মানুষ কথা রাখে

মূল: আকরাম ওসমান, অনুবাদ: ফজল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৭:৫৯, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১২

[লেখক পরিচিতি: আফগানিস্তানের যে ক’জন লেখক তাদের প্রতিভা, মননশীলতা এবং শৈল্পিক লেখনীর মাধ্যমে সমকালীন আফগান কথা সাহিত্যের, বিশেষ করে গল্পে উৎকর্ষ সাধন করেছেন, তাদের মধ্যে আকরাম ওসমান অন্যতম। তিনি ১৯৩৭ সালে আফগানিস্তানের হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে অধ্যয়ন সমাপ্ত করে তিনি ১৯৭১ সালে ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। সনাতন আফগান সাহিত্যের কলাকৌশলের সঙ্গে পশ্চিমা সাহিত্যের মিশ্রণে তিনি এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তার বিভিন্ন গল্পে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আফগানিস্তানের শহর কেন্দ্রিক, বিশেষ করে কাবুলের, জনপ্রিয় লোক সংস্কৃতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব গল্পে নস্টালজিয়ার পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়। তার গল্প আফগানিস্তানের রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারণাসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে ‘রহমান-বাবা’ পুরস্কারে ভূষিত হন। ইংরেজিতে ছোটগল্প সংকলন ‘রিয়েল মেন কিপ দেয়ার ওয়ার্ড’ ২০০৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি আফগান সরকারের রাষ্ট্রদূত এবং মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া একসময় তিনি আফগান রাইটার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ১৯৯২ সালে সুইডেনে গমন করেন। বর্তমানে তিনি স্টকহোমের আফগান পেন ক্লাবের সভাপতি। সেখান থেকে তার তত্ত্বাবধানে ‘ফারদা’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়।
‘মানুষ কথা রাখে’ গল্পটি আকরাম ওসমানের ইংরেজিতে ‘এ রিয়েল ম্যান কিপস্ হিজ ওয়ার্ড’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ১৯৭৫ সালে লেখা। ‘দারি’ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ড. আর্লে লোয়েন। গল্পটি ‘রিয়েল মেন কিপ দেয়ার ওয়ার্ড’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের পুরুষ মানুষের একদিকে গৌরব, আত্মসম্মান, ওয়াদা এবং অন্যদিকে শাশ্বত প্রেম-ভালোবাসার চিরাচরিত টানপোড়েনের কাহিনী লেখক সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন এই গল্পে। বলা হয়, গল্পটি আকরাম ওসমানের সবচেয়ে সফল এবং অন্যতম ছোটগল্প। গল্পের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ১৯৮৫ সালে সিনেমা তৈরি করা হয়।
অনুবাদক ফজল হাসান ক্যানবেরা প্রবাসী। বর্তমান গল্পটি ছাড়াও অনুবাদকের আরো বেশ কিছু আফগান গল্প ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।]

যেন আলতো করে কুয়াশার বরফকুচি ঝরে পড়ছে। জানালা গলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে শের এক এক করে কুয়াশার মিহি কণা গুণছে – এক, দুই, তিন ... এক, দুই, তিন, চার ... এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ। তুলা ধোনার লোকেরা উঁচু থেকে এমনভাবে তুলা ধুনছে যে বাতাসে পেঁজো তুলা উড়ে এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরনো খড় আর মাটির ঘরের ছাদ এবং বারান্দায় স্তুপাকারে জমা হচ্ছে। হঠাৎ দেখে মনে হয় চারপাশ যেন সাদা বরফের কম্বলে ঢেকে গেছে। শের কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ করে থাকে। তখন সে তাকের উপর রঙিন সুতার রিলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাকের খানিকটা উপরে অনেকগুলো পেরেক লাগানো। সেখানে সে বিভিন্ন সাইজের ঘুড়ি ঝুলিয়ে রেখেছে। অনেক বছর ধরে সে ঘুড়ি বানায় এবং ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দেয়। পুরনো কাবুলের শোর বাজার থেকে শুরু করে পায়েন চক পর্যন্ত সবার কাছে সে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী চ্যাম্পিয়ন ঘুড়িওয়ালা হিসেবে সুপরিচিত।
 
এতদিন শের সনাতন নকশা অনুসারে ঘুড়ি বানাতো। কখনো ঘুড়ির মাঝখানে চোখ এঁকেছে, আবার কখনো পাখির মাথা কিংবা ফুল এঁকেছে। কিন্তু যখন তার বয়স চৌদ্দ বছর এবং সবেমাত্র ঠোঁটের উপর পাতলা গোঁফ উঠতে শুরু করেছে, তখন থেকে পুরনো নকশার প্রতি তার একধরনের বিতৃষ্ণা জন্মায়। ফলে সে আরো বেশি আকর্ষণীয় এবং নতুন নকশার ঘুড়ি বানাতে শুরু করে। এ জন্য সে গাঢ় রঙের ভালো এবং দামী কাগজে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ির নকশা তৈরি করে। কিন্তু কোনটাই তার মনের মতো হয় না। চোখ ধাঁধানো ঘুড়ি বানানোর জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। সেই কাল্পনিক ঘুড়ির বর্ণনা কিছুতেই শের ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। একের পর এক ঘুড়ি বানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনটাই তার মনঃপুত হয় না। প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে এবং নিরুৎসাহিত হয়ে সে সেলফের উপর সাজিয়ে রাখা ঘুড়ির দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে জানে না, আসলে তার চোখ কি খুঁজছে।
 
তাহিরা তার খালাতো বোন। গুটিশুটি হয়ে কম্বলের নিচে শুয়ে সে দেখছে শের গভীর চিন্তায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং সে তার নিজের আপন জগতে মহা ব্যস্ত। প্রায় চিৎকারের মতো করে তাহিরা ডাকে, ‘শের, তোমার কি হয়েছে? তুমি কি সিরকা বা অন্য কিছু খেয়েছ?’
 
তাহিরার বাঁকা কথায় শেরের ভাবনার শান্ত দীঘিতে টুপ করে ঢিল পড়ে। সেলফ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে সে সরাসরি তাহিরার কালো চোখের দিকে তাকায়। তাহিরার চোখ দু’টো হরিণীর চোখের মতো সুন্দর, মায়াবী এবং নিষ্পাপ ধরনের। ভুরু জোড়া অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। অবাক বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকানোর সময় আচমকা দু’জনের মনের ভেতর তড়িৎ গতিতে অলৌকিক একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের অদৃশ্য ঢেউ খেলে যায়। তাহিরার হৃদয়ের গভীর গোপন থেকে একটা তীর ছুটে এসে যেন শেরের বুক বিদীর্ণ করে দিয়েছে। মুহূর্তেই শেরের হাত হিম হয়ে আসে এবং তার বুকের ভেতর ধুকপুকানির শব্দ আরো দ্রুত হয়।

একটা কথাও না বলে তাহিরা সরাসরি শেরের মুখের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসলো। হাসির সময় তার মুক্তোর মতো শুভ্র দাঁত শেরের দৃষ্টি এড়ালো না। সম্মোহিতের মতো সে তাহিরার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হলো তাহিরার দাঁতগুলো যেন কোন শীতের সকালের উজ্জ্বল এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ তুষার কণা। দৃষ্টি ঘুরিয়ে শের জানালা গলিয়ে বাইরের বরফকুচি দেখতে থাকে। তাহিরার গাল দু’টো বরফের চেয়ে আরো বেশি সাদা। অন্যরকম এক অনুভূতিতে শেরের মন কানায় কানায় ভরে যায়। তাহিরার মতো অপূর্ব সুন্দরী খালাতো বোন পেয়ে আসলেই সে অত্যন্ত ভাগ্যবান। একসময় শের পিঠ সোজা করে বসে। তখন তাহিরা কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে পাশের ট্রে থেকে কয়েকটা কাজুবাদাম আর শুকনো আঙুর তুলে নেয়। তাহিরার দীর্ঘ আঙুলের উপর শেরের দৃষ্টি আটকে যায়। তাহিরার আঙুলে নীলা পাথরের আংটি। পুনরায় শের জানালা গলিয়ে বাইরের নীল আকাশের দিকে তাকায়। তাহিরার আংটির নীলের সঙ্গে আকাশের নীল কোনমতেই তুলনা করা যায় না। তাহিরার আঙুল দেখে শেরের মনে পড়ে পাহাড়ি কোন ফুল গাছের ডাটির কথা। আনমনে সে দূরের পাহাড়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। সাদা বরফে ঢেকে আছে পাহাড়ের চূড়া। আপন মনে শের বললো, পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো একজন মানুষের জন্য খুবই গৌরবের।

ক্রমশ শের ভাবনার আরো অতলে ডুবে যেতে থাকে। বোবা দৃষ্টিতে সে তাহিরার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে তাহিরা বললো, ‘তুমি কি স্বপ্ন দেখছো, নাকি অন্য কিছু? আমি কি জিজ্ঞেস করেছি, তুমি ভুলে গেলে?’
 
জবাবে শের বললো, ‘আমার একটাই মাথা এবং সে মাথায় হাজার চিন্তার পোকারা সারাক্ষণ কিলবিল করে। দুঃখিত, তোমার প্রশ্ন আমি মনোযোগ দিয়ে শুনিনি।’
তাহিরা বললো, ‘ঠিক আছে। আসলে এখন তো তোমার রঙিন স্বপ্ন দেখার সময়।’
মনে মনে শের ভাবলো, ‘স্বপ্ন দেখার সময় কেন? তাহলে কি তাহিরা এমন কিছুর ইঙ্গিত করলো, যা আগামীতে ঘটবে। কী এমন ঘটতে পারে?’ ভাবতে ভাবতে একসময় সে শব্দ করে হেসে বললো, ‘তোমার নতুন কাজের জন্য অভিনন্দন। তুমি কি গণক হতে চাও, নাকি অন্য কিছু?’
তাহিরা চোখেমুখে দুষ্টুমির হালকা চিহ্ন এঁকে বললো, ‘শোন শের, আমি তোমার ভবিষ্যত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দিনদিন তুমি আরো বেশি স্বপ্নচারী হবে, এমনকি নির্ঘুম রাত কাটাবে। তখন খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তোমার কোন রুচি থাকবে না। ফলে তোমার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।’   
তাহিরার ভবিষ্যতবাণী শুনে শের শব্দ করে হেসে উঠলো। একসময় হাসি থেমে গেলে সে বললো, ‘ভালো কথা বলো। তোমার কি অন্য কিছু বলার নেই?’
তাহিরা চুপ করে থাকে। কিন্তু পুনরায় তার মোহনীয় দৃষ্টি এক পলকের জন্য আটকে যায় শেরের মুখের উপর। প্রচণ্ড অভিমানে শের বেমালুম ভুলে যায় আসলে সে কি বলতে চেয়েছিলো।
তবুও চোখেমুখে কপট হাসির রেণু ছড়িয়ে শের বললো, ‘জানি না, এ মুহূর্তে আমার কি বলা উচিত। মনে হয়, তুমি ঠিকই বলেছো।’
আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাহিরা প্রায় চিৎকার করে উঠে, ‘দেখেছো, কথাটা তুমি তোমার নিজের মুখেই স্বীকার করলে।’

শের কোন কথা বললো না। বরং তাহিরার কথায় সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে সে হালকা ভাবে বার দু’য়েক মাথা দুলিয়ে মুখ নিচু করে। কিছুক্ষণ তির্যক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকানোর পর যখন সে মাথা তোলে, তখন পুনরায় দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকা প্রাণহীন ঘুড়িগুলোর দিকে তার নজর পড়ে। সে ভাবে, যদি এই ঘুড়িগুলোর সৌন্দর্য সম্পর্কে তাহিরা কিছু বলে। কিন্তু তাহিরাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে সে শরমিন্দা বোধ করে এবং নিজের জিহ্বা সংযত করে।
তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘কি ভাবছো?’
আলতো করে শের বললো, ‘তোমাকে।’
আশ্চার্যান্বিত হয়ে তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে?’
এবার জোর দিয়ে শের বললো, ‘হ্যঁ, তাই।’
কথাটা বলেই শের এক মুহূর্তের জন্য থেমে পুনরায় বললো, ‘তোমার মতো যদি ঘুড়িগুলোর এত সুন্দর মায়াবী চোখ থাকতো, তাহলে খুব ভালো হতো, তাই না?’
সঙ্গে সঙ্গে তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘কিসের জন্য?’
শের বললো, ‘তাহলে আমি বাড়ির ছাদের উপরে খোলা আকাশে ঘুড়িগুলো উড়াতাম। চারদিক থেকে মানুষেরা আমার ঘুড়ির চোখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো।’
পুনরায় তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘তখন কত দামে তুমি তোমার ঘুড়ি বিক্রি করবে।’
জবাবে শের বললো, ‘হাজার হাজার আফগানি।’
তাহিরা বললো, ‘এত অল্প দামে!’
সঙ্গে সঙ্গে শের বললো, ‘তাহলে এক লক্ষ আফগানি।’
দুষ্টুমি করে তাহিরা বললো, ‘মনে কর, একদিন তুমি সত্যি অনেক বড়লোক হয়েছ। তোমার কাছে অঢেল আফগানি। তখন এত আফগানি দিয়ে তুমি কি করবে?’
শের বললো, ‘তখন আরো বেশি ঘুড়ি বানানোর জন্য অনেক অনেক সুন্দর কাগজ এবং বাঁশের কঞ্চি কিনব।’
বিস্ফারিত চোখে তাহিরা বললো, ‘আশ্চর্য!’
শের বললো, ‘কিসের আশ্চর্য? প্রত্যেকটা ঘুড়িতে তোমার মায়াবী চোখ আঁকবো। তারপর ঘুড়িগুলো যখন আকাশে উড়াব, তখন সবাই হা করে তাকিয়ে দেখবে তোমার চোখ কত সুন্দর।’
এবার তাহিরা শব্দ করে হেসে উঠলো। একটু বাদে হাসি থামিয়ে বললো, ‘তারপর তুমি কি করবে?’
জবাবে শের বললো, ‘তারপর একই জিনিস করবো। যতদিন বাঁচবো, ততদিন আমি আরো অনেক ঘুড়ি বানাবো।’

শেরের ঘরের দেয়ালে অসংখ্য ঘুড়ি ঝুলছে। পরদিন সে ওখান থেকে কয়েকটা ঘুড়ি নামিয়ে পাশের বাসার ছেলেটাকে দেয়।

সেদিন থেকে অনেক রাত পর্যন্ত শের ঘুড়ির কাগজ কাটে। কাগজের গায়ে তাহিরার মুখের আলপনা আঁকার চেষ্টা করে। সেসব আলপনায় ফুটে উঠবে তাহিরার চোখের দীপ্ত চাহনি, টিয়া পাখির মতো টকটকে লাল ঠোঁট, এমনকি তার আবেগের পরশমাখা ভালোবাসা, যে ভালোবাসা অনায়াসে একজন পুরুষের হৃদয় হরণ করতে পারে এবং প্রতি অঙ্গে কামনার অগ্নি জ্বালাতে পারে।
 
ক্রমশ ঘরের ভেতর ছেঁড়া কাগজের স্তুপ জমা হতে থাকে। শের এক একটা কাগজের সঙ্গে অন্য কাগজ আঠা দিয়ে জোড়া দেয়। ঘুড়িতে সে নানা ধরনের মুখের ছবি আঁকে, কিন্তু কোনটাই তাহিরার মুখের মতো হয় না। তাই সে পুরো একমাস কোন ঘুড়ি ওড়ায়নি এবং কাউকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানায়নি।
 
একদিন শের যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বি ফজলু জিজ্ঞেস করে, ‘শের, ইদানিং তোমার কি হয়েছে? তুমি কি ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে দিয়েছ? আশেপাশের কারোর সঙ্গে তোমার কোন দেখা নেই।’
জবাবে শের বললো, ‘ফজলু, আমি অন্য কিছু বানাচ্ছি। এমন কিছু বানাচ্ছি, যা তুমি কখনো কল্পনা করনি, এমনকি স্বপ্নেও দেখনি।’
উপহাসের ভঙ্গিতে ফজলু জিজ্ঞেস করে, ‘কি বানাচ্ছো? বেলুন, নাকি উড়োজাহাজ?’
শের বললো, ‘তারচেয়েও অনেক ভালো কিছু। আমি ঘুড়িতে একজন নববধূর সুন্দর মুখ আঁকছি।’
ফজলু বললো, ‘অভিনন্দন। আশাকরি শীঘ্রই আমরা মিষ্টি আর নকুলের ভাগ পাবো।’
ফজলুর কথার পিঠে শের কোন কথা না বলে পুনরায় সে তার কাজে ফিরে যায়। ফজলুর যদিও কাচের টুকরো দিয়ে ঘুড়ির সুতা মাঞ্জা দেওয়ার সুখ্যাতি রয়েছে, কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। বরং সবাই তাকে হারুপার্টি হিসেবে চেনে। কেননা সে সব সময় ঘুড়ি খেলায় অন্যদের কাছে হেরে যায়। এছাড়া সে মিথ্যাবাদী এবং বাচাল।
তাহিরার মুখেই শের শুনেছে যে ফজলু তার পেছনে লেগেছে। যখনই শের ফজলুকে দেখে, তখনই প্রচণ্ড রাগে তার শরীরের রক্ত টগবগ করতে থাকে। তখন তার ইচ্ছে হয় নিজের হাতে সে ফজলুর গায়ের চামড়া তুলে ফেলে।
 
ফজলুও শেরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। কেননা সে জানে, শের থাকলে কোনদিনই সে তাহিরাকে পাবে না। তাহিরাকে নিয়ে তাই সে নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির আঁটতে শুরু করে। একদিন সে তাহিরার বড় ভাই কুস্তিগীর পালোয়ান মাহমুদকে বললো যে শের এবং তাহিরা একে অপরকে ভালোবাসে। ফজলু এক কদম বাড়িয়ে আরো বললো যে ওদের সম্পর্কের কথা প্রতিবেশী সবাই জানে। সেই থেকে মাহমুদ শুধু শেরকে তাদের ঘরে ঢুকতে বারণ করেনি, বরং উভয় পরিবারের মধ্যে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে।
 
তারপর থেকে বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট নিয়ে শের একাকী জীবনযাপন শুরু করে। তাহিরার সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তাহিরা গৃহবন্দি। তাদের সংসারে তার মা, বদমেজাজী বাবা এবং তিন কুস্তিগীর পালোয়ান ভাই আছে।

শের নিজের কৃতকর্মের জন্য তাহিরাকে কথাটা বলতে পারেনি। একদিন তাহিরার বাবা মহসিন খান স্ত্রীর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডার সময় চিৎকার করে ঘোষণা করে, ‘আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ুক, তবুও অই ঘুড়িওয়ালা এবং কবুতর পালকের সঙ্গে কিছুতেই আমার মেয়েকে তুলে দেব না। তোমার ভবঘুরে ভাগ্নে ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কোন ছেলে নেই, যার সঙ্গে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারি?’

মহসীন খানের ঘোষণা শোনার পর শের কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না তার কি করা উচিত। কেননা তার সামনে সৌভাগ্যের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি স্বপ্নেও এখন সে আর তাহিরাকে দেখতে পায় না। দিনের পর দিন তার চেহারায় মলিনতার ছায়া গাঢ় হয়ে উঠে। খাবারের প্রতি কোন উৎসাহ নেই। সারারাত জেগে সে বিশাল আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা অগুণতি তারা গোণে। ক্রমশ সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার গায়ে প্রচণ্ড উত্তাপ। অদ্ভুত একধরনের জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে, যেন কোন চুলার জ্বলন্ত আগুনে মাছ ভাজা হচ্ছে।
 
সকালে শের যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন তার মাথার চুল থাকে আলুথালু এবং চোখ দু’টো ভীষণ লাল, উদাস। ফজলুর মুখোমুখি হতে সে মোটেও আগ্রহ বোধ করে না। কেননা রাস্তায় দেখা হলেই ফজলু টিপ্পণি কেটে বলে, ‘শের, কোথায় তোমার উড়োজাহাজ? বেলুনের খবর কি? কখন আমরা তোমার বিয়ের মিষ্টি আর নকুল খাবো?’
 
ফজলুর খোঁচার পরও শের কিন্তু তার কাজ থামায়নি। ঘুড়ির সবগুলো নকশার ভেতর সে তাহিরার অনিন্দ-সুন্দর মুখ খোঁজে। বুকের ভেতর আশার টিমটিমে প্রদীপ জ্বালিয়ে সে ঘুড়ি বানাতে থাকে, কিন্তু কোন ঘুড়ির মধ্যে সে তাহিরার মুখের আদল খুঁজে পায় না।
 
ইতিমধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে। রোজাও শেষ হয়ে গেছে। তারপর কোরবানির ঈদও এসে চলে গেছে। এ সময়ে শেরের কাছ থেকে কেউ কোন খবর তাহিরার কাছে পৌঁছায়নি, এমনকি তাহিরার কাছ থেকে কোন সংবাদ শেরের কাছে আসেনি। শের অনেক চেষ্টা করেও তাহিরাদের বাসায় যাওয়ার কোন অজুহাত খুঁজে পায়নি। সুতরাং সে তার ঘুড়ি বানানোর কাজে আরো বেশি মনোনিবেশ করে। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যেয় সে তার মনোহর ঘুড়ির গায়ে উজ্জ্বল হরফে সুন্দর করে লেখে ‘হ্যাপি ঈদ’।

রাতের বেলা শের বিছানায় যাওয়ার সময় বাইরে তেমন কোন বাতাস ছিলো না। তবে মৃদুমন্দ বাতাসে শুকনো মৃত গাছের ডালে একধরনের বিষাদমাখা মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো। ঘরের ভেতর থেকে শের স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো। একসময় সেই শব্দ থেমে যায়।
 
শৈশবের দিনগুলোর কথা শেরের মনে পড়ে। তখন হালকা বাতাস এসে তাদের বাড়ির ছাদের উপর উদাস ভঙ্গিতে চক্রাকারে ঘুরতো। আরো জোরে বাতাসের জন্য অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে সে সুর করে গাইতো, ‘বাতাস, তুমি শো শো করে প্রচণ্ড জোরে বও’।
 
অস্থির মনে সারারাত শের ফেলে আসা শৈশবের গান গেয়েছে। কোথাও বাতাসের কোন দোলা নেই। অনেকে যেমন জ্বর হলে কম্পমান শরীরে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে, তেমনই শেরও কম্বলের নিচে পা গুটিয়ে শোয়। তখন সে শুধু তাহিরার কথা ভাবতে থাকে। তার ভাবনার আকাশে রঙিন স্বপ্নের মতো তাহিরার মুখ ওড়াওড়ি করে। মনে হয় প্রচণ্ড বাতাসে তাহিরার মুখ একদিক থেকে অন্যদিকে দোল খাচ্ছে। ভয়ংকর দৃশ্য দেখে একসময় সে ভয়ে চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। ঘরের চারপাশে নিকষ অন্ধকার। কোথাও কোন টুঁ শব্দ নেই। এটা নিছক স্বপ্ন ভেবে সে শয়তানকে গালমন্দ করে এবং আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। সে টের পায় তার হাত বরফের মতো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তবে শরীরে কোন জ্বরের চিহ্ন নেই। তাই সে হাত-পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে। বালিশে মুখ গুজে শোয়। তখন সে ক্রমশ ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। সে আর্তচিৎকারের মতো করে বলে, তাহিরা, তাহিরা, আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। তাহিরা, আমার ভাগ্য গনণাকারী। তাহিরা, তুমি তো এখন আনন্দেই আছো। তোমার সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ, ধবধবে দাঁত, অপূর্ব সুন্দর ঠোঁট, মসৃন ফর্সা হাত, যা কি না ফুলের ডাটির চেয়েও নরম, হাঁসের বুকের পালকের চেয়েও শুভ্র।

ভোরের অন্ধকার ফুঁড়ে সূর্য উঠার আগে শের লক্ষ্য করে তার সুন্দর বড় ঘুড়িটা ঘরের দেয়ালে ঝুলছে। প্রায় চিৎকারের মতো সে বললো, ‘বাতাস, তুমি শো শো করে প্রচণ্ড জোরে বও’।

এক মুহূর্ত বাদেই বাতাসের বেগ বেড়ে গিয়ে দরোজায় আঘাত হানে। বাইরে বাতাসের তোড়ে গাছের পাতারা যেন ঝিরঝির শব্দ তুলে সঙ্গীত পরিবেশন করছে। চটজলদি শের বিছানা ছেড়ে ওঠে। যদিও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তবুও সে জানালার পাল্লা খোলে এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাইরের সতেজ কোমল বাতাস টেনে নেয় বুকের ভেতর।

রাতটা ছিল ঈদের রাত। অন্য সব দিনের চেয়ে সেদিন ভোর না হতেই বেকারির লোকজন আগেভাগে কাজ শুরু করে দিয়েছে। পোড়া কাঠের গন্ধে আশেপাশের হাওয়া ভারী হয়ে গেছে। শেরের কণ্ঠনালী বেয়ে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। কি ভেবে যেন সে দেয়াল থেকে হ্যাঁচকা টানে ঘুড়িটা তুলে আনে। তারপর বাইরে এসে আলতো করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। অনেকটুকু সুতা ছেড়ে সে কয়েকবার টেনে আপন মনেই বললো, ‘আজ ঈদ। সকালে তাহিরা নতুন পোশাক পড়বে। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে সে আনন্দফূর্তি করবে। বাবা-মা তাকে বিভিন্ন ধরনের উপহার দেবে। এই ঘুড়ি, তুমি আজ কি করবে? তুমি কি আজ শুধু আকাশেই উড়ে বেড়াবে? তুমি কি তাহিরার সঙ্গে দেখা করবে, নাকি করবে না? ওর সঙ্গে যদি তুমি দেখা কর, তাহলে ভালো। আর যদি দেখা না করো, তবে আমি তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। তারপর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করবো।’ একসময় উত্তেজনা প্রশমিত হলে শের শান্ত হয়। শেষ প্রহরের আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা ক্লান্ত নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে সে শব্দহীন হাসে। বিনিময়ে নক্ষত্রেরাও যেন তার দিকে হাসির পরাগ ছড়িয়ে দেয়।
 
ইতিমধ্যে জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সঙ্গে মুয়াজ্জিনের আযানের সুর ভেসে আসে, আল্লাহু আকবর। স্বগতোক্তির মতো করে শের বললো, ‘হে আল্লাহ, আপনি মহান। নবী করীম (সাঃ), তাঁর বিশ্বস্ত চার খলিফা (রাঃ), ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), তাবে-তাবেঈন এবং সকল ওলি আউলিয়ার উছিলায় আপনি আমার দোয়া কবুল করুন, যেন আরো অনেক জোরে বাতাস বয়।’

এই ভেবে শের স্বস্তি অনুভব করে যে সে আন্তরিকতার সঙ্গে দোয়া করেছে। পুনরায় সে বিছানায় ফিরে যায় এবং একসময় গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে অনেক দূরের এক অচেনা দেশে গিয়ে পৌঁছে। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে, তখন বাতাসও আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। শেরের মনে হয় বাতাস যেন কাপড় শুকানোর দড়িতে ঝুলন্ত কাপড়ের সঙ্গে খেলা করছে। কাপড়ের ওড়াওড়ির ধরন দেখে শের বাতাসের দিক-নির্দেশনা ঠিক করে। সে সময় তার মনের মধ্যে একধরনের উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায়। চটজলদি সে পোশাক পড়ে এবং মা-বাবাকে সালাম করে ঈদ মোবারক জানায়। তারপর ঘুড়ি এবং লাটাই নিয়ে বাড়ির ছাদে ওঠে। সুতা ছেড়ে সে আকাশে ঘুড়ি ওড়ায়। প্রচণ্ড বাতাসে ঘুড়ি এদিক-ওদিক গোত্তা খায়। শক্ত হাতে শের লাটাই ধরে রাখে।

বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তড়িৎ গতিতে ঘুড়ি এমনভাবে উপরে উঠছে যেন দেখে মনে হয় ঘুড়িটা লড়াইয়ের কোন উদ্যত মোরগ। শের ছাড়া আশেপাশের ছাদের ওপরে উঠে আরো অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। প্রপেলারের মতো শেরের বড় ঘুড়ি অন্যান্য ঘুড়ির সীমানা পেরিয়ে আরো উপরে উঠে যাওয়ার সময় কয়েকটা ঘুড়ির সুতা কেটে ফেলে। তখন অনেকেই নিজেদের ঘুড়ির সুতা গুটিয়ে নেয়। একসময় বিশাল আকাশের বুকে শেরের ঘুড়ি ছাড়া অন্য কোন ঘুড়ি দেখা যায় না। সে মনের আনন্দে ঘুড়ি ওড়াতে থাকে। মাঝেমাঝে ঘুড়িটা এমনভাবে গোত্তা খায় যেন কোন কবুতর ডিগবাজি খাচ্ছে। দূর থেকে ঘুড়ির গায়ের লেখা ‘হ্যাপি ঈদ’ স্পষ্ট দেখতে পেয়ে শেরের মনের মধ্যে পূর্ববর্তী পরিকল্পনার কথা মনে পড়ে যায়। যখন তার ফুরফুরে মন উড়ে যায় দূরের বন্ধুর কাছে, তখন সে আরো বেশি সুতা ছাড়ে। একসময় প্রিয়তমার বাড়ির ছাদের উপর ঘুড়ি উড়তে থাকে।
 
ফজলু নিজেদের ছাদের উপর থেকে শেরের ঘুড়ি ওড়ানো দেখছিল এবং মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। শেরকে আশ্চার্যান্বিত করে সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের ঘুড়ি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে।

যদিও ফজলু আসন্ন বিপদের গন্ধ উপলব্ধি করে, কিন্তু কিছুতেই সে তার মনোযোগ হারাতে চায় না। ঘুড়ি বেশি উপরে উঠার আগেই শেরের ঘুড়ি ঈগল পাখির মতো পলকে উড়ে এসে তার ঘুড়ির সুতা কেটে ফেলে। স্বগতোক্তির মতো করে শের বললো, ‘যার যা প্রাপ্য, তাই সে পায়।’

তাহিরা তার নিজের জগতে মশগুল। চুল বেঁধে সাজসজ্জার পর সে নতুন সিল্কের জামা পড়ে। বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খদ্দেরের মতো সে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে। নিজের কাছে নিজেকে তার অপূর্ব সুন্দরী বলে মনে হয়। সে ভাবে, নিশ্চয়ই অন্যরা তার এই ফুলের মতো অপূর্ব সুন্দর মুখ দেখে মুগ্ধ হবে। আয়নার ভেতরে প্রতিচ্ছবি আলতো হেসে তার ভাবনার সঙ্গে সুর মেলায়।
    
জানালার কাছে যাওয়ার সময় আনন্দ-উল্লাসে তাহিরা এক পাঁক ঘোরে। সে সময় কাচের মতো স্বচ্ছ আকাশ এক ঝলক হাসি ছড়ায় তার দিকে, এমনকি উজ্জ্বল সোনালি সূর্যটাও যেন তার মুখের উপর স্বর্ণের রেণু মেখে দেয়। তাহিরা যখন চুলের বিনুনি নিয়ে আনমনে খেলা করছিল, তখন তার দৃষ্টি কেড়ে নেয় উড়ন্ত একটা সাদা হাঁস। একটু বাদে হাঁসটা উড়ে চলে যাওয়ার পর সে দেখতে পেল ‘হ্যাপি ঈদ’ লেখা ঘুড়িটা আকাশে উড়ছে। সে সতর্কতার সঙ্গে লেখাটা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে ওঠে শব্দহীন এক টুকরো কোমল হাসি। ঘুড়িটা তার দারুণ পছন্দ হয়েছে। ইচ্ছে করে হোক, অথবা অনিচ্ছায় হোক, অস্ফুট গলায় সে বলল, ‘তোমাকেও ঈদ মোবারক।’

যাহোক, ঘুড়িটা খোলা হাওয়ায় এদিক-ওদিক, এমনকি উপরে-নিচে উড়ে বেড়াচ্ছে। কখনো ঘুড়ির ছায়া এসে ছাদে পড়ছে, আবার কখনো অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। কৌতূহলী তাহিরা এক দৌঁড়ে তাদের ঘরের ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। দূর থেকে সে দেখে শের তাদের ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে। তাহিরাকে দেখতে পেয়ে শেরেরও সারা শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। মুহূর্তেই শের মনোযোগ হারিয়ে ফেলে এবং ঘুড়িটা গোত্তা খেয়ে তাহিরাদের উঠোনে পড়ে। কপাল মন্দ হলে যা হয়, তাই হয়েছে। তাহিরার ছোট ভাই ফরিদ ঘুড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখানোর জন্য তার বাবার কাছে যায়। ফরিদের বাবা তখন কোরবানির ভেড়া জবেহ্ করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। খুশিতে চিৎকার করে ফরিদ বললো, ‘বাবা, বাবা, আমি একটা ঘুড়ি পেয়েছি।’
 
জবেহ্ করার সময় কিছুতেই মির্জা মোহাম্মদ মোহসীন খান কোন বাঁধা সহ্য করতে পারেন না। তাই তিনি তাড়াতাড়ি ভেড়ার গলায় ছুরি চালালেন। জবেহ্ করার পর তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘হতচ্ছাড়া ছেলে। তুই কি পেয়েছিস?’
ভয়ে ফরিদ থমকে দাঁড়ায় এবং অপরাধীর মতো চোখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে সে বললো, ‘আমি একটা ঘুড়ি পেয়েছি।’
মোহসীন খান বললেন, ‘বুদ্ধ কাঁহাকার, এদিকে আয়।’
ফরিদ রীতিমত হতচকিত এবং ভীত। তবুও সে কাছে গিয়ে বাবার রক্তাক্ত হাতে ঘুড়িটা তুলে দেয়।

তাহিরা ছাদে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছিল। ঘুড়িটার জন্য সে উদ্বিগ্ন। ঘুড়ির গায়ে লেখা ‘হ্যাপি ঈদ’ পড়ার সময় মহসীন খানের রক্তমাখা হাত থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ে ঘুড়ির ওপর। সন্দেহের তির্যক চোখে তিনি চারপাশে তাকালেন। পরক্ষণেই তিনি ছাদের দিকে তাকিয়ে তাহিরাকে দেখতে পেলেন। কোন কিছু না ভেবে তিনি ঘুড়িটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। হাতের আস্তিন গোটাতে গোটাতে তিনি প্রতিজ্ঞার ভঙ্গিতে তাহিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘সবুর কর। তোর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।’

তাহিরা ছাদের কিনারা থাকে সরে যায় এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে ফরিদ তার মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে এবং চিৎকার করে বলে, ‘মা, বাবা আমার ঘুড়িটা ছিঁড়ে ফেলেছে।’
ফরিদের মাথায় মা সান্ত্বনার নরম পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, সোনা মানিক। চুপ কর। তোর বাবা যেন কান্নার শব্দ শুনতে না পান। আসলে তিনি ঠিকই করেছেন।’
ফরিদ পাল্টা জিজ্ঞেস করে, ‘কেন? কেন?’

মনের ভেতর হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাহিরা, ফরিদ এবং তাদের মা ঈদের দিন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু জবেহ্ করা ভেড়ার মাংসের কাবাব বানানোর সময় মহসীন খানের রাগ বেড়ে দ্বিগুণ হয় এবং তিনি সারাদিন বাঘের মতো গর্জন করেন।
 
সেদিন থেকে তাহিরাকে ছাদে যাওয়া বারণ করেন মহসীন খান এবং তাহিরা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন কাটাতে শুরু করে। পরিবারের কারোর সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই মহসীন খান অনেক দূরে অন্য জায়গায় বাড়ি কিনেন। শীতের ঠিক আগে তারা সবাই সেই নতুন বাড়িতে চলে যায়। যাহোক, শের কোন কিছু না জেনে তখনো মহসীন খানের বাড়ির ছাদের ওপর ঘুড়ি ওড়ায় এবং অন্য ঘুড়ির সঙ্গে কাটকাটি করে।
   
শের একদিন মহসীন খানের বাড়ির সামনের রাস্তায় ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে মহসীন খানের ঘরের দরজায় বড় তালা ঝুলছে। যখন সে দেখতে পেল দরজায় তালা এবং ‘বাড়ি ভাড়া’ লেখা ঝুলছে, তখনই সে থমকে থেমে যায়। কয়েক মিনিট সে হতভম্বের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সে রীতিমত বিধ্বস্ত। দূর থেকে তাহিরাকে এক পলক দেখার যেটুকু আশা তার মনের ভেতর জমা ছিল, তা যেন এক নিমিষে হারিয়ে যায়। গভীর শোকে তার কণ্ঠনালী বেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমার দুনিয়া ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমি এখন কি করব? কিভাবে তাহিরাকে খুঁজে পাব? পাড়ার সমস্ত অলিগলি সে তন্নতন্ন করে খোঁজে।
    
তাহিরার কোন হদিস সে খুঁজে পায় না। তার মনে হয় তাহিরা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। সে ভাবে, ভালোবাসার কি যে জ্বালা, যার কোন ঔষধ নেই। শুধু জ্বলে পুড়ে ভস্ম হওয়া ছাড়া আর কোন সমাধান নেই। এই যন্ত্রণা আল্লাহপাকের তরফ থেকে এসেছে ভেবে সে তা সাদরে গ্রহণ করে।
 
শেরের ভাবনার পুরোটা জুড়ে শুধু তাহিরার উপস্থিতি। বিশেষ করে তার মনে পড়ে তাহিরার প্রাণখোলা উচ্ছ্বল হাসি এবং গল্প বলার ঢং, এমনকি পরিহাসের ভঙ্গিতে যখন সে বলেছে, ‘তুমি আরো বেশি স্বপ্নচারী হবে, খাওয়াদাওয়ার প্রতি তোমার অনীহা দেখা দেবে এবং তোমার চেহারা শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে। তুমি নির্ঘুম রাত কাটাবে।’

নিজেকে শের বলল, ‘যদি সমস্ত পৃথিবীটা সড়ক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যদি জান্নাত আর দুনিয়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, যদি আমাকে সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিতে হয়, যদি আমাকে পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করতে হয়, তবুও আমি তাহিরাকে খুঁজবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন না একদিন আমি ওকে খুঁজে পাবোই। অবশ্যই আমি ওর বাবার পাষাণ মনকে নরম করব। যদি তার মন গলে, তাবে ভালো। আর যদি না গলে, তাহলে তিনি তার শেষটা দেখতে পাবেন।’

প্রেমিক কখনো মৃত্যুকে ভয় করে না,
ভালোবাসা কখনো পাহাড় কিংবা জেলখানা ভয় করে না,
প্রেমিকের মন ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো,
যা রাখালের রক্তচক্ষু কিংবা চিৎকারে ভয় পায় না।

সেদিন থেকে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা শের শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে তাহিরাকে খুঁজতে থাকে। মনের ভেতর জাগানিয়া আশা নিয়ে সে সবাইকে তাহিরার কথা জিজ্ঞেস করে।

একদিন সড়কের শেষ প্রান্তের ঠেলাগাড়ির চালক মোরাদের কাছ থেকে তাহিরাদের নতুন বাড়ির খবর পায় শের। এই মোরাদই মোহসীন খানের মালসামাল ঠেলাগাড়ি করে নতুন বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। মোরাদের কথা শুনে শেরের মনের ভেতর খানিকটা আশার আলো জ্বলে ওঠে। সে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে মহসীন খানের বাড়ির সন্ধান পায়।

প্রথম কয়েকদিন শের তাহিরাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু একদিন মহসীন খানের বাড়ির কাজের মেয়েটি তাকে দেখে ফেলে। মেয়েটি বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেয়। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও তাহিরার তিন পালোয়ান ভাই তৎক্ষণাৎ শেরের খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তারা শেরকে পাঁজাকোলা করে বাড়িতে নিয়ে যায়। বড় ভাই মাহমুদ তিরস্কার করে শেরকে বললো, ‘তুই একটা আস্ত বদমাশ। এখানে কি করছিলি?’
নিজেকে সংযত রেখে শের বললো, ‘আমি আপনার খালাতো ভাই, শের। কি হলো, আমাকে কি চিনতে পারছেন না?’
স্কুলে পড়ুয়া মেজ ভাই নাদির হেঁয়ালির সুরে বললো, ‘ঘুড়িওয়ালা আর হাঁস বিক্রেতাকে কে চেনে না? তোকে সবাই খুব ভালো করে চেনে।’
নাদিরের কথা শুনে অপমানিত শের প্রচন্ড রেগে বললো, ‘মুখ সামলে ভদ্র ভাবে কথা বল।’

সঙ্গে সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। নামের মরতবা অনুসারে প্রথমে শের সিংহের মতোই লড়েছে। সে এলোপাথারি ঘুষি মেরে তার খালাতো ভাইদের মুখ থেকে রক্ত ঝরায়। একসময় তার দম ফুরিয়ে এলে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন চারদিক থেকে অনবরত তাদের কিল-ঘুষি আর লাথি এসে পড়ে তার উপর। ওরা এমন করে মেরেছে যে শেরের চেহারা পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। অবশেষে একজন এগিয়ে এসে মারামারি থামিয়ে দেয়। সবচেয়ে ছোট ভাই ফরিদ ভীষণ আনন্দ অনুভব করে। ভেংচি কেটে সে বললো, ‘অনায়াসে তুমি এখন যেতে পারো। যাও, গিয়ে পুলিশকে বলো।’
উত্তরে শের বললো, ‘পুলিশকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভালো মানুষ সময়ের অপেক্ষায় থাকে।’

শের উঠে পড়নের কাপড়চোপড় থেকে ধুলোবালি পরিস্কার করার সময় রাস্তার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তার চারদিকে ঘিরে ধরে। একসময় সে সরকারি ট্যাপের পানিতে রক্তাক্ত মুখ ধুয়ে নিজেকে পরিস্কার করে। সেদিনই শের উপহার হিসেবে এক ব্যাগ মিষ্টি আর নকুল নিয়ে হাজির হয় কুস্তিগীর ইয়াসিনের ব্যায়ামাগারে। ইয়াসীনের ছাত্র হিসেবে সে ব্যায়ামাগারে যোগদান করে।
   
এক বছর পর শেরের হাতের মাংসপেশী পুরুষ্ঠ হয় এবং বুকের ছাতি লোহার ঢালের মতো শক্ত হয়। শের এবং অন্যান্য শিক্ষানবীশ কুস্তিগীরেরা যখন গা গরম করে, তখন একমাত্র ওস্তাদ ইয়াসীন ছাড়া আর কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারে না। ইয়াসীন তার দক্ষতা এবং বিভিন্ন কায়দায় শেরকে কুপোকাত করতে পারে। দিনে দিনে শের একজন নামকরা কুস্তিগীর হয়ে ওঠে এবং তার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
 
নববর্ষের আগে ঈদগাহ্ মসজিদের পাশে হাজুরী গার্ডেনে সমস্ত কুস্তিগীর জমায়েত হয়েছে। কুস্তিগীররা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাহিরার বড় ভাই মাহমুদকে শের চ্যালেঞ্জ করলে মাহমুদ বিনা বাক্যে তা গ্রহণ করে। উভয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা নববর্ষের দিন বিকেলে লড়বে। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে শের বিন্দুমাত্র বিশ্রাম নিতে পারেনি। কুস্তিগীর মাহমুদ অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সে সিংহের মতো লড়তে পারে। কারোর কোন সন্দেহ নেই যে মাহমুদ অনায়াসে শেরকে দু’হাতে উপরে তুলে মাটিতে ছুড়ে দিতে পারে এবং উপস্থিত দর্শকদের হাসির খোরাক যোগাতে পারে। দিন যতই ঘনিয়ে আসে, শের বিভিন্ন মাজারে গিয়ে মানত করে এবং নির্ঘুম রাতে বিছানায় শুয়ে লড়াই নিয়ে ভাবে।

অবশেষে নির্ধারিত সময় আসে। শের এবং মাহমুদ মুখোমুখি দাঁড়ায়।

মাহমুদের হাত বেশ লম্বা। শের নড়াচড়া করার আগেই মাহমুদ তাকে উপরে তুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। দর্শকেরা তুমুল হাততালি দেয়। অনেকে দারুণ উত্তেজনায় আল্লাহপাকের নাম স্মরণ করে।

একসময় শেরের ধৈর্য্য শেষ সীমানায় এসে পৌঁছে। কিন্তু সে নিজেকে সংযত করে। মেঝেতে শুয়ে সে তার শেষ কৌশল প্রয়োগ করে, যা তার গুরু ইয়াসীন শিখিয়েছে। আচমকা সে মাহমুদকে পাল্টা আক্রমন করে এবং চোখের পলকে ধরাশায়ী করে। এত বেশি জোরে মাহমুদ মেঝেতে পড়ে যায় যে সে চোখ মেলে কিছুই দেখতে পেলো না। তার চারপাশে শুধু অন্ধকার এবং সবকিছু যেন পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে।

ক্ষমার হাত বাড়িয়ে শের মাটি থেকে মাহমুদকে টেনে তুলে কোলাকুলি করে। তারপর সে উৎফুল্ল দর্শকদের ভিড় এড়িয়ে বাইরে চলে যায়। শেরের এরকম ব্যবহার মাহমুদ মোটেও আশা করেনি। সে তার খালাতো ভাইয়ের নৈপুণ্যে রীতিমত বিস্মিত। সত্যিকার কুস্তিগীর হিসেবে সে সেদিন বিকেলেই খালার বাড়িতে যায়, যে বাড়ি এতদিনে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। শেরের সঙ্গে সমঝোতা করার পর সে বললো, ‘শের, তুমি আসলেই শের, ঠিক সিংহের মতোই শক্তিশালী। আমার ভুল হয়েছে। চল, অতীতের সব ঘটনা ভুলে যাই। পবিত্র কোরান শরীফকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আজ থেকে তুমি আর আমি চিরদিনের জন্য সত্যিকারের ভাই।’
     
শের কাঁপতে থাকে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করে না। একসময় তারা আবার কোলাকুলি করে এবং শপথ করে যে এখন থেকে তারা দু’জন আসল ভাই। মাহমুদের নমনীয়তায় মহসীন খান এবং তার পরিবারের সবার সঙ্গে শের মিলমিশ করে। তাদের মাঝে অতীতের পুরনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এত ঘটনার পর তাহিরা খুবই খুশি যে সে আবার শেরের সঙ্গে অনায়াসে যোগযোগ করতে পারবে।
 
এরপর থেকে তাহিরার মনের গোপন গভীর নিস্তব্ধ সরোবরে আনন্দ-ফূর্তির তরঙ্গ বইতে শুরু করে এবং দিনদিন তা বেগবান হতে থাকে। অন্যদিকে শের গভীর চিন্তা-ভাবনার অকূল দরিয়ায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে দিনে দিনে আরো বেশি শুকিয়ে যেতে থাকে। তার মনে হয় সে যেন কঠিন পাথর আর শক্ত কিছুর মাঝে পড়ে ক্রমাগত পিষ্ট হচ্ছে। তার একদিকে প্রেম, আর অন্যদিকে ভাতৃত্ব। তাহিরা একদিকে মাহমুদের আপন বোন, আবার অন্যদিকে কোরান শরীফ সাক্ষী রেখে মাহমুদকে সে ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাই তাহিরা তারও বোন।

‘তাহিরা, নাকি মাহমুদ? ভালোবাসা, নাকি ভাতৃত্ব?’ এই দ্বিধা-দ্বন্দের দোলনায় দুলতে দুলতে শের নিজেকেই নিজে বলল, ‘সত্যিকার মানুষ তার কথা রাখে। মাহমুদকে আমি কথা দিয়েছি। এখন থেকে সে আমার আসল ভাই। তাই তাহিরার ভালোবাসা আমার জন্য হারাম। আমি আর ওদের বাড়ি যাবো না। তাহিরা সম্পর্কে কোন আলাপ করব না, এমনকি ওকে নিয়ে একটুও ভাবব না।’

প্রতিজ্ঞা করার পর থেকে শেরের আচার-আচরণ এবং চিন্তাধারা আমূল বদলে যায়। যখন তখন সে বিভিন্ন কবরস্থান এবং পীর-আউলিয়াদের মাজারে যাতায়াত শুরু করে। অজু করে বিকেলে সে কবরস্থানে গিয়ে বিশেষ নামাজ আদায় করে এবং নামাজের শেষে হাত তুলে মোনাজাত করার সময় সে গোপনে অশ্রু বিসর্জন করে। মানুষের কবরগুলো আগাছায় ঢেকে গেছে। নিজেকে সে বলে, ‘একদিন সবাইকে মরতে হবে। সবাইকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। দুঃখ করে কোন লাভ নেই। অল্প সময়েই সব শেষ হয়ে যাবে।’

কিন্তু কোন কিছুই শেরের অস্থির মনকে শান্ত করতে পারে না। রাতে সে তার ঘরে ফিরে গিয়ে ছাদের উপর উঠে বসে থাকে। এ ছাদের উপর থেকেই সে ঈদের দিন সকালে ‘হ্যাপি ঈদ’ লেখা ঘুড়ি উড়িয়ে তাহিরাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। সে দেখতে পায় কাবুলের প্রাচীন কেল্লা বালা হিশারের চূড়া ভেদ করে ধীরে ধীরে অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে মলিন চাঁদ উঠছে। একসময় চাঁদের সিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শহরে। সে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ও চাঁদ, পূর্ণ চাঁদ, বিশাল আকাশে তুমি একা। তুমি কি আমাকে দেখতে পাও? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ এই সিংহটা কেমন করে কাঁদছে?’ তার চোখ থেকে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সার্টের কলার ভিজিয়ে দেয়। কিন্তু তার এই আকুল কান্নায় চাঁদ কোন সাড়া দেয়নি, বরং আস্তে আস্তে দূরের পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে যায়। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর হতাশায় শের মাটিতে এক দলা থুতু ফেলে অকৃতজ্ঞ দুনিয়াকে অভিসম্পাত দেয়।

শের প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আলি রেজা খান মসজিদে যায়। সেখানে আলেমদের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা এবং ধর্মীয় বয়ান শোনে। তাতে সে মনের ভেতর একধরনের শান্তি পায়। কিন্তু ভোর হলেই তার সামনে পুনরায় ভেসে ওঠে তাহিরার মুখ, যেমন পূবের অন্ধকার আকাশ বিদীর্ণ করে জেগে ওঠে সকালের নতুন সূর্য। তখন তার মনে হয় তাহিরার অদৃশ্য পেলব হাতের স্পর্শ যেন সমস্ত শরীরে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি মুছিয়ে দিয়ে একধরনের অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
 
কেমন করে সে তাহিরার কাছ থেকে নিস্কৃতি পাবে? সর্বত্র তাহিরার উপস্থিতি। সে তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

একদিন শেষ অপরাহ্নে সূর্য ডোবার পর শের যখন আনমনে বালা হিশারের উত্তরে অবস্থিত শহীদদের কবরস্থান থেকে ফিরছিল, তখন সে দেখতে পেল বোরকা পড়া দু’জন মহিলা তার দিকে এগিয়ে আসছে। শের তাদের এড়িয়ে যেতে চাইল, কিন্তু একজন সরাসরি তার সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় এবং চিৎকার করে বললো, ‘শের, আমার প্রিয়তম, তুমি কোথায় যাচ্ছো?’  
তাহিরার কন্ঠস্বর শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শের থমকে দাঁড়ায়। স্থাণুর মতো সে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোন শুকনো মরা গাছ।
মুখ থেকে বোরকা সরানোর সঙ্গে সঙ্গে তাহিরার চেহারার রোশনাইয়ে আশেপাশের কবরের শ্বেতপাথরগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক মুহূর্তের জন্য শের তাহিরার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিশ্চুপ থাকে। তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘প্রিয়তম শের, এখানে তুমি কি করছিলে?’
শের বললো, ‘কিছু না।’
সঙ্গে সঙ্গে তাহিরা জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু না বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?’
শের কোন কথাই বললো না। দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে একজনের প্রতি অন্যজনের ভালোবাসার আগুন জ্বলছে। তাহিরার সঙ্গী তাদের কাজের মেয়ে। ও সবকিছু জানে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটি সবই দেখছিল এবং মনে মনে প্রার্থনা করছিল মহান আল্লাহ্ তা’আলা যেন এই দু’জনের মনের আশা পূর্ণ করেন। অবশেষে তাহিরাকে শের জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এখানে কি করছিলে?’
উত্তরে তাহিরা বললো, ‘আমি কবরে একটুকরো ফিতে বাঁধতে এবং দোয়া করতে এসেছিলাম।’
শের জিজ্ঞেস করে, ‘কার জন্য? সবকিছু ঠিক আছে?’
তাহিরা বললো, ‘আমার নিজের জন্য।’
খোঁচা দিয়ে শের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নিজের জন্য?’
তাহিরা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। আবেগে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে কান্নাজড়িত গলায় বললো, ‘হ্যাঁ, আমার জন্য, এমনকি তোমার জন্যও। আল্লাহপাক যেন তোমার কোন ক্ষতি না করেন। তিনি যেন তোমাকে কোনদিন আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে নিয়ে না যান।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলেই তাহিরা চুপ করে থাকে।
শের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কন্ঠস্বরে খানিকটা তেতো মিশিয়ে বলল, ‘শোন তাহিরা, অনেকদিন আগে তুমি কিন্তু আমার ভবিষ্যত বলেছিলে। এখন আমার চোখে ঘুম নেই, খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি এবং দিনদিন আমি শুকিয়ে যাচ্ছি। তুমি আর কি চাও?’
তাহিরা বললো, ‘তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই চাই না। কথাটা বললাম, কেননা আমি তোমাকে দারুণ পছন্দ করি এবং এখনো ...’
শের জিজ্ঞেস করে, ‘এখনো কি?’
তাহিরা বললো, ‘তুমি ভালো করেই জানো। ন্যাকামো কর না।’
পুনরায় শের জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি জানি?’
তাহিরা বললো, ‘সত্য কথা। আমাদের সম্পর্কটা তুমি খুব ভালো করেই জানো – শুধু তোমার আর আমার।’
গলার স্বরে একবাটি দুঃখের করুণ রস মিশিয়ে শের বললো, ‘তোমার আর আমার মধ্যে অন্যরকম কোন সম্পর্ক নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। সেসব মধুর দিনগুলো দিগন্তের ওপাড়ে হাওয়ায় ভেসে গেছে, হারিয়ে গেছে অন্ধকার গহ্বরে।’
শেরের মুখে তার এবং মাহমুদের ঘটনা শুনে তাহিরা ভীষণ আঘাত পেয়েছে। শের এবং মাহমুদ কোরান শরীফ সক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে যে তারা দু’জন একে অপরের আসল ভাই। তাহিরা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। একসময় বিদায়ের কালে শের বলল, ‘পরজন্মে আমাদের দেখা হবে।’
তাহিরা বলল, ‘প্রিয়তম শের, তুমি মাহমুদকে কথা দিয়েছ এবং প্রতিজ্ঞা করেছ, কিন্তু আমি তো কোন কথা দিইনি, এমনকি প্রতিজ্ঞাও করিনি। সত্যি, আমি তোমাকে ভলোবাসি। সবসময় আমি তোমাকেই চাই। তুমি যদি আমার কাছে না আস, তবে তার জন্য তোমাকে হাশরের ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে।’
কোন কথা না বলে শের চলে যায়। তাহিরাও ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

কয়েক মাস পর চারদিকে কথাটা ছড়িয়ে পড়ে যে মোহসীন খান তার মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেবার আনজাম করছে। তখন কোন পথ খুঁজে না পেয়ে তাহিরা বিষ পান করে আত্মঘাতী হতে চেয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে বেঁচে যায়। শেরের কানে খবরটা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। তার মনে হয় সে যেন সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। কিন্তু সে নিজেকে সংযত করে তার প্রতীজ্ঞার প্রতি অনড় থাকে।
 
কয়েকদিন বাদে শের এবং তার মা তাহিরার বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে মহসীন খানের বাড়ির দিকে রওনা হয়। সে রাতে শের আতঙ্ক আর উৎকন্ঠায় দাঁত দিয়ে এত জোরে নখ কাটে যে তাতে রক্ত বের হয়। তবে কেউ জানে না আসলে তখন তার মনের ভেতর কিরকম ভয়ংকর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। যাহোক, শিল্পীরা যখন ঐতিহ্যবাহী বিয়ের সঙ্গীত ‘আয়েস্তা বুড়ো’ (ধীরে চল) পরিবেশন করছিল, তাহিরা তখন ধীর পায়ে শেরের সামনে থেকে চলে যায়। শুধু তাই নয়। তাহিরার এই চলে যাওয়া যেন অতীতের স্মৃতিময় মুহূর্ত থেকে চলে যাওয়া, এমনকি সে সব মধুর ঈদের দিন থেকে এবং জ্যোৎস্না-প্লাবিত নির্জন রাত থেকে নিজেকে দূরে সরে যাওয়া। শেরের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার পর সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজন বেঁটে-মোটা ভুড়িওয়ালার সংসারে প্রবেশ করে।

তাহিরার বিয়ের পর থেকে প্রতিদিন শেরের দশ বছর বেড়ে যেতে থাকে। পয়তাল্লিশের আগেই তার মাথার চুল তুলার মতো শুভ্র দেখায় এবং অর্ধেক দাঁত পড়ে যায়। তখন সবাই তাকে বাবা শের বলে সম্ভোধন করে। সে শিরাজী বাজারের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নেয়। ছেলেরা তার দোকান থেকে ঘুড়ি, সুতা এবং লাটাই কিনে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যাহোক, জীবনের সব কিছু হারিয়ে শের এখন আর ঘুড়ি ওড়ানোর কোন উৎসাহ খুঁজে পায় না। অন্ধকার সরু গলির শেষ প্রান্তে বিধ্বস্ত ভাঙা মন নিয়ে জুবুথুবু বুড়োর মতো সে কোন মতে বেঁচে আছে।
 
কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে শের চলাফেরা করে। দোকানের বেঞ্চে বসে সে সব সময় ছাদের উপর বাচ্চা ছেলেদের ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ আর চেঁচামেচি শুনতে পায়। ওদের কণ্ঠে ‘হাইডারাক জায়লানি, বাতাস আরো জোরে বও’, শোনার সময় তার ফেলে আসা দিনের কথা খুব মনে পড়ে।

সে-ও তখন দোকানের এক কোণে বসে ছেলেদের সুরের সঙ্গে সুর মেলায় এবং মনে মনে ভাবে তার বয়স যেন মাত্র কুড়ি বছর। এভাবেই তার আরো ছয় মাস কেটে যায় এবং কোরবানির ঈদ প্রায় আসন্ন। আরো একবার সে একের পর এক বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ির নকশা তৈরি করতে থাকে। সে সময় চারপাশে কাঁটাছেঁড়া কাগজের স্তুপ জমা হয়।
    
কিন্তু যা-ই তৈরি করুক না কেন, কোনোটাই শেরের মনের মতো হয় না। সে অতীতের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে। তার ভাবনা জুড়ে শুধু তাহিরা। হঠাৎ তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা। সে একটা ঘুড়ির ঠিক মাঝখানে ‘হ্যাপি ঈদ’ লিখে নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘কার জন্য? কেন?’ অনুশোচনা আর গভীর বেদনায় সে ঘুড়িটা দোকানের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখে দু’হাঁটুর মাঝে মাথা লুকায়।

সেই আগের ফজলু, যে এখন বাবা ফজলু নামেই অধিক পরিচিত, একদিন শেরের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। শের তখন মনমরা হয়ে দোকানে বসেছিল। ফজলু উপহাস করে বললো, ‘এই শের, তোমার বেলুন কোথায়? তোমার উড়োজাহাজ দেখালে না? কবে আমরা তোমার বিয়ের মিষ্টি আর নকুল খাব?’  
শের মাথা তুলে রক্তিম চোখে তাকিয়ে ফজলুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। ফজলু তার উদ্দেশে চিৎকার করে বললো, ‘তুমি একটা আস্ত বধির। কিসের ধ্যানে মশগুল তুমি যে আমার কথা তোমার কানে যায়নি?’
উত্তরে শের বললো, ‘আমি কাপুরুষদের কথা ভাবছি। আমি ভাবছি রামছাগলের কথা, এমনকি তোমার কথাও।’
ফজলু ব্যাঙাত্মক হাসি হাসলো। তখন তার পোকায় খাওয়া দাঁত আর পঁচা রক্তিম মাড়ি দেখে শেরের  বুড়ো শেয়ালের কথা মনে পড়লো, যে কিনা ভাণ করে সে কিছুই জানে না, অথচ হটকারিতায় পটু।
অবজ্ঞার সুরে শের বললো, ‘এখান থেকে চলে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’   
ফজলু বললো, ‘কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে। সেসব দিন আজ ইতিহাস, যখন তুমি চ্যাম্পিয়ন ছিলে। এখন আমার পালা। তোমাকে পিটিয়ে আমি তক্তা বানিয়ে ফেলবো।’
ফজলুর কথা শুনে শের বললো, ‘তাহলে এখনো তুমি প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে বেড়াচ্ছ?’
ফজলু বললো, ‘আমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।’
শের বললো, ‘হায় আল্লাহ, তবে তো তোমার সাহস আছে।’
ফজলু বললো, ‘উফ, তোমার দোকানে পঁচা দুর্গন্ধ। দূর হও, ধাড়ি ইঁদুর। তুমি শুধু কথা বলতে পারো, আর কিছুই পার না। ’

রাগে শের ফুঁসতে থাকে। তার ইচ্ছে হলো সে দু’ধারে শান দেওয়া বড় ছুড়ি ঢুকিয়ে ফজলুর পেট থেকে নাড়িভুড়ি সব বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু সে জানে, আল্লাহপাক দূর থেকে সবকিছু দেখতে পান। তারপর সে এত জোরে গর্জন করে ওঠে যে আশেপাশের দোকানিদের কানে গিয়ে পৌঁছে। সে চিৎকার করে বললো, ‘ঠিক আছে, ফজলু। এটা হলো সীমানা, আর ওটা হল লড়াইয়ের ময়দান। সারা জীবন আমি এর পেছনে সময় ব্যয় করেছি। তুমি যদি সত্যি সাহসী হও, তাহলে আগামিকাল দু-রাহীতে এসে তোমার ঘুড়ি ওড়াও।’
ফজলু বললো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। এখন শান্ত হও।’

শের এবং ফজলুর তর্কাতর্কি রাস্তার সবাই শুনছিলো, এমনকি সেই তর্কাতর্কির আওয়াজ আশেপাশের অন্যান্য রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার বিকেলে দু-রাহীতে শত শত ঘুড়ি নিয়ে উৎসাহী এবং দক্ষ লোকেরা জমায়েত হয়েছে। বাবা শেরের ডানে এবং বায়ে দু’জন যুবক কুস্তিগীর। সে মাঠের কাছে দাঁড়িয়েছে। তার পড়নের সবুজ প্যান্ট এবং মাথার লাল পাগড়ি অনেক দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সে যখন সামাণ্য ঢালু বেয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিলো, তখন উপস্থিত জনতা দু’পাশে সরে তাকে পথ করে দেয়। তারপর ফজলু আসে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ তার হাঁটা। ভাবটা এমন যেন সে থোরাই কেয়ার করে। ফজলুর অনর্গল ফাঁকাবুলি শুনতে শুনতে পড়শীদের অনেকে তাকে অনুসরণ করে।

লড়াইয়ের আগে নিয়মকানুন দু’জনের কাছে পরিস্কার করে বলা হয় এবং উভয়েই তা বিনা বাক্যে গ্রহণ করে। শের তার একজন সাহায্যকারীকে বলল, ‘তুমি আকাশে ঘুড়ি ওড়াও, আমি লড়াই করি।’

সেই নীল এবং সাদা ঘুড়ি, যার গায়ে শের ‘হ্যাপি ঈদ’ লিখেছিল, আকাশে ওড়ায়। বাতাস কেটে ওপরে ওড়ার সময় ঘুড়িটা দেখতে অবিকল মোরগের ঝুটির মতো দেখাচ্ছিল।

ফজলুর ঘুড়ির রঙ লাল আর কালো। ঘুড়িটা বুলেটের মতো ওপরে ওঠে এবং শেরের ঘুড়ির পাশে গিয়ে পৌঁছে। পরমুহূর্তেই ঘুড়ি দু’টি পাশাপাশি উড়তে থাকে। শেরের একজন সাহায্যকারী চিৎকার করে বললো, ‘এখন ঠিক আছে?’
অন্যজন বললো, ‘বিলকুল ঠিক আছে।’

ফজলুর ঘুড়ি শেরের ঘুড়ির খুব কাছে চলে আসে। ফজলুর ঘুড়ি ভালো অবস্থানে এবং অনবরত শেরের ঘুড়ির চতুর্দিকে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকে ফজলুর ঘুড়ির ওপর বাজি ধরে। কিন্তু যারা অনেকদিন থেকে শেরকে চেনে, তারা শেরের ঘুড়ির ওপর বাজি ধরে। শেরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য তারা চিৎকার করে বলে, ‘সাবাস শের। শের চ্যাম্পিয়ান। কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না।’

দূরের আকাশে ঘুড়ি দু’টি বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে এবং একসময় তা দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে যায়। ঘুড়ির সুতা যেন কসাইয়ের ছুরির মতো ধারাল। সুতার ঘষায় উভয়ের আঙুল কেটে গেছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। জুয়ারিদের থেকে কিছুটা দূরে কয়েক শ’ লোক উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বাচ্চা ছেলেরা, এমনকি যুবকেরাও, উত্তেজনা আর উৎকন্ঠায় হাতের তালু ঘষছে। তাদের দৃষ্টি আঠার মতো লেগে আছে আকাশের সঙ্গে। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে কখন দৌঁড়ে গিয়ে কাটা ঘুড়ি সংগ্রহ করবে। আচমকা শেরের ঘুড়ি থেমে যায় এবং ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। হাততালির সঙ্গে উপস্থিত বাজিকররা সোৎসাহে চিৎকার করে, ‘ফজলু জিতে যাচ্ছে! ফজলু জিতে যাচ্ছে!’

শের বাঁকা হয়ে হাঁটুর কাছে প্রায় মাথা নামিয়ে আরো বেশি সুতা ছাড়তে থাকে। কিন্তু সে আসন্ন বিপদ টের পায়। সে জানে, ফজলুর প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসে গেছে। সে যদি হেরে যায়, তাহলে তার উৎসাহী সমর্থকরা তার ঘুড়ি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
 
সবার দৃষ্টি শেরের দিকে। কিন্তু শের জানে, ফজলুর কাছে সে হেরে যাচ্ছে...

শেষ মুহূর্তে শেরের ঘুড়ি যখন নিচের দিকে গোত্তা খেয়ে নেমে আসছিল, তখন সে লাটাই ধরা সাহায্যকারীকে চিৎকার করে সে বলল, ‘সুতা প্যাঁচাও, আমি টানছি।’ বলেই সে রীতিমত ঝাকি দিয়ে এক, দুই, তিন বলে সজোরে সুতা টানে। তখন ফজলুর হাতে ঘুড়ির সুতার টান হালকা হয়ে যায়।
 
সবাই যা ভাবছিল, আসলে তা সত্যি হয়নি। শেষপর্যন্ত শের জিতেছে। বিজয়ের আনন্দে সে আরো সুতা ছেড়ে ঘুড়ি ওপরে তোলে। পরাজয়ের গ্লানিতে ফজলু চুপসে যায়। ঘুড়ি নামানোর জন্য পাশের একজনের হাতে সুতা তুলে দিয়ে শের বিজয়ীর বেশে পেছনে চলে আসে।
 
ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। মনে হয় আকাশ যেন তার নীল স্কার্টের গায়ে লাল টিউলিপ ফুলের নকশা এঁকেছে। দূরে ঈদের চাঁদ ভেসে উঠেছে, যা দেখতে অনেকটা তাহিরার ভুরুর মতো। লোকজন জানে আগামীকাল ঈদ। তাই তারা অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। অবশেষে শেরের ঘুড়ি এমন ভঙ্গিতে নেমে আসে যেন কোন নববিবাহিতা কনের মতো লাস্যময়। ঘুড়ির গায়ে লেখা ‘হ্যাপি ঈদ’ স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। শের বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ‘হ্যাপি ঈদ’ লেখার ওপর, যা সে বিগত পঁচিশ বছর ধরে মনের ভেতর খোদাই করে লিখেছে। কল্পনায় সে দেখতে পায় তাহিরা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার নতুন সিল্কের জামা। সামনের দিকে ঘাড়ের দু’পাশে চুলের বিনুনি এক জোড়া কালো সাপের মতো ঝুলে আছে। শের ভাবল সে তাদের ছাদের উপর উঠে মহসীন খানের বাড়ির দিকে ঘুড়ি ওড়াবে। তাহলে তাহিরা ভীষণ আনন্দিত হবে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই একের পর এক তার মনে পড়তে শুরু করে খালাতো ভাইদের সঙ্গে লড়াই, কুস্তিগীর জীবনের কথা, মাহমুদের সঙ্গে সমঝোতা, কবরস্থানে তাহিরার সঙ্গে দেখা এবং সবশেষে ভুড়িওয়ালার সঙ্গে তাহিরার বিয়ে। এসব ঘটনা তার স্মৃতির খাতায় জমা হয়ে আছে। এতদিন পর শের যেন পুনরায় শুনতে পেল তাহিরার কণ্ঠস্বর। সে বলছে, আমি তোমার ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। তুমি আরো বেশি স্বপ্নচারী হবে। খাবারের প্রতি তোমার অনীহা দেখা দেবে। তুমি শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে এবং নির্ঘুম রাত কাটাবে।     

শের বললো, ‘তাহিরা, তুমি ঠিক। সেদিন সত্যি কথাই বলেছিলে। তবে এ কথা সত্য যে, একজন প্রেমিক পাহাড়ও ভেঙে দিতে পারে।’

সে সময় তাহিরা যেন যোজন যোজন দূর থেকে কেঁদে উঠল। সেই কবরস্থানের অসংখ্য খোদাই করা পাথরের ফলকের মাঝ থেকে কান্নাভেজা কণ্ঠে সে বললো, ‘প্রিয়তম শের, মাহমুদকে তুমি কথা দিয়েছিলে, এমনকি প্রতিজ্ঞাও করেছিলে। আমি কিন্তু কোন কথা দিইনি, এমনকি কোন প্রতিজ্ঞাও করিনি। আমি তোমাকে ভীষণ ভলোবাসি। শুধু তোমাকেই চাই। তুমি যদি আমার কাছে না আসো, তবে তার জন্য তোমাকে হাশরের ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে।’
স্বগতোক্তির মতো করে শের বললো, ‘প্রকৃত মানুষ তার কথা রাখে। আমি আমার প্রতিজ্ঞার কোন বরখেলাপ করিনি।’
বলেই সে পাগড়ির এক কোনা দিয়ে অশ্রুভেজা চোখ মোছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস [email protected]


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান