পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময়সীমা তুলে দেওয়া হোক

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ২১:১৩, জুন ২৬, ২০২৫
এইচএসসির প্রথম বিষয়ে পরীক্ষা না দিতে পারা ভুক্তভোগী। ছবি: সংগৃহীত

এইচএসসির প্রথম বিষয়ে পরীক্ষা না দিতে পারা ভুক্তভোগী। ছবি: সংগৃহীত

একজন শিক্ষার্থী যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার হলে পৌঁছতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বোঝা যায় শুধু পরীক্ষা নয়, তার জীবনের একটা বড় স্বপ্নও থেমে গেছে দরজার ওপারে। আর এই থেমে যাওয়ার পেছনে দায়ী কেবল সময় নয় দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একগুঁয়ে নিয়ম, যেখানে মানবিকতা নয় শুষ্ক নিয়মই শেষ কথা।

সরকার পাবলিক পরীক্ষার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি শুরু করে। নির্ধারিত তারিখ আসার পর শুরু হয় পরীক্ষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হয়, কেউ হয় পরাজিত। কিন্তু যারা পরীক্ষা দিতে পারেন না, তাদের ভাগ্যে কি জোটে? 

২৬ জুন ২০২৫, দেশজুড়ে শুরু হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। এদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ঘটনা বেশ ভাইরাল হয়েছে। রাজধানীর সরকারি মিরপুর বাঙলা কলেজ কেন্দ্রে এক ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। কেন্দ্রে আসার পরও হলে ঢুকতে না পারায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই শিক্ষার্থীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি-ভিডিওতে দেখা যায়, পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা মেয়েটি অঝোরে কাঁদছেন।

জানা গেছে, মেয়েটির বাবা নেই। তার মাও গুরুতর অসুস্থ। মেজর স্ট্রোক করেছেন তিনি। পরীক্ষার হলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও পরিবারের একমাত্র সচল সদস্য হিসেবে ওই শিক্ষার্থী সকালে তার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে খালাকে নিয়ে যান কেন্দ্রে। কিন্তু দেরি হওয়ায় তাকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার খালা বার বার সরকারি মিরপুর বাঙলা কলেজ কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছিলেন যেন পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু, ‘রুলসে নেই’ অজুহাতে ওই শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি।

এই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার হলে ঢোকার সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টি ভাইরাল হতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন নেটিজেনরা। তাদের ভাষ্য, কতটা অমানবিক নীতি হলে একজন শিক্ষার্থী তার মমতাময়ী মাকে হাসপাতালে রেখে এলেও পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায় না!

একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ভুক্তভোগীর ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, সে ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, বরং জীবন-মৃত্যুর মুহূর্তে মায়ের পাশে দাঁড়াতে গিয়েই পরীক্ষায় দেরি করেছে। এই মানবিক পরিস্থিতিতে তার প্রতি সদয় হওয়া উচিত ছিল।

অনেকে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন— মানবিক বিবেচনায় যেন বিশেষ ব্যবস্থায় তার পরীক্ষাটি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

এ ঘটনার পর এখন পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য আসেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষ্য, ওই শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দেওয়ার ‍সুযোগ প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এখানে বাধা শিক্ষাবোর্ডের রুলস। তাই সেই রুলস তুলে দেওয়া হোক। 

একজন শিক্ষার্থী ১০-১২ বছর পড়াশোনা করে জীবনের দুটি বড় পরীক্ষার সিটে বসে। এ সময় কোনো কারণে যদি তার একটি পরীক্ষা ছুটে যায়, তাহলে তার পুরো একটি বছর নষ্ট হয়। ফলে পরীক্ষার সময়সীমা ঠিক রেখে শিক্ষার্থীকে তার পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া দরকার‌। পরীক্ষায় সে কতটা লিখতে পারল, সেটি ফলাফল বলবে। কিন্তু সুযোগ না দেওয়া মানে তার স্বপ্নটাকেই সরাসরি শেষ করে দেওয়া। আর সেটিই সবচেয়ে বড় অনাচার।

বিশেষ করে, এই শিক্ষার্থীর মতো যারা মানবিক বিড়ম্বনায় ভোগেন তাদের বিষয়টি শিক্ষা বোর্ড, পরীক্ষারে কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের মাথায় রাখা উচিৎ। কোনো পরীক্ষার্থী ইচ্ছা করে পরীক্ষার কেন্দ্রে দেরি করে আসে না। তাই দেরি হলেও পরীক্ষার সিটে বসার অধিকার তার আছে। 

আবার বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও যানবাহনঘন শহরে পরীক্ষার্থীদের হলে পৌঁছাতে যানজট অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এইচএসসি ও এসএসসি পর্যায়ের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোয় কয়েক মিনিট দেরি মানেই একটি পুরো বছর পিছিয়ে পড়া। অথচ এই দেরির দায় কোনোভাবেই কেবল পরীক্ষার্থীর নয়—তা নগর ব্যবস্থাপনার, যানবাহন নিয়ন্ত্রণের এবং প্রাতিষ্ঠানিক কড়াকড়িরও।

রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য বড় শহরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ফলে অনেকে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না সময়মতো। তাদের এই ভোগান্তির পেছনে রয়েছে অনির্ধারিত সড়ক সংস্কার, অব্যবস্থাপনা, যানবাহনের স্বল্পতা এবং অকার্যকর ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পরীক্ষার দিনগুলোয় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য পৃথক লেন, পরীক্ষাকেন্দ্র অভিমুখী নির্ধারিত বাস সার্ভিস কিংবা পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পাস সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। ট্রাফিক বিভাগও পরীক্ষার দিনগুলোয় কেন্দ্রঘেঁষা এলাকাগুলোয় বিশেষ নজরদারি চালাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে যদি দেখি, গত বছর ভুল কেন্দ্রে চলে যাওয়া এক পরীক্ষার্থীকে পুলিশ তার সঠিক কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছিল।

মিরপুর বাঙলা কলেজ কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীর ঘটনাটি শুধু একটি ব্যতিক্রম নয়, এটি আমাদের নিয়ম ও বাস্তবতার টানাপোড়েনের প্রতিচ্ছবি। 

শিক্ষা বোর্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, পরীক্ষার সময় নির্ধারিত থাকে, নির্দিষ্ট সময়ের পর কেউ হলে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু এই নিয়ম অমানবিক ও বাস্তবতাবিমুখ। এক বছরের জন্য একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ থেমে যাক শুধু পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য, সেটি কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। পরীক্ষাকেন্দ্র সংশ্লিষ্টদেরও দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের অনুরোধ বিবেচনায় নেওয়া। তারা চাইলে বিষয়টি বোর্ডে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন, যা একটি মানবিক পদক্ষেপ হতে পারত।

পরিবারেরও প্রস্তুতি থাকা জরুরি, বিশেষ করে মা গুরুতর অসুস্থ জানার পর শিক্ষার্থীকে সহায়তার জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সক্রিয় রাখা উচিত ছিল। যদিও এই পরিস্থিতিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই শিক্ষার্থীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

সবচেয়ে বড় কথা, এই সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার। সময়মতো পরীক্ষা হলে পৌঁছানো জরুরি, তবে যারা নিরুপায় ও মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে দেরি করে আসে, তাদের জন্য ‘স্পেশাল কেস’ বিবেচনার সুযোগ রাখা উচিত। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক বা বোর্ডের প্রতিনিধিকে তাৎক্ষণিক অনুমতির ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। দেরিতে এলেও পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, যদিও তার সময় কম থাকবে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার মানবিকতা যেমন প্রমাণিত হবে, তেমনি একজন শিক্ষার্থীর বছরের ক্ষতিও ঠেকানো যাবে। 

শিক্ষা শুধু পঠনপাঠন নয়, নীতি, মূল্যবোধ ও মানবিকতা শেখায়। আর এই মানবিকতার প্রথম বাস্তব পরীক্ষা শুরু হয় শিক্ষার্থীর নিজের জীবন থেকেই। তাই নিয়ম নয়, আগে বিবেচনায় আসুক শিক্ষার্থীর পরিস্থিতি। পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময়সীমা তুলে দেওয়া হোক— এটাই সময়ের দাবি।

লেখক: সাংবাদিক


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান