
প্রকৃতি সাক্ষী
১
সবুজ পাতায় মোড়া আগুনের মতন কৃষ্ণচূড়ার ফুল নিয়ে একটা পরি আসল একদিন, তন্দ্রাচ্ছন্ন গালে কপালে আগুন বুলিয়ে দিল। এই লাল-ঘ্রাণ খুব পরিচিত আমার— পরি-কাল মনে পড়ে। শিমুলে জারুলে খেলার সব স্মৃতি মনে পড়ে। গ্রামের বাড়ি যেতে যেতে শিমুল গাছ দেখা যেত। ফুল দেখা যেত। তুলা উড়তেও দেখেছি, নিজে তখন নিরেট কাঁচা গাব ফল হয়ে তুলার ন্যায় ফাটতে আমি বহুত চেয়েছি। ফলাফল এল— গাবের মিষ্টতাও গেল, তুলা না হওয়ায় গঞ্জনাও সইতে হল। তুলা হতে গিয়ে নিজেকে ফল ভেবেছি, যেহেতু কাঁচাসোনা রঙ ফুল আমি নাদান চোখে দেখি নাই, একটাও দেখি নাই, খোদার কসম এর আগে আমি নিজে হয়েও রাধাচূড়া দেখি নাই! এবার স্বরূপে আবির্ভূত, হিসাবে কাঁচা আমি অঙ্ক মিলে গেছে দেখলাম—
২
আমার সব ফুল আস্তে আস্তে
আস্তে আস্তে কৃষ্ণচূড়া হতে চেয়েছিল।
আমিটা এমন আগুনে পুড়িয়ে শুধু
লাল কমলা রঙের আগুনে—
কৃষ্ণচূড়ার আগুনে পুড়িয়ে শুধু
তাগা ছিন্ন করতে চেয়েছিল
তাগা চিহ্ন মুছতে চেয়েছিল
আমার সব ফুলেরা
সব সব সব ফুলেরা হয়ে উঠতে চেয়েছিল
কৃষ্ণচূড়া হতে চেয়েছিল...
৩
কৃষ্ণচূড়া এসে জানান দিল, ব্রহ্মপুত্রের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি জানালাম এমন অজানা কিছু নয় আমার, অন্যকিছু বলো। কিন্তু গোপনে আমি বারবার বারবার বারবার! — তাকিয়েছি! ... নিঃস্পৃহ, নির্লিপ্ত ব্রহ্মপুত্রের বুকে অজানা অথচ, চোখের সামনে থাকে এমন এক দৃশ্য দেখলাম। পানি শুকালেও ব্রহ্মপুত্র বন্ধ্যা নয়। একে খরা না কয়ে ফসলের কাল কহ হে রাধাচূড়া! দেখো চর ভাসে, কেমন সবুজ সবুজ কচি ধানের শিষে সাজে আমার নদ, ফসল হয় আমার নদের বুকে। হায়!— আমার নৌকা ঠেকে গিয়ে চরে তবু ফসল হোক! আমাকে সময় এসে দিয়ে গেল দুইটি শব্দ— দায়িত্ব আর জ্ঞান। দায়িত্বজ্ঞানের মহারাজা লেনে ভালবাসার জন্য এক চিলতে জমিও রেজিস্ট্রি হয় নাই— ইহাকে শত্রু সম্পত্তি কহে। উদ্বাস্তু আমি গোপনে কৃষ্ণচূড়াকে শুধাই, তুমি কৃষ্ণের চূড়া? নাকি চূড়ার কৃষ্ণ?
৪
তোমার তাপ যতটুকু
তাও ক্লোরোফিলে মাখা আদর,
সবুজ গন্ধ। চিরল চিরল পাতায়,
একেকটা পাতায় যত যত
শিরা আর উপশিরা ভেতরে শুধু দাহ্য তরল।
পরাগকেশর পর্যন্ত এই তরল
ফুটতে থাকে, বাষ্প হয় হল্কায়।
তবু সবুজের মখমলের আদরে
পাতা তাপ লুকিয়ে রাখে।
এমনকি ঠাণ্ডা পরশ লাগে পাতা গালে ছোঁয়ালে।
কৃষ্ণচূড়া তার পাতায় তাপ লুকিয়ে রাখে।
ছোট ছোট পাতায়, সবুজ সবুজ পাতায়...
একদম মখমল, মখমল... মখমল।
৫
মখমলের কথায় সবুজ শ্যাওলার কথা মনে পড়ল। ফুলের বন্দনা আমি ইতিহাস বাদ দিয়ে কী করে করি? অপিচ শ্যাওলাও বাস্তুসংস্থানের বড় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে দারুণ সব শ্যাওলা জন্মাত। দাপাদাপি শেষে ঘরে যেতে হত, যেতেই হত, অন্য কোনো রাস্তা ছিল না। ছোট ছোট আঙুল পানিতে ভিজে ভিজে সাদা আর চিমসানো। শ্যাওলা লেগে আছে একটা আঙুলে। শত মুছেও মোছা গেল না! শ্যাওলার বিরক্তি ভরা মুখ তোলা দেখলাম। তাহা একখানা জোঁক ছিল! অস্ফুট চিৎকার এবং জোঁক অপসারণ শেষে ঘরে গেলাম, যেন কিছুই হয় নাই। এমনিতেও জোঁক ছেড়ে যেত, রক্ত খাওয়া শেষে ওরা আর লেগে থাকে না, টুপটাপ ঝরে যায়, ঝড়ে পড়ে তড়পায় তাল গাছের বাবুই পক্ষী!
৬
বর্ষাকালে কৃষ্ণচূড়া তলোয়ার বের করে
সবুজের তলোয়ার, সবুজ রঙা তলোয়ার!
সভ্যতার সব কালি আর লাল
রক্তের দাগ
মোছে বর্ষা, বয়ে যায় নদী স্রোতে
কাঁটাগুলো সব কাটে সবুজ তলোয়ার।
সবুজ না চিনেই আমি বলেছিলাম
সবুজ আমার প্রিয় রঙ
তলোয়ার না জেনেই
নিজের খাপ হতে চাওয়ার বাসনা না জেনেই
বলেছিলাম,
আমরা খাপ আর তলোয়ার!
৭
আমি বলে দিলাম, এ ইলুশ্যন। যদিচ, ইলুশ্যন বাস্তবের অংশ। তবে কীনা রাস্তা আর উড়োজাহাজ আরো ইলুশ্যন লাগে। স্মৃতি সব অন্যের লাগে, এমনকি ‘স্মৃতি’ লিখতেই মনে হল আমি লিখেছি কি? ভুল আর পুরুস্কার সব অন্যের লাগে, দেহ অন্যের লাগে, যে দাঁত পড়ে গেছে, এবং যেসব মাড়িতে আছে এগুলো পরের লাগে, আমি শুধু একটা চাকরি যেন করি। শ্বাস শুধু নিয়ে যাই আমি। অনন্ত গ্যালাক্সির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে দেখতে গিয়ে দরিদ্র লাগে— এবং ভয়। যা কিছু দায় আর আদায় মিটিয়ে দিয়ে বৃক্ষজন্ম মানিলাম। ইলুশ্যন অথচ দেখো, প্রকৃতি দেয় সাক্ষী, বৃক্ষ হয়ে উঠতেই আমরা মানুষের গর্ভে জন্মেছিলাম।
০৫—০৭ জুলাই ২০১২
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২