ফুলবেলী’র কথা ফোটে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৯:৪২, জানুয়ারি ১৯, ২০১৩

দুইচার মায়াকথা

মায়া যে বাসার পেয়িংগেস্ট তা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে একটি দুইরুমের বাসা। বেডরুম, কিচেন, ডাইনিং, টয়লেট সবই একই স্পেসের চারটি দরজার স্বাতন্ত্রের ইশারা মাত্র। আছে এক চিলতে ফাঁকা, নামে বারান্দা। এই শহরে বারান্দা নিয়ে শখ করার এক্তিয়ার এখন শুধু কোটির মালিকদের। আমাদের এই বিশেষ বারান্দাটা একটা চারতলা কলোনির তিন তলায় ঝুলে আছে। বিল্ডিংয়ের সামনে ফাঁকা একটু জায়গায় কিছু কলাগাছ, আর অযত্নে বেড়ে উঠা শিম, লাউ-সব্জির বাগান। কয়েকটা শালিক ফড়িংয়ের পিছু ধাওয়া করছে। আটদশটা বিভিন্ন সাইজের ফ্ল্যাটের চারতলা বিল্ডিং সব, বেশ পুরোনো দিনের, হবে অন্ততঃ বিগত আশির আগেই নির্মিত। নিম্নপর্যায়ের কর্মচারিদের বাসস্থানগুলি কিছুটা অতিরিক্ত, রিক্ত অবহেলিত, দেয়ালের চুনকাম খসে পড়তে পড়তে কোনএক কালের চুন-পানির যত্নের কথা মনে করিয়ে দেয়। পানির ট্যাংকির ছাদ থেকে অতিরিক্ত ধারা কিংবা টয়লেটের ক্ষয়ে যাওয়া পাইপগুলির গা ঘেঁষে নোংরা জলের প্রশ্রয়ে পরিপুষ্ট শ্যাওলার পরিবার। কার্নিশের কোথাও কোথাও বটের নতুন চারা গজিয়ে ইতোমধ্যে ডালপালা মেলে দিয়েছে, ইহাদের পাখিবট, বটপাখিগাছ নামে ডাক দিলে সাড়া দিয়ে বসবে, এইযে- আমি এখানে।

বাসার কর্তা ওয়াসার একজন মেকানিক। পরহেজগার মানুষ, চিল্লায় যান। শরিয়তি অনুশাসন মেনে চলেন, কোরান-হাদিস তার পাথেয়। তবে গোঁড়া নন তিনি, নিজেকে ওইখানেই সীমায়িত করেননি। চল্লিশোর্ধ আলীমুজ্জামান খান সাহেবের গড়ন মাঝারি গোছের। ফর্সা মুখমণ্ডলে হালকা দাড়ি, এতোটাই কম যে প্রায় প্রতিটি দাড়ির গোছা আলাদা দেখা যায়। কিছু দাড়িতে পাক ধরেছে। চকচকে কালো চোখে কালো ফ্রেমের বাইফোকাল; চশমা আর শাদা রঙের পাগড়িতে তাকে বয়স্ক দেখানোর বদলে উল্টো তরুণ দেখায়। স্ত্রী হায়াতুন্নেসার বয়স মায়ার থেকে খুব বেশি হলে বড়জোর ছয়সাত বছর। আলীমুজ্জামানকে ‘আলী চাচা’ ডাকলেও মায়া তাকে শুধু চাচী নামেই সম্বোধন করে। পর্দানশীন স্বাস্থ্যবতী এই মহিলার গাম্ভীর্যই তাকে একটু দূরে দূরে রাখে। গত ছয় বছরে মায়া নানান মেয়েলী গপ্পগুজবের চেষ্টা করে দেখেছে সে চাচীর গাম্ভীর্যের পর্দা খসাতে পারেনি। তাদের একমাত্র কন্যা উম্মে সুহা খান। সুহা ক্লাস সেভেনে পড়ে। ক্লাসের বাইরে বইপড়ার অভ্যাস, হুমায়ূন আহমেদের লেখা গল্প-উপন্যাস প্রায় সবকয়টি একাধিকবার পড়া। বাবার স্বভাব পেয়েছে। এই বাড়িটাতে কোনো টিভি নেই, এবং আশ্চর্য এই মেয়ের টিভি দেখা নিয়ে বিশেষ কোনো কৌতূহলও নেই। আজকাল বস্তির বাসিন্দাদের কাছেও টিভি দেখা কোনো দুর্লভ অভিজ্ঞতা নয়। মায়ার ইচ্ছা, নিজের একটা ঘর হলে সে একটা ২৪ ইঞ্চি রঙিন টিভি কিনবে আর যখন খুশি দেখবে।

আজ খুব ভোরে কোরান পাঠের সুরের সাথে ঘুম ভাঙে মায়ার। রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। অফিস, মানে যে ইশকুলে সে পড়ায় সেখানে পরীক্ষার ঝামেলা না থাকলে বিছানা থেকে উঠার চিন্তাই করতো না। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সুহা একটা পা তার গায়ের উপর তুলে ঘুমাচ্ছে। কিশোরী মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে, হয়ত স্বপ্ন দেখছে। আহ্ কী মিষ্টি হাসি! ভোরের উপহার। টয়লেটে যাবার প্রয়োজন পড়ে তবু সুহাকে সে সরায় না, মায়া হয় তার।

রক্তাভিমানী কথা

আজ এই ভোরের বেলায়, মায়ার কৈশোরের কথা মনে পড়ে। বাবার সঙ্গে একটা নৌযাত্রার কথা। ছৈয়ের তলায় উপুর হয়ে শুয়ে মুড়ি আর পাটালি গুড় খাচ্ছে, আর নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। কনুইয়ে ব্যথা লাগছিল বলে মায়া উঠে গিয়ে বাবার কাছাকাছি ছৈয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। কী কথা, তার এখন কিছু মনে পড়ছে না। বাবা বোধহয় তার নববধূর কথা বলছিলেন। নতুন মা কেমন আদর করবে, ঠিক নিজের মায়ের মতো এইসব, নিজের মা! আসল মা, তিনি যা করেছেন আবার সৎমা! কিশোরী বয়সটাই অদ্ভুত। বাবার এই বরযাত্রা তাকে অনেক অভিমানী করেছিল ফিরতি যাত্রায়। মেয়েটার মুখ সৎমা টাইপের মনে না হলেও তার ভীষণ কষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই টুকটুকা ফর্সা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেই- কুমিরে খেয়ে নিক। বাবার ওপর মানটা আরো গভীর হয়ে উঠেছিল যে কথা- বলতো না মায়া, চোখে চাইতে চাইতো না পর্যন্ত যদি বাবা শ্লেটে আঁকা অক্ষরমালার মতো পড়ে ফেলেন। মায়ের অপকর্ম আর তার নিজের পরিণতির জন্য শুধু এই আলাভোলা মানুষটাই দায়ী! মায়ার অভিমানের বীজ স্যাঁতসেঁতে মনে, জমিনে বুনেছিল সেই কোন কৈশোরে। গাছটা বোধহয় তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, নইলে অভিমানের ডালপালা সারাক্ষণ চোখের সামনে হা ক’রে দাঁড়িয়ে থাকতো না।

মায়ার মা তার স্বামী-কন্যাকে ছেড়ে বাসার লজিং মাস্টারের সাথে একরাত্রে পালিয়েছে। মায়ের মনে কি মায়াদয়া হয়নি একবারও? ভাবে সে। তার স্বভাবচরিত্রের নীচতা নিয়ে লাইলী ফুপু কিংবা তার প্রিয় সই জুঁই যখন নানান কুকথা বলতো চোখ ফেটে কান্না আসতো। আর তা আটকে রাখতে বুকের ভেতর কী ভীষণ চাপ চাপ কষ্টই না হতো। মরে যাওয়া এরচেয়ে ভালো নয়? গলার ভিতর দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে আসতো বেদনার ঢ্যালা। জুঁইকে মনে হতো নিষ্ঠুরতমা সই। এই জুঁইকে মা কী যত্নে মাথায় নারিকেল তেল মাখিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছেন, রঙিন ফিতা বেঁধে দিয়েছেন। মনে পড়ে সেইসব বিকেল বেলার মায়াবী আলোর ঝিমধরা হলুদ বিকেল। এখনো কি মাঝে মাঝে মায়ের গায়ের আঁশটে গন্ধটা সে মিস করে? ভাবে মায়া। আর সেই জুঁই কিনা কী বিশ্রী কথা বলছে! শুনলেও ঘিন্যা লাগে। লাইলী ফুপুর কাজলদানিটা আনতে জুঁইদের বাসায় যাচ্ছিল, পাটখড়ির বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে জুঁইয়ের কণ্ঠে যা শুনলো তাতে মায়ার কান ঝাঁঝাঁ। গলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের ঢিপঢিপ যেন আবার ওরা শুনতে না পায়! পা টিপেটিপে সরে এসে জুঁইয়ের পরদাদীর হাতে লাগানো কুঁজা তেঁতুল গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। অশ্রুজলরক্তপানি করা বেদনার ধারা কেমন নোনতা। এজন্যেই কী বলে দুঃখের সাগরে ভাসায়া দিয়া গেছে, কেমনে সে মা? জুঁই তাদের আরেক সই সালেহাকে হাতের পাকা তেঁতুল, লেবুপাতা আর নুনমাখা আচার বেটে দিতে দিতে বলছে, ‘দেহিস, মায়া বড় হইলে ঠিক হ্যার মায়ের মতন ছিনাল হইবো। হাবুল স্যারের মতন একটা নাং ধরবো।’ ‘ভালো কথা, ক তো ওইরকম ফর্সা মাগীর পেটে মায়ার মতন কাইল্যা মাইয়া ক্যামনে হইছে জানছ? বাদ্দে ওই ক’সনা ক্যা, কী যেন কইতাছিলি হাবুল ছার নিয়া।’ ‘না কওয়া যাইবো না, তর লগে আমার ঝগড়া লাগলে ত ঠিকই মাইনষেরে গিয়া কইবা, আমার নামে বানায়া আরো কততা কইবা তার ঠিকাছে!’ ‘আল্লার কিরা কাটলাম, কমু না।’ ‘পচ্চিমে খাড়ায়া মাথায় হাত দিয়া ক’ কুরান-বিদ্যা-’ সালেহা তাই করে। তখন জুঁই তাকে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির পশ্চিমপ্রান্তে খড়ের পালার কাছে। আড়ালে গিয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ নেই। ‘কিরা কাটছস! মনথাকে য্যান। জুঁইয়ের বাপ যেমন খাটা, ওইডাও ত খাটাই হইবো নাকি?’ ‘ওইডা কী?’ ‘ওরে আমার বুনিটিপা-খাওয়া মাগি, কিচ্ছু বুঝনা!’ ‘ভালো হইবো না কিন্তু কইয়া দিলাম। ওই কস না ক্যা...শুন, নূরালী মামার দেড়আতের মইদ্দ্যে যাবি না। লজেন দিতে চাইলে কবি ফেইক্কা দেন...’ জুঁই ভ্রু-নাচিয়ে, ‘কেন তুমি একলাই থোরার উপরে বইয়া বইয়া লজেন চুষবা, না? তাই কও।’ ‘তর না পেটে-না খালি হিংসার কতা, তুই তো এইরম আছিলি না। আসল কতাডা ক-’ ‘কেউ যুদি হুনছে- জানুম তুই কইছস।’ ‘ওইডার কথা কইবি না? হুন ওইদিন অর্চনাদি ওইডারে কী কইতাছিল জানস? হুনলে হাইস্যা পেটে বিষ ধরবো। কয়কি, বাড়া!’ ‘হুনছি, মুছলমানি না করলে ধোনরে বাড়া কয়। স্যারের ধনডা আছিল ইয়া লাম্বা, একআত।’ ‘যাহ! কী কস না!’ ‘হাছা কই, কিরা!’ ‘ও আল্লা, কস কি? এত্যো বড়ও হয়! এইবার বুঝ! ছিনাল এইবার বুঝবো, কষ্ট কারে কয়!’ সালেহা খিলখিল করে হেসে জুঁইয়ের গায়ের উপর পড়ে। মায়ার আর শোনার সাহস থাকে না। ঢিবঢিব বুকে পা টিপে টিপে সে সরে যেতে থাকে। এতো সতর্কতার মধ্যেও একটা মানকাটা তার পায়ের ভিতর ঘুঁচ করে ঢুকে যায়, ‘আহ্-’ ক’রে উঠতে গিয়ে দাঁত চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সইয়ের গায়ের ওপর পড়ে। জুঁইও ধাক্কা দিয়ে সালেহাকে সরায়। সালেহার বুকটাতো বেশ বড় হয়ে উঠছে, তা অনুভব করে জুই। চোখের আন্দাজে নিজের সঙ্গে মাপ নিয়ে মন ছোট হয়ে আসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখের জিভ আর তালুতে টকাস্ টকাস্ করে তেঁতুল চাটে, ‘আরে ভুদাইয়ের ভুদ্দাই! কইছে তুমারে! ওই একহাত দেইখাইনা মায়ার খানকিমায়ে আবুইল্যার হাত ধইরা পলাইছে। আর যেমুন লাম্বা, তেমুন মোডা।’ ‘তর না যা কথা, ব্যথা লাগবো না! এত বড়তা ঢুকবো কোন দিয়া? মুতের জাগা দিয়া? খালি পেটবানানি কতা।’ ‘বিশ্বাস গেলে যা না গেলে নূরালী মামার টিপা খা-’ বলে জুঁই এবার উদ্দেশ্যমূলক হাসি দেয়। সালেহার তাতে অভিমান, ‘যাহ্ খাচ্চরডা তর নিকা করনের সময় আইছে। আইচ্ছা স্যারে তরে দেহাইছে?’ ‘কমু ক্যান?’ ‘বুছছি। তলে তলে তুমিও অংকইংরাজির লগে হাবুল ছারের কাছে ছিনালগিরি শিকসো!’ কপট রাগ করে, ‘কেউরে যুদি কইছস তরে কিন্তু বডি দিয়া কুটমু।’ ‘ধুর কমু ক্যা? আমার আর খায়াদায়া কাম নাই! সইয়ের কতা কইতে আছে জনেজনে?’ ‘একদিন বীজগনিত করতে গিয়া আমি ত ঘাইমা শেষ। হাতের পিন্সিল গেছে মাডিত পইরা। টেবিলের তল থিকা টুকাইতে গিয়া দেহি কি?’ ‘কী!’ ‘স্যারে লঙ্গির গিট্টুডা-না খুইলা, এক হাত দিয়া ওইডা আদর করতাছে। শইলে চিলিক দিয়া উঠলো। ডরে ত আর কইলজায় পানি নাই আমার।’ ‘তর ভাইগ্য ভালোরে সই! আমরাতো আর তর মতন হাউশ মিটায়া দেখার পারুম না। তাইতে তো কয়, সবার জিংলায় মানুগো লাহান আধমনি কুমড়া অয় না! ওই, একবারই দেখছস?’ ‘না। পাচ্ছয়বার। বাইতে অংকের বই ইচ্ছা কইরাই খুইলা দেখতাম না।’ ‘তাইতো কই, ক্যান আমারে আর মায়ারে পাঠাইয়া দিতো। আর তরে কইতো, জুঁই তুই অংকে কাচা, খালি কাঁচা আম আর তেঁতুল চাটলেই হইবো? আরো আধঘন্টা বীজগণিত কইরা তারপর তোমার ছুট্টি।’ ‘একদিন আমারে দরতেও দিছে। কয়, ছুঁইয়া দেকতে ইচ্ছা অয়? বইলাই আচমকা নিজেই আমার বাম হাত নিয়া ধরায়া দিছে। কমু আর কী! যে শক্ত আর গরম!’ ‘শুইনাই ত আমার কেমুন লাগতাছে! বাদ্দে, আর হুনুম না। গুনা অইবো যাইগারে।’ একজন সখি ও অন্য এক সখির মায়ের এই বিরল সব সৌভাগ্যে সালেহা রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করে। তারও খারাপ হতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু মনের কথা মনে থাকাই ভালো।

‘সুহা, মা জননী অনেক বেলা হয়েছে! উঠো মা, মায়া ও মায়া, দেখোতো...’ আলীচাচার ডাকে কল্পনার কিশোরীর বেশ ছেড়ে যুবা বয়সে ফিরে আসে মায়া। মায়া-অঙ্গে জড়িয়ে থাকা সুহার বাম হাতটাকে সরিয়ে তলপেটে নিজের হাতটা নামিয়ে আনে। ব্যথার ভারে টনটন। উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে সে টের পায় চিনচিনে একটা ব্যথা দুইপায়ের ফাঁকে ঘন হয়ে আছে, দাঁতে দাঁত চেপে এই ব্যথাকে ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয় মায়া।

গতকাল, আজ ছিল

আবাসিক এলাকার বড় রাস্তায় অফিসফেরত যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। টং চা-দোকানে বসে বসে নানান রকমের মানুষজন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে হাবিবুর রহমান। বলা ভালো, বেছেবেছে মেয়েদের দেখছে। চোখ চশমাঢাকা বলে সহসাই বোঝা মুশকিল হাবিবের দৃষ্টির গন্তব্য। যারা আসছে উল্টা দিক থেকে, তাদের প্রতিজনের কাপড়ে আড়াল করা বুকটাই কেন্দ্র। বুকের মাপ, স্তনের এখন কী শেপ, কী রঙ, নিপল ছোট না বড় সেই সব ডাটা মুহূর্তেই স্ক্যান হয়ে যাচ্ছে। আর যারা হাবিবুরকে পেরিয়ে যাচ্ছে তাদের পশ্চাদ্দেশ দেখে মুখের গড়ন, বুকের আভাস আন্দাজ চলছে যুগপৎ। প্রায় নিত্যনিদের অভ্যাস। তার বয়স ২৮, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকে মাস্টার্স করেছে। এখনো চাকরি হয়নি। থাকে একটা মেসে। ভিড়ের বাস ঠেলে আসবার সময় ভাগ্যক্রমে মেয়ে সহযাত্রী জুটে গিয়েছিল। এবং বাসের দুলুনিতে প্রাপ্ত হালকা স্পর্শই তাকে রীতমতো উত্তেজিত করে থাকবে। আর পারছে না, শুয়োর ড্রাইভারটা প্রতিদিনকার মতো গোঁয়ার নয়। একটাও হার্ড ব্রেক না! খানাখন্দের জামঝাকানিও নাই। এই লোকটারে রাস্তার মন্ত্রী বানাইলে সামলায়া ফেলতো এই আমাদের ক্রনিক ট্র্যাফিক জ্যাম। শহরটা রেহাই পাইতো। এইসব রগরগে যৌনাত্মক চিন্তার ভাবুকের ডাকনাম হাবিব, প্রেমিকা মায়া অবশ্য তাকে বিশেষ মুহূর্তে হাবি’ বলে ডাকে। হাবি’ শুনতে তার বেশ লাগে, হার্ডওন হয়। একজন ভারি হিপের সালোয়ার-কামিজ পড়া মধ্যবয়সী মেয়ের হাঁটার ভঙ্গি তাকে চা-দোকান থেকে তুলে চলমান রাস্তায় এনে ফেলে। যেন ট্রেডমিল কিংবা কনভেয়ার বেল্টে চেপে এগিয়ে যাচ্ছে মাংসের স্তুপ। মায়ার এখন ছাড়া পাবার সময়। মায়া একটি প্রাইভেট স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে মর্নিং শিফটে বাংলা পড়ায়; পরপরই সোজা আসে ‘জুলিয়া’স সিজার’এ, বিউটি পার্লারের পার্টটাইমার সে।

হাবিবের আজ একটা সুযোগ মিলেছে। মেসের অন্য মেম্বাররা সবাই যাবে একটা ওপেন এয়ার কনসার্ট দেখতে। ফ্রি গান, ফ্রি ভিড়, ফ্রি মেয়ে দেখা। এইদেখাদেখির বাইরে আজ হাবিবের আরো বেশি কিছু চাই। জুলেখা’র কাঁচি না শেক্সপীয়ার না সেক্সপিয়ার... পার্লারের কাছে পৌঁছে হাবিব একজন তন্বীর আউটলাইনের ড্রইংয়ে লম্বা চুলের গোছায় কাঁচির আড়াআড়ি ফলা সহ লোগোটা মনে ধরেছিল পয়লা দিনই। নিজের অজান্তে একদিন সিগারেটের বাক্সের ওপর এঁকেছিল সে। বেশ ফর্সা স্মার্ট এক মহিলা রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বেশ দ্রুত লাফিয়ে নামছে। হাবিবের ধারণা ছিল এসময় ওড়নার পাশ থেকে একটা গোলকের লাফ সে দেখতে পাবে। উত্তেজক মাংশপিন্ডের ছন্দোবদ্ধ গতি তার মনে মুহূর্তেই ঝাঁঝ তৈরি করে। সে কি আর জানতো, এই মহিলাই তার মায়াকে সময়মত বেরুতে দিবে না! বাইরের গেটে পায়চারি করতে করতে রতির ইচ্ছার রীতিমতো সূর্যাস্ত। আর আজকেই কিনা তার ফোনটা নষ্ট! আশ্চর্য, এতোদিনেও মায়ার সেলনম্বরটা তার মুখস্ত হয়নি। ‘অংকের ছাত্র! হাবিব। হাবিব তুমি ফেল! তুমি আস্ত একটা অংকের গাড়ল। এই স্মৃতিশক্তি নিয়ে তুমি কী করে ঘরে-বাইরে-রাস্তাঘাটে-বাসে-ক্লাসে-মার্কেটে দেখা মেয়েদের মনে রেখে দিনের পর দিন আচ্ছামত খিঁচে যাচ্ছো!’ স্মৃতি আর কল্পনার বিস্তারে নিজের ওপর যার এতো ভরসা, সে কিনা... যাক, বাদবাকিটা জানে তার মেসমেটরা। মাস্টারির জন্য সে চাকরির চেষ্টা করছে বলে তাকে ‘হাবিব মাস্টার’ ডাকতে গিয়ে ওরা ইয়ার্কি করে ডাকে, ‘মাস্টারবেটর হাবিব’। বিছানার চাদরে মুদ্রিত যৌবনের লালা ঝরিয়ে কিংবা টয়লেটে অধিক সময় নিয়ে, চেপে থাকা অফিসগামী কিংবা অফিসফেরত বোর্ডারদের বিরক্তি উদ্রেক করে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে অংকের মাস্টার হাবিবুর। একদিন মকবুলভাই তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফটা খুঁজে পান হাবিবের বিছানা থেকে উঁকি দেয়া একটা পর্নোগ্রাফির ভিতর। মকবুলভাই ফাজিল একটা, বলে কী-না, ‘ভাইরে কনডম মাইরা নিয়েন, ছোটভাই আপনের কল্পনার যে বহর আন্দাজ করি তাতে পরেরবার গিয়া দেখুম বৌ আমার পোয়াতি হইয়া গেছে। আমি কিন্তু একদিনও কনডম ছাড়া ওইসব করি নাই। বুইঝেন কিন্তু!’ অন্যেরাও এ নিয়ে ঠাট্টামস্করায় হাবিবকে কম হেনস্তা করে নাই।

জ্বালা

‘কী ব্যাপার তুমি! আসবা বল নাই ত।’ ‘উপায় থাকলে এতক্ষণ বোকাচোদার মতো এইখানে ঘুরাঘুরি করি? তাও মেয়েদের পার্লারের সামনে।’ ‘ক্যান, ভালোই হলো, অবশ্য রং টাইমিং।’ ‘লেকচার পরে শুনবো চলো টাইম নাই!’ ‘কই?’ ‘মেস ফাঁকা’ ‘উহু, উপায় নাই। রেড সিগনাল!’ ‘জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। চলো।’ দুইজন হাঁটতে থাকে। ‘অংকের জাহাজ এই হিসাবটা রাখলে ত আর এতো অপচয় হতো না। ফোনের কী হলো? ছিনতাই? না হারায়া ফেলছো?’ ‘হাত থেকে পড়ে বন্ধ।’ ‘ও। নম্বর মুখস্ত নাই? তিন বছরের ভালোবাসা। বেশ!’ ‘মনে রাখার কথা ভাবি নাই, মোবাইলে ত আছেই। আর এভাবে লাগবে তা কে জানতো। তোমার না সাতটায় ছুটি?’ ‘হুমায়রা আপা, সে নাকি জুলিয়া’স সিজার-এর পুরান কাস্টমার তাই আপা আমাকেই রিকোয়েস্ট করলেন। কী করি বলো, মাস গেলে ত কিছু টাকা পাই, না করি কী করে?’ ‘হ্যাঁ খুব ভালো করেছো। এখন কোন আপত্তি শুনবো না। অনেক পুরোনো পেপার আছে।’ ‘ছি: কী কথার ছিরি। ক্যান বিয়ে করে একটা বাড়ি নিতে পারো না... মেয়েদের কলেজে অ্যাপ্লাই করছিলাযে, কোনো রিপ্লাই এলো? অবশ্য আমি চাইনা ওটা হোক। না হওয়াই ভালো। তোমার এমনিতে যে দশা, শেষে না কলেজের উল্টাদিকে ম্যাটার্নিটি ক্লিনিক খুলতে হয়। কিম্বা চিন্তা করে দেখো মেয়েরা বইখাতার বদলে বাচ্চা কোলে নিয়ে কলেজে আসছে। আর সবকয়টা বাচ্চা দেখতে তোমার মতো... হি.হি.হি.’ ‘ইয়ার্কি ছাড়ো, আমি বাঁচি না আমার জ্বালায়।’

হাবিবের জন্য আরো বড় জ্বালা অপেক্ষা করছে সেটা তার জানা ছিল না। এইটুকুন মায়া-শরীর থেকে এতো রক্তপাত ঘটিয়ে বসবে তা ছিলো হাবিবের ধারণার বাইরে। আর আজই তার কুকুরাসন করার সাধ জাগে। মায়ার জন্যে অপেক্ষার সময়টুকু তাহলে পুরোপুরি বেকার না, ব্যর্থ নয় ওই দীর্ঘ অপেক্ষার কাল। হার্ডডিস্ক থেকে রিপ্লে করে বারকয়েক দেখে নিয়েছে রিকসা থেকে লাফিয়ে নামা মহিলা. হুমায়রাকে। মনের পর্দায় স্লো, কখনো ফাস্ট, কখনো আরো বেশি ডিটেলে। যন্ত্রণাকাতর মায়ার ‘না’, ‘নাআ’, ‘ছাড় ব্যাটা খাচ্চর’- তাকে আরো অ্যাকটিভ করে তোলে। চকির পায়া ভেঙে পড়ে কেচাপ্ শব্দে। মায়া আঁতকে উঠে। দুইজনের শারীরিক বিচ্ছেদে কাঁপে মেসবাড়িটা। হাবিবের মশারির স্ট্যান্ডের সাথে দড়িতে ঝুলছে মকবুল ভাইয়ের নয়া শার্ট। শাদা। বৃষ্টির অজুহাতে ঘরেই মেলেছে। তারপর আছে চোরের উপদ্রপ। মুহূর্তেই শাদা-লাল মিশামিশি। ব্যথায় কঁকাতে থাকে মায়া। ‘কুত্তা। কতোবার বল্লাম তলপেটে ব্যথা! হারামির দুইটা দিন সহ্য হইলো না! নিজে একলা ঘর নিতে পারে না! এতোগুলা ব্যাটাছেলের ঘামের গন্ধে আমার বমি আসে।’ ‘রাগ করে না, প্লিজ। স্যরি বলতাছি। এইরকম আর হবে না। কী যে সুন্দর করে করো তুমি। নাচ্‌তা নাকি কোনদিন? বলোনাই তো! এতো সুন্দর রিদম। ল্‌গারিদম।’ ‘খাচ্চরের বাচ্চা দেখ, রক্তে সব ভাইসা যাইতাছে। অ্যাঁ এইটা কার শার্ট?’ ‘সর্বনাশ। শার্টটা ত মকবুইল্যার। ব্যাটার মুখে কিছু আটকায় না! ধুইয়া আনি’ ‘উফ্ ব্যথায় আমি মইরা যাইতাছি। এতোক্ষণ ধইরা কে... কুত্তা একটা। বুঝছি, ওই ধারিপাছার হুমায়রারে চিন্তা করছে, আর এতোক্ষণ ধইরা ব্যথা দিছে আমারে। লম্পট কুত্তা একটা!’ মায়া ব্যথার কথা মুখে বললেও তার চোখেমুখে আমোদ ছড়িয়ে আছে, হুমায়রার কথা বলার সময়ও তার ঠোঁটের কোনায় হাসি ছড়ায়। হাবিব হেসে বলে, ‘আল্লার কসম প্রথমবার শুধু তুমি। পরের বারেরটা-’ হাবিবের কান জোরে টেনে ধরে, ‘এইযে, অংকের মাস্টর, একবার, না? এখনো গুনতে শিখো নাই হারামি!’ বিছানা ঠিক করেই মকবুলভাইয়ের শার্টটা নিয়ে বাথরুমে দৌড়ায় হাবিব। মায়া এসে হাবিবের বিছানায় শোয়। সারাদিনের কাজ ও কামের ক্লান্তি এখন ভর করেছে চোখে। ধীরে তার চোখের পাতা দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ঘুমম্।


আজ গতকাল

দুই বেডরুমের ছোট ছিমছাম ফ্ল্যাটে হুমায়রার একলা রাত। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নেই। দামী না হলেও সৌখিন। বড় বেডরুম এটাচ্ বাথ। শখ একটা বাথটাবের। বারান্দা আছে, খুব ছোট। বামন বারান্দা। একটা প্রাইভেট কোম্পানির একাউনটেন্ট সে। বিবিএ শেষ করেই চাকরি। এখন এমবিএ চলছে অফিসের পাশাপাশি। নিজে চাকরির প্রায় সবটাই জমাচ্ছে। স্বপ্ন একটা বড় বাথরুমের নিজস্ব ফ্ল্যাট। একটা শাদা বাথটাব আর গিজারের ব্যবস্থা। বড় বারান্দা থাকবে, যেখানে বৃষ্টি কিংবা জ্যোৎস্নায় বসে থাকতে পারবে; শোয়াও। শাওয়ারের নিচে ভিজতে ভিজতে এই কথাগুলি ভাবছে। শরীরে সাবান মাখে, ফেনায়িত হয়ে উঠে তার উরুজঙ্ঘানিতম্বকটিদেশপিঠবাহুবুকমুখ সবটা। বুক দুটো চেপে একটু উঁচু করার চেষ্টা করে; নিতম্বের তুলনায় স্তনদুটো একটু ছোটই, আটাশ বছরের যুবতীর নয়; কিশোরীসুলভ। সে ঠিক এই মুহূর্তে স্বামী আশফাকের কথা ভাবছে না। ভাবছে জামিলের সাথে তার নিকেতনের বাসার ওই মুহূর্তের কথা। বাহুতে একটু ছোঁয়া, নিতম্বে একটু চাপ, অফিস ম্যানেজার জামিলের রুমে অন্যকেউ নেই। বলা নেই কওয়া নেই জামিল তাকে চুমু খেয়েছিল প্রায় জোর করেই। হুমায়রা ছাড়িয়ে নিয়েছিল। জামিল ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে দেখে তার মায়া হয়। জামিল ভেবেছিল হুমা চীৎকার করবে কিংবা অন্যকিছু পাগলামি। তা না করে সেই বরং জামিলকে মিষ্টি করে একটা গভীর চুমু দিয়েছিল, ‘আর কোনদিন না। যেন ফ্যান্টাসি তৈরি না হয় তার জন্য এটা গিফ্ট। বন্ধুত্বের মর্যাদাটা রাখবেন।’

শাওয়ারের তলায় ভিজতে ভিজতে ওইদিনের কথাটা মনে পড়ে। হাসি পায়। জামিল তারই বয়সী, বিয়ের কথা হচ্ছে। ছিমছাম গোছানো বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই ব্যাচেলরস ফ্ল্যাট। তিন বছরের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড মাসছয়েক হলো অন্য কারো হাত ধরেছে। সেই অভিমানে আজ তার বুকের ভেতর ভালোবাসার অস্তিত্ব বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে। যা অনেকটাই সিদ্ধান্তের মতো। ইদানিং আশফাক ঢাকার বাইরে ব্রাঞ্চ অফিসে ট্যুরে গেলে ছোটবোন জারাকে আর ডাকাডাকি করে না। বরং ফেসবুক আর জামিলের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যক্তিগত রাত উপভোগ করে। মাঝেমধ্যে আশফাককেও তার সন্দেহ হয়, কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ ঘাঁটায় না, যেন সন্দেহটা সন্দেহই, সত্যি নয়। এটা কী বিশ্বাস? নাকি সন্দেহ করাটাই সম্পর্কটাকে কেয়ার করা- প্রেম? কই আগের মতো টানটান টান তো আসে না শরীরে বা মনে। সব বাসি, ভালোবাসাবাসি। একদিন তেমন প্রেম ছিল নাকি? প্রেম কী? বুকের ভিতর শিরশির করে নেমে যাওয়া বর্ণিল সাপের ঠান্ডা চলাচল? শাওয়ার বন্ধ করে। চুল মোছে।

তোয়ালে বুকে বেঁধে বের হয়ে আসে টয়লেট থেকে। আয়নায় নিজের চোখে তাকায়। কিছু একটা খোঁজে, কী খোঁজে? সেটাও সে চিন্তা করে- প্রতারণা, নাকি চোখের ভিতর অন্তরকে উজিয়ে উঠতে না দেবার কৌশল? যা সে যথেষ্ট রপ্ত করতে পারছে কিনা তাই পরখ করে দেখা? ফোনটা ডেকে উঠলে তার মগ্নতা কেঁপে উঠে। ভেবেছিল জামিল। ফোনটা তুলে দেখে আশফাক। ‘হ্যালো।’ ‘কী ফোন ধরো না কেন? কী করছিলা?’ ‘প্রেম’ ‘ইয়ার্কি রাখো, আমি ত রীতিমতো টেনশনে। তোমাদের বাসায় ফোন করলাম, জারা বললো, সে কিছু জানে না। তাকে ডাকো নাই ক্যান?’ ‘এমনি।’ ‘এটা কোন উত্তর হলো? বলো কী করছিলা?’ ‘বললাম না প্রেম, এতো প্রশ্ন করছো ক্যান? ভয় পাচ্ছো বউ আবার পরকীয়া করছে নাকি?’ ‘করছো নাকি?’ ‘করছি। সেই চিন্তায় ঘুম আসছে না তোমার?’ ‘ইয়ার্কি করবানাতো সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলাম, আধঘন্টা আগে ফিরে একেরপর এক ফোন করছি আর টেনশন হচ্ছে। বললানা?’ ‘আরে শাওয়ার নিচ্ছিলাম। একাএকা অস্থির লাগছিল। ভাবলাম জারারও ত মাঝেমধ্যে পরীক্ষাটরিক্ষা থাকে, অনেক সময়ই ত একা থাকতে হবে, একটু ট্রায়াল করে দেখি। তাই তোমাকেও ফোন দেই নাই।’ ‘এটা কোন যুক্তি হলো? এই শহরে একা একটা মেয়ে... বাদ দাও, যা খুশি কর, জাহান্নামে যাও’ ‘আমি অন্তত জাহান্নামের গেটকিপারকে বলবো- ভাই দয়া করে আমাকে ডাবল জাহান্নাম দিয়েন বদলে আমার পূন্যবান স্বামীটাকে জান্নাতের একটা টিকিট স্যাংশন করে দেন।’ ইয়ার্কিতে আরো রাগ হয়ে থাকবে আশফাকের। আশফাক দায়িত্বশীল; মাল্টিন্যাশনাল অফিসের মার্কেটিং অফিসার হিসেবে যেমন, তেমন যত্নশীল হুমায়রার স্বামী হিসেবেও। পুরো বিষয়টি হুমায়রা উপভোগ করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী মনে হয়? কণ্ঠস্বর কি তোমার দখলে রাখতে পেরেছো হুমা-?’ তার চোখেমুখে হাসির রেখা। এবার সে তোয়ালেটা বুক থেকে খুলে দুই হাতে টানটান করে হাজির হয় নিজের নগ্নতার কাছে। আজ সন্ধ্যায়ই সে ওয়াক্সিং করেছে। নির্লোম শরীরটা দেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তোয়ালের এক কোনা ছেড়ে দিয়ে হাত বোলায় নিজের নিতম্বে। বেশ মিহি একটা আমেজ। হাতে বুক উঁচিয়ে নিপলগুলো আয়নায় দেখে একবার, তারপর মাথা নামিয়ে নেয় বুকের দিকে। একটু কি বেশি লাল? আয়নার আরো কাছে এগিয়ে এসে চেক করে। ‘ফাজিলটাকে এতো করে না করলাম, কামড়াবি না!’ নিজের দিকে আর একবার চেয়ে কি যেন ভাবে। ফোনটা তুলে বিছানায় গিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে রিং করে। একবার, দুইবার, তিনবার। অপেক্ষা করে, চিত হয়ে শোয়। একটু চিন্তিত দেখায়। একটা এসএমএস পাঠায় আশফাককে। ‘মিসিং...ফাক্।’ একটু পর রিটার্ন এস.এম.এস. ‘ফাক্! ডোন্ট্ ফাক্!’ আরেকটা এসএমএস করার চেষ্টা করে, একটা রিং। জামিলের ফোন। ধরে না। সাইলেন্ট করে ফোনটা ফেলে রাখে। আরেকটা রিং। ফোনটা রিসিভ করে, ‘হ্যালো, আসো। লেট আস ফাক্...’ ‘তোমার ফোনএ ঢুকতে পারি না যে।’ ‘আমাতে ত পার, আসো ফাক্ মি বেবি। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিলাম, এখন আমি সবকিছু, সবটা মেলে আছি, আসোনা সোনা বাবু। অনেক মিস করছি আসো। প্লিজ। আমি নেংটুপুটু হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। অনেক হর্নি, বেবি প্লিজ...’ ‘এজন্যই ত বলি- একলা থাইকো না। পাগলামির ভূত চাপছে তোমার। ন্যুড হয়ে আছো, জানালার পর্দাগুলা ঠিকমতো বন্ধ আছে তো। পিছন দিকের তিনতলার ভোম্বলটা মনে হয় ওৎ পেতে থাকে। ওর হাতে একদিন একটা বাইনোকুলার দেখছিলাম।’ ‘ধুর দেখলে দেখুক, তোমার বউকে কেউ দেখলে কি ফুরিয়ে যাবে নাকি? আর ওই বায়নোকুলারটা মনে হয় তার বড় ছেলের। বার্ডওয়াচার।’ ‘হ্য ইয়ার্কির আর জায়গা পায় না, ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে কী পাখিটা যে দেখে আমরা আর বুঝি না।’ ‘আমার মনে হয় ওরা বাপ-বেটা পালা করে বাড়িবাড়ি চোখ রাখে। তুমি নাই ওরাই না হয় আমাকে চোখেচোখে রাখলো।’ ‘তুমি না, দিন দিন বেহায়া হয়ে উঠছো। শোনো খাওয়া দাওয়া করে দরজা জানালাগুলো চেক করে তারপর ঘুমাও। আমিও খুব টায়ার্ড ...’ ‘কী, এখনি ঘুমাবা?’ ‘হু... হুমা... সোনা আমারও ইচ্ছা হচ্ছে টেলিপোর্টেশনে তোমার পাশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমার বুকে মুখ রেখে ঘুমাই। গভীর ঘুমে যাই... এখন গুড বাই।’ ‘হ্যালো, হ্যালো...’ হুমায়রা ফোনটা রেখে বিছানায় একটু গড়াগড়ি খায়। নগ্ন হয়েই ঘরময় পায়চারি করতে থাকে। একপর্যায়ে কী মনে করে লাইট অফ করে, জানালার পর্দা সরায়।

মধ্যআয়ের মানুষের বসতি এই পাড়ার বাড়িগুলি মালিকদের সামর্থ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্নরকম ভাবে আকাশের দিকে উঠে গেছে, বেশিরভাগই গা-লাগোয়া। হুমায়রা এবাড়িওবাড়ি চোখ ঘুরিয়ে দেখে সত্যিই উল্টোদিকের বারান্দায় কেউ অন্ধকারে বসে আছে। লোকটা বোধহয় একটু নড়ে উঠেলো। জামিল আবার ফোন করেছে। অন্ধকার ঘরের বিছানায় নীলাভ আলো কেঁপে কেঁপে উঠে। জামিল হুমায়রার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়েছে সেটা শুধু সে মুখ ফুটে বলেনি, হুমাও শরীর দিয়ে জানে। শরীরে শরীর ঘর্ষণ তার বেলায় নিত্যকার বিষয় হয়ে উঠেনি বলেই হয়ত প্রতিটিতেই স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। ভাবতে ভাবতে আবার তার স্তনের কথা আসে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই জামিল ঠোঁট বাগিয়ে আসে, হুমা বাঁধা দেয়নি। শুধু জানান দিয়েছে, এর বেশিকিছু নয় কিন্তু। জামিল তখন তাতে সায় দিলেও হুমা যেমন জানে জামিলও জানে এটা ত বাইরের দরজার শুরু, এরপর যেতে যেতে যেতে ঘরের গভীরে।

সময়ে অন্ধকার সয়ে আসে

বাইরের অন্ধকারে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে সত্যি একজন দাঁড়িয়ে। এখন তার পেছনের পর্দার ওপাশে একটা টেবলল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে, হয়ত লোকটা তার অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে বুড়ো নয়, ছেলেটার বয়স কুড়ির কাছাকাছি হবে। লম্বাটে গড়ন। দিনের বেলা দেখেছে বেশ কয়েকবার। চোখাচোখি হতেই একটু পরই ভিতরে চলে যায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে যে সে বায়নোকুলার বাগিয়ে বসে আছে সেটা বুঝতে বাকি নেই হুমায়রার। আজ তার পাগলামি চাপে। অন্যান্য ঘরগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে দেখে হুমায়রা পর্দাটা সরায়। হ্যা, ছেলেটা সরে যাচ্ছে না। চেয়ারে বসে পা টা সামনের রেলিঙয়ে তুলে দিয়েছে। তার মাথায় খেলাটা পাকিয়ে উঠছে, হুমা দ্রুত জানালার পাশ থেকে সরে যায়। তারপর অন্যপ্রান্তের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে, ছেলেটা নড়েচড়ে তাকে খুঁজতে শুরু করেছে। নিচু হয়ে সরে এসে তাকে না দেখা যায় এমনভাবে পর্দাটা টেনে দেয়। ছেলেটা রীতিমত অস্থির হয়ে পড়েছে। বোঝা যায়, সে প্রায়ই হুমায়রার জন্যে কিংবা এই ফ্ল্যাট কিংবা আশপাশের কোনোকোনো নারীদেহের উপস্থিতি চাখতে উস্‌খুস করে।

হুমায়রার ঘুম পেয়েছে, অন্ধকারে ঘুমাতে হঠাৎ তার ভয়ভয় করে। সে গিয়ে বাথরুমের বাতি জ্বালিয়ে দরজাটা মেলে রাখে। আবার ফোনের নীলচে আলো। জামিলের এসএমএস... ‘প্লিজ ফরগিভ মি, ইফ আই মেড এনি মিসটেক। এনিওয়ে ইট ওয়াজ এ হেভেনলি জার্নি। আই উইল মিস দিস ট্রিপ আনটিল দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্লড।’ হুমায়রা প’ড়ে সেটা ডিলিট করে। আর ভাবে, ‘মিঠা কথা বলে বিনা পয়সায় রেগুলার পার্টনার পাওয়া গেলে বেহুদা সংসারের ঘানি টানে কোন বেটা? বোকা-বোকা চালাকি আরকি!’ কিন্তু আমাদের অবিবাহিত জামিল সাহেব মোটেই বোকা নন। নিতান্ত কম আলোতেও তার হাই-রেজ ওয়েবক্যাম যথেষ্ট ভালোভাবেই তাদের এই ডিভাইন জার্নির ভিডিও রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছে। আজ এই মুহূর্তে সে পুনর্বার সেই সুখানুভূতির জাবর কাটছে, এরকম আরো অনেক দিন চলবে নিশ্চয়। বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করতে পারে, কখনও প্রয়োজনে নেটে আপলোড করবে। দৃশ্যে নিজেও আছে- হয়ত ক্যারিয়ার ধ্বংস করার এই রিস্ক সে নেবে না। কিম্বা সবকিছু তুচ্ছ করে যদি সে হুমায়রাকে চেয়ে বসে আর হুমায়রা তাকে ভিতরে ঢুকতে না দেয় তো সেই দরজা ভাঙার চাবি। এই মুহূর্তে জামিলের মাথায় এই দৃশ্যমালা যে অনুভূতিই জাগ্রত করুক না কেন, ভবিষ্যৎ কে বলিতে পারে?

সুহাকথা

টয়লেট থেকে বেরিয়েছে মায়া। চেষ্টা করে যেন তার হাঁটা অশোভন না হয়। আর চাচী যে গরম তাওয়ায় রুটি ভাজতে ভাজতে তাকে আড়চোখে লক্ষ করছেন তাও বোঝে। ঘরে এসে দেখে, দুইটি মিসকল। জুলিয়া আপা। এবাসায় সে মোবাইলের রিংটোন সাইলেন্ট করে রাখে। সেটা আলী কাকার জন্যে যতোটা তারও চেয়ে বেশি প্রাইভেট স্পেস নাই বলে। কোন ছোট্ট বাসায় ফিসফিস করে কথা বলা আরো অস্বস্তির। স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়। চাচীর পাশে বসে গরম রুটি আর ভাজি দিয়ে নাস্তা সারতে সারতে কথা বলে মায়া। আলীমুজ্জামান টাকার ব্যবস্থা করেছেন শুনে অবাক হন চাচী। ‘কী জানি সংসারের সব দায়িত্বও নেন না তোমার চাচা আবার সবকিছু জানতেও দেন না। চাপা মানুষ।’ ‘আমি, একদিন শুনছিলাম কি জানি কী টাকার সমস্যার কথা...’ ‘সুহাকে ডাক্তার দেখানো দরকার তুমি দেখ একবার তারে নিয়া যাইতে পারো কিনা। আমার আন্দাজ, ওর ক্লাসের সবার এতোদিনে হয়ে গেছে...’ ‘নিয়ে যাবো মাসপয়লা। দেরি হচ্ছে ক্যান ডাক্তারই দেখেশুনে বলুক।’ কলোনীর সিঁড়ি বেয়ে নামে, স্কুলে যাবার জন্য দ্রুত হাঁটে। এরই মধ্যে সে জুলিয়া আপাকে ফোন করলে, তাকে স্কুল সেরে সোজা বাড়ি আসতে বলেন। আসবো- বলে ফোন রেখে দ্রুত হেঁটে যায় অন্যান্য অফিসগামী, স্কুলগামী পথচারীদের সঙ্গে। রিকশা ও অন্যান্য যন্ত্রযান চলছে দ্রুত, নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

জুলিয়া’স সিজর

জুলিয়া’স সিজর বিউটি পারলারের উপর তলাটায় থাকেন জুলিয়া। দোতলায় বড়ছেলে কলেজ ছাত্র শাফিন, প্রতিবন্ধী ছোটছেলে টুসু আর অসুস্থ বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি নিয়ে তার সংসার। পার্লারে বিশেষ কাজ না থাকলে উপর তলায় এসে টুসুর সাথে খেলে মায়া। খেলা মানে টুসুর হাতে মার খাওয়া। জুলিয়া আপার বৃদ্ধা শ্বাশুড়ির পাশে এসে বসে মায়া তার খোঁজ খবর করে। জুলিয়াকে আপা ডাকলেও মায়া আজবভাবে কেন যে বৃদ্ধাকে দাদি ডাকে। প্রথমদিন থেকেই সে এই ভুলটি করে বসে আছে, শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। বৃদ্ধা মনে হয় তাকে পছন্দ করেন। গতবছর ঈদে শাফিন-টুসুর দাদি তার আলমারিটা খুলে মায়াকে বলেন, ‘যেটা পছন্দ নে।’ মায়া তো আলমারির কাছে গিয়ে অবাক! ‘রীতমতো শাড়ির মিউজিয়াম।’ ‘পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরান শাড়িও আছে, তোর কোনটা পছন্দ?’ ‘দাদি শাড়ি লাগবে না, আমাকে দোয়া করবেন।’ ‘তা তো করি। তোরটা নিয়ে এখন পাল্লা বন্ধ কর।’ বিভ্রান্ত মায়া, কোনটা ছেড়ে কোনটা বের করবে। সে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে একটা শাড়ি বের করে আনে। দাদির হাতে শাড়িটা তুলে দিয়ে আলজ্জ খুশিচোখে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘অনেক দামি না দাদি’ ‘শাফায়াতের বিয়ের সময় তোর দাদা হায়দরাবাদ থেকে আনিয়ে দিয়েছিল। খুব ভালো রুচি ছিল লোকটার। তোর পছন্দ হয়েছে?’ ‘পছন্দ আবার হবে না? খুব পছন্দ হয়েছে।’ ‘যা এখন তেলের ডিব্বাটা নিয়ে আয়, মাথায় দিবি, জট ধরছে নাকি দেখতো।’ মায়া খুঁজে খুঁজে একটা কৌটা আর চিরুনি নিয়ে দাদির চুলে তেল দেয়। ‘দে ত মাথায় একটু বিলি করে, দেখি তোরা কেমন মালিশ করিস।’ ‘দাদি একদিন তুমি নিচতলায় আসো, আমি তোমাকে স্পা করে দিবো, দেখবে কেমন...’ ‘বেশ্যা মাগীদের কারখানায় আমার যেতে ঘিন্যা লাগে।’ এসময় জুলিয়া এসে দরজায় দাঁড়িয়ে শ্বাশুড়িকে দেখে, ‘আম্মার কাজটা সেরে একটু আসিস, টুসুকে তোর কাছে রেখে একটু বাইরে যাবো পার্লারের কিছু কেনাকাটা আছে।’ ‘মেয়েটা আমার কাছে বসলেই তাকে দরকার পড়ে?’ শ্বাশুড়ির কথার কোন উত্তর না দিয়ে জুলিয়া চলে যায়। বুড়ি বেশ বিরক্ত হন। ‘দেখ কেমন বেয়াদব। কথার জবাব দেয় না। পাপ বুজলি? পাপ। আমার পোলাডারে খাইছে এখন আমাকে খুন করবো দেখিস।’ ‘চুপ করেন ত দাদি আম্মা।’ ‘আমি বুড়া মানুষ। দেখভালের জন্য একটা কাজের লোক রাখতে কই, রাখবো না। আমার আরাম দেখতে পারে না। হিংসুক শয়তানী বুদ্ধি পেটে পেটে। দিবনা ওকে একটা কিচ্ছু দিব না। এই বাড়িটা আমার নামে না থাকলে কবে আমাকে লাথ্থি দিয়া রাস্তায় ফেলায়া দিত...’ ‘কথা কইয়েন না তো।’ ‘কথা কী কই? কত কথা কই না। দেইখাও দেখি না।’ জুলিয়া টুসুকে নিয়ে ফের এসে দাঁড়ায়। ‘কীরে, আম্মা দিলো? আমাকে তো কোনদিন আলমারির সামনেই দাঁড়াইতে দেয় না। শুন, হুমায়রা তোকে ফোন করতে বলছে। তার আগে আমার একটু কথা শুনে যা। আমি টুসুকে নিয়েই বের হচ্ছি।

স্পা

বেদনার উপশম সকলেই চায়। হুমায়রাও। মায়ার টানে সে প্রায়ই এখানে আসে। কালো এই মেয়েটার স্পর্শে একটা ঠান্ডা অনুভূতি ছড়িয়ে যায় হুমায়রার শরীরে। আশ্চর্য হলো, মায়ার ম্যাসাজে তার শরীরে একরকম আমোদ হয়, তা যৌনানন্দ বলা যায় কিনা সে বিষয়ে প্রথমপ্রথম সন্দেহ ছিল। প্রথমবার ওরগাজম হওয়ার পর তার রীতিমতো নেশা চেপে ধরে। মায়া এখন ব্যাপারটা জানে। ব্রেস্ট আপ করবার জন্য বিশেষ লোশন দিয়ে নিয়মিত ম্যাসাজ নেয় হুমায়রা। এরমধ্যে গল্পচ্ছলে মায়ার সংসার, বিয়ে প্রসঙ্গ, যৌনজীবন ইত্যাদি হুমায়রার জানা হয়ে গেছে। যদিও দু’জনের কেউই ঠিক লেসবিয়ান নন তবুও মায়ার ভরাট বুকটা দেখার খুব ইচ্ছা হয় হুমার। অনেক অনুরোধের তৃতীয় দিনে মায়া তার টপস্‌টা খুললে মুগ্ধ চোখে দেখে। নিজের বুকটাকে মনে হয় মরুভূমি। ঈর্ষা জাগে, মেয়েলি হিংসুটিপনা অনেকটা টক খাবার মতো বিলাসপূর্ণ আমোদ। সম্মতি-অসম্মতির জন্য সময় নষ্ট না করে হুমা মায়াবী বুকদুটো দু’হাতে আলতো ধরে, ‘তোর বয়ফ্রেন্ড খুব লাকি।’ ‘জুলিয়া আপা জানলে আমার চাকরি যাবে।’ ‘চাকরির ভয় নেই, কেউই তার অ্যাসেট হারাতে চায় না।’ মায়া টপস্টা পড়ে নেয়। ‘সিলিকন ইমপ্লান্ট পছন্দ না, এতে কাজ হবে বলে মনে হয়?’ ‘আপনার হাজব্যান্ড কী বলে?’ ‘ওর বিশেষ মাথাব্যথা নাই তবে জামিলের... আচ্ছা কালকে যে বলছিলি, তোর বয়ফ্রেন্ডের ওইটা সত্তি এতো বড়ো?’ মায়া হুমায়রাকে ম্যাসাজ করছে। ‘ও কিন্তু আপনাকে দেখেছে।’ ‘ওমা, কবে?’ ‘ওইযে প্রথম যেদিন আপনাকে ম্যাসাজ দিলাম।’ ‘তা-ই?’ ‘কী বলবো আপা, এমন খবিশ একটা! পিরিয়ডের মধ্যে... ব্যথায় আমার জ্বর এসে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।’ ‘কী করবে বেচারা, এরকম প্রলোভনের ফল রেখে তাকে কিনা থাকতে হচ্ছে কতগুলা ব্যাটাছেলের সঙ্গে। দেখিস আবার গে হয়ে না যায়’ ‘নাহ্ এইদিকে আবার টনটনা। মাস্টারবেট করে নাকি কয়েকবার, মেসের ব্যাটাছেলেগুলা হাবিবকে কী নামে ডাকে জানেন?’ হাসে। ‘ওর মাস্টারি করার শখ তো, ওরা ডাকে মাস্টারবেটার।’ ‘বেচারি, বড় কষ্টে আছে, তুই যা বলছিস তার যদি অর্ধেকটাও সত্যি হয়, ওর তো মাথা খারাপ হবার দশা। এতো কষ্ট না করে শিগ্গির একটা বাড়িতে গিয়ে উঠ।’ ‘ওর চাকরি আর চাচার ফ্যামিলির কথাও ভাবতে হচ্ছে।’ ‘এতো বিশাল প্রতিভা তবু কেন চাকরি হবে না?’ ‘আমার মন বলছে ওর মেয়েদের কলেজের চাকরিটাই হবে। এই নিয়ে আমি ইয়ার্কি যেমন করি তেমনি ভয়ও পাই, আজকালকার মেয়েরা এতো কেয়ার করে না। ওরা পেটের ক্ষুধার মতো শরীরের ক্ষুধাটাও মিটিয়ে নিতে অতো হেজিটেট করে না।’ ‘তাহলে দেখ, কী অন্যায়, ক্ষুধার্ত একটা মানুষকে এইভাবে অভুক্ত রাখা কী ঠিক?’ ‘কী করবো বলেন।’ ‘কথা বলে দেখ, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটার টু-লেট দেখে এলাম।’ ‘বলে দেখি, না না বলবো না।’ ভ্রকুঁচকে- ‘ক্যান?’ ‘হাসবেন। তবু বলি। প্রথমদিন আপনার হিপের নাচ দেখে গিয়ে আমাকে পরপর বেশ কয়বার করলো। ভিতরে আন্দাজ করছিলাম ও আপনাকে...’ অবাক আবার একটু লজ্জাও পায়, ‘কী বলিস?’ ‘হু। ওর চোখে এমন স্ক্যানার মেয়েদের কাপড়টা দেখতে পায় না।’ ‘ডেনজারাস! মেয়েদের কলেজের চাকরি হলে ত একেবারে এতো এতো নেংটা মেয়ে, ভাবতেই কিন্তু ইন্টারেস্টিং লাগছে।’ ‘পাশের ফ্ল্যাটে মানে প্রতিদিনই কয়েকবার আপনাকে দেখবে। সামলানো মুশকিল হবে।’ হেসে হুমায়রা, ‘কাকে? তাকে না আমাকে?’ ‘দুইজনকেই, সারাক্ষণ ত আমি পাহারা দিয়ে রাখতে পারবো না।’ ‘একবার একটা কাণ্ড করলে কেমন হয় বলতো?’ ‘কী?’ ‘এক্সচেঞ্জ।’ ‘কী এক্সচেঞ্জ?’ ‘পার্টনার, জাস্ট ফর ওয়ান নাইট?’ ‘ধুর, তাই হয় নাকি?’ ‘হওয়াইলেই হয়। ভেবে দেখ, তুই ভাবতেছিস হাবিব আমাকে বেশি সুখ দিয়ে ফেললো নাকি আবার পাশের ঘর থেকেই আমার হাজব্যান্ড ভাবলো ওই বেটা আমার বউরে ইচ্ছামতো... আশফাকও কিন্তু ফাকমাস্টার। লেটস ট্রাই ওয়ান্স।’ ‘না ভাই আমার  দরকার নাই, আমার আসলে আপা তোমারে হাবিবের ওইটার কথা বলা ঠিক হয় নাই... শেষে দেখা যাবে, তোমার হাজব্যান্ড ট্যুরে গেছে আর সেই সুযোগে তুমি... না না থাক ভাই, আমারটা আমার তোমারটা তোমার।’ ‘আচ্ছা ঠিকাছে বাদ্দে। তোদের নিজেদের কখনো স্পেস দরকার হলে বলিস। ভয় নেই আমি থাকবো না।’ মনেমনে ঠিকই হুমায়রা মায়াযন্ত্র ব্যবহার করে নিচের ফ্ল্যাটে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। ‘তিনচার দিন তোর সঙ্গে দেখা হবে না, তোর ছোঁয়া পাবো না।’ ‘আমিও মিস করবো তোমাকে।’

আগামীকাল এলো আজ

আজ ছুটি নিয়েছে হুমায়রা। মাদ্রাজ থেকে এক ডাক্তার আসবেন, ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান আর ব্রেস্ট ক্যানসার স্পেশালিস্ট। তার অ্যাপয়েনমেন্ট বিকালে। কলিংবেল শুনে বেশ বিরক্তমুখে কাপড়চোপড় ঠিক করে দরজা খোলে। আশফাককে দেখে রীতিমতো অবাক, ‘তুমি!’ তাকে আরো অবাক করে একটা বেলিফুলের টব, বনসাই। দুজনের কাছেই অচেনা। ভাবে পাতাবাহার। ছোট কুঁড়ি দেখে সন্দেহ যায় না। ‘তোমার না রাতে আসবার কথা?’ ‘সকালের ফ্লাইট পেলাম, কাল রাতেই কাজ শেষ! কেন তোমার লোনলিনেস-উদযাপন নষ্ট করে দিলাম?’ ‘এটা কোথায় পেলে? সুন্দর তো! কি গাছ? থ্যাংকু-’ বলে তাকে হাগ দিতে গেলে আশফাক বলে, ‘সরো, অন্যের প্রাপ্য হাগ আমি নিতে রাজি নই, নিজেরটুকুন কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিতে চাই।’ হুমায়রাকে কিছু বুঝে উঠতে না দিয়েই দ্রুত তাকে বিবস্ত্র করতে থাকে। প্রায় পাঁজাকোলে তাকে বিছানায় ফেলে উপুর করে শুইয়ে তীব্রভাবে উপগত হয়। আচমকা মিলন হুমাকে ব্যথিত করে মনে ও মিলনস্থলে। ‘কোন নাগর দিয়ে গেছে বল!’ ‘কী বলো এইসব’ ‘কী বলি? বেশ্যামাগী তুই জানিস না! আজ তোরে ফাটায়া মজা দিব’ ‘প্লিজ থামো। দাঁড়াও, আগে বলো ঐটা কই পাইছো?’ ‘দরজার সামনে। এখন পুসিবেড়াল থলে থেকে বের করো, উঁচু কর মাগী... আরেকটু... আরো... এবার বল... ফাক্ আশ ফাক্, ফাক্ মি... ফাক্... বল!’ দাঁত চেপে নিতম্ব উঁচু করে তুলে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে হুমা, এই যৌন আক্রমণ বেশকিছুক্ষণ চলে। ভিন্ন আসন, ভিন্নভিন্ন আসন। ছিন্নভিন্ন হতে থাকে হুমায়রা। এমতঃ যৌনক্রীড়া যা মূলত: ধর্ষণ। ব্যথায় কাতর হুমায়রা তাকে থামায় না, এটা তার প্রাপ্য, কর্মফল। একপর্যায়ে আশফাকের খেয়াল হয়, হুমার কুঁকড়ে যাওয়া শরীর, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁপছে। ‘কী হলো? তুমি এভাবে দরজা আটকে রাখলে... ভিজে নাই ত! সেজন্যেই...। ঠিকাছে আর দিব না... স্যরি, আমি এইকয়দিন উপাস দিয়ে জন্তু হয়ে গেছি। মাফ করো প্লিজ। হুমা! স্যরি... প্লিজ একটু চিত হয়ে শোও। আস্তে আস্তে দিবো। কী? এখন কথা নাই ক্যান? কলিগের সঙ্গে ত কতোকথা আসে। বোবাকথারাও ভাষার দাবি নিয়ে হাজির হয়ে যায়, তাই না?’

টুসুকথা

টুসুটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। জুলেখা’পাটা যে কী! দেখেও গা করে না। উল্টা বলে কিনা, এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক মন শরীরের আকাঙ্খা আড়াল করতে জানে না। তাই বলে ওইটুকু পুচকি ছেলে, মুখে লালা গড়াচ্ছে, শিশ্ন বের করে টানটান মায়ার কাছে এসে গায়ে ঘঁষবে! সরিয়ে দিলে চেঁচাবে। জুলেখা তখন বাইরে থেকে এসে টয়লেটে, মায়া টুসুর সঙ্গে খেলতে খেলতে একটু গা এলিয়েছে। শরীরটা বড় ক্লান্ত। চোখটা ঘুমঘুম। এবার প্রতিবন্দীর কাছে বন্দী মায়া। ওমা চোদ্দবছরের ছেলের এতো... মায়ার ওপর চেপে বসে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে কামিজটা। বুকদুইটা খামচে ধরে গোঙাচ্ছে আর চোখের সামনে উত্থিত লিঙ্গের দোলা! ভয়ে চেঁচিয়েছে মায়া, চলছে টুসুর চেঁচামেচিও। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দুইজনের এই অবস্থা দেখে জুলেখা’র কপট রাগ, সঙ্গে মুচকি হাসি। ‘একটু ম্যাসাজ করে বের করে দিলেই পারিস। বেচারির তাতে আরাম হয়। ...ছেলেটাকে নিয়ে যে কী করি!...’ ‘আমার মনে হয় ওকে বিয়ে দিয়ে দেন। কত অভাবী মেয়েই ত আছে। একটু ভালো খেতে-পড়তে পেলে সয়ে যাবে।’ ‘আম্মার পছন্দ তোকে।’ মায়ার রাগ হলেও সে হেসে ব্যাপারটা হালকা করে দেয়, ‘শাড়ি-বাড়ির লোভ আমার নেই বলবো না, কিন্তু টুসুরটা যা বড়! ভয় হয়, এই লোভেই না আবার মরণ ডেকে আনি, কাজ নেই বাবা অমন বাড়ির... আমার গরীব অংকের মাস্টারই ভালো।’ ততোক্ষণে জুলেখা একটা অলিভওয়েলের ক্যান এনে ধরিয়ে দিয়েছে। টুসুর চোখে খুশির নাচন, মায়ার অনিচ্ছুক হাতের তালুতে গড়িয়ে পড়ছে সোনালি তরল।

যৌননীতির ভ্রমণসঙ্গী, ফুলবেলীর রহস্যকথা

রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বাস, লঞ্চঘাটে ব্যাপক আকারে প্রচারিত যৌনতা বিষয়ক নানারকম বাস্তব-অবাস্তব রোগ, রোগের লক্ষণ ও উপশমের নানান  উপায় ও চিকিৎসালয়ের খোঁজখবর দিয়ে ভরা লিফলেট আর কামনা-বাসনা টাইপ পত্রিকা, রসময় গুপ্ত পরিচয়সুপ্ত রচিত চটিবইয়ের জায়গা দখল করেছে আধুনিক টেকনোলজি। প্রযুক্তির খরগোস দৌড়ে এখন তা সবার নাগালের মধ্যেই। লোকলজ্জা কমেছে, যৌন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে অথবা এতকালের ট্যাবু ভেঙে যাচ্ছে, যৌনভীতি কমছে। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাওয়া যাবে এইবিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি নাই রাষ্ট্রীয়ভাবে। তবুও যৌনদুর্নীতির একটি অপার এই লীলাক্ষেত্রে একতরফা যৌনাকাঙ্ক্ষা যৌনঅপরাধ ঘটতে সুযোগ করে দিচ্ছে। এইসময়পর্বে, দেশে এমন একটা দাবি উঠছে ইতিউতি- তৈরি হোক যৌননীতি, আর নিশ্চিত হোক সত্যিকারের লৈঙ্গিক সমানাধিকার। আর তার মাপকাঠি হোক লিঙ্গসুখানুভূতি। কিন্তু এমন দাবিদার নাগরেরা নীতিনির্ধারনের মাপকাঠি নিয়ে বিষম যন্ত্রণায় পড়েছেন, সুখানুভূতি পরিমাপক কি হবে, তা নিরূপণে। উল্লেখ, এইসব প্রাচীন নাগরবৃন্দ ‘আজ, গতকাল’ হয়ে আছেন নিজ নিজ স্ত্রী/পুংবাচক পরিবারের কাছে।

সুইমিংপুলে সাঁতার আর বাথটাবে গোসলের ফারাক আছে। নিজের অফিসকলিগ জামিলের সাথে তার ব্যাপারটা প্রায় রেগুলার হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে আশফাকের কি হাল একটু বুঝতে চায় হুমায়রা। আশফাক দেখে নিয়েছে বেলী ফুলের টব। কিছুকাল আগে হলে সঙ্গেসঙ্গেই আছড়ে ভাঙতো হুমায়রার সামনে। আজকাল যৌননীতি নিয়ে সংসদে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। খবরের কাগজে গোল-টেবিল, টিভিতে টক-শো, নাটক-সিনেমায় সেন্সর উঠে গিয়ে রেটিং সিস্টেম, ন্যুডবিচ, ক্লোজ সার্কিটে ওয়াইল্ড সেক্স পার্টি, পাবলিক স্পেসে লিপলক, চেইন সেক্সশপ, গে-লেসবিয়ান-বাই-ট্রান্স, পর্নইন্ডাস্ট্রির বৈধতা, পাঠ্যপুস্তকে যৌনসুখ ভিত্তিক শিক্ষার প্রবর্তন ইত্যাকার নানান বিষয়ে নাক গলাচ্ছে যৌনসচেতন অধুনা নাগরসমাজ। এই ক্রমঅগ্রসরমান সচেতনতার কারণে ধর্ষণের পরিমাণ কম হচ্ছে, ইভটিজিং বলে আর কোন শব্দ শোনাই যাবে না বলে বিশেষজ্ঞ গণ-মত। এই নতুন বাস্তবতায় হুমা-ফাক দম্পতি পিছিয়ে পরতে নারাজ। যাইহোক, দু’জনের সম্পর্কের ফাঁকটা ভরাট করে নিতে প্রয়োজন একটু নির্ভার সঙ্গমের। প্রয়োজন নতুন নতুন রীতিনীতি।

অবশেষে উদ্ধার করা গেছে বেলীফুল রহস্য। প্রেমের সৌরভে যৌনতার কম্বিনেশন লক খোলার কোড মাত্র। তবে সেটা বাইনুকুলার পিতা-পুত্রের কোনজন হ্যাকার সেই বিষয় অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। হুমা-ফাক দম্পতি এ বিষয়ে সময়ক্ষেপন না করে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নতুন রীতি আবিষ্কারে। এই মুহূর্তে তারা একটা খেলা উদ্ভাবন করেছে। ঘুম থেকে উঠে টবের গাছে বেলী যতগুলো ফুটতে দেখা যাবে, ততবার তারা সঙ্গম করবে, ঠিক চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে। ভিন্ন ভিন্ন লোকেশনে এবং নিত্যনতুন পদ্ধতিতে। এব্যাপারে উভয়েই তাদের স্ব স্ব কল্পনাশক্তিতে পরিপূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করা প্রসঙ্গে সমান ভূমিকা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বেলীফুলের টবটা এখন তাদের নিত্য সঙ্গী। ট্যুর পরিকল্পনার লিস্টেও ফুলবেলী থাকে সবার আগে।

শহরের ভিড় ছাড়িয়ে তারা যখন হাইওয়েতে। ইচ্ছে হলো গাড়িতেই তবে শুরু হোক। উল্লেখ্য, যে প্রস্তাবনা হাজির করবে তাকে অবশ্যই অ্যাকটিভ ভূমিকায় স্টার্টার হতে হবে। খেলার অনুশাসন পাল্টে যেতে পারে। তবে শেষ করবার সিদ্ধান্ত কেবল অন্যজনের হাতে। গাড়ি চলছে সিলেটের পথে। আশফাক ড্রাইভ করছে, তার পরনে শর্টস। হুমা আনবাটন করতে করতে স্বামীর বুদ্ধির প্রসংসা করে। ‘এমন ফাক-ফ্রেন্ডলি শর্টসটা কবে কিনলা?’ ‘ধীরে বৎস্য ধীরে, ম্যালা বাকি। পথটা যে বেশ দূরের।’ গাড়ি চলছে...

বিশ্বাসের চড়ুই-ছানারা

সুহা মরে গেলেও বিশ্বাস করবে না তার বাবা এ’কাজ করেছে। মায়ের ওপর তার ভীষণ অভিমান হয়। জেদ করে মা হায়াতুন্নেসাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তার আসা মানা। নিজের স্বামী বলছে সেটা না শুনে লোকের কথায় বলে কী না- ‘এই কথা শুনার আগে পরওয়ারদিগার আমাকে তুলে নিলো না ক্যান!’ মায়ের আহাজারি আর বাবার ক্রমশঃ বুড়িয়ে যাওয়া মুখ দেখে অন্তরে শুকিয়ে আসে প্রাণ। সুহা প্রার্থনা করে, তার কারণে, তাকে হাসপাতালে রেখে বাঁচিয়ে রাখবার এই অর্থবিনাশী চেষ্টায় যেন বাবাকে এতটুকু অন্যায়, এতোটুকু অপমানকর কিছু করতে না হয়। সুহা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তার বাবা একজন সহীহ্ মানুষ। গোধূলির শেষ আলোতে পুরোনো দিনের এই সরকারি হাসপাতালটাকে ভূতুড়ে দেখায়। শরীরে সুখ চায় না যেন অসুখ তাড়াতে পারলেই ওয়ার্ডের সব রোগী বেঁচে যায়। মরার আগে বাঁচতে চাইবার এই উৎসবে রোগী আর তাদের সহযাত্রীরা প্রথম-প্রথম সকলেই কেমন অচেনা ছিল। দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় সহযাত্রীরা ধীরে ধীরে যেভাবে সহজ হয়ে আসে, সুহাও ওয়ার্ডের সব রোগী-ডাক্তার-নার্স-আয়া সবাইকে আলাদাভাবে চিনে নিতে পেরেছে। এক যৌথ সংসার। রোগ-শোকের পরিবার। জানালায় তাকিয়ে এইসব ভাবছিল সুহা। বিস্তৃত জানালার নিচের দিকে জং ধরে ক্ষয়ে যাওয়া লোহার গরাদের চেহারা এমন দাঁড়িয়েছে যেনো ভাঙা দাঁতের ভেঙ্‌চি। ফাঁকা চোখে বেডে আধশোয়া সুহা। অনেকদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। বন্ধু-বান্ধবীদের জন্য মন খারাপ হয় না তেমন; হয় পড়াশোনায় ব্যাঘাতে। সেদিন যখন সুহা তলপেটে এক সূক্ষ্ণ অথচ তীব্র ব্যথায় কেঁদেছিল তখন মা হায়াতুন্নেসা ভেবেছিলেন এই হয়ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। আলীমুজ্জামান আর হায়াতুন্নেসার আরো বড় দুশ্চিন্তার শুরু সেখানেই। মিন্‌স্ট্রেশন-সূত্রপাতের ব্যাঘাতের কারণ ইউটেরাস ক্যান্সার। সময় বেশি নাই। বাবা আলীমুজ্জামান খান সাহেবকে চেম্বারে ডেকে নোটিশ জানিয়েছেন ডাক্তার। দিনকয়েক বাদেই খান সাহেব অফিসে পেলেন আরো একটি নোটিশ। কারণ দর্শাও- তহবিল তস্‌রুফ। এদিকে আছে জলের মতো টাকা খরচ। কন্যাঅন্তঃপ্রাণ অভাবী পিতা এই কাজ করতেই পারেন, এমত বিশ্বাস অনেকের। কারো আবার আফসোস, ‘নূরানী চেহারার আড়ালে এক ছদ্মবেশী চোর! দুনিয়ায় কাউরে বিশ্বাস নাইরে ভাই! বলেন কই যাই?’ খান সাহেব প্রথমে ভেবেছিলেন সব তাঁর ইশারা, পাকপরওয়ারদিগার তার ঈমান আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু সুহার দ্রুত ক্ষয়ে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে তার আর পরীক্ষার হলে থাকতে ইচ্ছা করে না। প্রায় নির্ঘুম দুইমাস। শরীরটাও বেঁকে বসছে, হাসপাতালের করিডোরেই গতকাল রাতে ফিট হয়ে পড়ে গেছেন। আজ মায়া এসে তাকে প্রায় জোর করে বাড়ি পাঠায়। সে থাকবে সুহার শয্যাপাশে। খোঁপায় জড়ানো বেলী ফুলের মালাটা খুলে ব্যাগে পোরে মায়া। সুহা কোনো প্রশ্ন করে না, বরং নিজেই উত্তরমালা রচনা করে। হাবিব আর মায়া আজ বিয়ে করেছে। এমন খাইখাই স্বভাবের হাবিব যে তাকে এই বিশেষ রাতটা হাসপাতালে থাকতে দিচ্ছে এইভেবে কৃতজ্ঞতায় মায়ার মন ভরে আসে। সে সুহার প্রায় চুলশূন্য মাথায় তেল মাখিয়ে তালুতে বিলি কেটে দেয়। সুহার আরাম হয়, এই সময়টায় মাথার খুলির ভিতরের দিকের পাগল করা চুলকানির হাত থেকে রেহাই পায়। চোখ বন্ধ করেই সে বলে, ‘আচ্ছা আপা, তুমি বিশ্বাস করো বাবা এইরকম একটা কাজ করবে! জানো চড়ুই পাখিগুলার সাথে আমার আজকেও কথা হয়েছে...’  

ভিড়ের রাস্তায় একজন কাউকে অনেকে মিলে প্রচণ্ড আক্রোশে পেটাচ্ছে। মারমুখী মাংসস্তুপের ভিড়ে হারিয়ে গেছে মারখাওয়া মানুষটি। শুধু একটা হাত। কাউকে খুঁজছে। বাচ্চা মেয়েটার ফাঁকা চোখ। অহেতুক তাকিয়ে আছে এই উন্মত্ত উৎসবে, যেন তলোয়ারের নিচে কোরবানির পশু। উদ্যমী আক্রোশ থেকে মুক্তি মেলেনি সাহায্য প্রত্যাশী হাতে আঁকড়ে থাকা স্কুল ব্যাগটিরও। ভেতরের খাতা-কলম-বই-পেন্সিলের কয়েকটি উগরে এসেছে। হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সরাতে চায় মানুষগুলোকে, ঠেকাতে চায়, বাঁচাতে চায় বাবাকে।

ঘুম ভাঙ্গে সুহার। পৌষের এই শীতল সকালেও ঘেমে গেছে। পাশের চেয়ারে ক্লান্তির ঘুমে নিস্তেজ বাবা আলীমুজ্জামান খান। ঘরে থাকতে পারেননি, গভীর রাতে ফের এসে হাজির হাসপাতালে। কুয়াশাঘেরা লম্বা বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে ভোরের ওশ মাখে উম্মে সুহা খান। বারান্দার বেঞ্চিতে অন্যরকম বাসর কাটানো মায়া-হাবিব। পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে একটি চাদরের উষ্ণতায়। সুহাকে দেখে নড়েচড়ে বসে মায়া। ‘কিরে চা খাবি?’ ‘দুধ চা।’ মায়ার সঙ্গে হাবিবও করিডোর বেয়ে হাসপাতালের ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সুহার ঠোঁটে হালকা হাসি ধীরে নীল হয়ে আসে। একটা ভোতা শীতলতা তাকে বিছানায় টেনে আনে। চড়ুইয়ের কিচির-মিচির। তিনদিন বাদে আজ সূর্য উঁকি দিয়েছে। ত্রসরেণুতে ভাসছে পাখির ডিমের ভাঙা খোসা আর টুকরো টুকরো খড়। ওই উঁচু ঘুলঘুলির বাসা ছেড়ে একটা পাখি ফুরৎ করে বেরিয়ে যায়, ঠোঁটে কিরা কেটে ছানাপোনাদের খাওয়ানোয় ব্যস্ত মা-পাখিটা। একটা ফিস্ট যেন। উড়তে উড়তে ডিমের খোসা এসে পড়ছে কাত হয়ে থাকা ঠাণ্ডা চিবুকে, চিবুক ছুঁইয়ে কানের লতিতে, যেন এক দুল। মুক্তাহার। সুহা অপলক, হিম।

বাংলাদেশ সময় : ১৯০৯ ঘণ্টা, ১৯ জানুয়ারি ২০১৩
এমজেএফ/ [email protected]


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান