি আবদুল হাকিম খালি গলায় গাইতেন, বাংলা মোদের মাতৃভাষা/ বাংলা মোদের বুলি/সেই বাংলায় কথা কইলে পরে/ বুকে চালায় গুলি। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের লেখা মিলিত প্রাণের কলরবে গানটি শেখ লুৎফর রহমানের সুরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। সময়ের দাবিতে লেখা এসব গানের আবেদন আজও আগের মতোই। তবে কমে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলন কিংবা গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন গানের সংখ্যা এবং মান। আজ যখন সন্ত্রাস, নিপীড়ন, নির্যাতন কিংবা গার্মেন্টস সেক্টরে আন্দোলন, ফুলবাড়ির আন্দোলন, তেল গ্যাস রক্ষার আন্দোলন, কানসাট আন্দোলন নিয়ে তেমন ব্যাপকভাবে গান রচনা হয় না, তখন বলতেই হয় গান সময়কে ধারণ করছে না। অন্যদিকে বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গান সময়কে ধারণ করতো। এ ছাড়া বিভিন্ন মিডিয়ায় বাংলার বিকৃতি উচ্চারণ, করপোরেট পুঁজির লোভ লালসা, বিভিন্ন সংস্থা বিনোদনের আনন্দ আয়োজন তরুণ সমাজকে সংগ্রামবিমুখ করছে। আবারও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক সংস্থা দোকানপাট, মার্কেটে বাংলা নামের পরিবর্তে ইংরেজি ব্যবহার যেন অঘোষিত আবশ্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। বাংলা ভাষার দৈন্যদশা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মহলসহ বিভিন্ন মিডিয়াকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।
দৈনিক জনকণ্ঠের সৌজন্যে গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের এই তথ্যবহুল লেখাটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
বাংলাদেশ সময় ২১০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৩
এমএমকে