
উনিশ শতকের রোম্যান্টিসিজমের রূপান্তরমূলক যে কাঠামো বিশ শতকের মডার্নিজমের শরীরে, তারই মেঘ-ছায়াতলে কাজী নজরুল ইসলামের (জন্ম: ২৫ মে ১৮৯৯; মৃত্যু: ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) প্রতিভার প্রক্ষেপণ-ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল হর্ষঘেরা প্রবণতায়। একুশ শতকের প্রথম প্রহরে এখন যখন মডার্নিজমের আক্ষেপ শমিত ও দমিত, উত্তর আধুনিকতাবাদ যা-যা এড়িয়ে-মাড়িয়ে গেছে, ধুলো ঝেড়ে তুলে নিতে প্রস্তুত পুনর্বার, তখন নজরুলের চিন্তাজগতের দরোজায় কড়া নড়ে ওঠে যেন অনিবার্যভাবে। হয়তো নজরুলের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাংলা কবিতায় বড় বেশি প্রয়োজন। জীবনানন্দ বলেছেন- ‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।’ তাঁর সংশয়হীনতা, জাগ্রত মানুষের প্রতি প্রবল আস্থা আর অস্তিত্ব-ব্যক্তিত্বের মজবুত ভিত বাঙালি সমাজ ও সভ্যতায় সমূহ নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চারণ। নজরুলের শুভবোধ আমাদের চিন্তা-ভুবনে তাই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলে এক অনাবিল বিলোড়ন। আর আমরা যেন উদ্ভ্রান্তের মতো আশ্রয় খুঁজতে থাকি নজরুলের সাহিত্যদর্শনের, শিল্পদর্শনের ইতিবাচক প্রহরের বিস্তৃত পরিসরে।
বিশেষ এক কালপর্বে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। দেশ-কালের সঙ্গে তাঁর অন্তরাত্মার যে যোগাযোগ, সেই শক্তি তাঁকে কালান্তরে মহানায়কের ভূমিকায় আসীন করেছে। ক্রান্তি-সঙ্কটের এই বর্তমানে নজরুল আমাদের আরো অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং নমস্য। সমূহ অন্যায়-অবিচার আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপক্ষে তাঁর স্বভাবজ আবেগের স্পন্দন-বিলোড়নের অন্তরালে আন্তরসত্যে অঙ্গীকার ছিল সুদৃঢ়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা, তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে প্রহরে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতি-ধর্মের পারস্পরিক সম্প্রীতি নজরুল-ভাবনার এক অনবদ্য আলোকশিখা। তাঁর আদর্শ ছিল এমন এক সমাজ, যেখানে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ থাকবে না। শ্রেণীবিভাজনের উর্ধ্বে সকলের পরিচয় হবে অভিন্ন। ‘মানুষ’ হিশেবে পরিচিত হবে সবাই। তিনি বাঙালিকে শুধু বাঙালি বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এ দেশের সম্প্রদায়িকতা বিষয়টি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মধ্যেবিত্তের বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বীতা। আর তাই তিনি নিজের সম্প্রদায়ের ভিতরে খুব স্পষ্ট অবস্থানে থেকেই তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন ও প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন- ‘ধর্ম আমাদের ইসলাম। কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের।’ সাম্প্রদায়িকতা যে ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা তা নজরুল গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। এর আগে ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়’-এর মুখপত্র লাঙল পত্রিকার বিশেষ (প্রথম) সংখ্যায় ‘সর্বপ্রধান সম্পদ-রূপে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সাম্যবাদী গ্রন্থের কবিতাবলিতে ধর্ম-জাতি-সম্প্রদায়গত ভেদাভেদকে অতিক্রম করে মানবতাবাদী চেতনায় সাম্যবাদী-প্রবণতাকে জায়গা করে দিয়েছেন নজরুল। কবির মতে সকল ধর্মের মূল বাণী হলো- মানুষ ও মানবতা। তাঁর ধারণা বিভেদ আর শ্রেণিবিভাজন করেছে মানুষ; নিজেদের লাভের জন্য। তাই সমাজের কোলাহল থেকে সরে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের আকুলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি দারুণ আগ্রহ ও সাহসের সাথে। মানুষের জয়গান গেয়েছেন কবি দেশ-কাল-পাত্রের ভেদাভেদকে ছাড়িয়ে। লিখছেন সে কথা-
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
.. . ... ...
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি...
- মূর্খরা সব শোন,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; - গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’
(মানুষ)
সাম্যবাদী জীবনের চেতনায় উপনিবেশ বিরোধিতা এবং জাতীয়তাবাদ নজরুলের মধ্যে মহত্তর বোধে চালিত হতে পেরেছে। নজরুল তাঁর কাব্যজীবনের প্রারম্ভ থেকেই হিন্দু- মুসমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন যখন কতকটা স্তিমিত, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাতাস তীব্র হয়ে উঠল। নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতাবাদের শাশ্বত বারতা। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! ডুবছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’ তার ভাবনায় সমুন্নত ছিল মানব জাতির ঐতিহ্য। সাম্প্রদায়িক বিবাদ প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ। দাঙ্গায় যে উভয় সম্প্রদায়েরই দায় রয়েছে তা তিনি পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে অবলোকন ও উপলদ্ধি করেছেন। কুসংস্কার আর সঙ্কীর্ণ মানসিকতায় আচ্ছন্ন উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িকরা তাঁকে তাঁর সৃষ্টির পথে বার বার বাধা দিয়েছে। দৃঢ়চেতা কবি নজরুল তখনও থেকেছেন আপোসহীন, প্রবল প্রতিবাদী। প্রসঙ্গত, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া তাঁর ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি- ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটো কিছুই নয়। আমি মাত্র, হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ মানবিকতা আর সহমর্মিতায় তাঁর চিন্তা আচ্ছন্ন ছিল সর্বদা। সমূহ বাধা-বিপত্তি-ব্যবধানকে দূরে সরাতে চেয়েছেন নজরুল-
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
... ... ...
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
(সাম্যবাদী)
দেশের ও জাতির শান্তি রক্ষায় কিংবা পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তাঁর যে অভিব্যক্তির প্রকাশ, তা জাতীয় চেতনার প্রতি তাঁর প্রবল বিশ্বস্ততাকেই ধারণ করে। হিংসামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূল সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের-গোত্রের বিভেদমোচন। মুক্তি-প্রয়াসী নজরুল আইরিশ বিদ্রোহী রবার্ট এ নেট (কহন মিশ্র ছদ্মনামে নজরুল রচিত জীবনী-ধূমকেতু, ১ম বর্ষ, ১৫ সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৯)-এর ভূমিকাংশে লিখেছেন- ‘সকল দেশের মুক্তির পথের যাত্রী আমাদের নমস্য। জগতে এই তীর্থযাত্রার আরম্ভ মানবের সৃষ্টিকাল হইতে আরম্ভ হইয়াছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে আভিজাত্যের বিপক্ষে যে অভিযান তাহার পন্থা যাহাই হোক না কেন, সে অভিযান যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত. সাফল্যের মাপকাঠিতে তাহার বিচার চলে না, কারণ মানুষ বাঁচে তাহার চেষ্টাতে, সাফল্যে নয়। মুক্তি লাভের আদর্শ মানব-সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন আকার ধারণ করে। কোথাও তাহা ধনাভিজাত্যের বিপক্ষে উঠিয়াছে, কোথাও বা প্রতিষ্ঠিত অত্যাচারমূলক রাজ ব্যক্তির বিপক্ষে, কোথাও বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে... এই যে সমাজের বা রাজশক্তির বা যে কোন প্রকার আভিজাত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সেই বিদ্রোহের শক্তি আমরা চাই।’ নজরুল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অপশক্তির মূল উৎপাটনের দিকেও সচেতন মানুষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করেছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যে রাজশক্তি মানুষের প্রতি পাশবিক আচরণ করে, যে রাজশক্তি অগণন নারীকে বিধবা কিংবা সন্তানহারা করে, সেই রাজশক্তির ধ্বংস অনিবার্য। জাগ্রত জনতাই নজরুলের আরাধ্য ছিল। তাই জাগ্রত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ দৃষ্টিগোচর হয়নি তাঁর। দেখাননি জাতিবিদ্বেষও। তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ নাই, জাতিবিদ্বেষ নাই, বর্ণবিদ্বেষ নাই, আভিজাত্যের অভিমান নাই। পরস্পরকে ভাই বলিয়া একই অবিচ্ছিন্ন মহাত্মার অংশ বলিয়া অন্তরের দিক হইতে চিনিয়াছি।’ জাতি-গোত্র কেন্দ্রিক হানাহানি থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার সাগরে ভাসবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তাঁর সরল বিবরণ-
‘সাম্যবাদী-স্থান-
নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।
নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর,
নাই কো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই।’
(সাম্য)
নজরুল এ সরল সোজা-পথেই মুক্তি অন্বেষণ করেছেন। সম্মিলিত শক্তিই যে পরিত্রাণের মোক্ষম উপায়, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর এ প্রসঙ্গেই তাঁর উদাত্ত আহ্বান- ‘এস ভাই হিন্দু। এস মুসলমান। এস বৌদ্ধ। এস ক্রিশ্চিয়ান। আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না। চাহিয়া দেখ, পাশে তোমাদের মহাশয়নে শায়িত ঐ বীর ভ্রাতৃগণের শব। ঐ গোরস্থান-ঐ শ্মশাণভূমিতে শোন শোন তাহাদের তরুণ আত্মার অতৃপ্ত ক্রন্দন।’
মহৎপ্রাণ মানুষ সত্য চিনতে ভুল করেন না। আর তাই তাঁদের ভাবনা নিবদ্ধ থাকে কল্যাণকামিতার দিকে। তাঁদের মতে ধর্মের জন্যে মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। নজরুলের কাছে মানুষের মূল্য এত বেশি যে ধর্মবেত্তাদের একই সারিতে সহজে সাজাতে পারার ঔদার্য ও সাহস দেখিয়েছেন এবং বলতে চেয়েছেন ‘বুদ্ধ-কৃষ্ণ-মোহাম্মদ-রাম’ ধর্মবিশেষের ভাষ্যকার হিশেবে পরিচিত হলেও বিস্তৃত অর্থে তাঁরা মানুষেরই বন্ধু। নজরুল ওই মহামানবের মানবতাবোধ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘চিনেছিলেন খ্রীষ্ট বুদ্ধ/কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম /মানুষ কী আর কী তার দাম।’
নজরুল তাঁর সাহিত্য সাধনার পুরোসময় মানুষকে মানবতাবাদে উজ্জীবিত হবার পথে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আর সকলকে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে ওঠার জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত তাঁর সাহিত্য ভাবনার অন্যতম প্রধান সুর হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রয়াস। ‘মন্দির ও মসজিদ’ নামক প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন- ‘মানুষের কল্যাণের জন্য ঐ-সব ভজনালয়ের সৃষ্টি, ভজনালয়ের মঙ্গলের জন্য মানুষ সৃষ্টি হয় নাই। আজ যদি আমাদের মাতলামির দরুণ ঐ ভজনালয়ই মানুষের অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠে, যাহার হওয়া উচিৎ ছিল স্বর্গসত্যের সেতু- তবে ভাঙ্গিয়া ফেল ঐ মন্দির-মসজিদ! সকল মানুষ আসিয়া দাঁড়াইয়া বাঁচুক এক আকাশের ছত্রতলে, এক চন্দ্র-সূর্য-তারা-জ্বলা মহামন্দিরের আঙ্গিনাতলে।’ নজরুল চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমাজ-ব্যবস্থা। তাঁর সৃষ্টিকর্মে তাই স্থান পেয়েছে উদার মানবতাবাদ ও প্রাণময়তার মাহাত্ম্য। নজরুলের শিল্পদর্শন উগ্রসাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে স্থিত। তিনি মোল্লাতন্ত্র-পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে এক প্রবল শক্তি অসাম্পদায়িকতার প্রবাহ বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নজরুল তাই তাঁর সমকালে এবং কালের প্রবহমানতায় কালোত্তরেও সাম্যবাদী সম্প্রীতি প্রত্যাশীদের শক্তি ও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছেন।
আজ সভ্যতার অগ্রগতির এ আলোয় এবং প্রযুক্তির প্রবল উৎকর্ষের দিনে আবারও যেন ধ্বনিত হতে শুনি নজরুলের সেই ক্ষমা-প্রার্থনা ও শান্তি ভিক্ষা- ‘শান্তি দাও, শান্তি দাও হে ক্ষমাময়, ক্ষমা কর/হে অভেদ! এই ভেদ ভুলাইয়া উদার বক্ষে ধর।/ বাংলার এই হিংসালীলা ঢেকে দাও, ভেঙ্গে দাও! চির সুন্দর! ক্ষমা প্রসন্ন নয়নে আবার দাও।’ (ঢাকার দাঙ্গা) নজরুলের এই আকুতি যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি- এই প্রত্যাশা, আজ এই ক্রান্তিকালে বড়ই প্রাসাঙ্গিক। বড়ো-ছোটর পার্থক্যকে ঘোচাতে হলে অতি-অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে বড়োকে। এবং মানবতার কবি নজরুল এ-বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। জানাচ্ছেন আমাদেরকে তাঁর সে আশার বাণী-
‘কালের চরকা ঘোর,
দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে- চড়ে দেড়শত চোর।
এ আশা মোদের দুরাশাও নয়, সেদিন সুদূরও নয়-
সমবেত রাজ-কণ্ঠে যেদিন শুনিব প্রজার জয়।
(রাজা-প্রজা)
কবিতায় ভাষার নবায়নের যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন টি. এস. এলিয়ট, সে অনুভবের ইতিবাচক ও বাস্তব অনুশীলন আমরা নজরুলে পাই। অনুকরণে কিংবা প্রভাবে অভ্যস্ত না-হয়ে তিনি স্বকীয় শব্দাবলি প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন অনায়াসে।
সমাজের, জীবনের আর মানুষের বিচিত্র প্রবণতার শাঁস-সত্যটি তিনি অকপটে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন কালের কাব্যরুচি আর হৃদয়গত কাব্যবাণীর প্রকাশধর্মিতার প্রবল চাপের কারণে। ব্যক্তি নজরুল যেমন ছিলেন আকর্ষণীয়, তেমনি তাঁর চিন্তালোক, সাহিত্যলোক পাঠককে আকর্ষণ করেছে- উচ্চকণ্ঠে, ধ্বনিনির্ভও ঝড়-বর্ষণ-কান্নার আওয়াজে-মোড়া বহির্মুখি প্রবণতার কঠিন বাস্তবতায়। নিজের সম্পর্কে বড় সাবধান নজরুল ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে ঘোষণা করেছেন- ‘আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,- কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই,- আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারীর তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।’ সত্য-সুন্দর আর অগ্রগমণের কবি নজরুল বলছেন সত্য-অন্বেষার কথামালা-
‘শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।’ (ঈশ্বর)
গ্রামসি বলেছেন- ‘নতুন শিল্প নিয়ে কথা বলার পরিবর্তে নতুন সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।’ নজরুলের সাহিত্যকর্মে আমরা গ্রামসি’র এ কথার প্রাসঙ্গিক ও ইতিবাচক প্রয়োগ লক্ষ্য করি। তিনি শিল্পের চাতুর্যকে ধরতে চেষ্টা করেননি তেমনভাবে, বরং খুঁজেছেন নতুন সংস্কৃতির আলো। আর তা হলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংস্কৃতি উদ্ভাসনের যে আহ্বান নজরুলের, তাতে গণমানুষের সমর্থন ও যোগ ছিল। বলা চলে নজরুল ওই বিশেষ বোধকে সচেতন মানুষের চিন্তন সুতোয় প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন। সময় ও সমাজ পরিসরে তাঁর এ অভিযাত্রা বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালিকে অমিত আলোর এক নতুন পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়েছে। তাই সকল ইতিবাচক বিদ্রোহে-সংগ্রামে নজরুল আমাদের নমস্য। উত্তর-উপনিবেশবাদ সম্পর্কে নজরুলের ভাবনা অত্যন্ত স্পষ্ট- প্রয়োজনে সশস্ত্র আন্দোলন এবং সর্বহারাদের সংগঠিত করে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা- কল্যাণ প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আপোসহীন, অতিসাধারণ জীবনযাপনে সংগ্রামী ‘মহান দারিদ্র্যের’ এক প্রতিবাদী প্রতিনিধি। আর সেই প্রতিবাদী চেতনা থেকে তিনি সমূহ শুভবোধ ও ইতিবাচক অনুভূতিকে লালন ও প্রকাশ করেছেন সাহিত্যচর্চার সময়-পরিসরে। শিল্প-প্রতিভা এবং নিবেদিত-প্রাণ কর্মী নজরুলের জীবনচেতনা বিরল কৃতিত্বে ভাস্বর। তাঁর ঘোষণা-
শুনিতেছি আমি, শোন ঐ দূরের তুর্যনিনাদ
ঘোষিছে নবীন ঊষার উদয়-সুসংবাদ।
ওরে ত্বরা কর। ছুটি চল্ আগে- আরো আগে।
তিনি জানতেন তাগিদই মানুষকে তার অধিকার আদায়ে প্রত্যয়ী হতে শক্তি ও অনুপ্রেরণা জোগায়। নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। পতিতা বলে গালি দিতে, অশ্রদ্ধা করতে আমাদের বাধে না। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব-স্বাধীনতা-ভালোলাগা-মন্দলাগাকে বিবেচনায় রেখে নজরুল সাজিয়েছেন ‘বারাঙ্গনা’ কবিতার কথারাজি। নজরুল জানেন- বিশ্বাস করেন, কোনো মানুষ ধার্মিক বা ধর্মের অনুসারী হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় না; পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজগতির অভ্যাসবশত ধর্ম ও মত অবলম্বন করে মানুষ। আর পাপ-পুণ্যের হিসেব-নিকেশ সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য এবং অভিমতও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের জন্মরহস্য, মানুষের মানসিক-শারীরিক সম্পর্কের বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ আমাদেরকে- সচেতন পাঠক সামান্য হলেও ভাবতে সহায়তা করে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিধান আর মানুষের মনের ইচ্ছা আর আকুলতার মধ্যে যে বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাকে তিনি মানবসৃষ্ট দুর্যোগই বোধ হয় বলতে চেয়েছেন; যে মহাদুর্যোগের অসহায় শিকার আমরা প্রায় সকলে- সভ্যতার প্রারম্ভকাল থেকে। সত্যভাষী-সাহসী- সমাজ-বিপ্লবী নজরুল জানাচ্ছেন-
শোনো মানুষের বাণী,
জনমের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোনো গ্লানি।
পাপ করিয়াছ বলিয়া কি নাই পুণ্যেরও অধিকার?
শত পাপ ক’রি হয়নি ক্ষুণ্ন দেবত্ব দেবতার।
... ... ...
শুন ধর্মের চাঁই-
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই।
অসতী মাতার পুত্র রস যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তারও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’
(বারাঙ্গনা)
নজরুল তাঁর সমকালে এদেশের মানুষের অকল্যাণ-অবনতির আশঙ্কায় অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী থেকে আমাদেরকে এক অনন্য কাব্যসুধা দান করেছিলেন। আর দিয়েছিলেন প্রতিবাদে প্রস্তুতি নেওয়ার শক্তি ও শক্তির মানসিক খোরাক। নজরুলের প্রয়োজন শেষ হবার নয়; যাবতীয় নেতিবাচকতা ও অশুভের বিপরীত বোধে তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। নারী-পুরুষের সহাবস্থান এবং পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠছে সভ্যতার সমূহ সৌন্দর্য। নারী পুরুষের কিংবা পুরুষ নারীর প্রতিযোগী নয়; শত্র“ও নয়- তারা পরস্পরের সম্পূরক। এই সহজ সত্যটি অঅমরা বেমালুম ভুলে থাকি ব্যক্তিস্বার্থের মোহজালে আবদ্ধ থাকার কারণে। কবি নজরুল আমাদের ঘুমে-কাতর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সে সত্যের রঙ ও বারতা-
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।...
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।.. .
জ্ঞানের লক্ষী, গানের লক্ষী, শস্য-লক্ষী নারী,
সুষমা-লক্ষী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি।’
(নারী)
লোভ আর স্বার্থের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মনের পবিত্রতাকে আশ্রয় করে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের কথা বলেছেন নজরুল। প্রসঙ্গত কুলি-মজুরকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে না দিয়ে তাদেরকে সম্মান জানাতে আহ্বান জানিয়েছেন।
‘তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?- ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে।
আসিতেছে শুভ দিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!’
(কুলি-মজুর)
সারাদুনিয়ার সকল মানুষ এক জাতি; মানবসমাজ- এই পরিচয় যেন সত্য হয়; যেন প্রতিষ্ঠা পায় মানবিক পরিচিতি- এই ছিল নজরুলের বাসনা। মহামিলনের আকুলতা তাঁর কবিতাকে দিয়েছের চিরন্তনতার সার্টিফিকেট। মিলনের সুরের আনন্দে নজরুল দূর করতে চেয়েছেন সকল ব্যথা-যন্ত্রণার অভিশাপ। তিনি জানাচ্ছেন-
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।
এক জনে দিলে ব্যথা
সমান হইঢা বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা- সকলের অপমান।
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।
(কুলি-মজুর)
নজরুল বাঙালি জাতিসত্তার রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে ছিল তার অবস্থান। ব্যক্তির আত্ম-উপলব্ধি আর আত্ম-উদ্বোধনকে বিবেচ্য রেখেছেন তিনি সবসময়। কেননা নজরুল মানতেন- ব্যক্তিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয় সমষ্টির অস্তিত্ব ও অবস্থিতি। সকল ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ড জীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ; দরিদ্র-অশিক্ষিত-ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য রুটি-কাজ আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সাজিয়েছেন কবি তাঁর কথামালায়। নজরুল ছিলেন জনতার কাতারের দাঁড়ানো এক শক্ত মানুষ; ফাঁকবিহীন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক।
বাংলোদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ২৭ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর