পারুল

হাসান কামরুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৮:৫০, নভেম্বর ১৯, ২০১২

[পারুল অতি পরিচিত এক গল্প। গল্পের যাত্রা অন্তিমপুরে। গরিবের যুবতি বউ বা যুবতি মেয়ের দিকে এ সমাজের সমাজকর্তাদের হা-করা মুখ প্রতিনিয়ত শরীর স্পর্শ করতে চায়। শরীর সর্বস্ব পারুলদের তাই বেছে নিতে হয় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সমাজপতিদের হয়তো স্বামী হিসেবে নয়তো রাতের সঙ্গী হিসেবে। এ গল্পের নায়িকা পারুল অবশ্য মাতব্বরকে জীবন সাথী হিসেবে বেছে নিতে মনস্থির করেছে নষ্টামি থেকে নিজের আবরণকে রক্ষার জন্য। গল্পের পরমপরায় পারুলরা হারিয়ে যায়। বিবাহিত জীবন নিয়ে পারুলদের সন্তুষ্টি আছে কি নেই এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কারো কাছেই নেই।]

কতোদিন বুবু তোর মুখ খানি দেহিনা। তোর সংসারে পোলা হয় নাই বলে খালি মন খারাপ করে রাখিস। আল্লায় তোরে তো দুইটা মাইয়া দিছে নাকি? শুকুর কর। আজকালকার জমানায় পোলারা কি সোনা কামাইয়া দিবে? দেখতাছিনা কতো সোনা কামাই দিতাছে। এই বলে মহব্বত মিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। মাইঝা পোলারে কতো কষ্ট কইরাই না লেখাপড়া শিখাইছি। চাকরিও পাইলো। এইডা কি এমনিই এমনিই হইছে নাকি। নামায পইড়া আল্লার কাছে কতো কান্নাকাটি করছি। হেই কথাতো কেউ জানে না। হেরে পড়াইতে গিয়া জমি জিরাত বিক্রি পর্যন্ত করছি। নিজে না খাইয়া হেরে টাকা দিছি। কিন্তু কি ফল পাইলাম। চাকরি পেয়েই তো হেয় আমগো ভুইল্লা গেলো। প্রথম প্রথম ক’মাস চাকরির টাকাটুকাতো দিতো। কিন্তু যেই বিয়াটা করলো। সব রাক্ষুসি গিল্লা খাইসে। আগেই কইছি আমরা গরিব মানুষ, অতো বড়লোকের লগে আত্মীয়তা করুনের দরকার নাই। কিন্তু বউ আমার বুঝলো না। বড়লোকের লগে আত্মীয় করে বউ নাকি জাতে উঠবে। এখন মজা বুঝ্। বিয়ার তিনমাস যেতে না যেতেই পোলা বউয়েরে ঢাকায় তুলছে। আমার মাগিরও কি যে দরদ। পোলায় নাকি ঠিকঠাক মতো খাইতে পারে না। মেসে খাইতে খাইতে গ্যাস্ট্রিক হইয়া গেছে। কতো ফন্দি কইরা যে পোলা তার মায়রে হাত করছে। ফুসলি ফাসলি দিয়া বউয়েরে ঢাকাত নিয়া গেছে। এখন টাকা দিবে দূরের কথা মাসে একদিনতো আওনেরও সময় হয় না তার। কি খাই কেমনে চলি কোন কিছু জানারও দরকার হয় না। মহব্বত মিয়ার দুই চোখে জল ছল ছল করে উঠে।
 
  -ভাই কান্দিও না। আমরা গরিব মানুষ, এইডা আমগো কপাল।
  -ভাইরে মাইয়াডা তো বড় হইয়া গেল। বিয়ে সাদিতো দেওন লাগে।
  -হ’ সমন্ধ-টমুন্ধ কেমন আইয়ে?
  -নারে ভাই সমন্ধ আয়ে কিন্তু একটাও মনের মতো না।
  -ঘটক কালুরতো চারিদিকে নামডাক, হেরে কসনা একটা সমন্ধ আনতো।
  -হ্যায় একটা সমন্ধ আনছে। পারুলের লাইগা। বেটা বিবাহিত। তাও আবার  আমগো তানির চাইতে বয়সে দুই এক বছর বড় হইবো। বউ মইরা গেছে। আবার বিয়া করবে। ছেলেপুলেরা সবই  শহরে থাকে। বিয়ে সাদি করে যের যার মতো সংসার করছে।
 
  -কেডা এইডা। কার কথা কইতাছস বুবু?
  -দশ ভাইয়াগো বাড়ির আরজু মাতব্বর আছে না। হের লাইগা।
  -হু, আরজু মাতাব্বরতো সাতগ্রামের মাতাব্বর। বহুত দুর থাইকাওতো বিচারের লাইগা মানুষ আইয়ে হের কাছে। নাম শুনবোনা কেন, হেয় বহুত টাকা পয়সা আছে। গেরামের সবায় তার কথায় চলে।

  -গেরস্থোর অভাব নাই। ইয়া বড় বড় গরু, তিন লাঙ্গল হাল। কতো মানুষ যে কাম কইরা খায়। তা যদি ভাইজান আমনে যাইতেন, দেখতেন। কালু নাকি আরজু মাতাব্বরে আমগো পারুলের লাইগা কইছে। ব্যাডা নাকি শুইন্নাই রাজি।
  -মাতব্বর কি পারুলরে দেখছে।
  -ভাইজানে যে কি কননা, দেখবে না ক্যান, কইদিন আগেও না আইয়া গেছে। আমারে ভাইরবৌ, ভাইরবৌ কইরা ডাকে। আমার হাতে পান খাইয়া গেছে না।
  -কিন্তু বুবু তোরে ভাইরবৌ ডাকে তয় তো মাতব্বর সম্পর্কে পারুলের চাচা হয়।
  -আরে পাড়া প্রতিবেশীর সম্পর্ক। এইডা কি রক্তের কিছু। আমনের কি মত?
  -হু সমন্ধটা ভালোই। কিন্তু মাতব্বর কইদিন বাঁচবে হেইডা হইলো কথা। এ বলে মহব্বত চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিজের কপাল চাপড়াইতে ইচ্ছা করছে তার। আল্লায় গরিব বানাইছে বলেইতো আজ পারুলের বিয়া আসে ঐ বুড়া মাতব্বরের লাইগা। গরিবদের কোন পছন্দ থাকতে নেই। তার উপর পারুলের গায়ের রং কালো। কালা মাইয়াগোতো এমনিই বিয়া হয় না।

কালু ঘটক হাজির হয়। পান চিবাইতে চিবাইতে বলে-
  -আরে মহব্বত ভাই যে কি খবর ভাইসাব?
  -এইতো।
  -আমি তো পারুলের লাইগা সমন্ধ একটা ঠিক কইরা ফেলছি পারুলের মায় কি কিছু কইছে?
  -হ, শোনলাম তো।
  -তয় কি মত আমনের, সব ঠিকঠাক থাকলে দেরি কইরা লাভ নাই। আরজু মাতব্বরের লগে সমন্ধটা হইলে পারুলের মায় জাতে উঠবে। এমন সোনা মাখা পাত্র, পাওয়াতো সাতরাজার ভাগ্য। বিয়ার যাবতীয় খরচাপাতি মাতব্বরই দিবো।

কালু ঘটকের কথা শুনতে শুনতে মহব্বতের জেদ ওঠে। মনে মনে বকতে থাকে, হারামজাদা বুইড়া একটা বেডার লাইগা কুড়ি বছরের মাইয়ার বিয়া দিতে চায়। আর বুবুরও যে কতো লোভ মাতব্বররে জামাই কইরা বুবু সংসারের অভাব মিটাইতে চাইতাছে। আল্লায় না দিলে..। এ কামে পানি দিবে এটা জাইন্ন্যা রাখিস বুবু।

  -ভাইজান কি ভাবতাছেন? টাসকি মাইরা গেলেন যে!

কালু ঘটকের ইয়ার্কির মর্ম মহব্বত মিয়া ঠিকই বুঝতে পারে। কিন্তু তারতো এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই।

  -দেশের যে অবস্থা তাতে সামনে সরকার নাকি আর বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে তো। টেলিভিশন পত্রিকায় খালি কিসব শুনা যায়। সরকারের লোকেরা নাকি ব্যাবাক মিল্ল্যা লুট পাট কইরা খাইতাছে?
  -কি জানি বাপু, এতোসতো বুঝি না। এগুলো সরকার বিরোধীরা কইয়া বেড়ায়। নাইলে যেই ভোট পাইয়া হেইবার দল জিতলো। সামনেরবার দল ক্ষমতায় না আইলে দেশে আগুন জ্বলবে।

মহব্বত মিয়ার কতো চিন্তা। শেখ সাহেবের মিটিংয়ে ৭৪ সালে মহব্বত মিয়া গেছিলো। হায়রে মানুষ। মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। আল্লায় শেখ সাহেবেরে একটা গলা দিলোরে বাবা। মাইকের সামনে দাঁড়াইয়া যখন ভাষণটা দিলো, মনে হয় পরাণটা জুড়াইয়া গেল। আমগো পাড়ার মাইনষে, চায়ের দোকানে খালি খুচুরখুচুর আলাপ করে। রাজনীতি নিয়া আলাপ করে। কি সব চিন্তা করতাছে। এরেই কয় কোথায় আব্বাস আর কোথায় গাবগাছ। আইছি বুবুর কাছে  দুইডা দিন নিরিবিলি ভাইবোনে মিল্ল্যা সুখ দুঃখের আলাপ কইরা কাটাইবো। হেয় নাকি রাজনীতি নিয়া আলাপ করে। পাগলে কামড়াইছে। এগুলো মন্ত্রী এমপির ব্যাপার। আমগো এমপি সাব যখন আইয়ে পুলিশের গাড়ি সামনে থাইক্যা বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে যায়। পোলা বইয়া এমপিতো। হগলের লগে মিশে। গেলে না করেনা। এইতো এইখানে আইবার দুইদিন আগেইতো এমপির কাছে গেছিল মহব্বত। এমপি’র এইহানে যাইয়া মাইনষের ভিড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়াই থাকতে থাকতে মহব্বতের পা ব্যাথা হইয়া গেছে। ক্যামনে ডাক দেই। তাই জোরে গলা খাগড়ানি দিলাম। এমপি মনে বুঝতে পারছে। গলা খেকড়ানিডা শুনে এমপি বললো কে গলা খাকড়ানি দিলো। মহব্বত বলে হু এমপি সাব আমি দিছি। এমপি তারে জিগায়:

  -আপনি কোন এলাকারগো।
  -আমিতো সোনাকান্দার।
  -ও সোনাকান্দার কাগো বাড়ির।
  -আজগরগো বাড়ির।
  -আমার নানার বাড়িওতো ঐখানে। মিয়াগো বাড়ি।
  -হ, চিনিতো, আপনের নানা বড়মিয়া সাব বহুত ভালা মানুষ আছিলো। আমিতো আগুন পৌষমাসে আপনার নানার বাড়িতে কামলা দিতাম। আপনের আম্মা সফুতন যখন আপনাগো লইয়া যাইতো। আমাগো আপনার নানা কইতো মহব্বত আমার বড় ঝিয়ে আইছে। তোমরা কাইল দুপুরে আমগো বাড়িতে দুপুরে খাইবা। আগুন পৌষ মাস আইলেই আপনের মা যাইতেন। আর আমগো কামলাগো আপনের মায় নিজহাতে ভাত বাইড়া খাওয়াইতেন। তাছাড়া আপনের মায়রে আমরা ছোড বেলায় কোলে কাহে নিসিতো।

এমপি সাবের মুখটা বিবর্ণ হয়ে পড়ে। তার মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ে। এমপি সাবের মায় মরছে বছরদুয়েক হবে। পকেট থেকে টিসু বের করে এমপি সাব মুখ মোছে।
এইবার মহব্বতকে কাছে ডেকে বলেন:
  -মামা আমার এইখানে কিয়ের লাইগ্যা আইছেন।
এমপি সাব তারে মামা কইছে গর্বে তার বুকটা ভইরা উঠে। আমতা আমতা করে মহব্বত বলে:
  -এমপি সাব গত কয়মাস ধইরা আমি ভিজিএফ কার্ডে চাইল পাই না। আগেতো পাইতাম। গেদু চেয়ারম্যান হওনের পর থেকেই আমগো বাড়ির ১০/১২ জনের কার্ড বন্ধ কইরা দিছে। চেয়ারম্যানের কাছে কয়বার যে গেছি, যাইতে যাইতে আমগো পা ব্যথা হইয়া গেছে। গেলে খালি কয় এমপি সাবের বরাদ্দ দেয় নাই। তোমরা আমার কাছে আইয়ো কে যাও এমপি সাবের কাছে যাও। হেই লাইগ্যা আপনের কাছে আইছি।

এমপি মনোযোগ দিয়া মহব্বতের কথা শুনে হের যে কয়ডা চেলা থাকে। এমপি যেইখানে যায় হেইখানে মটরসাইকেল দিয়া যায়। ঐডার একটারে কানে কানে কি যেন কইলো। তারপর মহব্বতেরে কইলো আপনে ওর লগে মোটর সাইকেলে কইরা যান। হেয় আপনারে নিয়া যাইবে। তারপর মহব্বত এমপির চেলার মটরসাইকেলে করে চেয়ারম্যানের বাড়িত যায়। চেয়ারম্যানতো মহব্বতরে এমপি’র লোকের মটর সাইকেলে দেখে টাস্কি খায়। হারামজাদা না জানি কি অকামটাই না কইরা আইসে। এমপির চেলা নাইমা চেয়ারম্যানরে কি জানি কয়। চেয়ারম্যান সাথে সাথে মহব্বতরে ডাইকা। ভিজিএফের চাল দেয়। আর বলে আপনাগো বাড়ির বাকি হগলরে ভিজিএফের চাইল নিতে আইতে কইবেন। মহব্বত এবার বেজায় খুশি। শালা চেয়ারম্যানরে এমপি ঠেলা দিছে। কম চোটে কি বিলাই গাছে উঠে। চাল লইয়া গ্রামের ব্যাবাকরে এ ঘটনা কয়। ব্যস, যায় কই। মহব্বতরে এমপির লোক ভাইব্বা কতোজনে কতো সুপারিশ করে। আর মহব্বও কম যায় না। সবার আবদারই শুইন্না রাখে। তবে এইডা সত্য এরপর থেকে এমপি সাব দেখলেই মামা মামা কইয়া ডাকতো। আজ মহব্বত কিছুটা ভীত। দলের অবস্থা দিনদিন যেইভাবে খারাপ হইতাছে। তাতে সামনের বার ক্ষমতায় না আইলে চেয়ারম্যান কি তারে ছাইড়া দিবে। আর চেয়ারম্যান নাকি সরকার দলের লোক না।  অন্যদলের লোক। হেইবার ওরা যখন ক্ষমতায় আইলো। এলাকায় কি অত্যাচারটাই না করলো। করিমের হাতটা কাইট্যা ফেলাইলো। বাড়িত ঢুইক্যা নাসিরের অস্ট্রেলিয়ান গাবিন গাইটারে রড দিয়া ফার মাইরা এফোড়ওফোড় কইরা দিল। গাইটা ছটফটাইয়া চোখের সামনে মইরা গেল। শুকুর আলীর পুকুরের ছাড়া মাছগুলো একরাইতে ধইরা নিয়া গেলো। এগুলানতো চোখের সামনেই দেখা। মহব্বত যেন স্মৃতির দরজার হাবুডুবু খাচ্ছে। ওর মতন চুনাপুটি দেশের রাজনীতি নিয়া ভাবে। এই জন্যই তো দেশের এই দশা। এইতো কবছর আগে ফকরুদ্দিন যহন ক্ষমতায় আইলো। কতো টিন চোর গম চোর ধরা খাইলো। আমগো আগের চেয়ারম্যানের বাড়িত থাইক্যাতো র‌্যাবেরা আইসা ত্রাণের টিন পাইলো। গরুর ঘরের চালায় লাগাইছিল। র‌্যাবেরা গরুর ঘরের চালাত থাইক্যা হেই টিন খোয়াইয়া নিয়া গেছে। হেইদিন চেয়ারম্যানেরে গলার মধ্যে গামছা দিইয়া পুরা গ্রাম র‌্যাবেরার গাড়ির সামনে দিয়া হাঁটাইয়া হাঁটাইয়া নিয়া গেছে, আর যারে রাস্তায় পাইছে হেরেই কইছে আমি ত্রাণের টিন চুরি করছি, এই লাইগ্যা আজ আমার এই দশা। কি বেয়াজ্জতি কারবার। পড়ে হুনছি চেয়ারম্যানেরে নাকি র‌্যাবেরা থানাত নিয়া আচ্ছামতো মাইর মারছে। মহব্বতের মাথায় যে কতোকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। হেই দলডার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়াইতো দেশের মানুষ এইদলডারে ভোট দিল। কি লাভ হইলো যেই লাউ হেই কদু। মহব্বতের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় জুনু।

  -ভাইজান ও ভাইজান কি এমন ভাবতাছেন। হেই কহোন থাইক্যা বসাইয়া বইসা কি ভাবতাছেন আমনে? কওনা দেহি আমার লগে। এর মধ্যে বৃষ্টি নামে। ভাদ্রর মাসতো শেষ অইয়া গেছে।
 
  -জুনু তোর কি মনে পড়ে আগে আমরা আশ্বিন মাসে মেঘ নামলে কাজিবাড়ির খালে গিয়া বইচা মাছ ধরতাম। জালি দিয়া দুই খেও দিলেই ডেকচি ভইরা যাইতো। হেই মাছ মায় শুটকি দিয়া উঠান ভইরা ফেলতো। দিন যে কই গেলো, এখন আর হেইদিন নাই। মাছই নাই।
  -হু ঠিকই কইছেন। ভাইজান এহনতো বইচা মাছই দেহিনা। আগে বইচা মাছের লগে ফোটকা মাছও আইতো। একবার সখিনাগো বাইত, ফোটকা মাছ খাইয়া মায়ঝিয়েরা হাসপাতাল গেছিল। ওই মাছে নাকি বিষ ছিল।
  -কি জানি বুবু, তয় আমরাতো খাইছি। কই কোনদিনতো আমগো কোনে সমস্যা হয়নাই। হেইবছর সখিনাগো এই কীর্তি দেইখ্যা আমরা আর মাছ ধরতে যাইনাই। মায় নিষেধ করছিল। না যাওন লাগবে না। আর ফোটকা মাছ দেখলেইতো গা ছম ছম করতো।
তাতি বাড়িত একবার জিওল মাছের উজান ধরছিল। পাড়ার ব্যাপাক মানুষ তাতি বাড়িত নামছিল। বউ ঝি মায় পুত কেউই বাদ যায় নাই। আপনেরে ভাই হেইবারইতো শিংয়ে কাটা ফুটাইছিল। সে কি চিৎকার আপনের। মাছেরও মাইর পড়ছে। মায় খালি কয় আমার পোলা না বাঁচলে মাছ দিয়া কি হইবো। মার মাথায় যে বুদ্ধি ছিলগো ভাইজান। মায় হারুরগো বাড়িত থাইক্যা লাল মচিরের বিচি ফালাইয়া দিয়া কেরাসিন তেল ভইরা গরম কইরা আপনের পায়ে দেওয়ার সাথে সাথে ভালা হইয়া গেলেন।

মহব্বত হাসে আর বলে:
  -তুই এহনও মনে রাখছোস। তোর ব্রেইনডা মাশাল্লাহ বহুত ভালা। লেহাপড়া করলে তুই র্জজ ব্যারিস্টার হইতে পারতি।
জানু দীর্ঘাশ্বাস ছাড়ে:
  -হু ভাইজান। জর্জ ব্যারিস্টার হইতে পারতাম। দু’বেলা খাওনই ঝুটে নাই। ভাইবোনেরা কতো কষ্ট কইরা যে বড় হইছি হেইডাতো ভুইল্যা যাই নাই। খাইতে না পাইয়া সারাক্ষণ ক্ষিদার জ্বালায় ছটফট করছি। মায় এই বাড়ি হেই বাড়ি থেকে চাইল কর্জ কইরা যাই-ই জোগার করতো তা দিয়াতো দুইবেলাই ভালো কইরা হইতো না। না খাইতে খাইতে পেটে চর পইড়া গেছে। আল্লায় আমনেরেতো ভালোই রাখছে। পোলাডারে লেহাপড়া কইরাছেন। শহরে ভালো চাকরি করেন। মোসেলমউদ্দিনের মতো বড় মাইনষের মাইয়া বিয়া করাইছেন। আমনের লগে আর কেডা।
 
  -কিরে বুবু তুই বুঝি ঠ্যাস দিয়া কথা কস? তুই তো সবই জানোস। আমরা গরিব মানুষ, আমগো কপালে সুখ হয় না। পোলাডা যেই ঢাকাত গেছে। আইজোবদি খবর নেওয়ার সময় পাইলো না। কামাই খামু দূরের কথা।
  -ভাইজান মোসলেমউদ্দির বেয়াই হিসেবে মাইনষে আপনেরে অনেক খাতির করে তাই না?
  -হ করে কিন্তু আমার না ঔসব আলগা খাতির টাতির ভাল্লাগে না। ঐ যে কথায় কয়না দাদার নামে চার আনি বাপের নামে আধা আর নিজের নামে শাহজাদা। আমি আবার এই কথায় বিশ্বাস করি।
  -ভাইজানেযে কতো সুল্লুক জানেন। আল্লায় আমনের মাথায় বুদ্ধি দিছে।
  -খালি আমারে কস ক্যা? তুইওতো কুলে উঠতে যাইতাছোস। আরজু মাতব্বরের কাছে মাইয়া বিয়া দিয়া কুলে উঠবি। আরজু মাতব্বর কি যা তা লোক নাকি? দশগ্রামের মানুষ চিনে। প্রত্যেক রাইতেইতো হেয় বিচার করতে যায়। কতো দূরে দূরে বিচারে যায়। হেয় বিয়া কইরা কি করবে। তোর মাইয়ারে কি হেয় সময় দিতে পারবে নাকি?
  -কিজানি ভাইজান। বিয়াটা ভালভালাসিল হইয়া গেলেই বাঁচি। বানজানি দেওনেরওতো মানুষের অভাব নাই। কুটনি বুড়ি মাইয়াডার কাছে আইয়া খালি বাজে কথা কয়। এদিক ওদিক তাকায়। যেই দেখে আমি ঘরে নাই, হেই মাইয়াডার লগে বাজাইরা গীত শুরু কইরা দেয়।

পাশের বাড়ি কুটনি বুড়ি। সম্পর্কে চাচিশাশুড়ি লাগে। ওনার তো কোন কাম কাজ নাই। খালি বিয়ার বানজানি দেওনই হের কাম।
 
  -বুড়া বেটারে বিয়া কইরা কি করবি। হেয় তোরে পোষাতেই পারবে তো? শেষে কামলা কোমলারে দিয়া তোর দিন যাইবো। সারা রাইত বিচার আচার কইরা বেড়ায়। কোন কোনদিন বাড়িও ফিরে না। তুই তো মাতব্বরের অপেক্ষায় বইয়া থাকবি। হেইসময় যদি কোন কামলা আইয়া তোরে ধইরা ফেলে তুই কি না করতে পারবি? কতো জোয়ান জোয়ান মরদ হেগো বাড়িতে কামলা খাটে। শেষে কার পোলাপাইন মাতব্বরের কইয়া চালাবি জানে কেডা!

পারুল সব শুনে। আর মনে মনে বলে বুড়ির মুখে আল্লায় লাজ শরমও দেয় নাই। যা খুশি তাই কইয়া বেড়ায়।
 
 -ঐ বুড়ি তোর মুখে কি আল্লায় টেকসো দেইনাই?
 -হ! যতো দুষ নন্দ ঘোষ। এহনতো কইবিই। দুইদিন পর বুঝবি। যখন জামাই আর ঠেলতে পারছে না। তোর মতো জুয়ান মাইয়ার মরদ হওন লাগবো পোক্তা। তয় হেই তোরে আরাম দিতে পারবো। তোর গতর ভর্তি যৌবন। ঔ মাতব্বর তোরে কি সুখ দিতে পারবে! হে তো এহন হের মাঝা লইয়াই খাড়াইতে পারে না। হের কি হেই জোর আছে যে তোরে ঠেইল্যা সুখ দিতে পারবে।

এইবার পারুল সত্যিই লজ্জা পায়। ভিতর বাড়িতে এক দৌড় দেয়। বুড়ি হাসে –‘ও লো এহন তো আমার কথাগুলো তোর তিতা তিতা লাগবে। বিয়ার দু’চারদিন যাক না।’ এই বলে বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে পারুলগো বাড়ি ছাড়ে।
 
একটু একটু করে পারুলের ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠে। সে ভুল করতাছে না তো। নানান প্রশ্ন উকি দেয় পারুলের মনে। এমন একটা পাত্রের সঙ্গে সমন্ধে পারুলই বা রাজি হলো কেন? এ প্রশ্ন স্বয়ং পারুলের। রাজি না হইয়া কি করুম। ঠিকমতো খাওন পিন্দোনের অভাব, ভালো একটা জামা পড়তে পারলামনা কোনদিন। খাইতেই পাইনা আর জামা পরুম। পারুলের চোখ দুইটা ছল ছল করে উঠে। হোকনা সে বুড়া বেডা, তয় কি হইছে, ভালা ভালা খাইতে পারুম, ভালা ভালা পড়তে পারুমতো। কামলারা আইয়া বেগম সাব ডাকবো। সংসারের চাবি গুছাটা হের কোমরে জনজন কইরা বাজবে। আরো কত্তো কি। হ, আমি মাতব্বররেই বিয়া করুম। পারুল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। এতো এতো সুখ হের হইবে তাই ঐ কানাবুড়ির হিংসা হচ্ছে। পারুলের এমন সব ভাবনায় রং মিশায়। চুলে বিলি দেওনের লাইগ্যা মায় ডাক পারতাছে।
 
  -পারুল ও পারুল। কই গেলিগো মা। আয় কাছে আয় আর কয়দিন বাদেই তো তোর বিয়া। তারপরতো বড়ঘরের বউ হইয়া এই বাড়িতে আহনের সময়ই পাবি না। আয় মা কাছে আয়। তোর চুলে বিলি দিয়া দেই।
  -মাগো আইতাছি।

পারুল তার মায়ের কাছে যায়:
  -ও মা খালি বিয়া বিয়া করো কেন, আমার বুঝি শরম লাগে না!
  -দেখতো দেখি কি কয় মাইয়াডা। আরে মাইয়ারা বড় হইলে হেগো বিয়া দেওন লাগেই। শ্বশুর বাড়িইতো মাইয়াগো আসল বাড়ি। বাপের বাড়িতে আর কয়দিন।

জুনু মানে পারুলের মায়ের চোখ দুইটা জলে ভরে ওঠে।
 
  -কি গো মা, কান্দো কেন? মাইয়ার লাইগ্যা মায়া লাগলে বিয়া দিও না। তয় তো সারাজীবন তোর পাশাপাশি থাকবার পারি।
  -হ, লায়েক হইছোস, এখন বিয়া না দিয়া কি তোরে ঘরে খাম্বা দিমু। আর গ্রামের মাইনষে কইবে আইবুড়ি। আয় চুলে বিলি দেই।

পারুল তার মা’র সামনে পিড়িতে বসে। মায় পারুলের মাথায় বিলি কাটে।
  -কি গো তোর চুলের একি দশা। চুল তো ফাইট্যা গেছে। আর মাথায় এতো উকুন। জামাই কইবো কি?
  -কি আর কইবো, জামাইনা তো বুড়া বেডা।
  -ছি ছি মা এইডা তুই কি কইলি? জামাইতো জামাইরে। বুড়া হোক আর কড়াই হোক। আর স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহশত। জানোস না মা! এমন কিছু কইবি না যাতে তোর স্বামী মনে কষ্ট পায়। তয় কিন্তু তুই পোড়া কপাইল্যা হইয়া যাবি। না পাবি এই দুনিয়া না পাবি হেই দুনিয়া। স্বামীরে ভক্তি শ্রদ্ধা করন লাগবে। এর যেন ত্রুটি না হয়। তোর মতোন এমন কপাল কয়জনেররে মা। রাজরানী হইয়া পায়ের উপর পা তুইল্যা খাবি। কতো চাকর বাকর আইস্যা তোরে মেমসাব ডাকবে।
 
  -মা দুইডা ট্যাহা দেসনা! একটা শেম্পু আইন্যা মাথাত দেই। অনেক দিন মাথা ধুইনা। আচ্ছা পারুল তোর কি মাসিক হয়তো নিয়মিত।
  -হ, মা। কোন সময় শুরু হয় সপ্তাহের প্রথমে না শেষে। পারুল চুপ কইরা থাকে। আরে দেহ দেহি মাইয়াডার কারবার, মার কাছে এতো শরম করনের লাগে না।
  -হ, মা সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়। কোনো সমস্যা নাই। যা মা পানের ডহিরডার ভিতর যাইয়া দেখ, দুইডা ট্যাহা আছে মনে হয়।

পারুল পানের ডহিটা খোলে। ‘মা চাইর ট্যাহা দেহি।’
  -হ, তুই দুই ট্যাহা নে, আর বিকেলে দুই ট্যাহা দিয়া পান কিন্যা আনমুনে। পানের যে দাম বাড়ছে না। পান খাওয়া ছাইড়াই দিতে হবে।

কালু ঘটক পিছন থেকে বলে উঠে- ‘আরে না পান খাওয়া ছাড়বা কেন? তোমার তো ক’দিন বাদেই বড়লোক জামাই ঘরে আইতাছে। বিরার বিরা পান কিন্যা দিবেনে।’
  -হ, ঠিকই কইছেন।
  -তো একখান পান খাওয়ানতো দেহি। উঠমু।
  -কই গেছিলা কালু ঘটক?
  -কই আর যামু। আমারতো কামই ঘুরা ফেরা করা।
  -আর কার বিয়া ঠিক করল্যা?
  -নাগো তোনগো বিয়ার কামডা ছাইড়া তারপর অন্যটা ধরুম।
কালু পান চিবাইতে চিবাইতে ওঠে।

জুনুও ওঠে। ‘যাই রান্ধা বাড়া করি। আবার ভাইজান আইয়া পড়বেনে। হেয় যে কই কই যায়। সারাটাদিন খালি চই চই কইরা ঘুইরা বেড়ায়।’

পারুলের বিয়ার দিন ঠিক হইয়া গেছে। আগুন মাসের ২০ তারিখ। ভাদ্রর মাসে বিয়ার কথা কইছিল কিন্তু ভাদ্র মাস পারুলের জন্ম মাস হওয়ায় ঔ দিন বিয়া হইবে না। আগুন মাসেই বিয়া। দিন আছে আর মাত্র কুড়ি দিন। আজইতো আগুন মাস ঘরে আইলো। জুনু মনে মনে হিসেব করেও ফেলছে। গরিব মানুষ কুড়ি দিনে কি করবো। মাইয়াটারে বিয়া দেয়ার পরতো জামাই আড়াইওল্লা করতে আইবো। তখনতো কয়ডা পিঠা চিড়ামুড়ি বানান লাগে। ঘরে আতপ চাইলও তো বেশি নাই। সের পাঁচেক হইবো। কোনরকম জামাইর বাড়িত পাঠান গেলেও পাড়া পড়শি কারো ঘরে দেওন যাইবো না। জুনুর মনে কতো কি উঁকি দিচ্ছে।

এরই মধ্যে কানা বুড়ি হাজির। ‘কিগো পারুলের মা। জামাই আদর কতদ্দূর। নতুন জামাই ঘরে আইতাছে?
  -হুম, পারুল তোর দাদিরে পিড়ি দে। আম্মা আপনে বসেন, আমি আইতাছি।
  -কই যাইবা পারুলের মা। শোন আমি কই কি, তোমরা ভুল করতাছো না তো। এমন গতর ভরা যৌবন মাইয়াটারে বুড়া বেটা তার কাছে বিয়া দেওন ঠিকই হইতাছে না। শেষে যদি কোন কেলেঙ্কারী হয়। আমার কথাটা ভাইবা দেখো।
  -নাগো আম্মা এখন ভাবাভাবির সময় নাই। আত্মীয় স্বজন সবাইরে দাওয়াত দিয়ে দিছি। এ মাসের কুড়ি তারিখে বিয়া। যা হওয়ার হবে। পারুলের কপালে যা আছে তাই হবে।
  -হু, তোমরা যা ভালা মনে করো করো, আমরা কেডা। শেষে চাকর বাকর দিয়া কিন্তু মাইয়াডার চলতে হবে নে।

কানা বুড়ি চলে যায়। জুনুর মনে এ কি বীজ দিয়ে গেল। চাকর বাকর কি করবে। আর সত্যিই জুনুর লোভে মাইয়াটার ভবিষ্যত নষ্ট হইবোনাতো! দীর্ঘশ্বাস জুনুর বুকে ধপাস করে ওঠে। পাড়া প্রতিবেশিওরাও কানাঘুঁষা করতাছে। গরিব মানুষের একটা বিয়াওতো ভালা উঠলো না। হয় বউ মরছে না হয় বউ অন্যবেডার লগে গেছে। যত্তোসব! যদি একটা গরিবের পোলাও আইতো। তয় না হয় মাইয়াডারে দিয়া দিতাম। কিন্তু আইলো না। এখন কপালে ঐ মাতব্বর আছে, ফ্যালাইবে কই? এই বলে জুনু চোখ মুছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, ১৯ নভেম্বর, ২০১২
এমজেএফ, [email protected]


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান