
সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকার সুবাদে জনস্বার্থ বা জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর ভাগ্য অনেকাংশে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত বছর চেম্বার জজ আদালতের স্থগিতাদেশ পদ্ধতিকে অবমাননার অপরাধে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ছয় মাস জেল খেটেছেন। আমি কোনো বিচার কাঠামোকে নিয়ে সামান্যতম অসৌজন্যতা প্রকাশের কথা চিন্তাও করি না। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতার অবসান কামনা করি।
নিম্ন আদালতে যে সমস্ত বিচার হয়, তার বিরুদ্ধে কিংবা রিট বা আদিম এখতিয়ারের বিষয় হাইকোর্ট ডিভিশনে নিষ্পত্তি করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতিকার লাভের জন্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচার প্রার্থীর আপিল করার সুযোগ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে হলে প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের লিভ বা অনুমতি নিতে হয়। সুপ্রিম কোর্টে পূর্ণাঙ্গ শুনানির পর অনুমতি মঞ্জুর হলে নিয়মিত আপিল করা যায়। সহজভাবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া এভাবে হয়ে থাকে।
তাছাড়াও মাঝখানে অন্য আরেকটি প্রক্রিয়া রয়েছে। আপিলেট ডিভিশন রুলস মতে, হাইকোর্টের পরাজিত পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে চেম্বার জজ নামক একক বিচারপতির চেম্বারে যেতে পারে। কিন্তু সেখানে এক অতি সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বা রায়কে স্থগিত করা যায়। আর এ সুযোগে হাইর্কোটের দেওয়া রায় ভোগের অধিকার থেকে বছরের পর বছর মানুষ বহুলাংশে বঞ্চিত হবার উপক্রম হয়েছে।
এ ধরনের প্রবণতা আগে কখনই ছিল না। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ নামক মাননীয় একক বিচারপতির চেম্বারে শুধুমাত্র মামলার শুনানির তারিখই নির্ধারণ করা হতো। হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বা রায়কে দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত করে ফেলে রাখার সুযোগও তখন ছিল না। আইনজীবীরাও এরকম কারণে স্থগিতাদেশ চেম্বার জজের কাছে চাইতেন না।
কিন্তু গত প্রায় দশ বছর ধরে তিনটি সরকারের সময়েই অভিযোগ উঠেছে যে, হাইর্কোটে সরকারের বিপক্ষে যে সমস্ত রায় দেওয়া হয়, সেগুলো বিদ্যুৎ গতিতে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে নামমাত্র শুনানিতে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। এতে হাইকোর্ট বিভাগের স্বাতন্ত্র্য বিপদের মুখে পড়েছে। প্রতিটি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরের অতি উৎসাহের কারণে এটি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকেই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এ বিষয়ে অভিযোগ করে আসছেন। এ পদ্ধতিটি নিয়ে শুধু আইনজীবীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীদের মধ্যেও বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
একজন ভুক্তভোগী দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াই চালানোর পর হাইকোর্ট থেকে একটি রায় পান। কিন্তু এ রকম সংক্ষিপ্ত বিচারে সে আদেশটির ওপর নিমিষেই স্থগিতাদেশ দেওয়া যেতে পারে। এ স্থগিতাদেশ দেবার পর আদালত মামলাটি নিয়মিত বেঞ্চে লিভ পিটিশন দাখিলের আদেশ দেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি মাত্র বেঞ্চ থাকায় দিনের পর দিন এমনকি বছরের পর বছর মামলাগুলো কার্যতালিকাভুক্ত হয় না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা যখন পাঁচজন ছিল, তখনও দুটি পৃথক বেঞ্চে মামলা নিষ্পত্তি করা হত। কিন্তু বর্তমানে এ বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১১ জন করা হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি মাত্র বেঞ্চ দিয়েই বিচার কাজ চালানো হচ্ছে।
আপিল বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে কিছু বিচারপতির পদ খালি থাকলেও নানাবিধ হিসাব-নিকাশের কারণে সে পদ পূরণ করা হচ্ছে না। ১৬ কোটি লোকের দেশে সর্বোচ্চ আদালতের সংখ্যা মাত্র একটি! চিত্রটি কতটা করুণ!
আমার ব্যক্তিগত এক মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা তার পেনশন নিয়ে একটি রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট ডিভিশন ওই মামলার গুণাগুণ দেখে সরকারের বিভিন্ন দফতরকে তার পেনশন ও বেনিফিট দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন।
কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরের অতি উৎসাহের কারণে সেই রিটের আদেশ চেম্বার জজ আদালতে স্থগিত হয়ে যায়। আপিল বিভাগের হাজার হাজার মামলার চাপ, দীর্ঘসূত্রতা ও জটের কারণে কয়েক বছরেও সেই আপিলের নিস্পত্তি সম্ভব হয়নি।
বৃদ্ধাবস্থায় একজন নাগরিককে পেনশন নিয়ে জীবন ধারণ করতে না দিতে সরকার বা অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরের এতো উৎসাহের কি কারণ থাকতে পারে, তা আমার জানা নাই।
আমাদের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট ডিভিশনকে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সর্বময় ক্ষমতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে অনুরূপ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে দেওয়া হয়নি।
আমাদের সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মানুষের মৌলিক অধিকারের বলবৎকরণের যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে এভাবে তাড়াহুড়ো শুনানিতে স্থগিতাদেশের মাধ্যমে কতোটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে তা ভাবতে হবে।
আমাদের সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশন পুরোটা কোর্ট অব আপিল হিসেবে কাজ করে যা হাইকোর্ট অব ইংল্যান্ডের মত। কিন্তু এটির গঠন প্রক্রিয়া ও স্বাতন্ত্র্য অনেকটা ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের মতো। আমাদের সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশন হাইকোর্ট ডিভিশনের কোনো রায়, ডিক্রি, আদেশ, নির্দেশনা বা দণ্ড নিষ্পত্তি করতে পারেন।
কিন্তু আমাদের চেম্বার জজ আদালতে প্রায়শঃই দেখা যাচ্ছে, হাইকোর্ট আদেশ দানের সময় কি কি আইনগত বা সাংবিধানিক বিষয় আমলে নিয়েছিলেন, সেগুলো দেখার সুযোগ সেখানে পাওয়া যায় না। প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, এ তাড়াহুড়োর সুযোগ নিয়ে অনেক সময় মামলার কোনো কোনো পক্ষ এমন সব তথ্য এবং গ্রাউন্ড চেম্বার জজ আদালতে বলে, যা কখনো হাইকোর্টে বলাই হয়নি।
হাইকোর্ট ডিভিশনের কোনো রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার অধিকার অবশ্যই প্রত্যেক বিচার প্রার্থীর আছে। সেই সঙ্গে এ রকম ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ পাওয়ার ন্যায়সঙ্গত অধিকারও রয়েছে। এটি না হলে তো ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়বে।
কিন্তু চেম্বার জজ আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতিতে মানুষের মৌলিক অধিকারের এ জায়গাটা কতোটা সুরক্ষা হচ্ছে, সেটাও ভাবতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এবং চেম্বার জজের একক বিচারপতির ক্ষমতার মধ্যে একটি পার্থক্য রাখাটাই স্বাভাবিক হবে। আপিল বিভাগের সকল বিচারপতিদের সমান ক্ষমতা একজন মাত্র চেম্বার জজের কাছে থাকাটা কেমন ব্যাপার হলো?
হাইকোর্ট ডিভিশনে দুইজন মাননীয় বিচারক দীর্ঘ শুনানির পর আইনের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর কোনো রায় বা আদেশ প্রদান করেন।
অপরপক্ষে শুধুমাত্র পদায়নের কারণে আপিল বিভাগের মাননীয় একজন বিচারক হাইর্কোটের দুইজন বিচারকের রায়কে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে স্থগিতাদেশ দিয়ে দিচ্ছেন। তাই চেম্বার জজ আদালতের গঠনে অন্ততপক্ষে দুইজন বিচারপতি থাকাটাই যুক্তিযুক্ত নয় কি?
সেই সঙ্গে কোন কোন বিষয়ে চেম্বার জজ আদালত স্থগিতাদেশ দিতে পারেন, তার একটি শ্রেণীবিন্যাসও প্রয়োজন রয়েছে।
কি কি বিষয় চেম্বার জজ দেখবেন এবং কি কি বিষয় পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের কাছে থাকবে তা নির্ধারণ করলে ভালো হয়। জনস্বার্থ বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ক মামলার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের আদেশই বেশি গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে।
চেম্বার জজ আদালতের স্থগিতাদেশের মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহের জন্য কার্যকর রাখার বিধান করা যেতে পারে। তখন দুই সপ্তাহের পর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হলে ভালো হয়। এ বিষয়গুলো বিবেচনার দাবি রাখে।
পাকিস্তান আমলে প্রণীত অ্যাপিলেট ডিভিশন রুলস সংশোধনের জন্য আপিল বিভাগের কয়েকজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সম্প্রতি একটি রির্পোট তৈরি করেছেন, বলে শুনেছি। তবে এ রির্পোটটি ফুল কোর্ট সভায় কবে অনুমোদন পাবে, তা জানতে পারিনি। আশা করছি, ২০১২ সালের প্রেক্ষাপটে এ সংশোধিত রুলসে আমাদের অনেক প্রশ্নের যর্থাথ উত্তর পাওয়া যাবে।
আমাদের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানুষের কমপ্লিট জাস্টিস বা পূর্ণাঙ্গ ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আপিল বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এখানে সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে স্থগিতাদেশ প্রদান মানুষের সেই অধিকারকে সংরক্ষণ করতে অনেকাংশে অসুবিধার সৃষ্টি করছে। তাই এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মানুষ ন্যায়বিচার ও সুবিচার পান।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিচ্ছেন, তা শুধু মামলার পক্ষদের ওপরই নয়, বরং তা পুরো জাতির ওপরও বাধ্যতামূলক।
কথাগুলো আমার মতো একজন আইনজীবীর বদলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সর্বসম্মত ঐকমত্য নিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের কাছে জানালে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের বারগুলো রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত হবার কারণে এ কথাগুলো কখনো সামনে আসতে পারছে না।
সবার কাছে তাই আমি একান্তই ক্ষমাপ্রার্থী। আদালতের সম্মানও আমার কাছে সবার ওপরে। যুগে যুগে সেই সম্মান মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরো গৌরবময় হয়ে ওঠে।ড. তুহিন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
E-mail: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১২
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর