গুমাই বিলের সোনালী ধানে কৃষকের মুখে হাসি, চোখে স্বপ্ন

রমেন দাশগুপ্ত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৪:০৫, নভেম্বর ২২, ২০১২

গুমাই বিল (রাঙ্গুনিয়া) ঘুরে এসে: চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার খ্যাত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার গুমাই বিলে কৃষকদের মধ্যে উৎসবের আমেজে ধান কাটার ধুম লেগেছে। হেমন্তের ভোরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে গুমাইবিলে উঁকি দেয়া সোনালী ধানের ঝিলিক মারা হাসির মত আমনের ব্যাপক ফলনে কৃষকের মুখেও ফুটেছে হাসি।

কিন্তু ব্যাপক ফলনে আবার আশংকাও আছে কৃষকদের মনে, যদি ধানের দাম পাওয়া না যায় !

রাঙ্গুনিয়ার নিশ্চিন্তাপুর পাহাড়ের পাদদেশে চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে এ গুমাই বিল। আর গুমাই বিলকে ঘিরে আছে উইটাল্যা খাল, হরিণ্যাখাল সহ কমপক্ষে ৫টি খাল। এসব খালের জোয়ার-ভাটার পানি বাঁচিয়ে রেখেছে গুমাই বিলকে।

স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, গুমাই বিলের ফলনে বাংলাদেশের মানুষের আড়াই দিনের ভাতের যোগান হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে এবার গুমাই বিলে আমনের চাষ হয়েছে দু`হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। আর গুমাই বিলে এবার ধান হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিকটন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, `প্রতি হেক্টরে এবার ধান হয়েছে গড়ে পাঁচ টন করে। এতে চাল হবে ৩ দশকি ২৫ টন করে। এ হিসেবে গুমাই বিলে ধান হয়েছে ১৩ হাজার টন যা থেকে চাল হবে প্রায় ৮ হাজার ৪৫০ টন।`

গত শনিবার সকালে রাঙ্গুনিয়ার মাঝের বিল, নিশ্চিন্তাপুর, কাটা বটতল, কদমতলি সংলগ্ন গুমাই বিলের বিভিন্ন অংশে গিয়ে দেখা গেছে, ধান কাটার বর্ণিল উৎসবে মাতোয়ারা কৃষাণ-কৃষাণী, দিনমজুর, গৃহস্থ সবাই। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে যেদিকে দু`চোখ যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে শুধুই শত শত কৃষকদের ধান কাটার দৃশ্য। মাঝে মাঝে দূর বিল থেকে মাথায় কিংবা কাঁধে বোঝাই করে কৃষক নিয়ে আসছে কাটা ধানের বড় বড় আঁটি।

ধান কাটতে গিয়ে কিংবা কাটা ধান আনতে গিয়ে অনেক কৃষক গলা ছেড়ে গাইছেন গান। হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠছেন কৃষক, মজুর সবাই পরস্পরের সঙ্গে।

কাটা বটতল এলাকার কৃষক আব্দুল মোমিন (৬৪) প্রায় ১২ কানি (৪৮০ শতক) জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন। তিনি চাষ করেছেন দিনাজপুরি পাইজাম ধানের যেটা উচ্চ ফলনশীল হিসেবে পরিচিত। তিনি হিসেব করে দেখালেন, তার চাষ করা প্রতি কানি জামিতে ৮০ আড়ি (৩২ মণ) করে ধান হয়েছে। বীজ, সার এবং কীটনাশক মিলিয়ে প্রতি কানিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা।

আব্দুল মোমিন বলেন, `দেশ স্বাধীনের আগে ধান পাইতাম কানিতে ২০ আড়ি, ৩০ আড়ি। জিয়া খাল কেটে দেয়ার পর ধানের ফলন বেশি হচ্ছে। তবে গত দু`তিন বছর ধরে কানিতে ৬০-৭০ আড়ি করে পাচ্ছি। এবার আরও বাড়ছে।`

এ বছর দু`কানি (৪০ শতক) জমিতে আমন চাষ করেছেন নিশ্চিন্তাপুরের আবদুল আজিজ। বাম্পার ফলন হওয়ায় সোনাফলা জমির সোনালী ধানে ভরে গেছে তার উঠোন। ধান মাড়াই, খড়খুটো বাছাই ও রোদে শুকিয়ে গোলায় ধান তোলার কাজে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তার পরিবার।

আব্দুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, `ধান যা পাই, বছরের খোরাক হয়ে যায়। কিছু বাঁচলে সেগুলো বিক্রি করি।`

মরিয়ম নগরের কাটাখালী গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ (৪০) গত ২৮ বছর ধরে গুমাই বিলে গৃহস্থের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করছেন। এবার ৩ কানিতে চাষ করেছেন। ফলন পেয়েছেন কানিতে ৮০ আড়ি করে।

তার মতে, ধানের ফলন কম হলেই তাদের লাভ। এতে দাম পাওয়া যায়। গত বছর প্রতি আড়ি (১৬ কেজি) ধান মাত্র ৭০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাতে শ্রমিকের মজুরি, উৎপান খরচ মিলিয়ে তাকে অনেক টাকা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল বলে জানান ইউসুফ।

আর ক্ষতির আশংকায় এবার চাষই করেননি নজরটিলা এলাকার কৃষক আবুল কালাম (৫১)। অথচ বাপ, দাদার আমল থেকে প্রতি বছর আবুল কালাম ছিলেন গুমাই বিলের ব্যস্ত কৃষক।

আবুল কালাম বলেন, `গত বছরও ২০ কানিতে চাষ করেছিলাম। এবার জমি গেরস্থকে বুঝিয়ে দিয়েছি। মজুরদের প্রতিদিন তিন বেলা ভাত, এক প্যাকেট করে সিগারেট, আর দৈনিক ৬`শ থেকে সাত`শ টাকা মজুরি দিতে হয়। সেভাবে ধানের দাম পায়নি। এখনও ধার শোধ করতে পারিনি। তাই এবার চাষ করিনি।`

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, `কৃষকদের মনে ধানের দাম না পাবার যে আশংকা সেটি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, এবার ধানের দাম গতবারের চেয়ে ভাল পাওয়া যাবে।`

এদিকে গুমাই বিলে ধান কাটার উৎসবের সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকদের কদর। গুমাই বিল থেকে ধান কাটা শেষ করে বাড়িতে ফেরার সময় যাতে বাড়তি কিছু উপার্জন করে নিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য আছে শ্রমিকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। কিন্তু তাদের মনেও আছে হতাশা। তারা বলছেন, বর্ষাকালের চেয়ে শীতকালে বেশি মজুর আসে। সেজন্য তারাও সেভাবে বেশি মজুরি পাচ্ছেন না।

নেত্রকোণার বারহট্ট থানার হারুলিয়া গ্রাম থেকে আসা মজুর করিম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, `মনে করেন, আমরা কামাই করতে বিদেশ আসছি। আমাদের পরিবার দেইখ্যা আছে, আমরা কখন যাব টাকাপয়সা নিয়ে। দুইটা সিজন তো মনে করেন, আমাদের টাকা কামানোর সিজন।`

একই গ্রামের শফিকুল জানান, তারা দিনে তিনবেলা ভাত থেকে সাড়ে ৩`শ টাকা করে মজুরি পাচ্ছেন। অথচ বর্ষাকালে তারা সাড়ে ৫`শ, এমনকি ৬`শ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়েছেন। এরপরও গুমাই বিলে কাজের কোন অভাব নেই। আর এতেই তাদের মনে খুশির অন্ত নেই।

গুমাই বিলে উটাইল্যা খাল পাড়ের একটি সেচকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আব্দুস সামাদ বাংলানিউজকে বলেন, `সরকার ইলেকট্রিসিটির লাইন দিলে, ডিজেলের দামে ভর্তুকি দিলে এখন গুমাই বিলের যেসব জমি খালি যাচ্ছে তা-ও আর অনাবাদি থাকবেনা। এসব জমিতে চাষ হলে গুমাই বিলে ফলন আরও বাড়বে।`

যত হতাশা আর আশংকা থাকুক না কেন, আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকদের চোখে এখন কিলবিল করছে হাজারো স্বপ্ন। ঘরে ঘরে উৎসবের সোনালী আমেজ। যেন সোনালী ধানে নাচছে গুমাই, স্বপ্নভরা চোখে হাসছে কৃষক।

বাংলাদেশ সময়: ১৩ ৪০ঘন্টা, নভেম্বর ২২ ২০১২

আরডিজি/সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান