ইরান কি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৩:১১, জুন ২৪, ২০২৫

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা এবং ইরানে ইসরায়েলের হামলা এখনো চলছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ইতোমধ্যে বোমা হামলা হয়েছে। জবাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এসবের পর মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের যুদ্ধের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে।

শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানে তাদের প্রথম প্রকাশ্য হামলা চালায়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর এমন হামলা এই প্রথম। ওই বিপ্লবে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতাচ্যুত হন।

রোববার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বৈঠকে দেওয়া এক ভাষণে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ‘সীমা’ অতিক্রম করেছে।

এই হামলার জবাবে ইরান যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, তার একটি সম্ভাব্য পথ হলো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া। এই বাণিজ্যপথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এবং বিপুল পরিমাণ তরল গ্যাস পরিবাহিত হয়। এটি বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দামে ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন হলো, ইরান কি এই গুরুত্বপূর্ণ পথ বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে? এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান কি এটি করার ঝুঁকি নেবে?

হরমুজ প্রণালী কী?

হরমুজ প্রণালীর একপাশে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। অন্যপাশে ইরান। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) প্রশস্ত, যেখানে উভয়মুখী নৌচলাচলের পথ মাত্র তিন কিলোমিটার (২ মাইল) চওড়া। এ কারণে এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় আকস্মিক হামলা চালানোর পর থেকে জ্বালানি ব্যবসায়ীরা হরমুজ প্রণালী ঘিরে উচ্চ সতর্কতায় রয়েছেন। এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোর বিভিন্ন অংশে হামলা চালালেও সামুদ্রিক বাণিজ্যে সরাসরি কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি।

তবে এই সংঘাত শুরু হওয়ার আগেই ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার জেরে সামুদ্রিক মালবাহী পরিবহনের ভাড়া দ্রুত বেড়ে যায়। পণ্য পরিবহনের খরচ এই মাসে গত মাসের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেড়ে গেছে, এমন তথ্য দিয়েছে ফ্রেইট বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান জেনেটা।

হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত কে নেবে?

ইরান অতীতেও হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়েছে, তবে কখনো তা বাস্তবায়ন করেনি।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রেস টিভি জানিয়েছে, হরমুজ প্রণালী বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলকে। দেশটির পার্লামেন্ট আপাতত এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আইন পাস হয়নি।

পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য এসমাইল কোসারি ইরানি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে পার্লামেন্টের অবস্থান হলো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা উচিত, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল।’

রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাগচিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তেহরান কি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করবে? তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ইরানের হাতে বেশ কিছু বিকল্প রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, ‘ইসরায়েল মারাত্মক ভুল করেছে এবং তাদের শাস্তি পেতে হবে।’ তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বা হরমুজ প্রণালী সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট মন্তব্য করেননি।

বাস্তবে কীভাবে প্রণালী বন্ধ করা সম্ভব?

ইরান চাইলে হরমুজ প্রণালীতে সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরক মাইন বসাতে পারে। ইরানের সেনাবাহিনী বা রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) উপসাগরীয় অঞ্চলে জাহাজে হামলা বা দখলেরও চেষ্টা করতে পারে, যা তারা অতীতেও বেশ কয়েকবার করেছে।

আশির দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধে এই অঞ্চলে ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ নামে সংঘাত হয়েছিল। তখন ইরাক ইরানি জাহাজে এবং ইরান সৌদি ও কুয়েতি তেল ট্যাংকার এবং এমনকি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজেও হামলা চালায়।

২০০৭ সালের শেষ দিকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর মধ্যে আবারও উত্তেজনা বাড়ে। এক ঘটনায় ইরানি দ্রুতগামী নৌকা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছিল, যদিও কোনো গুলি ছোড়া হয়নি।

২০২৩ সালের এপ্রিলে ইরানি বাহিনী গালফ অব ওমানে ‘অ্যাডভান্টেজ সুইট’ নামের একটি ক্রুড ট্যাংকার আটক করে, যেটি শেভরন কোম্পানির ভাড়ায় চলছিল। ট্যাংকারটি এক বছরেরও বেশি সময় পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কী হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও রোববার চীনের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ইরানকে হরমুজ প্রণালী বন্ধ না করার জন্য চাপ দেয়।

ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুবিও বলেন, ‘প্রণালী বন্ধ করা ইরানের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যা হবে। আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত, তবে অন্যান্য দেশগুলোকেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এটি অন্য দেশের অর্থনীতির উপর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে।’

হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, বিশেষ করে যারা ইসরায়েলের হামলার কড়া সমালোচনা করেছে, তাদেরও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। 

এ ছাড়া এই পদক্ষেপ সরাসরি চীনকেও আঘাত করবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ইরানের মোট তেল রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ (প্রায় ১৬ লাখ ব্যারেল প্রতিদিন) কেনে, যা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বিক্রি হয়।

মার্কিন ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে, হরমুজ প্রণালী অবরোধ করা হলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলারেরও বেশি হয়ে যেতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তা পণ্যের দামেও—বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক এবং রাসায়নিক পণ্যের মতো জ্বালানি-নির্ভর খাতে।

বিশ্বজুড়ে তেল আমদানিকারক দেশগুলো উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখে পড়তে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যেতে পারে, যদি এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়। এতে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর পরিকল্পনা পিছিয়ে দিতে পারে।

তবে ইতিহাস বলছে, বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের ব্যাঘাত সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে ২০০২ সালের শেষ দিকে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৪৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ২০০৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন হামলার ঠিক আগে দাম দ্রুত কমে আসে।

একইভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩০ ডলারে পৌঁছায়, তবে আগস্টের মধ্যেই আবার ৯৫ ডলারে নেমে আসে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, তেলের দামে এই দ্রুত ওঠানামার কারণ ছিল, বিশ্বে তখন অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা ছিল এবং দ্রুত দাম বাড়ার কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে গিয়েছিল।

আল জাজিরা অবলম্বনে

আরএইচ 


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান