
ঢাকা: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা সারা দেশের মডেল স্কুল ও কলেজগুলো চরম অব্যস্থাপনার ‘মডেল’ হয়ে উঠেছে। সরকারি বিধিমালার আলোকে চাকরি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও এ সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন এ ধরনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।
১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সারাদেশে ১১টি উচ্চ মাধ্যমিক মডেল স্কুল ও কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে রাজধানী ঢাকায় ৫টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি ও বগুড়া শহরে একটি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শিক্ষার মান উন্নয়নে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর, রূপনগর, লালবাগ, শ্যামপুর ও ইস্কাটনে মডেল স্কুল-কলেজগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশালে একটি করে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জানা গেছে, স্কুল পর্যায়ে ৬ষ্ঠ থেকে দশম ও কলেজ পর্যায়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়ন করছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ সব প্রতিষ্ঠান চরম অব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল ও কলেজের উপাধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ‘যে আশা নিয়ে মডেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে এসেছিলাম, তার কিছুই পূরণ হয়নি। ঠিকমতো বেতন হয় না। শিক্ষক থাকে না। বোনাস পাই না। আরো কত কী! সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না।’
শ্যামপুর মডেল স্কুল-কলেজের প্রভাষক মো. আসাদুজ্জামান এ ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব স্কুল ও কলেজ পরিচালিত হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ এর মধ্যে দুটি স্কুল ও কলেজ বেসরকারিভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকার ইস্কাটন ও বগুড়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটি পরিচালিত হচ্ছে বিয়াম ফাউন্ডেশন-এর অধীনে।’
জানা গেছে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। পর্ষদ রয়েছে দুই ধরনের। বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে। অপরদিকে, ঢাকার ৪টি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় শিক্ষা সচিবের অধীনে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদে দুইজন করে শিক্ষক প্রতিনিধি রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই।
এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ রাউউক উত্তরা মডেল কলেজের আদলে একটি নীতিমালা (স্মারক ২০/১১ মডেল-৭/২০০৭-৮৫/৮৬) আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আইন মন্ত্রণালয় চূড়ান্তভাবে সেটি জারি করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
লালবাগ মডেল স্কুল ও কলেজ-এর উপাধ্যক্ষ মঈন উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, ‘৭ বছর চাকরি করার পরও অনেক শিক্ষকের চাকরি স্থায়ী হয়নি। ফলে পদোন্নতি, গ্রাচ্যুইটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, পেনশন সুবিধা পাওয়ার কোনোরকম সুযোগ না থাকায় আমাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।’
বিভিন্ন মডেল কলেজের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, অধিকাংশ মডেল কলেজ পরিচালিত হচ্ছে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে। কারিগরি শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার শ্যামপুরসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মডেল কলেজে কোটি টাকার ভোকেশনাল সামগ্রী অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
তারা জানান, কলেজগুলোতে চরম আর্থিক সঙ্কট চলছে। যে কোনো সময় বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। প্রাথমিক বিদ্যালয় শাখার কোনো বিধান না থাকলেও আর্থিক সুবিধা বাড়াতে ২০১১ সালে এ সব প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শাখা খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ এর জন্য অনুকূল কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ তৈরি হয়নি।
এ ব্যাপারে রূপনগর মডেল স্কুল ও কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. আবদুল মান্নান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিয়োগের আগে বলা হয়েছিল, মডেল স্কুল-কলেজ সরকারিভাবে পরিচালিত হবে। অথচ সরকারি নিয়মের কিছুই নেই এখানে। আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনভাতা পেতে বেশ কষ্ট হয়। শুনেছি, সরকারিভাবে ঢাকাতে আরো ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘মডেল স্কুল ও কলেজগুলোকে এগুলোর সঙ্গে সরকারি করার জন্য আমরা আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।’
শিক্ষকরা দাবি করেছেন, মডেল স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল সত্ত্বেও সরকারিভাবে তাদের সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ নেই।
মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল ও কলেজ-এর উপাধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছর আমার স্কুল থেকে ১৩৬ জন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। সব কজন পরীক্ষার্থীই মেধার সঙ্গে পাশ করেছে। পাশের হার শতভাগ। এর মধ্যে ৫৬ জন পেয়েছে এ প্লাস। একইভাবে ভালো ফলাফলের অভিমত ব্যক্ত করেছেন ঢাকার বাইরের খুলনা মডেল স্কুল-কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম সিরাজুল ইসলাম।’
এ ব্যাপারে শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১০